নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
(৫) আমি সেকুরে
অবশ্য বাবার মতে ব্ল্যাকের অভিজ্ঞতা সে পর্যায়ের হয়নি তখনও।অনেক কষ্টে বাবা যদিও ব্ল্যাককে নাইম পাশার কাছে একটা কাজ জোগাড় করে দিল,তবে কেরানী হিসাবে,সে সুখী ছিল না,তার মতে নিজেকে উন্নতি প্রতিপত্তির দিকে নেয়ার কোন সূযোগ ছিল না সেখানে।
তবে নিঃসন্দেহে এক অবুঝের মত ব্যাবহার করছিল,সেটা বোঝাই গেল যখন রাতে বাবা বললো, ‘আমার এই ভাগ্নে বেশ অকৃতজ্ঞ আর তার নিজের সমন্ধে খুব একটা ভুল আর অনেক উঁচু ধারণা তার’,মায়ের উপস্থিতি উপেক্ষা করেই বাবা বললো, ‘যা ভেবেছিলাম তার চেয়ে অনেক চালাক,ছেলেটা’।
কিছুই করার ছিল না আমার,শুধু দুঃখে দেখে যাওয়া,বাবার ক্ষমতার ব্যাবহার-সব কিছু বুঝে ব্ল্যাকের সাথে একটুঁ দূরত্ব রেখে চলা আরম্ভ করলাম,ব্ল্যাকের যাতায়াতও বেশ কমে গেল আমাদের বাড়ীতে।বিস্তারিত বেশী কিছু বলতে চাই না,তাতে হয়তো আমাদের সবাই ঘৃনাই করবে,তবে ও ছাড়া বাবার আর কিছু করার ছিল কি না,জানি না।এ ধরণের অবস্থায় কি করা উচিত জানি না,যে ভালবাসায় কোন ভবিষ্যত নেই,শুধু হতাশা যেখানে চারপাশে,সেটা যত শীঘ্রি সম্ভব শেষ করে দেয়াই ভাল।বাবা,মা এটাকে যথাযথ সম্পর্ক হিসাবে চিন্তা করতে পারে নি,যদিও মনে পড়ে মা বারে বারে বলছিল তখন, ‘আর যাই হউক,ছেলেটার মনটা একেবারে ভেঙ্গে দিও না’।‘ছেলেটা’,আমার মা যার কথা বলছিল তার বয়স তখন চব্বিশ,আর আমি তার অর্ধেক বয়সী।আমার বাবা ব্ল্যাকের ঔদ্ধত্যে অবাক,তবু মায়ের মনটা ভাঙ্গার কোন ইচ্ছা ছিল না,তার।
আমরা তাকে একেবারে ভুলে যায়নি,তার ইস্তাম্বুল ছেড়ে যাওয়ার কাহিনী আমাদের কানেও এসেছিল।এরপর আর কোন খবর পাইনি,তার দেয়া ছবিটা কৈশোরের স্মৃতি আর বন্ধুত্বের ইতিহাস হিসাবে রেখে দিয়েছিলাম।বাবা আর পরে সিপাহী স্বামীর কাছ থেকে লুকিয়ে রাখার জন্যে, ‘সেকুরে আর ব্ল্যাক’, লেখাটাকে বাবার হাসান পাশার কালি দিয়্রে ঢেকে দিলাম,এমন ভাবে যেন কারও চোখে পড়লে মনে হবে,কালিটা কোন ভাবে পড়ে গেছে।আমি আজকে ছবিটা দেয়ার পর জানালায় দাঁড়িয়ে ভাবছিলাম,যারা মন্তব্য করতে চায় তারা অবশ্য সে রকম আর কিছু ভাববে না।
জানালায় যাওয়ার পর বেশ কিছুক্ষন দাঁড়িয়ে ছিলাম সেখানে,গোধুলির সোনালী রোদের সুরটা বাগানটাকে ছুয়ে যাচ্ছিল,এক সময় সন্ধ্যার হিমেল বাতাসটা আমাকে একটু নাড়া দিয়ে গেল।এ ভাবে জানালায় দাঁড়িয়ে থাকা নিয়ে রাস্তায় হেঁটে যাওয়া কে কি বলবে সেটা নিয়ে
