নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
গাধার রূপান্তর হলো এবার
(২১)
ঘুম ভেঙ্গে গেল আমার,ভঁয়ে আনন্দে,সারা শরির ঘামে ভিজে গেছে,দেবীর আদেশ মনে গেঁথে সমুদ্রের লোনা জলে আবার গোসল করে পবিত্র হলাম।
সুর্যের সোনালী আলোর খেলায় রাতের গাঢ় অন্ধকার একপাশে সরে হাসিতে ভঁরে গেছে সারা পৃথিবি,পথে ঘাটে মানুষের স্রোত,ছুটে যাচ্ছে সবাই দেবীর পূজার জন্যে।জীবজন্ত,এমন কি দালান কোঠায়ও ছড়ানো শান্তির ছোঁয়া,পাখীদের গান,ফুলের চমক জানান দিচ্ছিল বসন্তের সুর শীতের হাড়জুড়ানো ঠান্ডার শেষে,দেবী আসছে।
সবাই সুর করে বলছিল, ‘এসো নক্ষত্রের রানী,ধরিত্রী মাতা,ঋতুর সম্রাজ্ঞী’।চারপাশের গাছপালা,শুধু ফলের গাছ না,ছায়া দেওয়া গাছেরাও শীতের ঘুমের আড়মোড়া ভেঙ্গে বাতাসের দোলায় আনন্দে মাতোয়ারা হয়ে শীষ দিচ্ছিল।
সমুদ্রের উতলা ঢেউ কিছুটা শান্ত হয়ে গেছে তখন,আকাশ জড়ানো অন্ধকার মেঘ সরে গিয়ে সুনীল হাসিতে ভরপূর নতুন একটা পৃথিবী।প্রথম দিকে হেঁটে যাচ্ছিল শোভাযাত্রার কজন,
একেক জনের গায়ে একেক ধরণের পোশাক,একজনের সেনাপতি তলোয়ারের বেল্ট সাথে,
একজন শিকারী,কোমরে ঝোলানো ছোরা,হাতে বল্লম-আরেকজনের গায়ে মেয়েদের জরির পোষাক,পায়ে নকসা কাটা স্যান্ডেল,গায়ে অলঙ্কার,রঙ্গীন পরচূলা মাথায়।
যোদ্ধার পোশাক পরে যাচ্ছিল একজন,বর্ম,ছোট তলোয়ার,মাথায় শিরস্ত্রান।দার্শনিকের পোশাক,ছাগল দাড়িতে আরেকজন,পাখী ধরার পোশাকে একজন,একটা মেয়ে চেয়ারে বসে ছিল ভাল্লুকের পোশাক পরে,গরিলার পোশাক মাথায় শোলার টুপিতে একজন,জাফরান রং এর পোষাক সম্ভবত ফিরিজিয়ানদের তৈরী করা ছিল একজনের গায়ে।
গাধা সেজে কাধে পাখা লাগানো একজন,পিঠে বসে ছিল একজন বুড়ো,দেখে মনে হচ্ছিল পরিকল্পনায় ছিল হয়তো পেঘাসাস আর বেলোফন হওয়ার,তবে হিসাবে কোথাও একটু গরমিল হয়ে গেছে,মনে হয় সেই কারণে সবাই হাসিতে ফেটে পড়ছিল।মাঝে মাঝে কৌতুক অভিনেতাদের দৌড়াদৌড়ি,আর নানান ধরণের খেলায় আরও জমজমাট হয়ে ছিল আনন্দের আসর।
শোভাযাত্রার প্রথম দিকের মেয়েদের মাথায় ছিল ফুলের মুকুট,ফুল দিয়ে সাজানো পোষাক,
আনন্দ চোখে মুখে,ফুলের পাপড়ি ছড়াতে ছড়াতে এগিয়ে যাচ্ছিল।তার পরের মেয়েদের দলের,চুলের পেছনে বাঁধা আয়না,পেছনের লোকজনদের মনে হয় সবাই যাচ্ছে যেন দেবির উৎসর্গে,শুধু শুধু অকারণে ছুটে যাচ্ছেনা কোথাও।হাতীর দাঁতের চিরূনী হাতে যাচ্ছিল কজন তরুনী,সবাই যেন দেবীর লম্বা লম্বা চুল আঁচড়ে দিতে ব্যাস্ত।একদল ছড়াচ্ছিল নানান ধরণের সুগন্ধি,আরেক দল নিয়ে যাচ্ছিল রং সাজানো আলোর মশাল-‘স্বর্গের রাজকুমারীর’ প্রশংসা করতে করতে।
