নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

জয়দেব করের লেখাজোকা

জয়দেব কর

অন্ধ আমি অন্ধকারে আলো কুড়াই,গন্ধরাজের গন্ধে মাতাল জীবন পোড়াই!

জয়দেব কর › বিস্তারিত পোস্টঃ

বুদ্ধের নারী ও বৌদ্ধ নারীর সমাজতত্ত্ব // নিখিল নীল

২২ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৫ দুপুর ১২:২৭


প্রাচ্য দর্শনের গৌরবজনক অধ্যায়ের জনক বলা হয় গৌতম বুদ্ধকে । যদিও প্রাচীন ভারতীয় দর্শন ভাববাদে আচ্ছন্ন দর্শন, তথাপি, বস্তুবাদী দার্শনিক চিন্তার ঐতিহ্যও এখানে অনেক সুপ্রাচীন । বেদ-বিরোধী ‘নাস্তিক’ দার্শনিক সম্প্রদায়ের তিনটি ভাগ দেখিয়েছেন দেবীপ্রসাদ চট্টপাধ্যায়, চার্বাক ও জৈনের পাশাপাশি বৌদ্ধ দর্শনও এ ধারায় গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে১ ।

প্রাচ্য-প্রাতীচ্য তথা পুরো পৃথিবীর দর্শন, বাড়াবাড়ি রকম শোনালেও, গৌতম বুদ্ধের দর্শন আলোচনা ছাড়া অপূর্ণাঙ্গ থাকে। যদিও, ঔপনিবেশিক দাসত্বের চেতনা আর পাশ্চাত্য স্বীকৃতির পক্ষপাতের কারণে আমাদের চিন্তার কোষগুলোতে কেবল পাশ্চাত্য দর্শন কিলবিল করে ! আমি সবসময়ই যেটা মনে করে এসেছি, ‘বৌদ্ধ’র সাথে ‘ধর্ম’ প্রত্যয়ের চেয়ে ‘দর্শন’ প্রত্যয়টি বেশি প্রাসঙ্গিক । আলোচ্য ক্ষেত্রে এই প্রাসঙ্গিকতাকে সামনে রেখেই এ লেখা তৈরি করা হচ্ছে । অবশ্য সংস্কৃত ধৃ-ধাতুর অনুসরণ করে ধর্মকে ধারণ করার আক্ষরিক অর্থে গ্রহণ করলে বুদ্ধ-প্রদর্শিত বিস্তৃত দার্শনিক ভাবনার সাথে তেমন কোন সংঘর্ষ তৈরি হয় না । নাগার্জুন, দিঙনাদ, ধর্মকীর্তি ও আরো অনেক প্রতিভাবান দার্শনিকগণ এই ধারার মধ্যেই জন্মগ্রহণ করেছেন ।

এছাড়াও, ধর্মের চাইতে দার্শনিক প্রাসঙ্গিকতাকে পছন্দ করার পেছনে অনেকগুলো শক্তিশালী কারণ খোঁজে বের করা সম্ভব, তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যুক্তি হলো বৌদ্ধধর্মের সাথে প্রাতিষ্ঠানিক বা প্রচলিত অন্য সব ধর্মের মৌলিক জায়গাগুলোর কোন মিল বের করা যায় না, হয় তো একারণেই প্রাচ্য জাগরণের এক প্রভাবশালী দার্শনিক হিসেবেই তাঁকে চিহ্নিত করা বেশি যুক্তিযুক্ত হবে । প্রাতিষ্ঠানিক ধর্ম বলতে যা বোঝায়, সব ধর্মের ক্ষেত্রেই, সেগুলোর ভিতকে নাড়িয়ে দিয়ে তবেই না বৌদ্ধ দর্শনের উৎপত্তি এবং পরবর্তীতে সফলতার সহিত বিকাশ । সমাজের সবগুলো শ্রেণীকেই তাই ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করেছিল বুদ্ধের দর্শন । তাঁর দর্শন এবং শ্রেণী ও সভ্যতা নির্বিশেষে ব্যাপক প্রচলন-- সবকিছুরই সমাজতত্ত্ব খোঁজে বের করা সম্ভব । সেদিকে যাওয়ার সুযোগ খুব বেশি এই বিষয়ের সাথে প্রাসঙ্গিক করে নেই । তবু মূল আলোচনায় যাওয়ার আগে বৌদ্ধ দর্শনের মৌলিক ও মূল কিছু নীতির পূর্ব-উল্লেখ প্রয়োজন ।

মূল সিদ্ধান্তগুলো২ – নিম্নে উল্লেখিত তিনটি-- যার উপরে দন্ডায়মান বুদ্ধের শিক্ষা ও দর্শন সেগুলো হলোঃ

১) ঈশ্বরকে অস্বীকার করা । ২) আত্মাকে নিত্য স্বীকার না করা । ৩) কোন গ্রন্থকে স্বতঃপ্রমাণ হিসেবে স্বীকার না করা ।



উপরের তিনটি মৌলিক বিষয়ে নজর দিলেই সহজ বোঝা যায়- বুদ্ধের দর্শন কতটা বৈপ্লবিক এবং কোন ব্যাখ্যায় যাওয়ার আগেই এসব মূলনীতিগুলো আমাদের চিন্তাজগতে নাড়া দেয় । রবীন্দ্রনাথ তাই হয় তো তাঁর অন্তরের মধ্যে বসবাসরত সর্বশ্রেষ্ঠ মানব বলে আখ্যা দিয়েছেন বুদ্ধদেবকে৩ , যিনি নিজের মধ্যে মানুষকেই প্রকাশ করেছিলেন ।