কোন দূর্ভাবনা ছিল না,আমার।জিভ শহরের পাশার এক মেয়ে,মেসরুরে,যে সবসময় হাসিঠাট্টা আর গল্পগুজবে মত্ত থাকতো,জীবনের সব কিছুই ছিল তার কাছে হাল্কা একটা ব্যাপার,এমন কি অস্বাভাবিক পরিস্থিতে তার প্রগলভতার কোন অভাব ছিল না।আমার মধ্যেও ও ধরণের এ প্রভাবটা ছিল,হয়তো নিজে বানিয়ে নিয়ে কিছু একটা বললাম,হয়তো তার উল্টাটাই সত্যি।
আমি সত্যি সত্যিই বেশ দুঃখ পেয়েছিলাম,যখন হতভাগা শিল্পী জারিফ(এলেগান্ট)এফেন্দী,
যাকে বাবা প্রায়ই আমন্ত্রন জানাতো,হারিয়ে গেল অনেকটা আমার স্বামীর মতই।
জারিফ(এলেগান্ট) দেখতে ছিল বেশ কুৎসিত আর মানসিক ভাবে বেশ দূর্বল।
‘মা,সেভকেত তোমার কথা শোনেনি’,অর্হান বললো।ব্ল্যাক যখন ঘোড়া নিয়ে বেরোচ্ছিল,
সেভকেত তখন রান্নাঘর থেকে বের হয়ে দেয়ালের আলমারীর ছিদ্র দিয়ে চুপিচাপি দেখার চেষ্টা করছিল,কি ঘটছে।
‘হাইরিয়ে’,আমি বললাম, ‘মাখন দিয়ে কটা রুটি ভেজে,মারজিপান আর চিনির সাথে ওদের খেতে দাও’।
অর্হান আনন্দে বেশ লাফালাফি করছিল,আর সেভকেত বসে ছিল চুপচাপ।আমি যখন উপর তলায় গেলাম তখন দুইজন মিলে আনন্দে,উত্তেজনায় আমাকে ধাক্কাধাক্কি দেয়া আরম্ভ করলো।‘এই শয়তান কি করছিস,তোরা?থাম,থাম’,ওদের পিঠে বুলিয়ে বললাম।
অদ্ভুত এক অনুভুতি ছেলেদের সাথে বসে সন্ধ্যার সময়টা কাটানো,ওদিকে বাবা একপাশে ব্যাস্ত তার বই নিয়ে।
‘তোমার মেহমান চলে গেছে,আশা করি তেমন একটা সমস্যা হয় নি’,আমি বললাম।
‘তার উল্টোটা বরং সত্যি’, বাবা উত্তর দিল, ‘ও ওর এনিষ্টেকে বেশ সম্মান আর মর্যাদা করেই কথা বললো’।
‘তা হলে খুবই,ভাল,তুমি তো খুবই খুশী’।
‘এখন ও আর আগের মত নাই,বেশ হিসেব করে,মেপে মেপে কথা বলে’।
বাবা এমন ভাবে কথাটা বললো,যাতে বোঝা যায় ব্ল্যাকের ব্যাপারে আমার মানসিক প্রতিক্রিয়াটা,হয়তো বোঝার চেষ্টা করছিল।অন্য কোন সময় হলে আমি হয়তো রেগে গিয়ে তাকে একটা যথাযথ উত্তর দিতাম।তবে তখন সাদা ঘোড়ায় চড়ে যাওয়া ব্ল্যাকের ছবিটাই শুধু আমার মনে ভাসছিল,কোন উত্তর দেই নি।
জানি না কি ভাবে,তবে দেয়ালের আলমারীতে আমি আর অর্হান খেলা আরম্ভ করলাম।
সেভকেতও এলো পরে,আর দুজনে বেশ ঝাপাঝাপিতে ব্যাস্ত হয়ে গেল।দুজনে আমার সাথে যখন মাটিতে গড়াগড়ি করছিল,চুমু খেয়ে বুকে জড়িয়ে ধরলাম দুজনকে,তাদের দুজনার ওজন ছিল আমার স্তনে,নিঃশ্বাস নিতে একটু কষ্টই হচ্ছিল।
‘ছি,ছি,তোর চুলে অসম্ভব দূর্গন্ধ,কালকে আমি তোকে হারিইয়ের সাথে হাম্মামে পাঠাবো’,আমি বললাম।
‘আমি হাম্মামে যাব না,সেটা হারিইয়ে না,আর কারও সাথেও না’,সেভকেত উত্তর দিল।
‘কেন?খুব বড় হয়ে গেছিস তুই’?,আমি বললাম।
‘মা,তুমি আজকে তোমার বেগুনী ব্লাউজটা কেন পরলে’?
