নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

ছেঁড়াপাতা

হাসান জামাল গোলাপ

ম্যাপল

হাসান জামাল গোলাপ › বিস্তারিত পোস্টঃ

ক্যাম্পাস রাজনীতির কড়চা ও প্রেম

০৬ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১০:২৫


সময়কাল- আশির দশক

লাউড স্পিকারে ভুপেন হাজারিকার গান বাজছে, “মোরা যাত্রী সহযাত্রী একই তরণীর।”

শহীদ মিনারের সামনের মাঠে প্যান্ডেল টাঙানো। বড় লাল ব্যানারে লেখা এক বাম সংগঠনের প্রতিষ্ঠা বার্ষিকীর অনুষ্ঠান। পান্ডেলভর্তি ছাত্ররা বিভিন্ন জায়গা থেকে এসেছে। হেঁটে প্যান্ডেল পার হয়ে ক্লাসে যাচ্ছি। আরো পিছনে দেখলাম অন্য আরেকটি ডান সংগঠনের প্রচুর ছেলে, পিছন থেকে গালিগালাজ করছে - “লাল পতাকার তেজ দেখাস, এই তোদের কাস্তে তোদের পু-... এর ভিতর ঢুকাই দিব,”। আরেকজন বললো, "তোরা তো মস্কোতে বৃষ্টি হলে এখানে ছাতা ধরিস, তোর ছাতা পু-... এর ভিতর ঢুকাই দিব।” ক্যাম্পাসে এই ডান দলটি দাপটে রাজত্ব করে।

ভাষণে ক্লাসে লেকচার ঠিকমত শোনা যাচ্ছে না। স্যার ক্লাসের জানালার বাইরে যে পুকুর আছে সেই দিকে তাঁকিয়ে একমনে লেকচার দিয়ে যাচ্ছেন। আমি সেই পুকুরে কিছু হাঁসের জলকেলী দেখছি।

হঠাৎ পরপর ককটেল ফাঁটার বিকট আওয়াজ হলো। শোরগোল শোনা যাচ্ছে, এরপর আরও ককটেল বিস্ফোরণের আওয়াজ। মাইকে নেতাদের ভাষণ বন্ধ, র্মুহুর্মুহু ককটেল আর গুলির আওয়াজে ক্লাস ভেঙে গেলো, চারিদিকে হৈচৈ, যে যেদিক পারছে জোরে হাঁটছে, দৌড়াচ্ছে। ক্লাস থেকে বের হয়ে হাঁটতে শুরু করলাম। অল্প কিছুক্ষন পরই দেখি আশপাশ সব ফাঁকা। কিছুক্ষণ আগেও এ এলাকা যে রণক্ষেত্র ছিল তা এখন নিরব শান্ত। রৌদ্দুর দুপুরে কেমন যেন মায়াময় লাগছে চারিদিক। কাছেই আর একটি রাস্তা আছে। আমার রাস্তাটি সে রাস্তায় মিলেছে। সেই রাস্তায় একটি মেয়ে হাঁটছে, খোলা চুল কোমর পর্যন্ত দুলছে। বাতাসে সেই চুল কাঁধে ঝোলানো ব্যাগ পেরিয়ে চোখ ঢেকে দিচ্ছে, সে আলতো ভাবে চুল সরায়। আমি তাকিয়ে দেখি, চোখ ফিরাতে পারি না। কি মায়াময় চোখ, এমন কোমল শান্তিময় চেহারা অনুপম, আমি যতই দেখি ততই অবাক হই।

সন্ধ্যায় শুয়ে আছি, সেই মেয়েটির কোমল শান্তিময় ছবি ঘুরেফিরে মনে উঁকি দিচ্ছে, এমন সময় চপল রুমে ঢুকে বললো, খবর শুনেছিস?
- না , কি খবর?
- টোটন ভাইকে হাতুড়ি দিয়ে পিটিয়েছে, ডান পা থেঁতলে দিয়েছে, এখন হাসপাতালে। একবার হাসপাতালে যেতে হবে।

টোটন ভাই আমাদের হলে একই ফ্লোরে থাকেন, সেই বাম সংগঠনের অনুসারী, আনসারীর রুমে আমাদের সাথে ব্রিজ খেলতে আসেন, অত্যন্ত অমায়িক, সবার খোঁজ খবর নেন। আমার যাবার মন নেই, কিছুটা একান্তে থাকতে চাই। তবু যেতে হবে।