ঢোল বাশি,গায়ক ছেলেরা-নতুন এক কবির লেখা দেবীর স্ততির গেয়ে ছন্দে ছন্দে নাচছিল।
হেঁটে সেরাপিস দেবতার মন্দিরের বাদকেরা,আওড়াচ্ছিল অস্পষ্ট সুরে ধর্মীয় মন্ত্রের স্ত্রোত।
এক সময় পুরোহিতের দল চীৎকার করতে করতে ছোটা আরম্ভ করলো, ‘দেবী আসছে,দেবী আসছে,সরে দাড়াও,সবাই’।
দেবী মন্দিরের সহকারীরা সবাই ছুটে গেল,ধবধবে সাদা পোষাক পরা পুরুষ মহিলার দল।মেয়েদের চুল বাধা সোনালী ফিতা দিয়ে,আর পুরুষদের মাথার চুল সম্পুর্ণ চেঁচে ফেলা,
পৃথিবীতে নেমে আসা নক্ষত্রের দেশ।
পুরোহিতদের গায়ে ধবধবে সাদা বুকের বাঁধন,কোমর থেকে পোশাক মাটিতে গড়াচ্ছিল,হাতে দেবীর মন্ত্রের পুঁথি।
মহাপুরোহিতের হাতে আলোর বাতি,সেটা যে কোন সাধারণ আলোর বাতি না,বাতিটা দেখতে নৌকার মত আর জিভ দিয়ে মাঝে মাঝে আগুন বের হচ্ছিল।
দ্বিতীয় এক পুরোহিতের দুই হাতেই পুজোর বলির পাত্র-নামটা অক্সিলিরিয়া,দেবী প্রভিডেন্সের ভক্তদের দেয়া নাম।
তৃতীয় পুরোহিতের-এক হাতে ছোট্ট একটা তালগাছ,পাতাগুলো সোনার,আরেক হাতে দেবতা মারকারীর কাডুশিয়াস।
চতুর্থ পুরোহিতের-এক হাতে ছিল,সোনার তৈরী একটা বাম হাত আঙ্গুলগুলো খোলা,যা নিরপেক্ষ বিচারের প্রতীক হিসাবে,ডান হাতের চেয়ে বাম হাতের নিরপেক্ষ্রতা অনেক বেশী।আরেক হাতে একটা পাত্র যা দেখতে মেয়েদের স্তনের মত-দুধের ধারা সেখান থেকে বয়ে যাচ্ছিল মাটিতে,ধরিত্রি দেবীর প্রতিক।
পঞ্চম পুরোহিতের হাতে কুলা বেত দিয়ে তৈরী করা না,সোনা দিয়ে তৈরি।শেষে একজন মানুষ যে পুরোহিত না,হাতে তার মদের গেলাস।
পরের শোভাযাত্রা মানুষ শরীরে দেবীদের,হেটে যাচ্ছিল খালি পায়ে।সাথে ইহলোক আর পরলোকের দেবীর বার্তাবাহক,ভয়াবহ আনুবিস যার মুখটা কাল একদিকে,সোনালী অন্য দিকে।এক হাতে ধরা ঘোষকের বাদ্য আরেকহাতে একটা সবুজ তালগাছ।
পেছনে চেয়ারে গরুর মূর্তি নিয়ে বসা একজনকে নিয়ে নেচে বেড়াচ্ছিল একদল,গরু ফসল ফলমূলের দেবতা ডিমিতিরের জন্যে শোভাযাত্রা।বাক্স হাতে নিয়ে যাচ্ছিল একজন পুরোহিত যাতে লুকানো ধর্মানুষ্ঠান উদযাপনের গোপন রহস্য।আরেকজন পুরোহিতের পোষাকে লুকানো আরেক দেবতার প্রতিক,কোন জন্তুর ছবি না,বন্য বা পোষা,পাখি বা মানুষ,তবুও সকলের মনে শ্রদ্ধা আর ভঁয়,দেবতার ক্ষমতার কথা ভেবে।এটা যেন দেবীদের লুকিয়ে থাকা চিরন্তন রহস্য,যেটা বিচিত্র ভাবে অবোধ্য,একটা সোনালি পাত্র মিশরিয় হাইরোগ্লিপ্সে সাজানো,দুপাশে সুন্দর দুটো হাতল।