নিজের মধ্যে প্রকৃত মানুষের প্রকৃতিকেই প্রকাশ করেছে গৌতম বুদ্ধ । বুদ্ধের দার্শনিক আবিষ্কার হলো, দুঃখ আছে, দুঃখের কারণ আছে, দুঃখের নিরোধ আছে এবং দুঃখ নিরোধের পথও আছে ! চিত্তের মুক্তি দিয়ে তিনি তাঁর অন্তিম জন্মকে প্রকাশ করেছিলেন । জন্মান্তরের প্রচলিত ব্যাখ্যার সাথেও যা নিশ্চিভাবে তফাৎ তৈরি করে দেয় । বোধিপ্রপ্তির পর বুদ্ধ বলেছেন, জ্ঞান সম্যকভাবে দর্শিত হওয়ার পর চিত্তের মুক্তি অটল হয়ে যায়, এটাই অন্তিম জন্ম । বুদ্ধের জন্মান্তর তাই কোন পরকাল-সংযুক্ত জন্মান্তর নয়, বুদ্ধের জন্মান্তর নিজের ভিতরের চিত্তকে অতিক্রম করে আকাঙ্খিত চিত্তে পৌঁছানোর জন্মান্তর ! যা ব্যক্তিভেদে ভিন্ন হতে পারে । যাই হোক, বুদ্ধের জন্মান্তর নিয়ে ভিন্ন কোথাও লেখার ইচ্ছা রইল । তবে বুদ্ধ-দর্শনকে সমুন্নত রেখে তাঁর অগ্রগতির জন্য বৌদ্ধ দার্শনিকদের খেয়াল রাখতে হবে যে, বৌদ্ধ দর্শনে জন্মান্তর আসলে একটি দার্শনিক বিষয় এবং তাঁকে পূর্ব ও পরজন্মের মতো স্থুল আঙ্গিকের সাথে মিলিয়ে ব্যাখ্যা করলে বৌদ্ধ দর্শন ক্ষতিগ্রস্থ হয় । আমরা জানি যে, ত্রিপিটকে উল্লেখ্ আর্য অষ্টাঙ্গিক মার্গ, যার মাধ্যমে দুঃখের নিরোধ হয়, এর মাধ্যমেই বুদ্ধ জ্ঞান-চক্ষুর উন্মেষ ঘটান । জ্ঞান লাভের পথকে হৃদয়ঙ্গম করে বুদ্ধ দুঃখ হতে মানুষকে উদ্ধারের পথ আবিষ্কার করে দেন । বুদ্ধ নিজের এবং অপরের দুঃখকে এক করে দেখার জ্ঞানের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেছিলেন । অস্ত্র ছাড়া (কারণ গৌতমও ক্ষত্রিয়কূলে জন্মেছিলেন, বৈদিক নিয়মে যুদ্ধ তাঁর কর্মদর্শন ছিলো !), শুধু পরষ্পরের মৈত্রীর দ্বারা পরিচালিত সমাজব্যবস্থা নিয়ে চিন্তা করতেন গৌতম । রোহিনী নদীর জল নিয়ে দুই ক্ষত্রিয় বংশের মারামারির ইতিহাস আমরা জানি । নিজের প্রতিবেশী ও আত্মীয়ের উপর প্রতিশোধ নিতে তিনি মোটেও আগ্রহী ছিলেন না । তাই যুদ্ধ ছাড়া একটি শান্তিপূর্ণ সমাজব্যবস্থার উপায় খুঁজে বের করতেই তিনি গৃহত্যাগ করেন । আবার, কঠোর তপস্যাও তিনি ছেড়ে দিয়েছিলেন যখন দেখলেন এ-দ্বারা তেমন কিছুই হবে না, পরে তিনি তাঁর মধ্যমমার্গ আবিষ্কার করেন৪ ।



মনের পূর্ণ উৎসাহ দিয়ে সৎকর্ম করার উপদেশ দেন গৌতম বুদ্ধ, কল্যাণকর্মে মানুষকে ব্যস্ত থাকতে বলেন । তবে তাঁর কর্মবাদ নিশ্চিতভাবেই বৈদিক শাস্ত্রের জীবিকা উপার্জনের কর্মযোগের বিরুদ্ধে এক বৈপ্লবিক প্রতিবাদ । গীতায় উল্লিখিত কৃষ্ণ-বর্ণিত ধর্মযুদ্ধ, ইসলাম ও খ্রিস্ট ধর্মের যথাক্রমে জিহাদ ও ক্রুসেডস – এসবের সাথে কোন সাদৃশ্যই নেই বৌদ্ধ দর্শনের । নির্মল শান্তি ও পূর্ণাঙ্গ মুক্তির দর্শন তুলে ধরেছেন বুদ্ধ । বৌদ্ধ দর্শনের বিকৃতি শুরুর আগে – বুদ্ধের পরিনির্বানের পর, দেখা যায়, বুদ্ধের বাণীসমূহ (সুত্তপিটক, বিনয়পিটক) সম্মিলিত ভিক্ষুদের প্রথম সভায় গৃহীত হয়েছিল । গণতান্ত্রিক এই প্রক্রিয়াটি নিশ্চিতভাবেই গৌতম বুদ্ধের জীবন দর্শনকেই প্রতিনিধিত্ব করেছে । এ প্রসঙ্গে উল্লেখ্য যে, বুদ্ধের জন্মের পূর্বে ভারতবর্ষে বা জম্বুদ্বীপে ভিন্ন ভিন্ন ষোলোটি রাজ্য ছিল । এসকল রাজ্য এককালে গণমূলক অথবা গোষ্ঠীমূলক ছিল । কিন্তু এইগুলোও রাজতন্ত্রের কবলে পড়ে ধ্বংসের মুখোমুখি হয়ে পড়েছিল । বুদ্ধ এসব গণরাজ্যগুলিকে ভালো চোখে দেখতেন ৫ ।