হাসপাতালে পৌঁছাতে সন্ধ্যার পার হয় গেলো। টোটন ভাইকে দেখে খুব মায়া হলো, কপাল, মুখে আহত চামড়ায় রক্ত জমে আছে। পায়ে ব্যাণ্ডেজ, স্প্লিন্টার লাগনো। তিনি বয়সে অনেক বড়, বিবাহিত,একটি কন্যা সন্তান রয়েছে, মাস্টার্স অনেক আগেই শেষ করেছেন, পরিবার ফেলে মাসের পর মাস কি এক মায়ায় বিশ্ববিদ্যালয় আঁকড়ে পড়ে থাকেন! জিজ্ঞেস করলাম - টোটন ভাই, আপনার মেয়ে কেমন আছে? উনি জবাব দিলেন না, এত কষ্টের মাঝেও উনার মুখে একটা শান্তির রেশ দেখতে পেলাম। আমি জিজ্ঞেস করলাম, তিথী কোন ক্লাসে পড়ছে?
একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে বললেন, ক্লাস থ্রিতে। এখনি সাঁতার পারে, এবারে পুকুরে তাঁর সাথে সাঁতার কাঁটলাম।
- একদিন আপনার বাড়ি যাবো টোটন ভাই, তিথীর সাথে আমিও সাঁতার কাঁটবো।
বের হয়ে যাচ্ছি সেসময় দেখি সেই মেয়েটি ওয়ার্ডে প্রবেশ করছে। আমি তাঁকে দেখে থমকে দাঁড়ালাম, কি অসম্ভব মমতা আর মায়ায় জড়ানো চোখ। সেই চোখে যেন ব্যাবিলন উদ্যানের সমস্ত সৌন্দর্য ধরা দিয়েছে। মেয়েটি এক ঝলক তাঁকিয়ে চলে গেলো। আমি চপলকে জিজ্ঞেস করলাম, “মেয়েটিকে চিনিস?”
-”না রে চিনি না, কেন বল তো ?”
- “না, এমনি।”
- “মনে ধরলে বল, আজ রাতেই তোর রুমে আনবো।”
চপল একটা সিগারেট ধরালো, হাঁটতে হাঁটতে বললো, “মেয়ে জাতীয় জিনিসের খোঁজ করবি না, মেয়ে গেলে মেয়ে পাবি কিন্ত পড়াশুনা গোল্লায় গেলে আর পাবি না, তুই ডিপার্টমেন্টের টিচার হবি, মন দিয়ে পড়।”

হাসপাতাল থেকে ফিরবার সময় চপল হাউজি খেলতে নিয়ে গেলো। আমাকে এক প্যাকেট চানাচুর দিয়ে বললো, “তোকে দেখে মনে হচ্ছে ছ‍্যাক খাওয়া বার্থপ্রেমিক। ঝাল চানাচুর খা, মন চাঙা হবে। আর দেখতে থাক আমি কি করে রাজা হই।”

স্টেজে হাউজির নম্বর কল শুরু হলো। ডাক এন্ড হেভেন টুয়েন্টি সেভেন, চিংড়ি ফিস নাম্বার সিক্স। লাইন,কর্নার সব শেষ, বাকি থাকলো হাউজ। তাঁর মধ্যে টানটান উত্তেজনা, আর একটি নাম্বার মিললেই আজ রাতের জন্য সে রাজা হয়ে যাবে। চলতে চলতে একটা নাম্বার কল করার সাথে সাথে চপল ইয়েস বলে চিৎকার করে উঠলো। স্টেজে নাম্বার মিলিয়ে দেখলো একটা নাম্বার মিলেনি, সবাই বগি বগি আওয়াজ দিলো। মন খারাপ করে স্টেজ থেকে ফিরে বললো, “চল ফিরে যাই, আজ আর খেলবো না. তুই বড়ো অপয়া, তোর কপালে প্রেম নাই।”