আমার সময় প্রায় কাছে-স্বপ্নে মহাক্ষমতাশালি দেবী আমাকে ঠিক যে ভাবে বলে গেছে,সব কিছুই ঘটছে সে ভাবেই,যেন সাজানো।মহাপুরোহিত,হেঁটে যাচ্ছিল হাতে পুজার ঘণ্টা আর অর্ঘের ফুল নিয়ে,যে ভাবে স্বপ্নে দেখলাম,তবে আমার কাছে সেটা শুধু পুজার ফুল না বরং নিয়তির উপর বিজয়ের চিহ্ন।নিয়তির খেলায় শেষ পর্যন্ত আমি যাচ্ছি দূর্ভাগ্যের যন্ত্রনা থেকে স্বাভাবিকতার দেশে,দেবির আনুকুল্যে আমার অব্যাহতি হবে যন্ত্রনা পর্ব থেকে।যদিও খুবই কাছে ছিল ফুলগুলো,তবুও আমি তাড়াহুড়া করে ছুটে যাইনি,ধীরে ধীরেই এগিয়ে গেলাম।
মহাপুরোহিতও এগিয়ে যায়নি,দাড়িয়েই ছিল যেন ফুলের তোড়া আমার মুখের দিকে এগিয়ে দেয়ার জন্যে।যদিও একগাদা শংঙ্কা ছিল মনে মনে,তবুও ভঁয়ে ভঁয়ে খেয়ে ফেললাম গোলাপ ফুলের পাপড়িগুলো।দেখলাম দেবীর স্বপ্নবানী শেষ পর্যন্ত সত্যিই পুরণ হতে যাচ্ছে।আমার কর্কশ লোমগুলো ঝরে গেল,ঝুলে পড়া চামড়া ফিরে গেল পুরোনো চেহারায়,বীভৎস চার পেয়ে খুরওয়ালা চেহারা ছেড়ে আমি আবার সাধারণ এক মানুষ।
আমার চারপাশের সব পুরোহিতরা শুধু অবাক চো্খে তাকিয়ে ছিল না,তাদের দেখায় ছিল চরম শ্রদ্ধার এক ভাব,হাত তুলে সবাই মহাপুরোহিতের দূরর্দশিতার কথা বলতে বলতে স্বর্গ রাজ্যের দেবতাদের কাছে শ্রদ্ধায় মাথা নত করে প্রার্থনা করছিল।
আমিও আমার রূপান্তরে হতবাক,পা দুটো যেন বরফে জমে গেছে,ভাষাও ছিল না ঠোঁটে,
ক্ষমতাও ছিল না আমার ত্রানকর্তী মহিয়সী দেবীকে ধন্যবাদ জানানো্র।মহাপুরোহিতের জানাই ছিল আমার রুপ্যান্তরের রহস্য,সহকর্মীদের কোথাও থেকে একটা কাপড়ের টুকরো আনার জন্যে আদেশ করতেও তার সময় লাগেনি,যাতে অন্তত ঢাকা যায় যেন আমার নগ্নতা।
অবশ্য আমি,মানুষ রুপে আসার সাথে সাথেই,পা দুটো কোনভাবে জড়িয়ে হাতদুটো দিয়ে আমার নগ্নতা ঢেকে রাখার চেষ্টা করতে দ্বিধা করিনি।এক পুরোহিত একটা কাপড়ের টুকরো দিয়ে আমাকে ঢেকে দিল,মহাপুরোহিত সব কিছু জানা সত্বেও অবাক হয়ে দেখছিল আমার রুপান্তরিত চেহারা।
‘লুসিয়াস,বন্ধু আমার,’মহাপুরোহিত বললো, ‘ভাগ্যের অত্যাচার,পরিহাস কম সহ্য করনি তুমি।
মহাদেবীর করুনায় আবার তুমি এখন মানুষ।মনে রেখ,শিক্ষা দীক্ষা,প্রতিপত্তি রক্ষা করতে পারেনি তোমাকে অযথার যন্ত্রনা থেকে।কিশোর ছেলেমী স্বভাব আর অযথার কৌতুহলের জন্যেই এই যন্ত্রনা,এই শাস্তি ভোগ করলে তুমি।