মগধের রাজা বিম্বিসার বুদ্ধের অনুগামী ছিলেন । বুদ্ধের জন্ম-মৃত্যু দুটোই গণরাজ্যে (যথাক্রমে শাক্য ও মল্ল) হয়েছিল । বিম্বিসারের পর তার পুত্র অজাতশত্রু মগধের রাজা হলে তার সাথেও বুদ্ধের ভাল সম্পর্ক ছিল । কি করলে তাদের প্রজাতান্ত্রিক রাষ্ট্র অপরাজিত থাকবে সেই বিষয়ে যে সাতটি পরামর্শ বুদ্ধ দেন, তার মধ্যে গণতান্ত্রিক উপায়ে ঐক্যবদ্ধ থেকে সিদ্ধান্ত গ্রহণের উপদেশের পাশাপাশি উল্লেখযোগ্য একটি হলো – স্ত্রীলোকের প্রতি শক্তি প্রদর্শন না করা ৬ । সৎকর্ম ও নীতিশিক্ষার উপদেশ সত্ত্বেও বুদ্ধ কতটা নিন্মবর্ণের স্বার্থকে প্রতিফলিত করতে পেরেছিলেন সে নিয়ে বিতর্ক থাকতে পারে, তবে নারী-পুরুষ প্রভেদ বুদ্ধের দর্শনে খুব একটা পরিলক্ষিত হয় না ।



ধর্মীয় দর্শনের ভিতরে নারীর অবস্থান বিশ্লেষণ করা নতুন কিছু নয় । মানবাধিকার লঙ্ঘনের দলিলের মতো কাজ করে ধর্মীয় গ্রন্থসমূহ । অবশ্য বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই গবেষকরা ধর্মীয় বিধানগুলোকে নারী অধিকারের পরিপন্থী বলে মনে করেন না । মূল কারণ অবশ্যই তাদের শ্রেণী ও ধর্মীয় চরিত্র । আর ‘নারী’ বিষয়কে প্রচলিত সব ধর্মেই এমনভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে যেন নারীকে সযতনে ঈশ্বর নিজে, আলাদা প্রজাতির মতো করে, মর্যাদার আসনে বসিয়েছেন ! নারী যেহেতু পুরুষ নয়, তাই আলাদা গুরুত্ব প্রদানের পরেও নারীর বিপর্যয়ের বিপন্ন চিত্র প্রতিভাত হয় নিজ নিজ ঈশ্বরের প্রেরিত(!) বিধানসমূহে । বিপত্তি এখানেই ঘটে, কারণ নারীকে আলাদা দলভুক্ত করে আযতন স্বতন্ত্র বিধান দেয়া হয়েছে বলেই নারীকে মানুষের আসন কোন প্রচলিত ধর্মই তেমন দিতে পারে নি । বিষয়টির অবশ্য সমাজতত্ত্বও আছে । সেখানে নিশ্চিতভাবেই তৎকালীন বা তৎপূর্ববর্তী সমাজের প্রতিফলন ঘটেছে । বুদ্ধের দর্শন এক্ষেত্রে দেশজ কিংবা জাতিগত চেতনার সীমানা ছাড়িয়ে প্রশংসনীয় জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে ।

বুদ্ধ-বিধানে স্ত্রী-লোকের সঙ্ঘের বিধান দিয়েই আলোচনা শুরু করা বাঞ্ছনীয় হবে । বৌদ্ধ ধর্ম ব্যতিরেকে অন্য কোন ধর্ম সে সাহস দেখাতে পারেনি । বর্তমানে তো কোনো ধর্মে নেই-ই, এমনকি বুদ্ধের এই বিধান বৌদ্ধধর্মের অনুসারীরা আজ আর মানতে রাজি নন । যাই হোক, এক্ষেত্রে জৈন সাধ্বীদের সঙ্ঘকেই মতান্তরে সবচেয়ে প্রাচীন বলা হয় । জৈন ও বৌদ্ধ সাহিত্যেই প্রমাণ পাওয়া যায় যে, মেয়েদের তখন ধর্মের ব্যাপারে সমান আগ্রহ ছিল । আগেই উল্লেখ করেছি যে, জৈন ও বৌদ্ধ দুটো ধর্মই বেদবিরোধী অবস্থানের জন্য ব্যাপক জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল । সব ধরণের বৌদ্ধ ইতিহাসেই দেখা যায় যে, গৌতমী ও পাঁচশত শাক্য মহিলা সর্বপ্রথম সংসারের মায়াকে বিসর্জন দিয়ে ভিক্ষুণীসঙ্ঘে যোগদান করেন । সঙ্ঘে নারীদেরকে নেয়ার ব্যাপারে প্রথম বৈপ্লবিক কাজটি তাই প্রকাশ্যে করে বৌদ্ধধর্ম । যদিও সেটাও জানা ইতিহাস যে নারীদেরকে সঙ্ঘে নেয়ার ব্যাপারে প্রথমদিকে আপত্তি জানিয়েছিলেন বুদ্ধ ।

পরবর্তীতে, তাঁর নিকটতম শিষ্য আনন্দের অনুরোধে, নারীদেরকে সঙ্ঘে নেয়ার অনুমতি দিয়েছিলেন বুদ্ধ । মহাপ্রজাপতি গৌতমী এবং আরো মহিলার সঙ্ঘ অভিষেকের পরেই ভিক্ষুণীসঙ্ঘ প্রতিষ্ঠা পায় এবং তা দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে সর্বত্র । কথিত আছে যে, সঙ্ঘে নারীদেরকে অনুমতি দানের ফলে এই অনুশাসনগুলোর দীর্ঘস্থায়ীত্ব লোপ পেয়ে তা মাত্র পাঁচশত বৎসর মাত্র টিকে থাকবে, আনন্দকে উদ্দেশ্য করে বুদ্ধ তা বলেছিলেন । বিনয় পিটক অবশ্য এই ভবিষ্যতবাণীর সফলতার কথাও বলেছে ! কোসম্বীর মতো ইতিহাসবিদ অবশ্য এই ধরণের ভবিষ্যতবাণী পরবর্তী সংযোজন বলে তা খন্ডন করে দিয়েছেন ৭ । কোন গবেষণা ছাড়াই সেটা অবশ্য সহজে বোধগম্য যে, মানুষের মুক্তিকে চূড়ায় স্থাপন করে যিনি অনন্য সব বিধান তৈরি করেছেন তাঁর মুখে এই সংকীর্ণতা প্রকাশিত হওয়ার কথা নয় ।