আরেকটা ঘরে যেয়ে বেগুনী ব্লাউজটা খুলে ফেললাম,আবার পুরোনো সবুজ ব্লাউজটা গায়ে দিলাম।কাপড় বদলানোর সময় শীতের ছোঁয়াচটা একটুঁ নাড়া দিল যদিও,কিন্ত শরীরে যৌবনের আগুনটা নতুন ভাবে জ্বলজ্বল করে জ্বলে ওঠা,আবার।গালে একটুঁ রুজ ছিল,ছেলেদের সাথে মাটিতে গড়াগড়ি করার সময় চারপাশে দাগ হয়ে গেছে।জানি হাম্মামে আমার পরিচিত মেয়েরা বলে,দেখতে আমি এখনও এক ষোল বছরের মেয়ের মত,দু ছেলের মা চব্বিশ বছরের মহিলার মত না।বিশ্বাস করলে বা না করলে আমার কিছু যায় আসে না।
কেউ যেন অবাক না হয়,আমি যেন তাদের সাথে কথা বলছি বলে।বাবার বইগুলোতে আমি অনেক সময় খুঁজেছি,সুন্দরী মেয়ে আর সুপুরুষদের ছবি।এটা ঠিক তারা আছে,বেশী না হলেও,লজ্জায় একে অন্যের দিকে মাথা নীচু করে।কোন সময় তারা সাহসে তাকায় না একে অন্যের দিকে,এক সাহসী সৈনিক বা সুলতানের মত।শুধু সস্তা দু একজন শিল্পীর ছবিতে সুন্দরী চোখ তুলে দেখছে জানি না,প্রেমিকের চোখে না,তার মদের গেলাসে-হয়তো বা পাঠকের দিকে,আমি জানি না ঐ পাঠক কারা।
আমি অবাক হয়ে ভাবি,দু তিনশ বছরের পুরোনো বইগুলোর কথা,যার মধ্যে অনেকগুলোই লেখা সেই তৈমুর লং এর সময়ে,কোন কোন ছবি সোনার পাতা দিয়ে মোড়ানো,টেনে নিয়ে যায় গল্পের দেশের সেই সময়ে।হয়তো একদিন দূরের কোন এক দেশের কেউ আমার এই গল্পগুলো শুনবে,কোন এক বই এর পাতায় নিজের নামটা দেখা কাকে না উৎসাহিত করে?এই কারণেই না সুলতান,উজির অনেকেই বস্তা বস্তা মোহর দেয় ঐতিহাসিকদের তাদের কৃতিত্বের কথা লিখে যাওয়ার জন্যে?এ কারণেই আমি অনেকটা বই এর সুন্দরীদের মত যাদের এক চোখ বই এর পাতায় আরেক চোখ বাইরের পৃথিবীর দিকে,আমার ও ইচ্ছা যারা দূর থেকে তোমরা আমাকে দেখে যাচ্ছ,তাদের সাথে কথা বলার জন্যে।আমি,সুন্দরী,
বুদ্ধিমতী,ভালই লাগে ভাবতে আমাকে নিয়ে কেউ ভাবছে।যদিও মাঝেসাঝে দু একটা মিথ্যা কথা বলি না তা না,তাতে কেউ যেন আমার সমন্ধে অযথা একটা খারাপ ধারণা না করে নেয়।
তোমরা নিশ্চয় দেখেছ বাবা আমাকে কত আদর করে।তার তিনটা ছেলে ছিল কিন্ত আল্লাহ তাদের এক এক করে সবাইকে নিয়ে গেছে,আর কেউ নেই শুধু আছি আমি একা,তার একমাত্র সন্তান।বাবা অসম্ভব আদর করে আমাকে,যদিও আমি তার অপচ্ছন্দের ছেলেকে বিয়ে করেছি।আমি স্পাহীতে এক সিপাহীকে ভালবেসে বিয়ে করেছি,বাবার কথামত বিয়ে করলে আমার স্বামী হতো নামকরা একজন শিল্পী বা পন্ডিত,তার শিল্প,সাহিত্যের ওপরে থাকতো সম্পূর্ন অন্য ধরণের একটা অনূভূতি,আর সে হয়তো হতো কারুনের মত ধনী,