অন্ধ ভাগ্য তোমাকে এক যন্তনার সমুদ্র থেকে আরেক যন্ত্রনার সাগর ছুঁড়ে দিয়ে শেষ পর্যন্ত পৌঁছে দিল,বিশ্বাসের রাজ্যে।নিষ্ঠুর ভাগ্যদেবী তার খেলা করুক অন্য কাউকে নিয়ে এখন,তুমি মহাদেবীর বিশ্বাসী ভক্ত একজন।জানি না তোমাকে ঐ ডাকাতদের হাতে দিয়ে,অত্যাচারের পর অত্যাচারের সম্মুখীন করে কিই বা আনন্দ পেল,ভাগ্য দেবতা।নিশ্চিন্ত থাক আর কোন বিপদ হবে না,এখন তো তুমি দেবীনেত্রীর হাতে যার আনুকুল্যের জন্যে অস্থির দেব দেবীদের সবাই।তোমাকে দেখলে, লোকে বলবে, “ঐ যে,হেঁটে যাচ্ছে লুসিয়াস।শুধু দেবী আইসিসের জন্যেই সে আজ গাধা থেকে মানুষ”।ভুলে যেও না,স্বপ্নের প্রতিশ্রুতির কথা।তোমার এই স্বাধীনতায়,কোন সময় যেন ভুলে না যাও,দেবী আইসিসের করুনার কথা’।
মহাপুরোহিতর কথা শেষ হওয়ার পর আমিও যোগ দিলাম অন্যান্য পুরোহিতদের সাথে, শোভাযাত্রা যথারীতি এগিয়ে চললো করিনিথের দিকে।লোকজন আমার দিকে তাকিয়ে মাথা ঝাকিয়ে বলছিল, ‘ঐ যে হেঁটে যাচ্ছে লুসিয়াস,দেবীর বরে সে এখন গাধা থেকে মানুষ।কত ভাগ্যবান মানুষটা,পুন্যতা আর সৌভাগ্যে কারণ,তার এই নতুন জীবন।সৌভাগ্য সে দেবি আইসিসের একান্ত ভক্ত’।বেশ জোরে সোরেই সবাই বলছিল কথাগুলো।
শোভাযাত্রা পৌছালো সমুদ্র সৈকতে যেখানে গতকালকে আমি শুয়ে ছিলাম,গাধার শরীরে।এক এক করে বিভিন্ন দেব দেবীদের প্রতীক সাজিয়ে পুজো আরম্ভ হলো,এক পুরোহিত সাজালো জাহাজটা,সোনালী রংএ আবার মিশরীয় হাউরোগ্লিপ্সে সাজানো সম্পুর্ন জাহাজটা।
পুরোহিত পুজা করার আগে প্রথমে মন্ত্র পড়ে বিশুদ্ধ করলো বাতাস,সাথে মশালের আগুন,ডিম আর সালফার।জাহাজের পালটার সাদা কাপড়ে লেখা ছিল দেবী আইসিসের কাছে প্রার্থনা নতুন বছরে সফল সমুদ্র যাত্রার জন্যে।আরেক পাশের পালে ছিল দেবী আইসিসের ছবি,চিরন্তন লম্বা পাখীর মত গলায় চিনতে কষ্ট হবে না কারও।উপস্থিত পুরোহিত দর্শক সবাই দুধ,নানান ধরণের সুবাসিত তেল সমুদ্রে ঢেলে দেবীর কাছে প্রার্থনা আরম্ভ করলো।
পূজার শেষে জাহাজ ভর্তি করা হলো মালপত্রে,জাহাজের নোঙ্গরের দড়ি কাটার পর এক সময় ধীরে ধীরে স্রোতের সাগরে,জাহাজটা চলে গেল আমাদের দৃষ্টির বাইরে,তারপর পুরোহিতরা এক এক করে দেব দেবীদের প্রতীক তুলে ফিরে গেল শোভাযাত্রা করে।মহাপুরোহিত,
