নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
মূল : ওয়ালপোলা রাহুল
ভাষান্তর : জয়দেব কর
ধর্ম-প্রবর্তকদের মধ্যে বুদ্ধ ( যদি আমাদেরকে জনপ্রিয় ধারণায় তাঁকে ধর্মের প্রবর্তক বলতে বলা হয়) ছিলেন একমাত্র শিক্ষক যিনি নিজেকে একজন খাঁটি ও সরল মানুষের বাইরে আর কিছু হিশেবে দাবি করেন নি। অন্যান্য ধর্মগুরুগণ বা প্রবর্তকগণ ছিলেন_ ঈশ্বর, অথবা তার অবতার নাহয় তার দ্বারা অনুপ্রাণিত। বুদ্ধ শুধুই একজন মানবসত্তা ছিলেন না; তিনি কোনো ঈশ্বর অথবা বাইরের কোনো শক্তির অনুপ্রেরণাহীনতাও দাবি করেছিলেন। তাঁর সকল বোধ, সিদ্ধি, ও অর্জন তিনি মনুষ্য প্রচেষ্টা ও বুদ্ধিমত্তায় আরোপ করেছিলেন। একজন মানুষ, শুধু একজন মানুষই, বুদ্ধ হতে পারে। একজন মানুষের ভিতর বুদ্ধ হওয়ার সম্ভাবনা আছে, যদি সে তা চায় এবং প্রচেষ্টা করে। আমরা বুদ্ধকে উৎকৃষ্ট মানুষ হিসেবে ডাকতে পারি। তিনি তাঁর মানবীয়তায় এতটা নিখুঁত ছিলেন যে, পরবর্তীতে জনপ্রিয় ধর্মে প্রায় অতিমানব হিসেবে পূজিত হয়ে এসেছেন।
বুদ্ধমতবাদ অনুযায়ী মানুষের অবস্থান হচ্ছে সর্বোচ্চ। মানুষ নিজেই নিজের প্রভু, এবং তার গন্তব্য বা তাঁর পরিণতির বিচারের জন্য উচ্চতর কোনো সত্তা অথবা শক্তি নেই।
বুদ্ধ বলেছিলেন ‘নিজেই নিজের আশ্রয়, নিজে ব্যতীত অন্য কে আশ্রয় হতে পারে ?’১ তিনি তাঁর শিষ্যদের সতর্ক করেছিলেন ‘তাদেরকে তাদের আশ্রয় হতে’ এবং অন্যকারো কাছে কখনো আশ্রয় অথবা সাহায্য খোঁজ না করতে।২ মানুষের ব্যক্তিগত প্রচেষ্টা ও বুদ্ধিমত্তা দিয়ে সকল প্রকার বন্দিত্ব থেকে নিজেকে মুক্ত করার ক্ষমতা মানুষের আছে বলে তিনি শিক্ষা, সাহস ও উদ্দীপনা দিয়েছিলেন প্রত্যেক মানুষকে নিজেকে উন্নত করতে এবং আত্মমুক্তির জন্য কাজ করতে। বুদ্ধ বলেন, ‘আপনাদের নিজেদের কাজ করা উচিত। কারণ তথাগত৩ শুধুমাত্র পথের শিক্ষা দেন।’৪ বুদ্ধ নির্বাণ বা মুক্তির পথ আবিষ্কার করেছিলেন এবং দেখিয়েছিলেন বলে তাঁকে পরিত্রাণকর্তা ডাকা যায় । কিন্তু আমাদেরকে অবশ্যই নিজেদের পথের দিকে হাঁটতে হবে।
এই ব্যক্তিগত দায়িত্বপরায়ণতার নীতির উপর বুদ্ধ তাঁর শিষ্যদের স্বাধীনতা অনুমোদন করেছিলেন। মহাপরিনির্বাণতন্ত্রে বুদ্ধ বলেছেন যে, তিনি কখনোই সঙ্ঘ৫ (সন্ন্যাসীদের সংগঠন ) নিয়ন্ত্রণের কল্পনা করেন নি, সঙ্ঘ তাঁর উপর নির্ভরশীল হোক তাও তিনি চান নি। তিনি বলেছিলেন যে তাঁর শিক্ষায় কোনো গোপন তত্ত্ব নেই। ‘শিক্ষকের হাতের মুঠোতে’ (আচারিয়া মুটঠি) কিছুই লুকানো নেই। অন্যভাবে বলতে গেলে বলা যায় ‘তাঁর অস্তিনের ভিতর’ কোনোকালে কিছুই লুকানো ছিলো না।৬
ধর্মগুলোর ইতিহাসে, অন্যখানে, বুদ্ধ অনুমোদিত চিন্তার মুক্তি অশ্রুত। এই মুক্তি প্রয়োজনীয়, কারণ, বুদ্ধের মতে, মানুষের মুক্তি নির্ভর করে তার নিজস্ব সত্য উপলব্ধির উপর ; কোনো ঈশ্বরের দয়ার দানে অথবা কোনো বাহ্যিক শক্তির প্রতি অনুগত ভালো ব্যবহারের পারিতোষিক প্রাপ্তিতে নয়।
বুদ্ধ একবার কোশল রাজ্যের কেসাপুত্তায় গিয়েছিলেন। এই শহরের অধিবাসীরা কালাম নামে পরিচিত। যখন তারা শুনলেন বুদ্ধ তাদের শহরে আছেন কালামরা তাঁর সাথে সাক্ষাৎ করেন এবং তাঁকে বলেন :
‘মহোদয়, কেসাপুত্তায় কিছু সন্ন্যাসী এবং ব্রাহ্মণ আসেন, তারা শুধু তাদের নিজস্ব মতবাদ ব্যাখ্যা ও উপস্থাপন করেন, এবং অন্যদের মতবাদ তাচ্ছিল্য করেন, দোষযুক্ত করেন, এবং অবজ্ঞাভরে প্রত্যাখ্যান করেন। তারপর অন্যান্য শ্রমণ-ব্রাহ্মণরা আসেন এবং তারাও তাদের বেলায় শুধু তাদের নিজস্ব মতবাদ ব্যাখ্যা ও উপস্থাপন করেন, এবং অন্যদের মতবাদ তাচ্ছিল্য করেন, দোষযুক্ত করেন, এবং অবজ্ঞাভরে প্রত্যাখ্যান করেন। কিন্তু মহোদয়, তাদের মধ্যে কোন শ্রমণ ব্রাহ্মণরা আমাদের প্রতি সত্যভাষণ এবং মিথ্যাচার করেন সে ব্যাপারে আমাদের সন্দেহ ও দ্বিধা আছে।’
তারপর বুদ্ধ তাদের উদ্দেশে ধর্মের ইতিহাসের অনন্য এই উপদেশ প্রদান করেন :
“ হ্যাঁ, কালামগণ, সন্দেহপূর্ণ বিষয়ে সন্দেহ উদয় হয়েছে বলেই আপনাদের সন্দেহ থাকাটা যথাযথ, আপনাদের দ্বিধা থাকাটা যথাযথ। এখন কালামগণ শুনুন, গুজব দ্বারা অথবা প্রথা দ্বারা অথবা শ্রুতি দ্বারা পরিচালিত হবেন না। ধর্মগ্রন্থ দ্বারা অথবা কাল্পনিক যুক্তি বা অনুমান দ্বারা অথবা উপস্থিতি বিবেচনা করে, আনুমানিক সিদ্ধান্তে উল্লসিত হয়ে অথবা আপাতদৃশ্যমান সম্ভাব্যতাসমূহ দ্বারা অথবা ‘এই আমাদের শিক্ষক’: ধারণায় নিয়ে পরিচালিত হবেন না। কিন্তু হে কালামগণ যখন আপনারা আপনাদের জন্য যে-সমস্ত বিষয় অমঙ্গলজনক (অকুশল) , ভুল, মন্দ জানবেন তখন সেগুলো পরিত্যাগ করে ফেলুন।… এবং যখন আপনারা আপনাদের জন্য যে-সমস্ত বিষয় মঙ্গলজনক (কুশল) ও ভালো জানবেন তখন সেগুলো গ্রহণ করুন এবং অনুসরণ করুন।”৭
এমন কী বুদ্ধ আরো গভীরে গিয়েছিলেন। তিনি ভিক্ষুদের উদ্দেশে বলেছিলেন যে, একজন শিষ্যের স্বয়ং তথাগতকে পরীক্ষা করা উচিত, যার ফলে তিনি (শিষ্য) যাকে অনুসরণ করেছেন সেই শিক্ষকের যথার্থ মূল্যায়ন করতে যুক্তিসঙ্গতভাবে দৃঢ় হবেন। ৮