এবার আরেকটু বিশদ ব্যাখায় যেতে হয়। বুদ্ধ-দর্শনে অনন্য সব মানবিক উপাদান পরিলক্ষিত হয় । সংযুক্তনিকায় চতুর্থ খন্ডের ষড়ায়তন বর্গে মাতৃজাতির জন্য পুরুষ হতে স্বতন্ত্র কিছু দুঃখের উল্লেখ করেছেন বুদ্ধ, যা স্বতন্ত্র দুঃখ সূত্র নামে অভিহিত । সেগুলো সংক্ষেপে নিন্মরূপঃ

১) পিতা হতে স্বামীর গৃহে গমন ।

২) ঋতুস্রাব ।

৩) গর্ভধারণ ।

৪) সন্তানপ্রসব ।

৫) পুরুষের পরিচর্যা বা সেবা ।

পুরুষ হতে স্বতন্ত্র এই পাঁচপ্রকার প্রকৃতি ও সমাজনির্ধারিত বৈশিষ্ট্যসমূহকে স্বতন্ত্র দুঃখের মহিমায় সংজ্ঞায়িত করা নিঃসন্দেহে বুদ্ধের এক বৈপ্লবিক অবদান । আজকের তৃতীয় পর্বের নারীবাদ রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক অধিকারের ক্ষেত্রে যে সমান সুযোগের দাবী নিয়ে হাজির হয়েছে তার উপকরণ দেখা যায় বুদ্ধের দর্শনে । এমনকি, র‍্যাডিকাল নারীবাদরাও নারীর গর্ভধারণ, সন্তান প্রসব ও পুরুষের পরিচর্যার বিপক্ষে নারীকে যেভাবে জাগরণের কথা বলেন তার সাথে খুব বেশী বৈপরীত্যপূর্ণ নয় বুদ্ধের দর্শন ।



বুদ্ধযুগের সমাজব্যবস্থায় নর্তকী ও বারবণিতার ভুরি ভুরি উল্লেখ পাওয়া যায় । পুরুষের আমোদ-প্রমোদের জন্য নারীর ব্যবহার ছিল নৈমিত্তিক বিষয় । পুরুষের বিলাস-বাসনা চরিতার্থ করতেই প্রচুর অর্থের বিনিময়ে নিজেদের জীবনকে ভোগসামগ্রীর মতো ব্যবহার করতে হতো । বিমলাচরণ লাহা দেখিয়েছেন, বৈশালীতে এরকম আইন-ই হয়তো বা ছিল যে সুন্দরী রমনী বিয়ে করতে পারবে না; জনসাধারণের আনন্দ দান হবে তাঁদের মূল কাজ ৮ । বুদ্ধের অনুশাসন অনেক রমনীর, শ্রেণী ও জাতি নির্বিশেষে, চিত্তে ভাবনার উদ্রেগ করেছিল । বিত্তশালী, গরিব, গৃহিণী, বারবনিতা বুদ্ধের দর্শনের ছায়াতলে এসে সমাজ-নির্ধারিত-জীবন ছেড়ে নিজেদের জন্য স্বতন্ত্র জীবন খুজেঁ পেয়েছিলেন । আবার যুবতী কন্যারা সবচেয়ে বেশি পণে বিক্রি হয়ে যাবার অপমান হতে বাঁচার জন্য এবং চিন্তাশীল রমণীরা যুগ-যুগান্তরের সংস্কার তাঁদের জ্ঞানের বিকাশের পথে যে বাধার পাহাড় গড়ে তুলেছে সেই বাধার হাত থেকে মুক্তির জন্য বুদ্ধের ছায়ায় আশ্রয় গ্রহণ করেছিলেন । ধর্ম সম্বন্ধে অনেক মহিলার বক্তৃতা শোনেও অনেক মানুষের প্রীত হওয়ার কাহিনী জানা যায়, যা বৌদ্ধ সাহিত্যে উল্লিখিত আছে ।



আজকের নারীবাদীরা তাই বুদ্ধের দেয়া অনুশাসনকে তাঁদের রেফারেন্স হিসেবে ব্যবহার করতে পারেন । যদিও গৃহকর্মে নারীর প্রতি বুদ্ধের যেসব উপদেশ বা অনুশাসন মেলে তাতে নারীকে তাঁর সমাজ থেকে উঁচুতে দেখার কিছু আমাদের পরিলক্ষিত হয় না । সেটা, বুদ্ধের অনুশাসনের মতোই, সমাজের চাপে পড়ে করতে হয়েছে বলে অনুমান করা যায় ৯।