পবিত্র কোরানে যার কথা বলা আছে।বাবার বই এ হয়তো এ ধরণের কাঊকে খুঁজে পাওয়া সম্ভব হতো না,আমাকে যেত হতে দূরে অন্য কোথাও।
আমার স্বামী ছিল বেশ সুন্দর এক পুরুষ,হাম্মাম থেকে আসার সময় তার সাথে প্রথম দেখা আমার,আর তার বন্ধুদের উস্কানি,সহায়তায় আমাদের যোগাযোগে খুব একটা সময় লাগেনি।ঝকঝকে দুটো চোখ ছিল যেন আগুনের উজ্জলতায় ভঁরা,আর প্রথম দেখায় প্রেম,আমাদের।কাল লম্বা চুল,উজ্জল রং,সবুজ চোখ,সবল বাহু,সাহসী এক যোদ্ধার মত দেখতে,তবে ভাবে ভঙ্গীতে ছোট্ট ঘুমন্ত এক শিশু।তবু আমার মনে হলো,ওর রক্তের গন্ধে সাথে ভেসে আসে শান্ত এক রুপ-যার সব শক্তি ঢেলে দেয়া মানুষ খুন করাতে,বাড়ীতে সে শান্ত,শিষ্ট এক নারীর মত স্নিগ্ধ মানুষ।এই মানুষটা বাবা ভাবতো একেবারে কপর্দকশূন্য,
প্রথমত বিয়েতে সম্মতি না দিলেও,আর আটকাতে পারেনি-আমি যখন আত্মহত্যার ভয় দেখালাম।প্রথমে আমরা সবার করুনার পাত্র হলেও-যুদ্ধে তার সাহস আর সফলতায়,দশ হাজার রুপার মোহর আর কিছু জমি পেলে,আমরা সকলের ঈর্ষার পাত্র হয়ে দাঁড়ালাম।
বছর চার আগে যখন সাফাভিদের যুদ্ধ থেকে অন্যান্য সৈন্যদের সাথে যদিও সে ফিরে আসে নি,আমি একটুঁও বিচলিত হইনি।ভেবেছি ওর অভিজ্ঞতা,সাহস,চাতুর্য যে ধরণের তাতে সে কোন না কোনভাবে তার সৈন্যদের নিয়ে ফিরে আসবে,আর আমরা জমি জায়গা আর পুরষ্কার নিয়ে আরও ঈর্ষার পাত্র হবো।অনেকে বললো,তারা দেখেছে সে তার সৈন্যদের সাথে পাহাড়ের দিকে পালিয়ে গেছে।প্রথমে ভাবলাম হয়তো কোন এক কারণে সে ফিরে আসতে পারছে না,তবে আর বেশীদিন অপেক্ষা করতে হবে না।দুটা বছর চলে যাওয়ার হতাশা কিছুটা ছেয়ে গেল মনে,দেখলাম আরও অনেকে আছে ইস্তাম্বুলে যাদের যুদ্ধে হারানো স্বামী আর ফিরে আসে নি,ও ভাবেই ভাগ্যের হাতে নিজেকে সপে দিলাম।
রাতে ছেলেদের বিছানায় ছেলেদের জড়িয়ে তাদের কান্না থামানোর চেষ্টা করি,সান্তনা দেয়ার জন্যে আশা দিয়ে মিথ্যা বলতে আমার দ্বিধা হয় না।যেমন কোন কোন সময় বলি,এই বসন্তেই ফিরে আসবে,তাদের বাবা,কোন সময় বলি কেউ দেখেছে ওদের বাবাকে।বলতে বলতে এমন হয়ে গেছে যেন ঐ মিথ্যেগুলোই আমার মনেই একটা আস্থা নিয়ে এসেছে।
বাড়ীর উর্পাজনের রাস্তাটাই যখন বন্ধ হয়ে যায়,তখন দুঃসময় ছুটে আসতে তেমন একটা সময় লাগে না।আমরা চারশ কাপ এলাকার একটা ভাড়া বাড়ীতে থাকতাম,সাথে আবখাজিয়ান,স্বামীর বুড়ো বাবা,জীবনের একটা দিনও যে কোনদিন আয়েশে কাটায়নি,আর আমার স্বামীর ছোট ভাই যার চোখ দুটোও ছিল নীল।