বুদ্ধের শিক্ষা অনুযায়ী সত্য সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণালাভে এবং পারমার্থিক উন্নতির পথে (অথবা যেকোনো প্রগতির ক্ষেত্রে) পঞ্চঅন্তরায়ের৯ (পঞ্চ নীবরণ) একটি হচ্ছে সন্দেহ (বিচিকিৎসা)। সন্দেহ, যাই হোক, একটা পাপ না; কারণ বুদ্ধমতবাদে বিশ্বাসের কোন স্থান নেই। অবিদ্যা এবং ভুল দৃষ্টিভঙ্গি ( মিথ্যাদৃষ্টি) হচ্ছে সমস্ত অকল্যাণের উৎস। এটা অনস্বীকার্য যে, পরিষ্কারভাবে না-বুঝা অথবা না-দেখা পর্যন্ত অবশ্যই সন্দেহ থাকবে। কিন্তু গভীরভাবে অগ্রসর হতে হলে অবশ্যই সন্দেহমুক্ত হতে হবে। সন্দেহ থেকে মুক্তি পেতে হলে যে কাউকে পরিষ্কার বুঝতে হবে। এমনটি বলার সুযোগ নেই যে, কারো সন্দেহ করা অনুচিত অথবা কারো বিশ্বাস করা উচিত। ‘ আমি বিশ্বাস করি’ বললে বোঝায় না যে আপনি তা বুঝেছেন এবং দেখেছেন। যখন একজন ছাত্র কোনো একটা গাণিতিক সমস্যা সমাধানে কাজ করে , সে একটা পর্যায়ের কাছে আসে, যা সে জানে না কিভাবে অগ্রসর হতে হয় এবং সেখানে সন্দেহ ও দ্বিধায় থাকে। যতক্ষণ পর্যন্ত তার এই সন্দেহ থাকবে, সে অগ্রসর হতে পারবে না। যদি সে এগিয়ে যেতে চায়, তাকে অবশ্যই এই সমস্ত সন্দেহের অবসান ঘটাতে হবে। এবং সন্দেহ দূরীকরণেরও উপায় আছে। শুধু ‘আমি বিশ্বাস করি’ অথবা সন্দেহ করি না বলে অবশ্যই সমস্যার সমাধান ঘটবে না। কাউকে বিশ্বাস করতে ও কোনো জিনিস না-বুঝে গ্রহণ করতে জোর করা রাজনৈতিক, এবং তা পারমার্থিক বা বুদ্ধিবৃত্তিক নয়।
সন্দেহ দূরীভূত করতে বুদ্ধ সবসময় উৎসুক ছিলেন। তাঁর মৃত্যুর কয়েক মিনিট পূর্বে, তিনি তাঁর শিষ্যদের কয়েকবার বলেছিলেন যে, তাঁর শিক্ষা সম্পর্কে কোনো সন্দেহ থাকলে তাঁকে তা অবহিত করতে এবং পরবর্তীতে ঐ-সমস্ত সন্দেহ সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা অর্জন করতে না পেরে দুঃখ অনুভব না করার জন্য। কিন্তু শিষ্যরা ছিলেন নীরব । তারপর তিনি যা বলেছিলেন তা ছিলো মর্মস্পর্শী : ‘ যদি শাস্তার প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে কোনো কিছু জিজ্ঞেস না করেন, তাহলে আপনাদের মধ্য থেকে যে-কেউ তার বন্ধুকে অবহিত করুন’ (কাউকে তার বন্ধুকে বলতে দিন যাতে, পরে, অন্যের পক্ষ থেকে প্রশ্ন করতে পারেন)। ১০
শুধুমাত্র চিন্তার মুক্তি নয়, ধর্মসমূহের ইতিহাসের শিক্ষার্থীর প্রতি বুদ্ধ-অনুমোদিত সহিষ্ণুতা বিরলপ্রজ সুন্দর। একসময় নালন্দায় নিগন্থ নাথপুত্তের (জৈন মহাবীর) সুপরিচিত শিষ্য উপালি নামক বিখ্যাত ধনী গৃহস্থ মহাবীর কর্তৃক উদ্দেশ্যপূর্ণভাবে বুদ্ধের সাথে সাক্ষাতের জন্য এবং কর্মতত্ত্বের নির্দিষ্ট বিষয়ের উপর যুক্তিতর্কে তাঁকে পরাস্ত করার জন্য প্রেরিত হয়েছিলেন। কারণ, বিষয়টির উপর বুদ্ধের দৃষ্টিভঙ্গি মহাবীরের১১ থেকে ভিন্ন ছিলো। প্রত্যাশার চাইতে সম্পূর্ণ বিপরীতে, উপালি, আলোচনার উপসংহারে, বুদ্ধের দৃষ্টিভঙ্গি সঠিক এবং ঐগুলোতে তাঁর গুরু ভুল_ তা ভালোভাবে বুঝেছিলেন_ তাই তিনি বুদ্ধের নিকট নিজেকে তাঁর গৃহী শিষ্য (উপাসক) করে নিতে প্রার্থনা করলেন। কিন্তু বুদ্ধ তাঁকে পুনঃবিবেচনা করতে এবং তাড়াহুড়া না করতে বললেন_ ‘ তোমার মতো সুপরিচিত মানুষের জন্য সতর্কতার সহিত বিবেচনা উত্তম’ এর জন্য । যখন উপালি তাঁর অভিপ্রায় পুনরায় প্রকাশ করলেন তখন বুদ্ধ তাঁকে অনুরোধ করলেন তাঁর প্রাক্তন গুরুর প্রতি আগের মতো সম্মান ও সমর্থন বহাল জন্য।১২
সহিষ্ণুতা ও বোধের এই মহৎ দৃষ্টান্ত অনুসরণ করে, খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতকে ভারতের বিখ্যাত বুদ্ধমতাবলম্বী সম্রাট অশোক, তাঁর সম্পূর্ণ সাম্রাজ্যে অন্যসকল ধর্মসমূহকে সম্মান এবং সমর্থন জানিয়েছিলেন । আজো পড়া যায় এমন পাথরে খোদাইকৃত তাঁর অধ্যাদেশগুলোর একটিতে সম্রাট ঘোষণা করেছিলেন: “শুধু নিজের ধর্মকে সম্মান করা ও অন্যধর্মের নিন্দা করা কারো ঠিক নয় , বরং যেকোন ব্যাপারে অন্যধর্মকে সম্মান প্রদর্শন উচিত। এইভাবে একজন নিজের ধর্মের প্রসারে সহায়তা করে এবং বিনিময়ে অন্যদের ধর্মগুলোকেও সেবা করে। অন্যথা ঘটলে, নিজের ধর্মের কবর খুঁড়ে এবং অন্যের ধর্মেরও ক্ষতি করে। যেকোন লোক তার নিজের ধর্মকে সম্মান এবং অন্যের ধর্মকে নিন্দা করে প্রকৃতপক্ষে নিজের ধর্মের প্রতি অনুগত হয়ে, ‘ আমি আমার ধর্মকে উজ্জ্বল করবো’ এমন চিন্তায়। কিন্তু, ফলশ্রুতিতে তেমন করতে গিয়ে, সে তার নিজের ধর্মকে বহুলাংশে আহত করে। তাই মতৈক্য শুভ: সবাইকে শুনতে দিন, এবং অন্যের অনুসৃত মতবাদ শুনতে ইচ্ছুক হোন। ” ১৩
আমাদের এখানে যোগ করা উচিত যে, এই সহানুভূতিপূর্ণ বোধশক্তির চেতনা শুধুমাত্র ধর্মীয় মতবাদের বেলায় নয়, যেকোন ব্যাপারেও প্রয়োগ করা যথার্থ।
সহিষ্ণুতা এবং বোধের এই চেতনা বৌদ্ধ সংস্কৃতি ও সভ্যতার শুরু থেকেই সবচেয়ে বেশি লালিত আদর্শ। এই কারণেই, মানুষকে বুদ্ধমতাবলম্বী করতে অথবা ২৫০০ বছরের দীর্ঘ ইতিহাস জুড়ে এর বিস্তারে, নির্যাতন বা রক্তপাতের একটিও নজির নেই। আজ ৫০০ মিলিয়নের অধিক অনুসারী নিয়ে তা এশিয়া মহাদেশের সর্বত্র শান্তিপূর্ণভাবে বিস্তৃত। যেকোনো অজুহাতে যেকোনো ধরণের সংঘাত সম্পূর্ণভাবে বুদ্ধশিক্ষার পরিপন্থী।