বুদ্ধের বোধিপ্রাপ্তির দর্শন কেবলমাত্র দুঃখমুক্তির দর্শনেই সীমাবদ্ধ নেই । মানুষকে উদ্ধার করার যে জ্ঞান, যাকে বোধি বলে অবহিত করা হয়, তাতে প্রচলিত সমাজ-সংস্কৃতির প্রতি একধরনের বিদ্রুপের ভাব পরিলক্ষিত হয় । বিষয়ের উপভোগ ও ভোগবাদে মত্ত অসুস্থ চিন্তার সাহায্য দ্বারা সুখ পাওয়ার প্রবণতা দমন করার মধ্যেই জ্ঞান নিহিত । এই ভাবনা আজকের পুঁজিবাদের বেপরোয়া ভোগ-সংস্কৃতির নেতিবাচক দিককে আঘাত করে । ‘মার’ এর আক্রমণ নিয়ে তাই কাব্যিক বর্ণনা পাওয়া যায় "থেরীগাথা"তে । যা স্পষ্টতই মেয়েদের দ্বারা গীত হয়েছিল । নারীর প্রতি সম্মান ও নারীদের দ্বারা রচিত বক্তব্যগুলো বৌদ্ধধর্মে এক অনন্য সংযোজন । থেরীগাথার কাব্যিক বর্ণনার পাশাপাশি এর দর্শনের আবেদনও আমাদের কাছে কম গুরুত্বপূর্ণ নয় । স্বামী-সংসার ছেড়ে, ভোগের সুখমত্ত জীবন বিসর্জন দিয়ে বুদ্ধের আশ্রয় নিয়েছিলেন বহু রমনী । দৈহিক সৌন্দর্যের অর্থহীনতাকে উপলব্ধি করে ধ্যানে সিদ্ধিলাভপূর্বক তাঁরা অর্হত্ব অর্জন করেন । যদিও বৈরাগ্য বিষয়ক বক্তব্য গাথার পরতে পরতে আছে তবু কাব্যিক সুষমায় আনন্দের উচ্ছ্বাস অন্য এক মাত্রা যুক্ত করেছে প্রাচীন এই বৌদ্ধ সাহিত্য । বারবনিতা, সম্ভ্রান্ত রমনীর পাশাপাশি অনেক সাধারণ রমনী কেবল গার্হস্থ্যজীবনের নাগপাশ থেকে মুক্তির জন্য ভিক্ষুনীর জীবন গ্রহণ করেছেন । প্রচলিত সংসার থেকে মুক্তি লাভ ছাড়া যে আসল মুক্তির স্বাদ আস্বাদন করা সম্ভব নয় তা ভিক্ষুণীদের বক্তব্যে খোলাখুলিভাবে উঠে এসেছে । একদিকে তাঁরা যেমন নারী-স্বাধীনতার নির্দিষ্ট কিছু ক্ষেত্রের উপর আমাদের মনোযোগ কেড়েছেন, অন্যদিকে বুদ্ধের দর্শন তাঁর মানবিকতা প্রদর্শন করেছে রাজমহিষী থেকে দাসি সবাইকে অকুন্ঠভাবে স্বাগত জানিয়ে ।



বুদ্ধ যেভাবে দ্বান্দ্বিক পদ্ধতির পরিবর্তনশীলতার তত্ত্বকে নিয়ে এসেছেন আমাদের সামনে তেমনি ভিক্ষুণীদের বিতর্ক করার পান্ডিত্যেরও প্রমান মেলে । বুদ্ধের রমণী তাই রমণীয় নয়, তাঁরা মানবিক এবং পুরুষের সমান মানবিক । অর্হত্ব প্রাপ্তির পর সম্ভ্রান্ত বংশের সুমেধার কন্ঠ থেকে আমরা শোনতে পাই – "দেহ দেবস্বভাবসম্পন্ন হলেও তা নশ্বর ...কামে আনন্দের অনুসরণ করিও না, এটি যে অশুভ তা অনুধাবন কর ...... আকাশ হতে যদি সপ্তবিধ রত্নের বৃষ্টিতে দিগন্ত পূরিত হয়, তা হলেও তৃষ্ণার তৃপ্তি হবে না... মানুষ অতৃপ্ত হয়ে মরবে..."১০

উল্লিখিত চরণগুলোর কাব্যিক সৌন্দর্য যেমন আমাদেরকে মোহিত করে তেমনি প্রচলিত সমাজের মানুষের আমরণ অতৃপ্ত বাসনার চরিত্রও তোলে ধরে এসব গীতিকা । পটাচারা নামক ভাগ্যবিড়ম্বিত এক রমণীর পরিচয় পাই থেরীগাথায় । পটাচারা স্বামী, সন্তান, পিতা-মাতা হারিয়ে উন্মাদিনী হয়ে যখন রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন, কপর্দক নোংরা সমাজের মানুষ তাকে পাগল ঠাউরে বুদ্ধের পাশে আসতে দিতে চায় নি । কিন্তু মানবতাবাদী বুদ্ধ সেই বিবসনা রমণীকেও স্মৃতি পুনরুদ্ধারে সাহায্য করে তাঁকে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনেন । পটাচারাকে লক্ষ্য করে বুদ্ধের বাণী যে বৈজ্ঞানিক ভিত্তিকে আমাদের মনে রাখতে বলে তা পুনরায় এখানে উল্লেখযোগ্য, অনুসরণযোগ্য তো বটেই – "যে মানুষ শতবর্ষ জীবিত থাকিয়া বস্তুস্মূহের উৎপত্তি ও বিনাশ দেখিতে পায় না, তাহার পক্ষে উহা দেখিয়া মাত্র একদিন জীবনধারন শ্রেয়" ১১





কার্য-কারণ বাদ রেখে, অন্তত অন্যসব প্রভাবশালী ধর্মের মতো, প্রার্থনা বা এবাদত-বন্দেগীর শ্রেষ্ঠত্বকে বুদ্ধদর্শন কোনো ভাবেই ঐকান্তিক গুরুত্ব দেয় নি, আর সেখানেই বুদ্ধের মহত্তম কীর্তি । এরকম অনেক নারী-চরিত্র, যারা অর্হত্বপ্রাপ্ত হয়েছিল, শ্রেণী-বর্ণ নির্বিশেষে, আমরা থেরীগাথায় দেখতে পাই । বিমলা নামক এক চরিত্র, প্রথম জীবনে যিনি গণিকা ছিলেন, শেষদিকে তিনিও নিয়েছিলেন সন্যাসের জীবন । স্বর্গের দেবস্থানের প্রতি বিতৃষ্ণাও প্রকাশিত হয়েছে সেসব গাথায় । অর্হত্ব লাভের পর উল্লসিত বিমলা গেয়েছিলেন – "সৌন্দর্যের ল্যাবণ্যে উদ্দীপিত হয়ে জন-সাধারণে সৌভাগ্য ও খ্যাতি লাভ করে, যৌবনের অহঙ্কারে মত্ত হয়ে, অজ্ঞান ও অনবহিত হয়ে আমি কত স্ফীত হতাম . . . আজ আমি শান্ত ও নির্বাণ প্রাপ্ত ।" ১২