শ্বশুর তার ফেরীর ব্যাবসা ছেড়ে আমাদের সাথে ভালই সময় কাটাচ্ছিল,কিন্ত এখন বুড়ো বয়সে আবার তাকে একই কাজ করতে হচ্ছে।হাসান,আমার স্বামীর ভাই কোন চাকরী বাকরী ছিল না, শুল্ক বিভাগে চাকরী পাওয়ার পর সে,বললো, ‘সংসারের সব দায়িত্বটা আমার’।তবে এক মাসেই যখন দেখলো ভাড়া দিতে বেশ কষ্ট হচ্ছে,বাড়ীর ক্রীতদাসীকে বাজারে বিক্রি করলো।বাড়ীর সব কাজ করার দায়িত্ব,রান্নাবান্না,কাপড় ধোঁয়া,ঘর পরিষ্কার সবকিছুই পড়লো আমার কাঁধে।আমি কোনদিন কোন প্রতিবাদ করিনি,বলিনি, ‘এ ধরণের নীচু কাজ করার মত মেয়ে আমি না’,মুখবুজে মেনে নিয়ে সব কিছু করে গেছি।কিন্ত যখন হাসান রাতে ক্রীতদাসীকে না পেয়ে,আমার দরজায় ধাক্কা দিয়ে,গোলমাল করা আরম্ভ করলো,ঠিক বুঝে উঠতে পারিনি কি করা উচিত আমার।
আমি হয়তো ফিরে যেতে পারতাম বাবার বাড়ীতে,তবে কাজীর আইন মতে আমার স্বামী এখনও জীবিত,আর শ্বশুর পক্ষের সাথে রাগারাগি করে চলে গেলে,আইনের সাহায্য নিয়ে ছেলে দুটাকে তারা নিয়ে যেতে পারে,শুধু তাই না তারা শুধু আমাকে না,বাবাকেও যথেষ্ট হেনস্থা করতে পারে।সত্যি বলতে কি হয়তো আমি হাসানকে নিয়ে সংসারও করতে পারতাম,
মানুষ হিসাবে সে আমার স্বামীর চেয়েও মানসিকভাবে অনেক সহজ সরল,যুক্তিযুক্ত।তবে একটাই ভয় ওর ব্যাবহার ধরণে মনে হচ্ছিল,ঐ সম্পর্ক আমাকে নিয়ে যাবে দাসীর পর্যায়ে।
যাই হউক ওদের আরেকটা ভঁয়,বাবার বাড়ীতে গেলে আমি স্বামীর অংশ দাবী করবো সাথে সাথেই।তাই আমার স্বামীর মৃত্যু নিয়ে তারাও কিছু করতে চাচ্ছিল না,আর সবকিছু দেখে হাসানের সাথে সংসার করার কোন প্রশ্নই উঠে না,তাই ও ভাবেই চলে যাচ্ছিল জীবনটা।
বাড়ীঘর পরিষ্কার করা,রান্নাবান্না,কাপড় ধোঁয়া সবই আমার কাঁধে,আর তার ওপর প্রেম পাগল হাসানকে সামলানো।
অবশ্য এই পরিস্থিতিতে আমার শ্বশুর বা হাসান কেউই খুশী ছিল না,হাসানের বিয়ের কথাবার্তা,চিন্তাও আরম্ভ হলো,কাজীকে ডেকে সাক্ষী দিয়ে আমার স্বামীকে মৃত ঘোষনা করার পদক্ষেপও নিল,আমার শ্বশুর।আর আমার শ্বশুর,হাসান যখন তাকে মৃত হিসেবে মেনে নিতে রাজী হলো,কটা রুপার মোহর দিয়ে সাক্ষী জোগাড় করা একেবারেই কষ্টকর ছিল না।বাগড়া দিল হাসান,তার সর্ত ছিল,আমি বাড়ী ছেড়ে যাব না,উত্তরাধিকারী কোন সম্পত্তিও দাবী করবো না।এটা বোঝানোর জন্যে আমাকে হাসানের সাথে রাত কাটাতে হবে আর তাকে বিশ্বাস করাতে হবে,আমি তার ভালবাসায় পাগল।