পুরোহিতরা, দেবী আইসিসের প্রতীক,অন্যান্য সরঞ্জাম নিয়ে মন্দিরে পৌছে,যথারীতি সাজিয়ে রাখলো।মন্দিরের ঢোকার পথে মহাপুরোহিত একটা আলোচনা সভায় বসে দেবী আইসিসের পূজোর মন্ত্র থেকে উঁচু সুরে লাতিন ভাষায় প্রার্থনা করছিল, ‘দেবি আর্শীবাদ কর,আমাদের সম্রাটকে,আমাদের সংসদ সদস্যদের,আমাদের বীর যোদ্ধাদের,আমাদের জনসাধারণকে,আমাদের জাহাজের নাবিকদের তাদের সমুদ্র যাত্রায়।দেবি তোমার স্বর্গীয় ক্ষমতায়,অভাবনীয় শক্তিতে অসম্ভব হইয়ে উঠুক,সম্ভব’।
তারপর গ্রীক ভাষায় মহাপুরোহিত বললো, ‘প্লোয়াফেসিবিয়া,’চারপাশের সমাবেশের সবাই আনন্দে হৈ হৈ করে উঠলো,সমুদ্র যাত্রার শুভবানিতে।এক এক করে পূজোর উপকরণ যে যা পারলো সাথে নিয়ে সবাই ফিরে গেল বাড়ীর দিকে,শুধু দেবী আইসিসের রুপোর মূর্তিটা সাজিয়ে রাখা ছিল মন্দিরে।আমি তখনও স্তম্ভিত বসে ছিলাম,দেবীর মুর্তির দিকে দেখে দেখে ভাবছিলাম,কদিন আগে ফেলে আসা দূর্ভাগ্যের কথা।
আমার রূপান্তর কথা আর দেবী আইসিসের আমার প্রতি আনুকুল্যের কথা লোকজন জানে শহর থেকে শহরান্তরে,এমন কি আমার শহর নিজের মাদুরায়ও যেখানে সকলে ভাবতো,আমি মৃত।বেঁচে থাকার খবর শুনে আমার চাকর বাকর আত্মীয় স্বজন সবাই ছুটে গেল করিনিথে,
মরলোক থেকে ইহলোকে আসার আনন্দে নানান উপঢোকন নিয়ে ছুটে গেছে সবাই।
আমার আনন্দ উচ্ছাসও কোন অংশে কম ছিল তাদের চেয়ে,আমি বারে বারে তাদের আমার উপহারগুলোর জন্যে ধন্যবাদ দিতে দ্বিধা করিনি।বিশেষ করে ধন্যবাদ দিচ্ছিলাম-চাকরবাকরদের,বুদ্ধি করে কাপড়চোপড়,কিছু টাকাপয়সা নিয়ে আসার জন্যে।
সকলের সাথে গল্পগুজব করে-আবার বসলাম দেবী আইসিসের পুজায়।মন্দিরের একটা ঘর আমার থাকার জায়গা-আর দেবীর পূজা,যেটা পুরোনো দিনে কিছুটা অবহেলাই করতাম সেটাই আমার প্রধান কাজ,এখন অন্যান্য পুজারীদের কাছে আমি তাদেরই একজন।
এমন একটা দিন বা রাত্রি ছিল না,দেবী আইসিস আমাকে স্বপ্নে কোন একটা আদেশ দেয়নি।
প্রতিদিনই একটা না একটা বিশেষ আদেশ ছিল-যা ছিল আমার জন্যে পুর্বনিদিষ্ট।ধর্মীয় আঁচারের জন্য সে গুলো পুরণ করা সম্ভব হয়নি আমার,কেননা আমাকে সেটা এক নতুন ধরনের জীবনযাত্রা,সাধারণ ব্যবহার সবকিছু ছেড়ে পবিত্রতার এক নতুন আঙ্গিনা,আমি প্রস্তত ছিলাম না সেই পৌরোহিত্যের জীবনের জন্যে।
স্বপ্নে দেখলাম মহাপুরোহিত আমার জন্যে অনেকগুলো উপহার নিয়ে বলছে, ‘থিসালী থেকে,তোমার ক্রীতদাস কান্ডিডুস আনলো এই মাত্র’।ঘুম ভেঙ্গে গেল,ঠিক বুঝে উঠতে পারলাম না,স্বপ্নের মানেটা কি?কান্ডিডুস বলে আমার কোন ক্রীতাদাস ছিল না।তবে কোন সন্দেহ ছিল না মহাপুরোহিতের স্বপ্নের উপহার নিশ্চয় কোন উপকারী বস্ত।