হলে ফিরে মেয়েটির কথা মনে হতে লাগলো, এক ধরণের অস্থিরতায় আচ্ছন্ন হয়ে গেলাম। রুমে, হলের বারান্দায় পায়চারি দিতে দিতে ক্যাম্পাস থেকে বেড়িয়ে উদ্দেশ্যহীন হাঁটতে লাগলাম। হাঁটতে হাঁটতে রেলস্টেশনে চলে এলাম। গভীর রাতে প্লাটফর্মে এক স্বামী-স্ত্রী ছোট বাচ্চা সহ কাঁথা মুড়ি দিয়ে ঘুমাচ্ছে, সেই ঘুমে গভীর মায়া। এক লোক ঘুমাচ্ছে, তাঁর পাশেই একটি কুকুরও ঘুমাচ্ছে। প্লাটফর্মে অপূর্ব মায়ার সব দৃশ্যর সাথে হাঁটতে হাঁটতে মনে হলো সেই মেয়েটিও আমার সাথে ছায়ার মত ঘুরছে।

রেলস্টেশন থেকে খুব সকালে হলে ফিরে আসছি, হলের কাছাকাছি চলে এসেছি, কানে আমার নাম ভেসে আসলো, তাঁকিয়ে দেখি ছোট খুপরি রেস্তুরাঁতে সেই ডান সংগঠনের একজন বড় ভাই আমাকে ডাকছেন, উনি একজন উঁচু স্তরের ক্যাডার, দেখলে সবাই সালাম দেয়, কিন্ত আমাকে কেন জানি সম্মান করেন! ইনারই গতকাল বাম সংগঠনের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর অনুষ্ঠান পন্ড করেছেন। উনার চারিদিকে বসে আরো বেশ কিছু কর্মী সকালের নাস্তা করছে। আমি কাছে এগিয়ে গেলাম। তিনি বললেন, “তোমারে তো পুরাই বিধস্ত লাগতেছে, কৈ গেছিলা?”
“কোথাও না, এমনি সকালে হাঁটতেছি”
“আসো, নাস্তা করো”
“আমার ক্ষুধা লাগেনি ভাই।”
“আরে আসো, নাস্তা কইরা যাও।“
আমি বসলাম, তিনি দোকানের কাজের ছেলেকে বললেন, “এই এরে ভালো কইরা নাস্তা দে।”
আমার বেশ ক্ষুধা পেয়েছিলো, আমি নাস্তা করা শুরু করলাম। সবাই বলাবলি করছে ভার্সিটি অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করেছে, সকাল দশটার মধ্যে হল ছাড়তে হবে। আমি তাড়াতাড়ি খাবার শেষ করে আসলাম, হল বন্ধ করে দিবে, কিছু কাজ গোছাতে হবে।

বাসস্ট্যান্ডে যাবার আগে সেই রেস্তুরাঁতে আবার গেলাম, আমি জানি ইনারা এখানে কেউ নাস্তা খেয়ে ঠিকমত বিল দেবেন না, আমারটাও নিশ্চয় দেন নাই। আমি দোকানির কাছে সকালের নাস্তার কথা উল্লেখ করে কিছু টাকা দিয়ে বললাম, “ভাই আমি পেটের ভিতরের খাবার হারাম করতে চাই না, টাকাটা রাখেন প্লিজ।”

আমি বাড়ি ফিরে আসলাম। মন পড়ে থাকলো ক্যাম্পাসে, শরীরে একরাশ ক্লান্তি অথচ অস্থির মন সারারাত ঘুমাতে দিলো না।

সকালে মা এসে বললো, “কিরে আর কতক্ষণ ঘুমাবি, উঠে পড়। জুঁই এসেছে, ওর মা তোর জন্য চালের পিঠা পাঠিয়েছেন।”
জুঁই আমার চেয়ে তিন বছরের ছোট, নিকটতম প্রতিবেশী, সেই ছোটবেলা থেকে আমরা একসাথে বড় হয়েছি। মা জুঁইকে খুব পছন্দ করেন, আমাদের বাড়িতে এলেই মাকে রান্নাঘরের কাজে সাহায্য করেন। আমি বললাম, শরীর ক্লান্ত লাগছে মা, পিঠা ঘরে পাঠিয়ে দাও। জুঁই উঠোনে ছোট বোনের সাথে কথা বলছে, ছোট বোন রানু তাঁর ভীষণ ভক্ত। সবাইকে খুব বিরক্ত লাগছিল, বের হয়ে বললাম, রানু তোর স্কুল দেরি হয়ে যাবে, স্কুলে যা। জুঁইয়ের এর তাঁকিয়ে বললাম, “কি রে তোর আজকে কলেজ নাই?”
“আছে দাদা।”
“যা বাসায় যেয়ে কলেজের জন্য তৈরী হ।”
রানু, জুঁই দুজনেই ভীষণ অবাক হলো আমার ব্যাবহারে, মুখ কালো করে চলে গেলো।