অজ্ঞাতনামা অনেক থেরীর উল্লেখ যেমন পাওয়া যায়, যারা সাংসারিক জীবনের দুঃখ কষ্ট ছেড়ে, পাকশালার দাস্যবৃত্তি হতে মুক্ত হয়ে মধুর মুক্তির গান গেয়েছেন, তেমনি আম্রপালি নামক আরেক চরিত্রের (বৌদ্ধধর্মে সুজাতার মতোই জনপ্রিয় ) বর্ণনা থেকে আমরা জানতে পারি যে, তার সৌন্দর্য্যে মুগ্ধ হয়ে তাঁকে অধিকার করার জন্য রাজপুত্রগণ কলহে লিপ্ত হলে তাকে গণিকায় পরিনত করে সে সমস্যার সমাধকান করা হয় । সমাজের এই করুণ বাস্তবতার বেরী ডিঙিয়ে অন্যসব ভিক্ষুণীর মতোই সকল বস্তুর ভিতরকার অনিত্যতার সূত্রকে বুঝতে পেরে আম্রপালিও বুদ্ধের দীক্ষা নিয়ে অর্হত্বপ্রাপ্ত হয়েছিলেন । শরীরের অনিত্য বর্তমানকে তিনি তুলে এনেছেন তাঁর গাথায় এভাবে – " স্থুল সুগোল উন্নত আগের স্তনযুগল জরাগ্রস্থ হয়ে এখন বারিশূন্য চর্ম থলের মতো আকার ধারণ করেছে . . . এখন তা দুঃখের আলয় . . ." ১৩

নিজের শরীরের অনিত্যতাকে ধ্যান-মগ্ন-চেতনায় ধারন করে বিশ্ব-পৃথিবীর অনিত্যতার তত্ত্ব আবিষ্কারের মহত্ব এসব বাণীর মধ্যে খোঁজে পাওয়া যায় । থেরীগাথায় ব্রাহ্মণকন্যা রোহিণী নামক যে চরিত্রের পরিচয় আমরা পাই সেখানে দেখতে পাই রোহিণী পিতামাতাকে বুদ্ধের শিষ্যত্ব নেয়ার জন্য তাঁদের সাথে বিতর্কে জড়িয়ে পড়েন । বুদ্ধের নারী ও বৌদ্ধ নারী – সৌন্দর্য ও মানবতাবাদী উপাদানে দু’দিক থেকেই বৌদ্ধ-দর্শনে শক্তি সংযোজিত হয়েছে ।



বুদ্ধের দেয়া অনুশাসনের সিকিভাগও আজকের বৌদ্ধধর্মের অনুসারীদের ভিতরে খোঁজে পাওয়া মুশকিল হবে । এই উপমহাদেশে বৌদ্ধ দর্শনের বিরুদ্ধে অনেক ষড়যন্ত্র-অত্যাচারের ইতিহাস আছে । তবে বৌদ্ধ ধর্মের পতনের পেছনে সেসব কারণগুলো মুখ্য হলেও তাঁর পতন আসলে শুরু হয়েছে বৌদ্ধ ধর্মের অনুসারীদের মধ্যে মত-অনৈক্য থেকেই । বুদ্ধের দেয়া মৌলিক ধর্মোপদেশ নিয়ে বুদ্ধের মৃত্যুর মাত্র একশত বৎসরের মধ্যেই বিবাদ শুরু হয় । দেখা দেয় দুই সম্প্রদায়; দুই সম্প্রদায়ের থেকে পরবর্তীতে একশত বৎসরের মধ্যে ১৮টি প্রকারভেদ তৈরি হয় ১৪ ।

এমন কি বিপুল পরাক্রমের বৌদ্ধ দর্শনের মৌলিক নীতিগুলোর তোয়াক্কা না করে তার ভিতরে পূজাঅর্চনাও শুরু হয়ে যায় । বৈদিক হিন্দুগণ যেভাবে বুদ্ধের প্রভাবকে ঠেকিয়ে রাখার জন্য বুদ্ধকে তাদের অবতারে পরিণত করে, তাঁর চেয়ে ভয়ঙ্কর চর্চা বৌদ্ধ অনুসারীরা নিজেদের ভিতরেই শুরু করেছেন । অন্য সব ধর্ম থেকে তাই তাঁকে আলাদা করে চেনার কোনো সুযোগ থাকে না । এসব বিকৃতির সমালোচনা কোসম্বী, রাহুল সাংকৃত্যায়নের গবেষণাধর্মী বইগুলোতে যেমন পরিলক্ষিত হয় তেমনি রিচ ডেভিডস এর "গৌতম, দ্যা ম্যান " – এর ভিতরে দেখা যায় ১৫ ।