প্রশ্নটি প্রায়শই করা হয় : বুদ্ধমতবাদ ধর্ম নাকি দর্শন? আপনি যে নামেই এটাকে ডাকেন না কেন তা কোনো বিষয় না। যেকোনো তকমা লাগান না কেন বুদ্ধমতবাদ যা, তা-ই থাকবে। এমনকি আমরা বুদ্ধের শিক্ষাকে ‘বুদ্ধমতবাদ’-এর যে তকমা দেই তাও সামান্য গুরুত্বপূর্ণ। কারো দেওয়া নামটি অপরিহার্য নয়।
একটা নামে কী আসে যায়? যেটিকে আমরা গোলাপ নামে ডাকি,
অন্য যেকোনো নামেও সুগন্ধ বিলাতো।
একইভাবে সত্যের কোনো তকমার প্রয়োজন নেই: এটা না-বৌদ্ধ, না-খ্রিস্টান, না-হিন্দু ,না-মুসলমান। এটা কারো একক দখলে নেই। স্বাধীন সত্য উপলব্ধির পথে সাম্প্রদায়িক তকমাগুলো একটা বাধা এবং সেগুলো মানুষের মনে ক্ষতিকর অপরিপক্ক বোধের জন্ম দেয়। এটা শুধুই বুদ্ধিবৃত্তিক এবং পারমার্থিক বিষয়ের ক্ষেত্রেই সত্য নয়, মানুষের সম্পর্কের বেলায়ও সত্য। উদাহরণস্বরূপ, যখন আমরা একজন মানুষের সাথে সাক্ষাৎ করি, আমরা তার দিকে একজন মানুষ হিশেবে দৃষ্টিপাত করি না; কিন্তু তার উপর তকমা লাগাই ইংরেজ, ফরাশি, জার্মান,আমেরিকান অথবা ইহুদী হিশেবে এবং মনের সকল অপরিপক্কতায় সংগঠিত মোড়ক দিয়ে তাকে বিবেচনা করি। আমরা যে-সমস্ত বৈশিষ্ট্য আরোপ করে তাকে ধারণা করে নিই হয়তো তিনি সে-সমস্ত বিষয় থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত।
মানুষ বৈষম্যমূলক মোড়কগুলো ভালোবাসে, তাই তারা সবার জন্য একই মনুষ্যগুণ ও আবেগ আরোপে চলে যায়। তারা বিভিন্ন ধরণের তকমার সেবার কথা বলে, উদাহরণস্বরূপ, বৌদ্ধ সেবা অথবা খ্রিস্টিয় সেবা। এবং অন্য তকমার সেবার দিকে দৃষ্টি নামিয়ে দেখে। কিন্তু সেবা সাম্প্রদায়িক হতে পারে না; এটা না-খ্রিস্টান, না-বৌদ্ধ, না-হিন্দু, না-মুসলমান। একজন মায়ের তার সন্তানের প্রতি ভালোবাসা না-বৌদ্ধ , না-খ্রিস্টান : এটা মায়ের ভালোবাসা। ভালোবাসা, সেবা, সমবেদনা, সহিষ্ণুতা, ধৈর্য, বন্ধুতা, আকাঙ্ক্ষা, ঘৃণা, শুভতা-অশুভতা, অজ্ঞতা, আত্ম-অহঙ্কার প্রভৃতির কোনো সাম্প্রদায়িক তকমার প্রয়োজন নেই; তা কোনো নির্দিষ্ট ধর্মের অধীনে নেই।
সত্য ধারণা কোত্থেকে আসলো তা জানা একজন অনুসন্ধানীর জন্য নিরর্থক। একটি ধারণার উৎস ও উন্নয়ন হচ্ছে প্রাতিষ্ঠানিক ব্যাপার। এমনকি, প্রকৃতপক্ষে, সত্য বোঝার ক্ষেত্রে, শিক্ষাটি বুদ্ধ না অন্যকারো থেকে এলো তা জানা প্রয়োজনীয় নয়। ব্যাপারটি দেখা ও বোঝা প্রয়োজনীয়। মজ্ঝিম নিকায়ে (সুত্র নং ১৪০) একটি গুরুত্বপূর্ণ গল্প আছে যা তা ব্যাখ্যা করে।
বুদ্ধ একদা একরাত্রি এক কুমারের ছাউনীতে কাটিয়েছিলেন। একই ছাউনিতে আরো একজন তরুণ সন্ন্যাসী ছিলেন যিনি পূর্বেই অবস্থান নিয়েছিলেন।১৪ বুদ্ধ যুবক ছেলেটিকে পর্যবেক্ষণ করে ভাবলেন : ‘সন্তুষ্ঠি এই ছেলেটির পাথেয়। তার সম্পর্কে জানাটা ভালো হবে।’ তাই বুদ্ধ তাকে জিজ্ঞেস করলেন: ‘হে ভিক্ষু১৫ আপনি কার নামে গৃহত্যাগ করেছেন? অথবা আপনার আচার্য কে? অথবা আপনি কার মতবাদ ভালোবাসেন?
‘হে বন্ধু’, যুবক লোকটি উত্তর দিলেন, ‘গৌতম নামে, শাক্যবংশজাত, একজন শ্রমণ আছেন, যিনি শাক্য-সংসার ত্যাগ করেছিলেন সন্ন্যাসী হওয়ার বাসনায়। অর্হৎ অথবা পূর্ণ আলোকিত একজন হিশেবে তাঁকে ঘিরে এক উচ্চ সুনাম আছে। আমি ঐ প্রশংসিতজনের নামে সন্ন্যাসী হয়েছি। তিনি আমার গুরু এবং আমি তার শিক্ষা ভালোবাসি।’
‘সেই প্রশংসিত, অর্হৎ, পূর্ণ আলোকপ্রাপ্ত ব্যক্তি বর্তমানে কোথায় বাস করেন?’
‘দেশের উত্তরে শ্রাবস্তী নামক শহর আছে বন্ধু। সেই প্রশংসিত, অর্হৎ, পূর্ণ আলোকপ্রাপ্ত ব্যক্তি বর্তমানে সেখানে বাস করছেন।’
'আপনি কি কখনও সেই প্রশংসিত লোকটিকে দেখেছেন? আপনি কি তাঁকে দেখলে চিনতে পারবেন?
'আমি কখনও সেই প্রশংসিত লোকটিকে দেখিনি। তাঁকে দেখলে চিনতেও পারবো না।'
বুদ্ধ উপলব্ধি করলেন যে, তাঁর নামেই এই অপরিচিত যুবক গৃহত্যাগ করে সন্ন্যাসী হয়েছেন। কিন্তু নিজের পরিচয় গোপন রেখে তিনি বললেন : ‘হে ভিক্ষু, আমি আপনাকে শিক্ষাটি প্রদান করবো। শুনুন, মনোযোগ দিন। আমি বলবো।’
সম্মতিসহকারে যুবক বললেন, ‘অতীব উত্তম, বন্ধু।’
তারপর, বুদ্ধ সত্য সম্পর্কে যুবকটির উদ্দেশে তাৎপর্যপূর্ণ এক বক্তব্য দিলেন (যার মূলকথা পরবর্তীতে দেওয়া হয়েছে) । ১৬
যুবক সন্ন্যাসী পুক্কুসাথি, বক্তব্য সমাপ্ত হওয়ার পরই শুধু, অনুধাবন করতে পারলেন, তার সাথে যিনি কথা বলেছেন, তিনি স্বয়ং বুদ্ধ। তাই তিনি বুদ্ধের সামনে গিয়ে হাঁটু গেড়ে বসে, তাঁকে না-চিনে বন্ধু১৭ সম্বোধন করার জন্য, ক্ষমা প্রার্থনা করলেন। এরপর তিনি বুদ্ধের নিকট প্রবজ্যা-গ্রহণ করার এবং সঙ্ঘভুক্ত হওয়ার প্রার্থনা করলেন।
বুদ্ধ তাকে তার ভিক্ষাপাত্র ও চীবর প্রস্তুত আছে কিনা জিজ্ঞেস করলেন। (একজন ভিক্ষুর অবশ্যই ত্রিচীবর এবং খাদ্য অন্বেষণের জন্য ভিক্ষাপাত্র থাকতে হয়।) যখন পুক্কুসাথি নাবোধক উত্তর জ্ঞাপন করলেন, বুদ্ধ বললেন, যে-ব্যক্তির পাত্র-চীবর প্রস্তুত নেই তথাগত তাকে প্রবজ্যা প্রদান করেন না। ফলে পুক্কুসাথি পাত্র-চীবরের সন্ধানে বাইরে গেলেন, কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত উন্মত্ত ষাড়ের আক্রমণে আহত হয়ে মারা গেলেন। ১৮