একাশি দিন পর ভার্সিটি খুললো। আমি সেই মেয়েটিকে খোঁজা শুরু করলাম, এখানে শত শত মেয়ে পড়াশুনা করে, প্রতিটা ফ্যাকাল্টি, ডিপার্টমেন্টের ক্লাসের সামনে দাঁড়িয়ে খুঁজতে লাগলাম।

একদিন খুঁজতে খুঁজতে তাঁকে লাইব্রেরিতে পেয়ে গেলাম। মাথা নিচু করে নোট লিখছে, তাঁর চুলগুলো কপাল, ঘাড়ের পাশ দিয়ে নেমে একটি বইয়ের উপরে ছড়িয়ে আছে, এ দৃশ্য আমার মধ্যে অস্থির আন্দোলন শুরু করলো, ভেতরে এক ধরণের নিরবিচ্ছিন্ন কাঁপুনি হচ্ছিলো, আমি লাইব্রেরী থেকে বেড়িয়ে পড়ি।

মনের মধ্যে এক তোলপাড় চলছে, বাইরে এসেও মন টিকলো না। আমি আবার লাইব্রেরিতে ফিরে আসলাম, তাঁর থেকে কিছুটা দূরেই বসলাম যাতে সে অনুমান করতে না পারে আমি তাঁর জন্যই বসেছি। অল্প কিছুক্ষন পরে দেখলাম লাইব্রেরির শেল্ফে একটা বই রাখলো এবং ব্যাগ গুছিয়ে চলে গেলো। আমার খুব ইচ্ছা হলো দেখি সে কি বই পড়ে, যেয়ে দেখলাম বইয়ের কভারে লেখা ‘ক্যাপিটল, প্রথম খন্ড’, অনুবাদ পীযুষ দাসগুপ্ত। এই বইতে তার নরম হাতের ছোঁয়া রয়েছে, বইটা মুখের কাছে কিছুক্ষণ গন্ধ নিলাম, ভালোবাসার রোমাঞ্চ অনুভব করলাম।

নিউমার্কেট থেকে ফিরে ক্যাম্পাসে ঢুকছি। একটা রজনীগন্ধার মালা কিনেছি, রাস্তায় ছোট্ট এক মেয়ে এমন করে অনুনয় করছিলো যে না কিনে পারিনি। বেশ দূর থেকে দেখলাম সে মেয়েটি রিক্সার জন্যে অপেক্ষা করছে। হটাত বুকে অসীম সাহস হলো, মালাটা তাঁর হাতে দিয়ে আলাপের সূচনা করবো। রিক্সওয়ালাকে তাঁর কাছে থামতে বললাম। তাঁর কাছে পৌঁছানোর আগেই সে রিক্সা পেয়ে উঠে পড়লো। মাথায় অন্য একটি চিন্তা এলো, আমি সোজা লাইব্রেরি চলে এলাম।‘ক্যাপিটল’ বইটি সেল্ফ থেকে নিলাম, ভাবলাম এরকম একটি জটিল অর্থনীতি আর দর্শনের বই তাঁকে নিশ্চয় আরো কিছুদিন স্টাডি করতে হবে। মালা থেকে কয়েকটি ফুল ছিঁড়ে ‘ক্যাপিটল’ বইয়ের ভিতরে রেখে দিলাম, সাথে ভালোবাসার এক ছোট্ট চিরকুট,
“ভালোবেসে, সখী, নিভৃতে যতনে
আমার নামটি লিখো - - তোমার মনের মন্দিরে।”