বুদ্ধের মূল নীতিগুলোকে ভুলে যেয়ে তাঁর দর্শন-চর্চা আলাদা কোনো গুরুত্ব বহন করে না । সাংঘর্ষিক এরকম চর্চা বরং বৌদ্ধ দর্শনের গতিকেই স্থিমিত করে দিচ্ছে , বুদ্ধকে মানুষ হিসেবে মেনে নিলে বুদ্ধের বুদ্ধত্বকে খাটো করা হয় না । বিপরীত চর্চাই বরং ক্ষতির কারণ হয় । গ্রীক রাজা মিলিন্দের সাথে নাগসেনের বিতর্কসমৃদ্ধ আলোচনা, যা "মিলিন্দ প্রশ্নে" গ্রন্থিত আছে, সেগুলোই বুদ্ধের প্রকৃত অনুসারীর কাজ । অতিমানবিক কোন শক্তি বুদ্ধের মহিমায় যুক্ত করতে চাইলে সেটা তাঁর মানবিক মহিমাকেই খাটো করবে । গুহার অভ্যন্তরে তৈরি অজন্তা, ইলোরার মতো ভাস্কর্যের নিদর্শন অন্য কোনো প্রচলিত ধর্মের ইতিহাসে নেই । বৌদ্ধ দর্শন সাহিত্য-শিল্পকলায় সমৃদ্ধ । সমৃদ্ধ মানবিক মানবতার উপকরণেও । জাতিভেদের ওপর নিষেধাজ্ঞা প্রথম বুদ্ধই আরোপ করেন । যজ্ঞকেও অমঙ্গল হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন বুদ্ধ । এ-লেখার আলোচ্য বিষয় নিয়ে সেসব দিকগুলোতে আলোকপাত করার সুযোগ নেই, তবু বুদ্ধ এসব নিষেধাজ্ঞা নিয়ে যেসব উপদেশ আর গল্প শুনিয়েছেন তা যেকোন বিচারে সুসমৃদ্ধ এবং সেসব বিষয়কেই যেকোন বিষয়ে আলোচনায় যাওয়ার আগে নিয়ে আসতে হবে । নেতৃত্ব নিয়ে ঝামেলা হতে পারে তাই সংঘে সবাইকে মিলেমিশে কাজ করার কথা বুদ্ধ বলেছেন । ভিক্ষুদের জন্য নির্ধারণ করেছেন ব্যক্তিগত সম্পদহীন খুবই সাদামাটা জীবন । বলেছেন, "যেমন কোনো পক্ষী যেদিকে উড়ে, সেইদিকে সে পাখা সহই উড়ে, তেমনই, ভিক্ষুও শরীরের জন্য প্রয়োজনীয় বস্ত্র এবং পেটের জন্য প্রয়োজনীয় অন্ন শুধু ইহাতেই সন্তুষ্ট হয়"১৬ ।

কোসম্বী থেরীগাথা থেকে দেখিয়েছেন, সোমা নামক এক ভিক্ষুণীর মারের সাথে কথোপকথন – "চিত্ত ভালোরকমে সমাহিত হইলে এবং জ্ঞান লাভ হইলে, সম্যকভাবে যে ব্যক্তি ধর্ম জানে, তাহার স্ত্রীত্ব নির্বেণ মার্গে কী করিয়া অন্তরায় হয়?" এই-ই তো বুদ্ধের নারী । বৌদ্ধ নারীরাও তাই সমৃদ্ধ করেছেন বুদ্ধের দর্শনকে । সঙ্ঘের মূল যেসব নিয়মাবলী বুদ্ধ সঙ্ঘের শ্রীবৃদ্ধির জন্য বেঁধে দিয়েছিলেন সেগুলোও তাঁর মানবিক চেতনার সুশোভন রূপকে প্রকাশ করে । মানুষের কাজকর্মে নিষধাজ্ঞা আরোপ বুদ্ধের মূল উদ্দেশ্য ছিল না, কাজকর্মে নৈতিকতাকে শক্তি হিসেবে নেয়ার উদাহরণ পাওয়া যায় চাষী ভারদ্বাজকে তাঁর উপদেশের মাধ্যমে ।



আমরা জানি- বৈশাখ মাসের এক পূর্ণিমা রাত্রিতে গৌতম বোধিসত্ত্ব, চারটি আর্যসত্য ও তাঁর অন্তর্গত অষ্টাঙ্গিক মার্গ লাভ করেছিলেন । কথিত আছে যে ওইদিন এক উচ্চবংশীয় রমণী – সুজাতা – তাঁকে অন্নভিক্ষা দিয়েছিলেন । অন্যদিকে চুন্দ নামক কর্মকারের দেয়া ভিক্ষা গ্রহণ করে বুদ্ধ অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন এবং পরিনির্বাপিত হয়েছিলেন সেদিন । চুন্দের উপরে যাতে কোনো দোষ আরোপ না করা হয় সেজন্য তিনি পরিনির্বাণের আগে আনন্দকে বলে গিয়েছিলেন, "বোধিপ্রাপ্তির দিন আমি যে ভিক্ষা নিয়েছিলাম ও আজ যে ভিক্ষা পেয়েছি এ দুটির মূল্য আমার কাছে সমান ।" বোধিপ্রাপ্ত গৌতমের এরকম সংবেদনশীলতা ও মানবতার পরিচয় তাঁর দর্শনের সব জায়গাতেই খোঁজে পাওয়া যায় । এজন্যই তা প্রভাবিত করেছিল সব শ্রেণীর মানুষকে ।