হয়তো চেষ্টা করলে,হাসানের প্রেমে পড়তে খুব একটা কষ্ট হতো না,তবে সে আমার চেয়ে আট বছরের ছোট,আর সারাটা সময় আমি তাকে ভায়ের মতই ভেবেছি,সেটা কি আর ভোলা সম্ভব।হাসানের নম্র,বিনয়ী স্বভাব আমি অবশ্যই পচ্ছন্দ করতাম,ছেলেদের সাথে আদর খেলা করা,আমার দিকে তাকিয়ে থাকতো এক তৃষ্ণাত্ব চেহারা নিয়ে,আমি যেন এক গ্লাস চেরীর সরবত।তবে কাজে কর্মে,ব্যাবহারে আমি তার কাছে বাজারের একটা ক্রীতদাসীর,
চেয়েও অধম,মাঝে মাঝে বাবার কাছে কান্নাকাটি,ছেলেদের সাথে বিছানায় জড়াজড়ি করে শুয়ে সময় কাটাতাম শান্তি খোঁজার আশায়,আর হাসান এমন কিছু করেনি,যা আমার মনটা বদলে দিতে পারে।তার আত্মবিশ্বাস ছিল না যে আমি তাকে ভালবাসতে পারি,আর তার বিয়ের পূর্বশর্ত সময়ে সব ঠিক হয়ে যাবে,তাই তার আচার ব্যাবহার কোন সময় ঠিক ছিল না।আমাকে একপাশে নিয়ে জোর করে আদর করা,চুমু খাওয়াতেই সে ব্যাস্ত থাকতো।এর মাঝে সে জোর দিয়ে বলা আরম্ভ করলো,আমার স্বামী কোনদিনই ফিরে আসবে না,আর আমি যদি কারও কাছে কোন অভিযোগ করি,সে খুন করতেও দ্বিধা করবে না,আমাকে।
আমাকে জড়িয়ে কান্না,আর বাচ্চাদের মত ব্যাবহার করা,এর মাঝে প্রেম উদ্ভব হওয়ার সময়টা কোথায়?
মাঝরাতে একদিন,বাচ্চাদের নিয়ে যখন ঘুমিয়ে ছিলাম,হাসান এসে দরজায় ধাক্কাধাক্কি আরম্ভ করলো,উপায় না দেখে,আমি জিনের নাম করে যেন ভঁয়ে চীৎকার করে উঠলাম,আমার শ্বশুর আর আশে পাশের সবাই জেগে উঠলো।শ্বশুর বুঝতে পারলো হাসানের কুবুদ্ধি আর শয়তানীর কথাঃতার ছেলে আপন ভায়ের বৌ,দুই সন্তানের মাকে অযথা যন্ত্রনা দিচ্ছে,ওটা তার কাছেও ছিল অসহনীয়।পরের দিন আমি ফিরে গেলাম বাবার বাড়ীতে,বাবার অসুস্থতার কথা বলে,হাসানের শয়তানী থেকে নিজেকে বাঁচানোর,আর কিইবা উপায়।ফিরে গেলাম,সাথে সংসারের স্মৃতির কিছু জিনিষপত্র,ঘন্টাওয়ালা ঘড়ি,তাব্রিজে তৈরী হাতীর কাজ করা দাবার সেট,আরবের চাবুক,রুপার মোমদানী(অনেক কষ্টে যা আমি হাসানকে বিক্রি করতে দেইনি)।
ঠিক যা ভেবেছিলাম তাই হলো,আমার বাসা ছেড়ে যাওয়ার পর হাসানের অস্বাভাবিক,জঘন্য ভালবাসা নিলs,হতাশার হিস্র একটা রুপ।সে জানে তার বাবা(আমার শ্বশুর)এব্যাপারে তাকে একটুও সমর্থন জানাবে না,তাই ভঁয় দেখানো ছেড়ে সহানুভুতির আশ্রয় নিল সে,একের এক প্রেমের চিঠি লেখা আরম্ভ করলো,কোনটাতে আঁকা নিরুপায় এক পাখী,কোনটাতে কান্নায় ভেসে যাওয়া এক সিংহ,কোনটাতে দুঃখী এক হরিন।আমি অবশ্য লুকাবো না,হাসানের লেখা পড়ে দেখলাম তার মনের অজানা অনুভুতি কোনদিন দেখিনি-ধরে নিচ্ছি চিঠিগুলো তারই লেখা,কোন কবি বা সাহিত্যিক বন্ধুর ভাষার একটা চিঠি না।হাসান চিঠিতে প্রতিজ্ঞা করা আরম্ভ করলো,আর কোন কাজ করতে হবে না আমাকে,তার টাকা পয়সারও অভাব নেই,আয়েসে কাটাতে পারবো বাকী জীবনটা।চিঠির মিষ্টি সুর,ছেলেদের সব সময়ের ঝগড়াঝাটি,আবদার,বাবার অভিযোগ আমাকে যন্ত্রনার চরমে নিয়ে গেছে।তাই এই জানালার স্বস্তির নিঃশ্বাসটা আমার খুবই দরকার ছিল।