পরের দিন ক্লাস পার করে লাইব্রেরি আসতে আসতে দুপুর পার হয়ে গেলো। আমি সেল্ফের কাছে যেয়ে সেই বইটি নামালাম এবং খুলে দেখলাম ফুলের পাপড়িগুলো নেই, সাথে সেই চিরকুটও নেই। কিছুটা মন খারাপ হলো, বইটি রাখতে যাবো অমনি দেখি পৃষ্ঠাগুলোর মাঝে কিছুটা ফাঁক, কিছু একটি আছে মনে হয়, বই খুলে সেই অংশে দেখি চিরকুটটা রয়ে গেছে। চিরকুট হাতে নিয়ে দেখলাম এটা আমারি লেখা, কিন্ত অবাক বিস্ময়ে দেখলাম আমার আঁকা হার্টের মাঝামাঝি আরেকটি হার্ট আঁকানো, একটি তীর দুই হার্টের ভিতর দিয়ে চলে গেছে। আমার হাত কাঁপুনি শুরু হলো, নিজের চোখকেই যেন বিশ্বাস করতে পারছি না। রজনীগন্ধা ফুলের পাঁপড়িগুলি সে কি যত্ন করে রেখেছে? সেই পাঁপড়িতে সে কি আমাকে খুঁজে?

আমি ক্লাসের ফাঁকে সময় পেলেই লাইব্রেরিতে আসি, মেয়েটিকে খুঁজে বেড়াই, কিন্তু তাঁর দেখা পাই না। সেল্ফ থেকে বইটি নিয়ে আসি, ভাঁজ করা চিরকুটটা খুলে দেখি। দিনের পর দিন বিভিন্ন সময়ে লাইব্রেরিতে যেয়ে তাঁর দেখা পাই না, কিন্ত খেয়াল করে দেখলাম চিরকুটটা বুকমার্ক হিসাবে পৃষ্ঠার সাথে, বইয়ের খন্ডের সাথে একটু একটু করে এগোচ্ছে। একদিন দেখলাম আমার চিরকুট বুকমার্ক ষষ্ঠ খন্ডের একেবারে শেষ প্রান্তে। এটি সংকলনের শেষ খন্ড, আমার কেন জানি মনে হলো এটি পড়া শেষ হলে সে আর লাইব্রেরি আসবে না, আমার সাথে আর দেখা হবে না।

তাঁর সাথে আর দেখা নাও হতে পারে - এই চিন্তা আমায় অস্থির করে তুললো। অস্থির লাগলে রেলস্টেশনে বা বাসস্ট্যান্ডে যাই, অনেক মানুষের আসা যাওয়া দেখতে বড় ভালো লাগে, অন্যরকম মায়ার পরিবেশ। কোথাও যেতে মন চাইলো না, আমি দিনভর লাইব্রেরিতে রয়ে গেলাম। সন্ধ্যা হওয়ার পর সমস্ত লাইট জ্বলে উঠলো, লাইব্রেরি অনেকটাই ফাঁকা এখন। এলোমেলো হাঁটছি, বসছি আর সেই সেল্ফের দিকে তাঁকাই, মনে হয়, হয়ত এখনি সে বইটি নিবে। হঠাৎ সেল্ফের উল্টো দিক থেকে মনে হলো একটি মেয়ে সেল্ফ থেকে ওই বইটি নিচ্ছে। আমি দ্রুত হেঁটে সেল্ফের দিকে রওয়ানা দিলাম। আমি সেল্ফের কাছে পৌঁছার আগেই সে বইটি রেখে জোরে হেঁটে লাইব্রেরি থেকে বের হওয়ার পথ ধরলো। আমিও পিছন পিছন হাঁটছি, তাঁর খোলা চুল হাঁটার সাথে সাথে দোল খাচ্ছে। আমি কিছুটা দ্রুত হেঁটে তাঁর সামনে এসে দাঁড়ালাম। আমি অবাক বিস্ময়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। এটি সেই মেয়ে নয়, এ আমারি ক্লাসের, নাম তাঁর অঞ্জনা। ক্লাসে তাঁকে কোনদিন দেখে বুঝিনি, এই মুহূর্তে তাঁর চোখ মুখে অব্যাক্ত ভালোবাসা ঠিকরে পড়ছে, ঠোঁট থিরথির করে কাঁপছে, কোমল ভীরুতায় তাঁর হাত থেকে ব্যাগ পরে গেলো। ব্যাগ থেকে বই, খাতা এবং একটি লিপস্টিক বেরিয়ে পড়লো। লজ্জায় সে দু হাত দিয়ে মুখ ঢেকে ফেললো। আমি বড় মায়ায় পড়ে গেলাম, হাঁটু গেড়ে বসে তাঁর ব্যাগে জিনিসগুলো রেখে দিতে লাগলাম। এই মায়াটাই আমার সবচেয়ে বড় ক্যাপিটাল, আজও এই মায়ার ক্যাপিটাল নিয়ে পথ চলি।