পরে, যখন এই দুঃসংবাদ বুদ্ধের কাছে পৌঁছলো , তিনি ঘোষণা করলেন যে পুক্কুসাথি একজন জ্ঞানী মানুষ, যিনি ইতঃপূর্বে সত্য দর্শন ও নির্বাণলাভের শেষ পূর্বস্তরের জ্ঞান অর্জন করে ফেলেছিলেন এবং তিনি এমন এক লোকে উপনীত হয়েছিলেন যেখানে তিনি অর্হৎ১৯ হয়ে যান এবং চিরতরে মুক্তিলাভ করেন, এই পৃথিবীতে তিনি আর কখনো ফিরে আসবেন না।২০
এই গল্প থেকে এটা পরিষ্কার হয় যে পুক্কুসাথি যখন বুদ্ধের কথামালা শুনছিলেন এবং তাঁর শিক্ষা অনুধাবন করছিলেন, তখন তিনি জানতেন না যে তিনি যার সাথে কথা বলছিলেন অথবা যিনি শিক্ষা দিচ্ছিলেন তিনি কে। তিনি সত্য দেখেছিলেন। ওষুধ যদি ভালো হয়, রোগমুক্তি ঘটবে, এটা কে প্রস্তুত করেছেন বা এটা কোত্থেকে এসেছে জানাটা দরকারি নয়।
প্রায় সকল ধর্মই বিশ্বাসের উপর নির্মিত _ বরং ‘অন্ধ’ বিশ্বাসই দেখা যায়। কিন্তু বুদ্ধমতবাদে ‘দেখা’, জানা ও বোঝার প্রতি গুরুত্ব দেয়া হয়েছে, আস্থা বা বিশ্বাসের প্রতি নয়। বৌদ্ধ গ্রন্থসমূহে সদ্ধা ( সংস্কৃতে শ্রদ্ধা) যা সচরাচর আস্থা বা বিশ্বাস অর্থে গৃহীত হয় । কিন্তু সদ্ধা আস্থার মতো নয় বরং তা বিচারের মাধ্যমে উৎপন্ন প্রত্যয় । লোকপ্রিয় বুদ্ধমতবাদে এবং গ্রন্থে সাধারণ ব্যবহারেও সদ্ধা শব্দটির, অবশ্যই স্বীকৃত, এই অর্থে বিশ্বাসের উপাদান আছে যে তা বুদ্ধ, ধর্ম (শিক্ষা), সঙ্ঘ (সংগঠন) –এর প্রতি নিবিষ্টতা বোঝায়।
খ্রিস্টিয় চতুর্থ শতকের মহান বৌদ্ধ দার্শনিক, আসঙ্গের মতে , শ্রদ্ধার তিনটি রূপ আছে: (১) বিষয়বস্তু যা, তা সম্পর্কে যথাযথ পূর্ণ ও দৃঢ় প্রত্যয়, (২) ভালো গুনাবলীসমূহে নির্মল আনন্দ এবং (৩) অভীষ্ট বস্তু লাভের আকাঙ্ক্ষা বা কামনা। ২১
আপনি এটাকে যেভাবেই নেন না কেন , অন্যান্য ধর্মসমূহে অনুধাবন করা বিশ্বাস অথবা আস্থা দিয়ে বুদ্ধমতবাদে অল্পই করার আছে। ২২
কোনো কিছু না-দেখা গেলে বিশ্বাসের প্রশ্ন ওঠে _ শব্দের প্রত্যেক অর্থেই দেখা। যে মুহূর্তে আপনি দেখতে পান, সে মুহূর্তে বিশ্বাস অদৃশ্য হয়ে যায় । যদি আমি আপনাকে বলি যে মুষ্ঠিবদ্ধ হাতের তালুতে রত্ন লুকানো আছে, বিশ্বাসের প্রশ্ন জেগে উঠবে, কারণ আপনি তা সরাসরি দেখতে পান না। কিন্তু আমি যদি আমার হাতের মুঠি খুলি, এবং আপনাকে রত্ন দেখাই, তখন আপনি স্বয়ং দেখবেন এবং বিশ্বাসের প্রশ্ন আর জাগবে না। তাই প্রাচীন বৌদ্ধিক গ্রন্থে একটা প্রবাদে বলে : ‘বুঝতে পারা হচ্ছে কারো হাতের তালুতে রত্ন বা হরতকী দেখা।’
মুসীলা নামক বুদ্ধের এক শিষ্য অন্য এক ভিক্ষুকে বলেন: ‘বন্ধু সাবিত্থা, ভক্তি, বিশ্বাস বা আস্থা২৩ ছাড়া, পছন্দ বা আকাঙ্ক্ষা ছাড়া, শ্রুতি বা প্রথা ছাড়া, আপাত সত্য আমলে না-নিয়ে, আনুমানিক বিষয়ে আনন্দিত না-হয়ে, আমি জানি ও দেখি যে, হয়ে ওঠার বিরতিই নির্বাণ। ’২৪
এবং বুদ্ধ বলেন: ‘হে ভিক্ষু, আমি বলি যে, কলুষ আর অশুদ্ধতা বিনাশ হচ্ছে সে ব্যক্তির জন্য, যে জানে ও দেখে, এবং যে জানে না ও দেখে না তার জন্য নয়।’ ২৫
এটা সবসময়ই জানা ও দেখার প্রশ্ন, বিশ্বাস করার নয়। বুদ্ধের শিক্ষা ‘এহি পাসসিকো ’ হিশেবে উত্তীর্ণ, আপনাকে আমন্ত্রণ জানায় ‘আসো এবং দেখো’, কিন্তু আসতে এবং বিশ্বাস করতে নয়।
কোনো ব্যক্তির সত্য উপলব্ধি বুঝাতে বৌদ্ধ গ্রন্থসমূহের সর্বত্র উল্লিখিত অভিব্যক্তিগুলো হচ্ছে : ‘ সত্যের নির্মল ও নিষ্কলুষ চক্ষু (ধর্মচক্ষু) উৎপন্ন হয়েছে।’ ‘তিনি সত্য দেখেছেন, সত্য লাভ করেছেন, সত্য জেনেছেন, সত্য গভীরভাবে অনুধাবন করেছেন, সন্দেহমুক্ত হয়েছেন, দুদোল্যমানতা ছাড়া।’ ‘এইভাবে সঠিক প্রজ্ঞা দ্বারা তিনি যথাযথভাবে (যথাভূতম) দেখেন। ’২৬ নিজের বোধিলাভের কথা উল্লেখ করে বুদ্ধ বলেছেন : ‘চক্ষু জন্ম নিয়েছিলো, আলো জন্ম নিয়েছিলো।’২৭ জ্ঞান ও প্রজ্ঞা দিয়ে (ঞানা-দসসনা) সব সময় দেখা যায় এবং আস্থার মধ্য দিয়ে বিশ্বাসে নয়।
এটা সেই সময় খুবই মূল্যায়িত হয়েছিলো যখন ব্রাহ্মণ্য গোঁড়া-প্রথা অসহিষ্ণুভাবে বিশ্বাস করতে এবং তাদের প্রথা ও কর্তৃত্ব বিনাপ্রশ্নে গ্রহণ করতে জোর করতো । একদা একদল শিক্ষিত ও সুপরিচিত ব্রাহ্মণ বুদ্ধকে দেখতে গিয়েছিলেন এবং তাঁর সাথে দীর্ঘ আলাপ-আলোচনা করেছিলেন। দলের একজন, ষোল বছর বয়সের যুবক ব্রাহ্মণ, নাম কাপত্থিক, তাদের সকলের বিবেচনায় অসাধারণ মেধাবী, বুদ্ধের প্রতি প্রশ্ন রাখলেন :২৮
“পুজনীয় গৌতম, ব্রাহ্মণদের প্রাচীন পবিত্র গ্রন্থসমূহ অবিকৃতভাবে শ্রুতি-পরম্পরায় আগত। সেগুলোর বিষয়ে ব্রাহ্মণগণ চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন : ‘ পরমব্রহ্মই একমাত্র সত্য, এবং বাকি সব মিথ্যা’। এখন পুজনীয় গৌতম এ-ব্যাপারে কী বলেন?”
বুদ্ধ জানতে চাইলেন : “ব্রাহ্মণদের মধ্যে কি এমন একজন আছেন যিনি দাবি করতে পারেন তিনি অবগত আছেন ও প্রত্যক্ষ করেছেন , ‘পরমব্রহ্মই একমাত্র সত্য, এবং বাকি সব মিথ্যা’?”
যুবক ছিলেন স্পষ্টভাষী, ‘না’ বললেন।
“ তাহলে, সাতপুরুষ পেছন থেকে ব্রাহ্মণদের কোনো একজন আচার্য, আচার্যের আচার্য অথবা ঐ গ্রন্থসমূহের মূল প্রণেতাদের মধ্যে একজনও কি দাবি করতে পারেন তিনি অবগত আছেন ও প্রত্যক্ষ করেছেন , ‘পরমব্রহ্মইএকমাত্র সত্য, এবং বাকি সব মিথ্যা’?”