হাইরিয়ের রাতের খাবার সাজানোর আগে আরবের খেজুরের ফুলের সাথে এক চামচ মধু আর লেবুর রস দিয়ে হাল্কা একটা খাবার তৈরী করে,বাবার টেবিলে নিয়ে গেলাম।বাবা তখন, ‘অশরীরি আত্মাদের’, নিয়ে লেখা একটা বই পড়ায় মগ্ন,আমিও এক অশরীর মত সবকিছু রেখে চুপিচাপি সরে গেলাম।
‘বাইরে বরফ পড়ছে,নাকি’?এমন কি একটা দূর্বল সুরে ছিল কথাগুলো,যেন ওটাই বাবার জীবনের শেষ শীতটা।
আমি একটা গাছ
আমি একটা গাছ,খুবই একা আমি।বৃষ্টিতে একা কাঁদি,আমি।আল্লাহর ওয়াস্তে দোহাই তোমাদের,আমি যা বলতে চাই একটুঁ শোন তোমরা।কফিটা খেয়ে নাও,ঘুমটা যেন কেটে যায় আর সজাগ মনে আমার কথাগুলো শুনতে কোন অসুবিধা না হয় তোমাদের।অবাক হয়ে দেখ আমাকে যেমন দেখ আগুনের জিনকে আর বলতে দাও আমার একাকীত্বের কথাঃ
১)ওরা বলে গাছের ছবিটা ঠিকমত আঁকা হয় নি,তাড়াহড়া করে একটা খসড়া কাগজে সামঞ্জস্য ছাড়ানো একটা ছবি,যা ঝুলানো থাকবে গল্পকথকের পেছনে।এটা ঠিক যে এ সময়টায় আশেপাশে কোন সুন্দর গাছ নেই আমার পাশে,পাতা জুড়ে কোন মরুদ্যানের গাছ নেই,কোন পাহাড় নেই যা দেখতে শয়তানের মত,কোন মেঘ নেই যা দেখতে চীনদেশের মেঘের পেঁচানো রাজত্বের মত,শুধু আমি,আকাশ আর শূন্যতা,কিন্ত আমার কাহিনী আরও অনেক জটিল।
এরজুমি হোজার শিষ্যদের কি জানা নেই আমার এই অবমাননার কষ্টটা।
৩)একাকীত্বের সবচেয়ে বড় কারণ যে আমি জানিনা আমার অবস্থানটা কোথায়?কথা ছিল আমার গল্পের একটা অংশ হওয়ার তবে আমি এখন হেমন্তের ঝরা পাতা একটা,
জায়গা হয় নি আমার।
তা হলে গল্পটা বলিঃ
আমার হেমন্তের ঝরা পাতার গল্প
আনুমানিক বছর চল্লিশ আগে,পারস্যের শাহ তাহামশাপ,যে ওটোমান সাম্রাজ্যের বেশ বড় একজন শত্রু,তবে শিল্প সাহিত্যের সমজদার,পৃষ্ঠপোষক হিসাবে তার সুনাম ছিল।তবে হঠাৎ আরম্ভ হলো তার পাগলামি-কবিতা,সঙ্গীত,ছবির প্রতি তার উৎসাহ ছিল না আর,এমন কি কফি খাওয়াও ছেড়ে দিল,সমস্ত বুদ্ধি হারানো নতুন এক মানুষ।
পাগলামি,সন্দেহ ভঁরা বুড়ো শাহ তার রাজধানী সরিয়ে নিয়ে গেল,যা তখন পারস্য সাম্রাজের একটা অংশ,তাব্রিজ ছাড়িয়ে কাজভিনে,ওটোমান সাম্রাজের থেকে যার দূরত্বটা অনেক।সে যখন আরও বুড়ো হয়ে গেছে এক সময় জিন ভঁর করলো তাকে,ভয়ে অস্থিরতায় আল্লাহর কাছে সবসময় মাফ চাওয়া আরম্ভ করলো শাহ,প্রতিজ্ঞা করলো আর কোন দিন মদ ছুবে না,কোন কচি বয়সের ছেলেদের কাছে নিয়ে আসবে না,ছবি নিয়েও ব্যাস্ত থাকবে না,কেননা ওগুলো তো সব শয়তানের কাজ।