সকালের আলোর অপেক্ষায় আমি-ভাবছিলাম না জানি,কি অপেক্ষা করে আছে মন্দিরের চত্বরে আমার জন্যে।সকালের আলোর ছটাটা মন্দিরের জানালা ছেড়ে ছুঁয়ে যাচ্ছিল দেবীর মন্ডপ,স্বর্গীয় এক দৃশ্য যা শুধু অনুভুতি করা যায়,মহাপুরোহিত স্ততি করে দেবীর প্রতিমার চারপাশে পবিত্র জল ধূপধূনো ছিটিয়ে সকালের পূজো শেষ করলো।
অবাক হয়ে দেখি দরজা খুলে ঢুকছে-সেই দুই ক্রীতদাস যাদের ভুলেই শুরুহাইপাতাতে গলায় দড়ি পরে আমার গাধা পর্বের যন্ত্রনা।তারা আমার নানান অভিযান,যন্ত্রনার কথা শুনে-সাথে আমার পোষাক আশাক এগুলো নিয়ে হাজির।এমন কি আমার সাদা ঘোড়াটাকেও সাথে আনতে ভুলেনি-যদিও এক হাত থেকে আরেক হাতে-নানা পথ হয়ে ঘুরে আসা আমার কাছে।এবার আমি বুঝতে কষ্ট হয়নি স্বপ্নের মানেটা-থেসালী থেকে পোষাকআশাক শুধু না সাথে সাদা ঘোড়াটা,‘কান্ডিদুস’ আমার জন্যে অপেক্ষা করছিল, ‘কান্ডিডুস’ মানে ‘সাদা’।
এর পর আমার বেশীর ভাগই সময়ই কাটলো দেবীর পূজায়-দেবী আইসিসের আনুকুল্যে আরও বিরাট কোন একটা পুন্য লাভের আশায়।আমি মহাপুরোহিতকে অনুরোধ করা আরম্ভ করলাম-দেবীর রাতের পুজোর বিশেষ আঁচার,পদ্ধতি শেখানোর জন্যে।মহাপুরোহিত ধর্মের আঁচার ব্যাবহার ছিল বেশ যথাযথ,সবকিছু নিয়মমত এগিয়ে নেওয়া যাওয়াই ছিল তার পদ্ধতি।আমার বারবার অনুরোধে বিরক্ত না হয়ে মহাপুরোহিত আমাকে বুঝিয়ে বললো, দেবীর আদেশ হলেই সবকিছুই হবে সময়মত।দেবীই জানিয়ে দেবে দিনক্ষন আর আমাকে যথাযথ প্রশিক্ষনের পদ্ধতি।তার কথামত আমাকে অযথা উদগ্রীব না হয়ে যথাযথ সময়ের জন্যে অপেক্ষা করে যেতে হবে।‘পুরোহিতদের কারও সাহস্য হয়নি আজ পর্যন্ত দেবির নির্দেশ ছাড়া কোন কিছু করার,পুরোহিত দীক্ষার কথা তো দূরের কথা।
দেবী আইসিস তার ক্ষমতা ইহলোক ছাড়িয়ে মরলোকে,তাকে অমান্য করা মানে ইহলোকে যন্ত্রনা,পরলোকে চিরন্তন যন্রনায়,পূর্নজন্মের কোন সম্ভাবনা হারানো।বেশীর ভাগ ক্ষেত্রেই দেবীর বাছাই করা বয়স্ক পুরোহিতদের যারা দেবীর রহস্য,নানান বানী অযথা বলে বেড়ায় না,তারা মৃত্যুর কাছাকাছি,পুর্নজন্মের আশায়’।
এক কথায় মহাপুরোহিত যা বললো,আমাকে অপেক্ষা করতেই হবে দীক্ষার বিশেষ সময়ের জন্য,যদিও আমি দেবীর বিশেষ পচ্ছন্দের পাত্র।ইতিমধ্যে আমি যেন সাধারণ নিষিদ্ধ খাবারদাবার থেকে,যা পুরোহিতদের জন্য নিষিদ্ধ যেন সময় এলে কোন দ্বিধা না থাকে আমার মনে।