মন্তব্য ৬ টি রেটিং +৪/-০

মন্তব্য (৬) মন্তব্য লিখুন

১| ০৬ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:০৭

সোনাবীজ; অথবা ধুলোবালিছাই বলেছেন: Simply speechless. মুগ্ধতায় অভিভূত।

গল্প, নাকি সত্য কথা জানি না। যেভাবে শুরু করেছেন, তাতে সত্য কথা মনে হয়। আবার পোস্টের বিভিন্ন মোড়, টুইস্ট থেকে মনে হয় গল্প। এর আগে এরকম একটা গল্প পড়েছিলাম আপনার, তা থেকে অনুমান করি এটা একটা গল্প। এ ধরনের গল্পের একটা নাম আছে, জনারের নাম ভুলে গেছি - সত্য ঘটনাটাকে গল্প বানিয়ে ফেলা, কিংবা গল্পটাকে সত্য ঘটনার মতো করে বলা। আমার প্রথম দিকের গল্পগুলো তো বটেই, এখনও আমার অনেক গল্প পড়ে পাঠক ধরে নেন যে, এটা আমার পারিবারিক কাহিনি :)

হুমায়ূন আহমেদের 'রূপা' নামের একটা গল্প আছে। নায়ক একদিন পথে হাঁটতে হাঁটতে একটা মেয়েকে দেখতে পেয়ে খুব ভালো লেগে যায়। তার পিছে পিছে হেঁটে মেয়েটির বাড়িতে যায়। এরপর প্রতিদিনই সেই বাড়ির গেটে দাঁড়িয়ে থাকে। মেয়েটিকে প্রতিদিনই ফুল পাঠায়, মাঝে মাঝে চিরকুট। একদিন সে জেদ ধরে, আজ সে মেয়েটির সাথে দেখা করবেই। মেয়েটিকে সে ভালোবাসে, বিয়ে করবে। সে গেটের বাইরে দাঁড়িয়ে রইল। তুমুল বৃষ্টি হচ্ছে, সে যাচ্ছে না। বাড়িতে খবর পাঠালো, কিন্তু তিরস্কারের কথা ফিরে এলো। অনেক চেষ্টা করেও যখন ফেরানো গেল না, তখন মেয়েটি এলো নায়কের কাছে। এসে হাত বাড়িয়ে দিল। নায়ক অবাক হয়ে তার দিকে তাকিয়ে দেখলো - যে মেয়েটিকে দেখে সে এ বাড়িতে এসেছিল, এটি সে মেয়ে নয়। কিন্তু যেভাবে সে হাত বাড়িয়ে দিয়েছে, সে হাত ফেরানো যায় না, আর আসল রহস্যটিও কোনোদিন বলা যাবে না।

ব্লগে পুতুপুতু প্রেমের গল্পের মধ্যে (যেসব গল্প পড়লে আমার চরম বিরক্ত লাগে, লেখকের সাহিত্যমানও খুব নিম্নস্তরের মনে হয়) আপনার গল্পটি অনন্য। মায়াময় চেহারার মেয়েটির সাথে কথা বলিয়ে দিয়ে সঘন প্রেম শুরু করিয়ে না দিয়ে অনেক পরিপক্বতা, স্বাতন্ত্র্য ও সংযমের পরিচয় দিয়েছেন। এটা সত্য ঘটনা হয়ে থাকলে আপনিও অনেক ম্যাচিউরিটি দেখিয়েছেন। জুঁইয়ের উপস্থিতি আবার একটা রহস্য সৃষ্টি করেছিল - ঐ মেয়েটি কিনা। এটা হলে সত্যিই খুব খারাপ হতো, একেবারে নিম্নমানের একটা গল্প হতো।

রেস্টুরেন্টের বিল পরিশোধ করাটাও এক মানবিক দিক উন্মোচন করে।

টোটন ভাইয়ের ঘটনাটা খুব খারাপ লেগেছে। ক্লাস থ্রি-তে পড়া মেয়েসহ দারা পরিবার ফেলে কোন আশায় সে ভার্সিটিতে পড়ে আছে? তাদের ব্যর্থ রাজনৈতিক মোটিভেশনও সুন্দরভাবে তুলে ধরেছেন।