এটা প্রমান করে যে কফি খাওয়া ছেড়ে দিয়েই,শাহ হারালো তার বুদ্ধিশক্তি সব।
এই কারণেই গত পঞ্চাশ বছরে তাব্রিজের নামকরা কালিগ্রাফী শিল্পী,চারুশিল্পী,বই বাঁধাই এর শিল্পীরা সবাই চলে গেল বিভিন্ন শহরে।সুলতান ইব্রাহিম মির্জা,শাহ তামাশাপের জামাই আর ভায়ের ছেলে,তখন মাসাদে গর্ভনর হিসাবে কাজ করছিল,সব নাম করা শিল্পীদের ডেকে-জামির সাত সাম্রাজের গল্প,ছবি দিয়ে আর নতুনভাবে নকল করার দায়িত্ব দিল-জামি তৈমুর লং এর সময়ের হেরাতের একজন নামকরা কবি।তামাশাপ,তার ভায়ের ছেলেকে বেশ সম্মান করতো আবার হিংসাও করতো,ঈর্ষায় অতিষ্ঠ হয়ে উঠলো বইটার কথা শুনে,তাকে রাগের চোটে মাসাদের গর্ভনরের পদ থেকে সরিয়ে পাঠালো কেইনে,
তারপর একেবারে ছোট্ট একটা শহর সেভজিবারে।বাধ্য হয়ে মাসাদ থেকে তখন
চারুশিল্পী,কালিগ্রাফী,আর বাঁধাই শিল্পীরা গেল অন্যান্য শহরের সুলতান আর শাহজাদাদের কাছে,কাজের জন্য।
অদ্ভুতভাবে সুলতান মির্জার এই চমৎকার বইটা কিন্ত অসমাপ্ত থাকেনি,এই কাজটার দায়িত্ব ছিল একজন লাইব্রেরীয়ানের হাতে।মানুষটা সূদূর সিরাজে যেত ঘোড়ার পিঠে নামকরা চারুশিল্পীদের কাছে,সেখান থেকে আবার দু তিনটা পাতা নিয়ে যেত ইস্পাহানে যেখানে নেস্টালিকের সব নামকরা কালিগ্রাফী শিল্পীরা থাকতো,সেখান থেকে পাহাড় পেরিয়ে যেত বুখারায়,সেখানে নামকরা চারুশিল্পী যারা উজবেক খানের সাথে কাজ করতো,তাদের আঁকা ছবি আর লেখার পাতা নিয়ে যেত হেরাতের বাঁধাইকারীদের কাছে
অনেক প্রশংসা পেত সে,সুলতান ইব্রাহিম মির্জার কাছে।
কিন্ত ওভাবে বইটা তো কোনদিনই শেষ হবে না,তাই লাইব্রেরীয়ান তাতারদের ভাড়া করা হলো বাহক হিসাবে।বই এর পাতা যে গুলো সাজানো নানান ডিজাইনে,বিশেষভাবে অক্ষরগুলো তুলে ধরা,একেকজন তাতারকে চিঠি নিয়ে বিশেষ কাজের জন্য শিল্পীদের কাছে যেত।এ ভাবে বই নিয়ে তারা পারস্য,খোরাসান,উজবেকিস্থান,মঙ্গোলিয়াও গেল।
বইটার কাজ বেশ তাড়াতাড়ি হওয়া আরম্ভ করলো।রাতে,বই এর ১১ আর ২৯ অধ্যায়ের কথা,মাঝে মাঝে কোন সরাইখানা বসে গল্প করার সময় দেখা হতো তাদের,কথা আদানপ্রদান আর পাতাগুলো দেয়া নেয়া,দেখার সূযোগও হতো কোন পাতাটা কোথায় দেখার সূযোগটা।
২৯ শে জানুয়ারি, ২০২১ রাত ২:২১
ইল্লু বলেছেন: ধন্যবাদ
©somewhere in net ltd.
১| ২৮ শে জানুয়ারি, ২০২১ বিকাল ৫:৫৩
রাজীব নুর বলেছেন: সুন্দর ঝরঝরে লেখা।