তার উপদেশমত আমি প্রতিদিন দেবীর পুজোর আঁচার পালন করে চললাম অন্য পুরোহিতদের সাথে,দেবী আইসিসকে খুশি করার জন্যে যেন আমার কোন ঘাটতি না থাকে।আমার সময় এলো,স্বপ্নে এসে দেবী আইসিস আমাকে জানিয়ে দিল,আমার দীক্ষার সময় এসে গেছে।দেবী এটাও বলে গেল স্বপ্নে-মহাপুরোহিত মিথরাস এর সাথে আছে আমার ভাগ্যের যোগ,দেবী তাকে আমার দীক্ষার আদেশ জানিয়ে দিয়েছে।
সকালের প্রথম আলোর ছটায় ছুটে গেলাম মহাপুরোহিতের কাছে,আমার অনুরোধ ছিল যত শীঘ্রিই সম্ভব আমার দীক্ষা যেন আরম্ভ হয়।মহাপুরোহিত বেশ নম্র সুরে বললো, ‘তুমি সত্যিই ভাগ্যবান একজন,আইসিস,বিশ্বব্রক্ষান্ডের মহাশক্তিশালী দেবী,যার ক্ষমতা ছাড়িয়ে যাওয়া জীবীতের রাজ্য শুধু না মৃতদের রাজ্যেও,সেই দেবী তোমার প্রতি প্রচন্ড সহানুভুতিশীল,
অপেক্ষা করবো না আমরা দেবীর কথামত আমরা এখনই আরম্ভ করবো তমার যথাযথ দীক্ষা’।
স্নেহের সাথে আমার হাত ধরে মহাপুরোহিত এগিয়ে গেল দেবীর সেই বিশাল মন্দিরের দিকে।সকালের পূজো অর্চনা সেরে দুটো শাস্ত্রীয় বই বের করে নিয়ে এলো যার ভাষা আমার কাছে ছিল সম্পূর্ন অজানা,কিছু জন্ত জানোয়ারের ছবি দেওয়া হাইরোগ্লিফিক্স,কিছু অক্ষরে লেখা তার ওপর নীচে বিশেষ ভাবে গোল করে বা লম্বা করে অবোধগম্য করে দেওয়া।মহাপুরোহিত সেই বই থেকে আমার বিশেষ দীক্ষার জন্যে পোষাক,সরঞ্জামের হিসেব তৈরী করে নিল।
আমি সাথে সাথেই আমার পুরোহিত বন্ধুদের কাছে গিয়ে সব কিছু কিনে আনার জন্যে অনুরোধ জানালাম।সময়মত মহাপুরোহিত আমাকে নিয়ে গেল সরকারী গোসলখানায়,চারপাশে উপস্থিত ছিল অন্যান্য সব পুরোহিতরা।মহাপুরোহিত আমাকে নিজে গোসল করিয়ে আমার শরীরে ছড়িয়ে দিল পূজোর পবিত্র জল,বিড়বিড় করে মন্ত্র আউড়ে আমাকে আর্শীবাদও করলো আমাকে।এর পর আমার হাত ধরে নিয়ে এসে আমাকে দাঁড় করিয়ে দিল দেবী আইসিসের পায়ের কাছে।
মহাপুরোহিত দেবীর র্নিদেশগুলো আমার কানে ফিসফিস করে জানিয়ে দিল,উপস্থিত সব পুরোহিতদেরও বলে দিল অন্তত দশটা দিন যেন মাছ,মাংস,মদ,এই সব বিশেষ খাবারদাবার থেকে সবাই বিরত থাকে।
মহাপুরোহিতের আদেশমত,আমি নিয়ম পালন করে গেলাম অক্ষরে অক্ষরে,অবশেষে হিসেবমত মন্দিরে গেলাম আমার শপথ নেয়ার জন্য।দিনের শেষে পুরোহিতেরা একে একে নিয়ে এলো নানান উপহার নিয়ে কেননা সেটাই ছিল নতুন পুরোহিতের দীক্ষা,শপথ নেওয়ার প্রথা।