‘না’
“তাহলে, এটা একটা অন্ধ লোকদের সারির মতো, প্রত্যেকেই পূর্ববর্তীজনকে ধরে আছেন; প্রথম জন দেখেন না, মাঝের জনও দেখেন না, শেষের জনও দেখেন না । এই কারণে ব্রাহ্মণদের দশা আমার কাছে একদল অন্ধ লোকের সারির মতো মনে হচ্ছে।’
তারপর বুদ্ধ ব্রাহ্মণদের প্রতি চরম-গুরুত্বের উপদেশ প্রদান করেন: “ যিনি সত্য প্রতিপালন (সত্যরক্ষা) করেন সেই জ্ঞানীর জন্য ‘পরমব্রহ্মই একমাত্র সত্য, এবং বাকি সব মিথ্যা’ _ এমন সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া উচিত নয়। ”
ব্রাহ্মণ যুবকের প্রশ্নকৃত সত্য-প্রতিপালন ও সত্যরক্ষার ধারণা ব্যাখ্যায় বুদ্ধ বলেন, “ একজন মানুষের আস্থা আছে। যদি তিনি বলেন ‘এই আমার আস্থা’, ততদূর তিনি সত্য প্রতিপালন করেন । কিন্তু তাদ্বারা তিনি ‘পরমব্রহ্মই একমাত্র সত্য, এবং বাকি সব মিথ্যা’ _ এমন সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারেন না। অন্য অর্থে, একজন মানুষ যা পছন্দ করেন তা বিশ্বাস করতে পারেন, এবং তিনি বলতে পারেন, ‘আমি এটা বিশ্বাস করি’, যদ্দূর তিনি সত্যকে সম্মান করেন। কিন্তু বিশ্বাস ও আস্থার কারণে তিনি বলতে পারেন না যে, তিনি যা বিশ্বাস করেন তা-ই একমাত্র সত্য, এবং বাকি সব মিথ্যা।
বুদ্ধ বলেন : ‘কোনো ব্যাপারে অত্যাসক্ত হওয়া (নির্দিষ্ট মতে) এবং অন্য যেকোনো ব্যাপার (মতামত) নিম্নতর হিশেবে নিন্দা করা_জ্ঞানীগণ পায়ে বেরী পরা বলে অভিহিত করেন।’২৯
একদিন বুদ্ধ কার্য-কারণ নীতি তাঁর শিষ্যদের ব্যাখ্যা করলেন৩০, এবং তারা বললেন যে তারা তা পরিষ্কারভাবে দেখেছেন ও বুঝেছেন। তারপর বুদ্ধ তাদের বললেন :
“হে ভিক্ষুগণ, এমনকী এই দৃষ্টিভঙ্গী, যা খুব নিখাদ ও স্বচ্ছ, যদি আপনারা তা আঁকড়ে ধরে থাকেন, যদি আপনারা তাতে অনুরাগ দেখান, যদি আপনারা এটাকে ‘সাত রাজার ধন’ করে ফেলেন, যদি এতে অনুরক্ত হয়ে যান, তাহলে আপনারা বুঝতে পারেন নি যে, এই শিক্ষা ভেলার ন্যায়, যা পারাপারের জন্য, আঁকড়ে ধরে রাখার জন্য নয়।”৩১
অন্যত্র বুদ্ধ এই বিখ্যাত উপমা ব্যাখ্যা করেছেন, যাতে তাঁর শিক্ষাকে পারাপারের ভেলার সাথে তুলনা করেছেন, এবং কারোর কাঁধে করে বহন করে নিয়ে যাবার জন্য নয় :
“হে ভিক্ষুগণ, একজন মানুষ ভ্রমণে আছেন। তিনি বিপুল জলরাশির কাছে এলেন। এই দিকের তীর বিপদসঙ্কুল, কিন্তু অন্যটি নিরাপদ ও বিপদমুক্ত। কোনো নৌকাই নিরাপদ ও বিপদমুক্ত অন্য পারের দিকে যায় না, এমনকী পারাপারের কোনো সেতুও নেই। তিনি মনে মনে বললেন: ‘এই জলসমুদ্র বিশাল এবং এই দিকের তীর বিপদসঙ্কুল, কিন্তু অন্যটি নিরাপদ ও বিপদমুক্ত। কোনো নৌকাই অন্য পারের দিকে যায় না, এমনকী পারাপারের কোনো সেতুও নেই। অতএব, ঘাস, কাঠ, ডালপালা ও পাতা দিয়ে একটি ভেলা তৈরি করাই উত্তম হবে, এবং আমার হাত-পা চালিয়ে ভেলার সাহায্যে অন্য পারে নিরাপদে নিজেকে নিয়ে যাবো।’ তারপর হে ভিক্ষুগণ, ঐ লোকটি ঘাস, কাঠ, ডালপালা ও পাতা সংগ্রহ করলেন ভেলা বানানোর জন্য, হাত-পা চালিয়ে ভেলার সাহায্যে অন্য পারে নিরাপদে নিজেকে নিয়ে গেলেন। নিরাপদে পার হয়ে এবং পারে এসে তিনি ভাবলেন: ‘এই ভেলাটি আমার জন্য খুব উপকারী ছিলো, এর সহায়তায় আমি আমার হাত-পা চালিয়ে নিরাপদে এপারে এসেছি। যদি আমি এটাকে আমার মাথায় বা কাঁধে করে, যেখানেই যাই না কেন সেখানে, নিয়ে যাই ভালো হবে’।
_ আপনারা কী ভাবছেন, হে ভিক্ষুগণ, যদি তিনি এমনটি করে থাকেন, তার দ্বারা কি ভেলার প্রতি যথাযথ সম্মান প্রদর্শন হলো?
_না ভন্তে ।
_তবে কোন পন্থায় তিনি ভেলার প্রতি যথাযথ সম্মান জানাতে পারতেন?
_নিরাপদে পার হয়ে লোকটির এইরকম ভাবা উচিত: ‘এই ভেলাটি আমার জন্য খুব উপকারী ছিলো, এর সহায়তায় আমি আমার হাত-পা চালিয়ে নিরাপদে এপারে এসেছি। যদি আমি এটাকে তীরের উপর রেখে দিই অথবা নোঙর করে ভাসিয়ে দিই এবং ,যেকোনো জায়গায় হোক, আমার পথে চলে যাই ভালো হবে’।
_হে ভিক্ষুগণ, ঠিক একইভাবে, আমি যে মতবাদ শিক্ষা দিয়েছি তা ভেলাসদৃশ_তা পারাপারের জন্য, বহনের জন্য নয় (আঁকড়ে ধরে রাখার জন্য নয়)। হে ভিক্ষুগণ, আপনারা যারা বুঝেন যে শিক্ষাটি ভেলার ন্যায়, এমনকি ভালো জিনিস (ধর্ম) পরিত্যাগ করা উচিত; তাহলে আরো বেশি খারাপ জিনিস (অধর্ম) আপনাদের পরিত্যাগ করা উচিত।" ৩২
এই রূপক থেকে স্পষ্ট হওয়া যায় যে, বুদ্ধশিক্ষার মানে হচ্ছে মানুষকে নিরাপদে, শান্তিতে, সুখে, অপ্রমত্ততায়, নির্বাণলাভে নিয়ে যাওয়া। বুদ্ধের শিক্ষা দেয়া সম্পূর্ণ মতবাদ এই প্রান্তের দিকে পরিচালিত করে। তিনি কেবল বুদ্ধিবৃত্তিক কৌতূহল মেটানোর কথা বলে যান নি। তিনি ছলেন কর্মবাদী শিক্ষক, এবং সেই সমস্ত ব্যাপারই শিক্ষা দিয়েছিলেন যেগুলো মানুষের সুখ ও শান্তি নিয়ে আসে।
বুদ্ধ একদা কোসাম্বির (এলাহাবাদের কাছে) সিমসাপা অরণ্যে অবস্থান করছিলেন। তাঁর হাতে কিছু পাতা নিয়ে শিষ্যদের জিজ্ঞেস করলেন: ‘হে ভিক্ষুগণ, কোনগুলো বেশি? আমার হাতের এই পাতগুলো নাকি অরণ্যের পাতাগুলো?’