বৌদ্ধ দর্শনের অন্তর্গত যেসব বক্তব্য তাঁর চিন্তার সাথে সংঘর্ষজনক মনে হয়, আমরা অনুমান করে নিতে পারি তা পরবর্তী সময়ে অন্যদের সংযোজন । তার অনেক কিছুই হয়তো এখন প্রমাণ সাপেক্ষ নয়; তা না হোক, সাংঘর্ষিক এ বিষয়গুলো বুদ্ধের মুখ-নিঃসৃত হলেও বৌদ্ধ দর্শন প্রগতির দর্শন, কারণ দুঃখমুক্তির জন্য এ দর্শন কোনো অতিমানবিক বা অলৌকিক শক্তির ওপর নির্ভর করতে বলে নি, বুদ্ধের বক্তব্যে তাই অক্ষরে অক্ষরে দেখা যায় সামাজিক ও মানবিক উপকরণ । সবকিছুর পরেও, বুদ্ধের দর্শন তাঁর বক্তব্যকে পরম বলে মেনে নিয়ে মানুষের সৃজনশীলতাকে তালাবদ্ধ করে প্রতিক্রিয়াশীল করে তোলার সপক্ষে কাজ করে না । পরিনির্বাণ লাভের মুহূর্তে বুদ্ধ তার প্রিয় শিষ্য আনন্দকে বলে গিয়েছিলেন, "হে আনন্দ, আমার মৃত্যুর পর, সঙ্ঘ, ইচ্ছা করিলে, ছোট-খাটো নিয়মগুলি বাদ দিতে পারিবে" ১৭ ।



নারী-চেতনা, শ্রেণি-চেতনা কিংবা অন্যসব বঞ্চিতের চেতনাকে ব্যাখ্যা প্রদানের ক্ষেত্রে উল্লিখিত বক্তব্যকে সূত্র হিসেবে ধারণ করার সাহস ও প্রজ্ঞা বৌদ্ধ দর্শনে সমুন্নত রাখতে পারলে মানব জাতির জন্য বুদ্ধের অনুশাসন এক অনন্য পথের প্রদর্শক হিসেবে কাজ করতে পারে । ধার্মিক দিয়ে সেটা হবে না, কারণ সবধর্মেই, এ-চেতনা ব্যবহার হয় নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির সংরক্ষক হিসেবে। বৌদ্ধ-চেতনার অনুসারী বুদ্ধিজীবিদেরকে এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হবে, না হলে বুদ্ধের দর্শনও "নিপীড়িতের দীর্ঘশ্বাসে"র ধর্মে পরিণত হবে ।



পাদটীকাঃ

১) দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়, ভারতীয় দর্শন ।

২) রাহুল সাংকৃত্যায়ন, বৌদ্ধ দর্শন ।

৩) রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বুদ্ধদেব ।

৪) ধর্মানন্দ কোসম্বী, ভগবান বুদ্ধ ।

৫) ধর্মানন্দ কোসম্বী, ভগবান বুদ্ধ ।

৬) রাহুল সাংকৃত্যায়ন, বৌদ্ধ দর্শন ।

৭) ধর্মানন্দ কোসম্বী, ভগবান বুদ্ধ ।

৮) বিমলাচরন লাহা, বৌদ্ধরমণী ।

৯) রাহুল সাংকৃত্যায়ন, বৌদ্ধ দর্শন ।

১০) থেরীগাথা, ভিক্ষু শীলভদ্র অনুদিত ।

১১) থেরীগাথা, ভিক্ষু শীলভদ্র অনুদিত ।

১২) থেরীগাথা, ভিক্ষু শীলভদ্র অনুদিত ।

১৩) থেরীগাথা, ভিক্ষু শীলভদ্র অনুদিত ।

১৪) রাহুল সাংকৃত্যায়ন, ভারতে বৌদ্ধ ধর্মের উত্থান পতন ।

১৫) রিচ দেভিডস, ‘গৌতম, দ্যা ম্যান’ – অনুবাদঃ ড. অমল বড়ুয়া ।

১৬) ধর্মানন্দ কোসম্বী, ভগবান বুদ্ধ ।

১৭) ধর্মানন্দ কোসম্বী, ভগবান বুদ্ধ ।


লেখক : নিখিল নীল, সহকারী অধ্যাপক, সমাজবিজ্ঞান, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।

মন্তব্য ৩ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (৩) মন্তব্য লিখুন

১| ২২ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৫ দুপুর ১২:৪৯

দরবেশমুসাফির বলেছেন: ভাল লিখেছেন। প্রিয়তে।

আপনি বলেছেনঃ

যার উপরে দন্ডায়মান বুদ্ধের শিক্ষা ও দর্শন সেগুলো হলোঃ

১) ঈশ্বরকে অস্বীকার করা । ২) আত্মাকে নিত্য স্বীকার না করা । ৩) কোন গ্রন্থকে স্বতঃপ্রমাণ হিসেবে স্বীকার না করা

আমি যতদুর জানি বুদ্ধ ঈশ্বরের সমস্যা দেখেছিলেন অজ্ঞেয়বাদী দৃষ্টিভঙ্গিতে। তিনি সরাসরি ঈশ্বরকে অস্বীকার করেন নি।তাই আপনার এ বক্তব্যর রেফারেন্স দিলে উপকৃত হতাম।

২| ২২ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৫ দুপুর ১:০০

জয়দেব কর বলেছেন: ধর্মপদে পাবেন- " অত্তা হি অত্তনো নাথো কোহি নাথো পরো সিয়া-তুমিই তোমার নাথ বা প্রভু ,তুমিই তোমার আশ্রয়। তুমি ছাড়া তোমার অন্য কোন আশ্রয় আছে?"

৩| ২০ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ সন্ধ্যা ৭:০৪

পি কে বড়ুয়া বলেছেন: উপরের প্রশ্ন কর্তা কে জানাতে চাই, যে বুদ্ধের এই অভিপ্রায় অজ্ঞেয়বাদিতারই নামান্তর। তিনি ইশ্বর কে নিয়ে অজ্ঞতা দেখিয়েছেন ,ঠিক বিজ্ঞানীদের আদলে, কারন তার কোন প্রমান নেই। অপ্রয়োজনীয় হেতু, ইশ্বর ভাবনায় সময় ক্ষয় কে তিনি নিরুতসাহিত করেছেন তাঁর বক্তব্যে । পক্ষান্ততে নাস্তিকরা ইশ্বরকে না বলার মাঝে , তার অস্তিত্বকে স্বীকার করে নেয় ।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.