মহাপুরোহিত সবাইকে বিদায় দিয়ে আমাকে ধবধবে সাদা সিল্কের পোশাক পরিয়ে নিয়ে গেল মন্দিরের গোপন মহলে,অন্যান্য পুরোহিতদের প্রবেশ ছিল সেখানে নিষিদ্ধ,পাঠকদের নিশ্চ্য় চরম কৌতুহল,কি হলো তারপর।তবে সেগুলোর ব্যাখা দেয়া সম্ভব না এই জন্যে-দেবীর কাছে আমার প্রতিজ্ঞা,নিয়ম ভাঙ্গলে আমি হারাবো আমার বলার শক্তি আর যে শুনবে সে হারাবে তার শোনার শক্তি,সে জন্যে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি।
যাকগে ধর্মের অভিশাপ ছাড়িয়ে যতটুকু বলা সম্ভব,আমি বলার চেষ্টা করছি যাদের জানা নেই দীক্ষা নেওয়ার আঁচার,তাদের কাছে শুধু এটুকুই অনুরোধ আমার কথাগুলো বানানো ফানুস বলে উড়িয়ে যেন না দেয়।
দীক্ষায় গেলাম মরলোকে,এক পা ছিল পরলোকের দেবী প্রস্পেরিনের হাতে,তবুও সূযোগ হলো সশরীরে ফিরে আসার।মাঝরাতে দেখলাম ভঁরা দুপুরের আলো,সেখানে আমি পূজোর অর্চনা দিয়ে সম্মান জানালাম ইহলোক আর পরলোকের দেবীকে।
জানিনা,হয়তো আমি কিছু বোঝাতে পেরেছি কি না আমার দীক্ষা পর্বটা,হয়তো বা কোন কিছুই বোঝাতে পারিনি।
রাত কাটানো ভোরে আমি বের হয়ে এলাম মন্দির থেকে,গায়ে জড়ানো গোটা বার ধরণের বিভিন্ন উত্তরীয়,অবশ্যই একটা স্বর্গীয় যোগাযোগ,তবে এটা বলতে তো কোন বাধা নেই।
বাইরের বেশ কিছু যারা তখনও পুরোহিত হিসেবে শপথ নেয়নি দাঁড়ানো সেখানে,মহাপুরোহিত আমাকে দেবীর সামনে একটা কাঠের মঞ্চে নিয়ে দাঁড় করিয়ে দিল।আমার বাইরের পোশাকটা তখন সাদা সিল্কের,কারুকার্য করা নানান ধরণের ফুল তার ওপর,একটা উত্তরীয় ঝোলানো গলা থেকে পায়ের গোড়ালী পর্যন্ত।উত্তরীয়তে কারুকার্য করা পবিত্র জীবজন্তদের ছবি দিয়ে,ভারতের সাপ,উত্তর প্রান্তের গ্রিফিন-পাখাওয়ালা শুধু যাদের অস্তিত্ব পৃথিবীর উত্তর দক্ষিনে।পুরোহিতরা এটাকে জানে অলিম্পিকের উত্তরীয় হিসেবে,আমার এক হাতে ধরা মশাল আরেক হাতে তাল গাছের মালা যার প্রতিটা শাখা থেকে বেরোচ্ছে যেন স্বর্গীয় রশ্মি।
এক সময় চারপাশের সব পর্দা সরিয়ে দেওয়া হলো,অনেকটা যেন পর্দা সরিয়ে কোন বিশেষ শিল্পীর পাথরের মুর্তি উদঘাটন,আমার জীবনের একটা বিশেষ আনন্দের দিন,অনেকটা যেন বিরাট রাজভোজের সাথে আমার জন্মদিন পালন।এ ভাবে আমার দীক্ষার তৃতীয় দিনে প্রাতরাশের পর শেষ হলো আমার দীক্ষাপর্ব।আরও বেশ কটা দিন আমি কাটালাম দেবীর মন্দিরে-আর যাই হউক আমার প্রতি দেবীর আনুকুল্যের প্রতিদান দেওয়া কোনদিনই আমার পক্ষে সম্ভব হবে না।
০০০০০০০০
©somewhere in net ltd.