‘ভন্তে, তথাগতের হাতের পাতাগুলো যৎসামান্য, কিন্তু, প্রকৃতপক্ষে, সিমসাপা অরণ্যের পাতাগুলো অনেক অনেক বেশি। ’
‘ঠিক এরকমই, ভিক্ষুগণ, আমি যতটুকু জানি, তার অল্পই বলেছি, আর যা বলি নি তার পরিমাণই বিপুল। এবং কেন আমি ওগুলো বলি নি ? কারণ তা প্রয়োজনীয় নয়... নির্বাণের দিকে পরিচালনা করে না। এই কারণে আমি তোমাদেরকে বলি নি।৩৩
যা জেনেও বুদ্ধ আমাদের বলেন নি সে-সম্পর্কে অনুমান করা নিষ্ফল, যেরকম কিছু পণ্ডিত বৃথা-চেষ্টা করেন। বুদ্ধ অপ্রয়োজনীয় অধিবিদ্যামূলক প্রশ্নের জবাব দিতে আগ্রহী ছিলেন না_যেগুলো সম্পূর্ণ অনুমান-নির্ভর এবং কাল্পনিক সমস্যা তৈরি করে। তিনি সেগুলোকে ‘মতামতের নিষ্প্রাণ বিস্তার’ হিশেবে বিবেচনা করেছিলেন। তাঁর কিছু শিষ্য এই সমস্ত আচরণ মন থেকে মেনে নিতে পারেন নি বলে মনে হয়। তাদের মধ্যে মালুঙ্ক্যপুত্র নামক একজনের উদাহরণ আছে, যিনি বুদ্ধ-সমীপে দশটি সু-পরিচিত ধ্রুপদী অধিবিদ্যামূলক প্রশ্ন রাখেন এবং উত্তরপ্রার্থী হন। ৩৪
একদিন মালুঙ্ক্যপুত্র তার দুপুরের ধ্যান থেকে উঠে বুদ্ধের কাছে গিয়ে, অভিবাদন জানিয়ে, একপাশে বসে তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন:
“ভন্তে, যখন আমি একাকি ধ্যান করছিলাম, আমার এই ভাবনাগুলোর উদয় হয়: এই সমস্ত সমস্যাগুলো অব্যাখ্যাকৃত, একপাশে রাখা এবং তথাগতের দ্বারা পরিত্যাজ্য। যেমন, (১) বিশ্ব কি শাশ্বত অথবা (২) শাশ্বত নয় কি, (৩) এই বিশ্ব-ব্রহ্মাণ্ড কি সসীম অথবা (৪) অসীম, (৫) আত্মা ও শরীর কি অভিন্ন অথবা (৬) আত্মা ও শরীর কি ভিন্ন, (৭) তথাগত কি মৃত্যুর পরে থাকেন অথবা (৮) তিনি কি মৃত্যুর পর থাকেন না, (৯) মৃত্যুর পর তিনি কি উভয় (একই সময়ে) থাকেন ও থাকেন না অথবা (১০ ) মৃত্যুর পর তিনি কি উভয় (একই সময়ে) না থাকেন ও না থাকেনও না? এই সমস্যাগুলো তথাগত আমাকে ব্যাখ্যা করেন না। এটা ( আচরন) আমাকে সন্তুষ্ট করে না, আমি এর মর্ম বুঝি না। আমি তথাগতের কাছে যাবো এবং তাঁকে এই ব্যাপারে প্রশ্ন করবো। যদি ঐগুলো তিনি আমাকে ব্যাখ্যা করেন, তাহলে আমি তাঁর অধীনে পবিত্র জীবন যাপন করবো । যদি তিনি ঐগুলো ব্যাখ্যা না-করেন তবে আমি সঙ্ঘ পরিত্যাগ করে চলে যাবো। যদি তথাগত জেনে থাকেন যে বিশ্ব-ব্রহ্মাণ্ড শাশ্বত, তিনি আমাকে তাই ব্যাখ্যা করুন। যদি তথাগত না-জেনে থাকেন বিশ্ব-ব্রহ্মাণ্ড শাশ্বত কি শাশ্বত নয়, ইত্যাদি, তাহলে যে ব্যাক্তি জানেন না, সোজাসুজিই বলা ভালো ‘আমি জানি না, আমি বুঝি না’। ”
বুদ্ধ প্রত্যুত্তরে বলেন মালুঙ্ক্যপুত্রের লক্ষ-মিলিয়ন লোকের ভালো করা উচিত যারা তাদের মূল্যবান সময় নষ্ট করছেন এই ধরণের অধিবিদ্যামূলক প্রশ্ন করে এবং অপ্রয়োজনে তাদের মনের শান্তি নষ্ট করছেন:
“মালুঙ্ক্যপুত্র, আমি কি কখনো বলেছি, ‘আসেন এবং আমার অধীনে পবিত্র জীবন যাপন করেন, আমি আপনাকে এই সমস্ত প্রশ্নের উত্তর দেবো’? ”
‘না, ভন্তে’
“তাহলে, মালুঙ্ক্যপুত্র, এমনকি আপনি কি আমাকে বলেছেন ‘ভন্তে, আমি আমি তথাগতের অধীনে পবিত্র জীবন যাপন করবো, এবং তথাগত আমাকে এই সমস্ত প্রশ্নের ব্যাখ্যা দেবেন’ ?”
‘না, ভন্তে’
“ এমনকি এখনো, মালুঙ্ক্যপুত্র, আমি আপনাকে বলবো না: ‘ আসেন এবং আমার অধীনে পবিত্র জীবন যাপন করেন, আমি আপনাকে এই সমস্ত প্রশ্নের উত্তর দেবো’ এবং আপনি আমাকে বলবেন না : ‘ভন্তে, আমি তথাগতের অধীনে পবিত্র জীবন যাপন করবো, এবং তথাগত আমাকে এই সমস্ত প্রশ্নের ব্যাখ্যা দেবেন’। এই পারিপার্শ্বিকতায় কে কাকে অস্বীকার করে?৩৫”
“মালুঙ্ক্যপুত্র যদি কেউ বলেন: ‘আমি তথাগতের অধীনে পবিত্র জীবন যাপন করবো না, যতক্ষণ পর্যন্ত তিনি এই সমস্ত প্রশ্নের উত্তর না-দিচ্ছেন। তিনি মারা গেলেও তথাগত এই সমস্ত বিষয়ে নিরুত্তর থাকবেন। মালঙ্ক্যপুত্র, ধরেন, একজন মানুষ বিষাক্ত তীরে আহত, এবং তার বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়স্বজন তাঁকে শল্যবিদের নিকট নিয়ে গেলেন। ধরেন, লোকটি বললেন: ‘আমি এই তীরটি তুলতে দেবো না, যতক্ষণ না আমি জানছি কে আমাকে তীর ছুঁড়েছে ; সে কি ক্ষত্রিয় (যোদ্ধা শ্রেণি), না ব্রাহ্মণ (পুরোহিত শ্রেণি), না বৈশ্য (বণিক ও কৃষিজীবি শ্রেণি), না শুদ্র (নিম্নবর্ণ); তার নাম ও পরিবার কী হতে পারে; সেকি লম্বা, না খাটো, না মাঝারি গড়নের; তার গায়ের চামড়া কি কালো, বাদামী না সোনালি; সে কোন গ্রাম বা শহর থাকে। আমি এই তীর উপড়াতে দেবো না যতক্ষণ পর্যন্ত আমি জানতে পারছি না কী-ধরণের তীর দ্বারা আমি বিদ্ধ হয়েছি; কী-ধরণের দড়ি তীরে ব্যাবহৃত হয়েছে; কী-ধরণের পালক তীরে ব্যাবহৃত হয়েছে এবং কি-ধরণের ধাতু দিয়ে তীরের অগ্রভাগ নির্মিত হয়েছে। ’ মালুঙ্ক্যপুত্র, ঐ লোকটি এসবের কোনোটাই না-জেনে মারা যাবে। তাই মালুঙ্ক্যপুত্র, যদি কেউ বলেন : ‘আমি তথাগতের অধীনে পবিত্র জীবন পরিচালনা করবো না, যতদিন তিনি বিশ্ব শাশ্বত কি শাশ্বত না প্রভৃতি প্রশ্নের উত্তর না-দিচ্ছেন।’ তিনি মারা যেতে পারেন তথাগত এর উত্তর দেবেন না।”
তারপর বুদ্ধ মালুঙ্ক্যপুত্রকে ব্যাখ্যা করলেন যে, পবিত্র জীবন এই সমস্ত দৃষ্টিভঙ্গীর উপর নির্ভর করে না। এই সমস্ত সমস্যার বিষয়ে যেকোনো মতামত থাকুক, জন্ম, জরা, বার্ধক্য, মৃত্যু, দুঃখ, শোক, ব্যথা, পীড়া, আত্মযন্ত্রণা, ‘যেগুলোর নিবৃত্তির (নির্বাণ) ঘোষণা আমি এই অন্তিম জীবনে দিই’।
‘অতএব, মালঙ্ক্যপুত্র, আমি যা ব্যাখ্যার তা ব্যাখ্যা করেছি, যা ব্যাখ্যার নয় তা ব্যাখ্যা করি নি। কোন জিনিসগুলো আমি ব্যাখ্যা করি নি? এই ব্রহ্মাণ্ড শাশ্বত কিনা (ঐ দশ মতামত) আমি ব্যাখ্যা করি নি। মালঙ্ক্যপুত্র কেন আমি তা ব্যাখ্যা করি নি? ঐগুলো উপকারী নয়, ঐগুলো মৌলিকভাবে পারমার্থিক পবিত্র জীবনের সাথে সম্পৃক্ত নয়, বৈরাগ্যের, ক্ষান্তির, নিরাসক্তির ,অপ্রমত্ততার, গভীর বোধের, পূর্ণ উপলব্ধির নির্বাণের সহায়ক নয়। এই কারণে আমি আপনাকে সেগুলো সম্পর্কে বলি নি।
‘তাহলে, মালুঙ্ক্যপুত্র, আমি কী ব্যাখ্যা করেছি? আমি দুঃখ, দুঃখের কারণ, দুঃখের নিরোধ, দুঃখ-নিরোধের উপায়৩৬ ব্যাখ্যা করেছি। মালুঙ্ক্যপুত্র, কেন আমি তা ব্যাখ্যা করেছি? কারণ তা উপকারী, পারমার্থিক পবিত্র জীবনের সাথে মৌলিকভাবে সম্পৃক্ত; বৈরাগ্য, ক্ষান্তি, নিরাসক্তি ,অপ্রমত্ততা, গভীর বোধ, পূর্ণ উপলব্ধি, নির্বাণের সহায়ক। তাই আমি সেগুলো ব্যাখ্যা করেছি। ’৩৭
..............................................................................................................................................................................................................
তথ্যসূত্র:
১ ধর্মপদ XXII4.
২ দীর্ঘ নিকায় II(কলম্বো,১৯২৯), পৃ ৬২ (মহাপরিনির্বাণ সূত্র) ।
৩ তথাগত মানে ‘যিনি সত্যে উপনীত হয়েছেন’ ‘যিনি সত্য উদ্ঘাটন করেছেন’ । এই অভিধাটি বুদ্ধ নিজেকে এবং সাধারণভাবে বুদ্ধগণকে বুঝাতে ব্যবহার করতেন।
৪ ধর্মপদ XX4 .
৫ সঙ্ঘ মানে ‘সম্প্রদায়’। কিন্তু বুদ্ধমতবাদে এই শব্দ দিয়ে ‘বৌদ্ধ সন্ন্যাসীদের সম্প্রদায়’ বুঝায় যা সন্ন্যাসীদের সংগঠন । বুদ্ধ , ধর্ম (শিক্ষা) ও সঙ্ঘ (সংগঠন) হচ্ছে তিশরণ ‘তিনটি আশ্রয়’ অথবা তিরতন (সংস্কৃতে ত্রিরত্ন)।
৬ দীর্ঘ নিকায় II (কলম্বো, ১৯২৯), পৃ. ৬২
৭ অঙ্গুত্তরনিকায় (কলম্বো ১৯২৯), পৃ. ১১৫
৮ বিমাংসাক সুত্ত, ন. ৪৭ মজ্ঝিম-নিকায়।
৯ পঞ্চ অন্তরায়গুলো হচ্ছে : (১) ইন্দ্রিয়জাত কামনা-বাসনা (২) অশুভ ইচ্ছা (৩)শারীরিক ও মানাসিক অবসাদ এবং আলস্য (৪) অস্থিরতা ও দুশ্চিন্তা (৫) সন্দেহ।
১০ দীর্ঘ নিকায় (কলম্বো,১৯২৯), পৃ. ৯৫; অঙ্গুত্তর নিকায় (কলম্বো,১৯২৯), পৃ. ২৩৯
১১ মহাবীর, জৈনধর্মের প্রবর্তক, বুদ্ধের সমসাময়িক এবং সম্ভবত বুদ্ধের চেয়ে কয়েক বছরের বড় ছিলেন।
১২ উপালি সুত্ত, ন. ৫৬, মজ্ঝিম-নিকায়।
১৩ শিলালিপি ১২ ।
১৪ ভারতে কুমারের ছাউনীগুলো প্রশস্ত ও শান্ত। শ্রমণ-সন্ন্যাসী এবং স্বয়ং বুদ্ধেরও ভ্রমণের সময় রাত্রি ছাউনীতে কাটানোর উল্লেখ পালিগ্রন্থসমূহে রয়েছে।
১৫ এখানে এটা উল্লেখ করা চমকপ্রদ ব্যাপার যে, বুদ্ধ এই একান্তবাসীকে ভিক্ষু বলে সম্বোধন করেন যা বৌদ্ধ সন্ন্যাসীদের বেলায় ব্যবহৃত হয়। পরিনামে দেখা যাবে যে তিনি ভিক্ষু ছিলেন না, সঙ্ঘসদস্য ছিলেন না, তাই তিনি বুদ্ধকে অনুরোধ করেন তাঁকে সঙ্ঘভুক্ত করার জন্য। সম্ভবত বুদ্ধযুগে ভিক্ষু অভিধা অন্যান্য সন্ন্যাসীদের বেলায়ও সমভাবে ব্যবহৃত হতো। অথবা এমন সম্বোধন প্রয়োগে বুদ্ধ কঠোরতা অবলম্বন করেন নি। ভিক্ষু মানে ‘ভিক্ষারত’ ,‘যে খাদ্য ভিক্ষা করে’ এবং সম্ভবত আক্ষরিক অর্থে ও মূল চিন্তায় এটা এখানে ব্যবহৃত হতো। থেরবাদী রাষ্ট্র শ্রীলঙ্কা, মায়ানমার,থাইল্যান্ড, কম্বোডিয়া, বাংলাদেশের চট্টগ্রামে ভিক্ষু অভিধা শুধু বৌদ্ধ সন্ন্যাসীদের বেলায় ব্যবহৃত হয়।
১৬ তৃতীয় আর্যসত্যের অধ্যায়ে বর্ণিত।
১৭ আবুসো শব্দটির ব্যবহার বন্ধু অর্থ প্রকাশ করে । সমকক্ষদের মধ্যে এটা একটি সম্মানজনক শব্দ । কিন্তু বুদ্ধকে সম্বোধন করার বেলায় কখনোই শিষ্যরা এই শব্দটি ব্যবহার করেন নি। তার বদলে তারা ভন্তে শব্দটি ব্যবহার করতেন, যার মানে মহোদয় বা প্রভুর কাছাকাছি। বুদ্ধের সময়ে, ভিক্ষুসঙ্ঘের সদস্যরা একজন আরেকজনকে আবুসো ‘বন্ধু’ বলে সম্বোধন করতেন। কিন্তু বুদ্ধ তার মৃত্যুর পূর্বে কনিষ্ট ভিক্ষুদেরকে জ্যেষ্ঠ ভিক্ষুদের প্রতি ভান্তে ‘মহোদয়’ অথবা আয়ুষ্মান ‘পূজনীয়’ হিশেবে সম্বোধন করার জন্য নির্দেশনা দেন । কিন্তু জ্যেষ্ঠদের কনিষ্ঠ সদস্যদের প্রতি নাম ধরে অথবা আবুসো ‘বন্ধু’ বলে সম্বোধন করা উচিত। (দীর্ঘ নিকায় II কলম্বো, ১৯২৯, পৃ. ৯৫) । এই রীতি আজকের দিন পর্যন্ত সঙ্ঘে চলমান রয়েছে।
১৮ ভারতবর্ষের রাস্তাঘাটে গরুর বিচরণ সুবিদিত। এই সূত্র থেকে মনে হচ্ছে প্রথাটি অনেক পুরনো। কিন্তু সাধারণত গরুগুলো বাধ্য, এবং হিংস্র বা বিপজ্জনক নয়।
১৯ অর্হৎ একজন ব্যাক্তি যিনি নিজেকে কামনা, হিংসা, ঘৃণা, অশুভ ইচ্ছা, অজ্ঞতা, অহঙ্কার, আত্মভিমান ইত্যাদির ন্যায় সকল কলুষতা ও অশুদ্ধতা থেকে মুক্ত করেছেন। তিনি নির্বাণ উপলব্ধির চতুর্থ বা সর্বোচ্চ ও চূড়ান্ত পর্যায়ে উপনীত হয়েছেন, এবং প্রজ্ঞা, করুণার মতো বিশুদ্ধ ও উন্নত গুণাবলিতে পরিপূর্ণ। পুক্কুসাথি মুহূর্তে শুধু তৃতীয় স্তর লাভ করেছিলেন যেটাকে পারিভাষিকভাবে অনাগামী বা ‘চিরতরে না-ফেরা’ ডাকা হয়। দ্বিতীয় স্তরকে সুকৃতাগামী ‘একবার-ফেরা’ ডাকা হয় এবং প্রথম স্তরকে স্রোতাপন্ন ‘ স্রোতে পতিত’ ডাকা হয়।
২০ কার্ল জেল্লিরাপের দ্য পিলগ্রিম কমনিটা মনে হয় পুক্কুসাথির এই গল্প দ্বারা অনুপ্রাণিত।
২১অভিসমুচ্চয়, পৃ. ৬ ।
২২ ইডিথ লুডউইক-জ্ঞ্যমরই দ্বারা রচিত দ্য রোল অব দ্য মিরাকেল ইন আর্লি পালি লিটারেচার –এ বিষয়টি আছে। দুর্ভাগ্যবশত এই পি.এইচ. ডি. থিসিসটি এখনো পর্যন্ত প্রকাশিত হয় নি। একই বিষয়ে একই লেখকের প্রবন্ধ দেখুন সিলন ইউনিভার্সিটি রিভিউয়ে, ভলিয়ম-১, ন. ১ (এপ্রিল, ১৯৪৩), পৃ.৭৪ ।
২৩ এখানে সদ্ধা শব্দটি সাধারণ জনপ্রিয় ধারণায় ‘ভক্তি, আস্থা,বিশ্বাস’ অর্থে ব্যবহৃত।
২৪সংযুক্ত-নিকায় II পৃ.১১৭ ।
২৫ প্রাগুক্ত III, পৃ. ১৫২।
২৬ সংযুক্ত-নিকায় v (PTS), পৃ. ৪২৩; III পৃ.১০৩; মজ্ঝিম-নিকায় III (PTS), পৃ. ১৯
২৭ সুমঙ্গলবিলাসিনী (PTS), পৃ. ৪২২।
২৮চঙ্কি-সুত্ত, ৯৫ ন., মজ্ঝিম-নিকায়।
২৯সুত্ত-নিপাত (PTS), পৃ.১৫১(ভ.৭৯৮)।
৩০ মহাতানহাসংখয়া-সুত্ত, ন.৩৮, মজ্ঝিম-নিকায়।
৩১ মজ্ঝিম-নিকায় I (PTS), পৃ. ২৬০ ।
৩২ মজ্ঝিম-নিকায় I (PTS), পৃ. ১৩৪-১৩৫, এখানে ধর্ম, টিকা অনুযায়ী, মানে উচ্চ পারমার্থিক প্রাপ্তি এবং শুদ্ধ দৃষ্টিভঙ্গি ও ধারণা। এমনকী এগুলোতে অনুরক্ত হওয়া, সেগুলো উচু ও পবিত্র হতে পারে, পরিত্যাগ করা উচিত; তাহলে অশুভ ও খারাপ জিনিসের বিবেচনায় এগুলো কতো বেশি হতে পারে। মজ্ঝিম-নিকায় অটঠকথা, পপঞ্চসুদনি II(PTS), পৃ. ১০৯ ।
৩৩সংযুক্ত-নিকায় V (PTS) পৃ. ৪৩৭।
৩৪চূল-মালঙ্ক্য সুত্ত, ন. ৬৩, মজ্ঝিম-নিকায়।
৩৫ উভয়েই মুক্ত এবং কেউই অন্যের অধীনে বাধ্য নয়।
৩৬ এই চার শ্রেষ্ঠসত্য পরবর্তী চার অধ্যায়ে ব্যাখ্যা করা হয়েছে।
৩৭ বুদ্ধের এই উপদেশ মালুঙ্ক্যপুত্রের উপর আকাঙ্ক্ষিত প্রভাব ফেলেছিলো, কারণ অন্যত্র উল্লেখ আছে যে তিনি বুদ্ধের নিকট নির্দেশনার জন্য পুনরায় গিয়েছিলেন, যা অনুসরণ করে তিনি অরহত হয়েছিলেন। অঙ্গুত্তর-নিকায় (কলম্বো,১৯২৯), পৃ. ৩৪৫-৩৪৬; সংযুক্ত-নিকায় IV (PTS), পৃ. ৭২ ।
২| ২৪ শে মে, ২০১৫ দুপুর ১২:৪৪
আলী আকবার লিটন বলেছেন: জীব হত্যা মহাপাপ ! জীব হত্যা মহাপাপ !
এ গুলার কি ব্যাখ্যা দিবেন ?
এ গুলার কি ব্যাখ্যা দিবেন ?
৩| ২৪ শে মে, ২০১৫ দুপুর ১:২৮
আলোরিকা বলেছেন: আজো পড়া যায় এমন পাথরে খোদাইকৃত তাঁর অধ্যাদেশগুলোর একটিতে সম্রাট ঘোষণা করেছিলেন: “শুধু নিজের ধর্মকে সম্মান করা ও অন্যধর্মের নিন্দা করা কারো ঠিক নয় , বরং যেকোন ব্যাপারে অন্যধর্মকে সম্মান প্রদর্শন উচিত। এইভাবে একজন নিজের ধর্মের প্রসারে সহায়তা করে এবং বিনিময়ে অন্যদের ধর্মগুলোকেও সেবা করে। অন্যথা ঘটলে, নিজের ধর্মের কবর খুঁড়ে এবং অন্যের ধর্মেরও ক্ষতি করে। যেকোন লোক তার নিজের ধর্মকে সম্মান এবং অন্যের ধর্মকে নিন্দা করে প্রকৃতপক্ষে নিজের ধর্মের প্রতি অনুগত হয়ে, ‘ আমি আমার ধর্মকে উজ্জ্বল করবো’ এমন চিন্তায়। কিন্তু, ফলশ্রুতিত্ তেমন করতে গিয়ে, সে তার নিজের ধর্মকে বহুলাংশে আহত করে। তাই মতৈক্য শুভ: সবাইকে শুনতে দিন, এবং অন্যের অনুসৃত মতবাদ শুনতে ইচ্ছুক হোন। ” ১৩ ............ ++++
৪| ২৪ শে মে, ২০১৫ দুপুর ২:৫৯
টি এম মাজাহর বলেছেন: প্রথমত- যারা খুব আক্রমণাত্বক কমেন্টগুলো করেছেন ওনাদের অনৃুরোধ করছি এমনটা না করতে। কারণ ঐসব দেশে বৌদ্ধ ধর্মাবলাম্বী ক্ষমতাসীনদের এরকম নৃশংস কাজের দায় আমাদের এই ভাইদের উপর চাপানো উচিৎ না। এমনকি এভাবে লিখে ওনাদের পরোক্ষভাবে মানসিক চাপ দেয়টাও ঠিক না। ওনারা তো এর জন্য দায়ী নন।
দ্বিতীয়ত- একটু নিজের অভিজ্ঞতা- ছোটবেলায় এই বৌদ্ধ ধর্মের শান্তিভাব এবং জীবহত্যা মহাপাপ সংক্রান্ত এতো এতো প্রশংসা শুনেছিলাম যে, আমার নিজের মনে ওনাদের সম্বন্ধে একটা অদ্ভুত শ্রদ্ধার ভাব তৈরী হয়ে গিয়েছিলো। মনে আছে একবার একজন বড় মানুষকে বোকার মতো ফস করে বলে বসেছিলাম- আচ্ছা বৌদ্ধরা কি সবাই বেহেশতে যাবে ? (নিতান্ত শিশু মনের চিন্তা থেকেই বলেছিলাম) সেই মুরুব্বীটি আজও আমাকে এ কথাটি মনে করিয়ে দিয়ে খুব হাসাহাসি করেন। ইতিহাস পড়বার বয়স থেকে আবিস্কার করি, এই ধর্মটা আর বাকী ধর্মগুলোর মতোই একটি ধর্ম যেখানে খুব ভালো কথা বলা আছে, কিন্তু অনুসারীরা যে সবাই ভালো কাজ করেন, তা নয়, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপানী নৃশংসতা, চীনের নৃশংসতা(এখনও পর্যন্ত এ দেশটিতে বার্ষিক ফাসি দেবার হার সর্বোচ্চ) দেখে বুঝলাম অনুসারীরা যদি নৃশংসতা করে, তাহলে ধর্মের কি করার আছে? তার ওপর সাম্প্রতিক কালে মায়ানমারে যে নিষ্ঠুর কার্যক্রম চলছে, তা কিন্তু আবার ধর্মের নামে!
বিকাল ৫ টায় বিটিভির সেই গেরুয়া পোষাক পড়া শ্রদ্ধেয় ধর্মগুরুর কথা কানে বাজে আবারও- "পৃথিবীর সকল প্রাণী সুখী হোক, মঙ্গল লাভ করুক"
৫| ২৪ শে মে, ২০১৫ সন্ধ্যা ৭:১২
মুরশীদ বলেছেন: "আমার ঔপদিস্ট ধর্মকে নৌকার মত মনে করিবে। ইহা নদী পার হওয়ার কাযে লাগাইবে। পরপারে পৌছিয়া ঘাড়ে করিয়া লইবার জন্য নহে।" ছোটো বেলায় কোথায় যেন পড়েছিলাম। এখনো মনে আছে। বিস্তারিত আপনার লেখায় ভাল করে জানলাম। খুব ভাল একটি পোস্ট পড়া হলো। লেখককে অনেক অনেক ধন্যবাদ। শুভ কামনা রইল।
৬| ২৪ শে মে, ২০১৫ রাত ৮:৪৪
আহমেদ জী এস বলেছেন: জয়দেব কর ,
বিশাল লেখা । হঠকারী মন্তব্যগুলো বাদে আন্যগুলো থেকেও শেখার আছে কিছু । অথচ সময়ের অভাবে মনযোগ দিয়ে সবটা পড়া হবেনা বলে কিছু জানার আশায় প্রিয়তে নিয়ে রাখছি ।
শুভেচ্ছান্তে ।
৭| ২৫ শে মে, ২০১৫ বিকাল ৩:৩৪
তৌফিক মাসুদ বলেছেন: আসলে কোন ধর্মই অনুসারী দের হত্যা, বা যুদ্ধে যাবার কথা বলেনা, যদি তাকে বাধ্য হতে না হয়। আমাদের দেশের ধর্মান্ধ জেএমবি, পাশের দেশের কট্টর হিন্দু দাংগাবাজ, মিয়ানমারের রোহিঙ্গা হত্যায় বৈদ্ধ সন্যাসী, ইহুদীবাদ ইসরাইল, কিংবা একসময়ের রোমান ক্যাথলিক চার্চের প্রিয়ভাজন যুদ্ধবাজ প্রেসিডেন্ট বুশ এদের সবাই নিজেদেরকে আসল ধর্মভীরু মনে করে। কিন্তু বাস্তবতা হল, তারা কি হত্যাজজ্ঞ চালিয়ে শান্তি দিয়েছে? মানুষ তাদেরকে কতটা ভালবাসে? ধর্ম তো শান্তির জন্য, তারা কোন শান্তি এনেছে আমাদের জন্য?
লেখক নিজে পজেটিভ তাই তাকে আক্রমণাত্মক মন্তব্য দিয়ে বিরক্ত করাটা বোকামি।
৮| ২৭ শে মে, ২০১৫ বিকাল ৪:৩৮
তুষার কাব্য বলেছেন: পোস্ট টা বেশ বড় হয়ে গেছে । পুরোটা পড়তে পারলাম না । উপরের কিছু কমেন্ট দেখলাম যার জন্য হয়তো লেখক প্রতি উত্তর দিচ্ছেন না।
©somewhere in net ltd.
১| ২৪ শে মে, ২০১৫ দুপুর ১২:০৬
আটলান্টিকের প্রবাল বলেছেন: বার্মায় বৌদ্ধরা মুসলিমদের ওপর গণহত্যা চালাচ্ছে কেন?