বুক মার্ক চিরকুটটি প্রতিদিন ১ খণ্ড করে এগোনো ছিল একটা চমৎকার আইডিয়া।

৮০'র দশকে আমিও ঢাকা শহরে ছিলাম। ঢাকা কলেজের নর্থ হোস্টেলে থাকতাম। অবসর পেলেই, বিশেষ করে বিকেলে বেরিয়ে পড়তাম। পকেটে টাকা থাকতো খুব কম। ঘুরতে হতো পায়ে হেঁটে। নীলক্ষেতের রাস্তা ধরে টিএসসি - অনেক অনেক যাওয়া হতো। আপনার লেখাটা পড়ার সময় মনে হচ্ছিল, আমিও যেন ঐ পথে হাঁটছি। চারপাশটা করুণ, বিষণ্ণ।

লাস্ট লাইনটা অসাধারণ।

দুর্দান্ত এক পোস্ট।

০৭ ই এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:২২

হাসান জামাল গোলাপ বলেছেন: উত্তর দিতে দেরী হলো, দুঃখিত @সোনাবীজ; অথবা ধুলোবালিছাই, গতকাল মেয়েদের নিয়ে ঈদ কেনাকাটা নিয়ে ব্যাস্ত হয়ে পড়েছিলাম। প্রথমেই আন্তরিক ধন্যবাদ জানাই লেখা পড়ে চমৎকার অনুভূতি প্রকাশ করার জন্যে। আপনার গল্পগুলো আমি ব্লগে সময় পেলে পড়ি এবং আপনি অত্যন্ত উচুঁ মানের গল্প লিখেন, ইদানিং আপনি ছাড়া ভালো গল্প খুব কম আসে ব্লগে।
রাজনীতি নিয়ে ঘটনাগুলো চোখের সামনে ঘটে যাওয়া সত্য। নামগুলো বদলে ফেলেছি, চপল এখন দেশের বাইরে থাকে, PhD করে বিদেশে থাকে, সাদা বিদেশি বউ, ছেলের নাম আকাশ, ভালো বাংলা বলে, বাম রাজনীতি করতো। ডান দলের ক্যাডার ভাই দেশেই থাকেন, আমার সাথে যোগাযোগ নেই, তবে বর্তমানে অত্যন্ত প্রভাবশালী নেতা। অঞ্জনার প্রেম সত্যি, গল্পের খাতিরে কিছুটা রং মাখিয়েছি প্রেজেন্টেবল করার জন্যে।
হুমায়ুন আহমেদের কিছু উপন্যাস পড়েছি, ছোট গল্প পড়া হয় নাই, তবে তাঁর যে কোন সৃষ্টিই অসম্ভব আকর্ষণীয়, এক সিটিংএ শেষ করতাম।
আমি আসলে হলে থাকতাম না, বাসায় থেকেই পড়াশোনা করতাম, কিন্তু হলে আসতাম, আড্ডা দিতাম, রাত পাড় করে ফেলতাম আড্ডা দিয়ে, এলোমেলো ঘুরাফিরা করে। খুব মিস করি সেসব দিনগুলো, অসম্ভব সুখের দিনগুলো ভাবলে বিষণ্ন লাগে, মাঝে মাঝে মনে হয় "কে হায় হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগাতে ভালোবাসে।'
ভালো থাকবেন, অগ্রিম ঈদ মুবারক।

২| ০৭ ই এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:২৭

ঢাবিয়ান বলেছেন: খুব ভাল লাগল পড়ে। ক্যম্পাস নিয়ে কেন যেন খুব কম গল্প উপন্যাসই লেখা হয়েছে। হুময়ুন আহমেদও তেমন একটা লিখেন নাই। অরুন চৌধুরি অনেক আগে বিচিত্রায় সাপ্তাহিক একটা ধারাবাহিক লিখতেন ক্যম্পাসের আনন্দ বেদনা, প্রেম , বিচ্ছেদ ইত্যদিকে উপজীব্য করে।। দারুন সারা জাগিয়েছিল সিরিজটা। আসিফ নজরুলও লিখেছে কয়েকটা উপন্যাস।

আপনি এরকম লেখা জারী রাখুন ব্লগে --

৩| ০৭ ই এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:৩৩

হাসান জামাল গোলাপ বলেছেন: অনেক ধন্যবাদ পড়ে মন্তব্য করবার জন্য @ঢাবিয়ান
যে কয়েকজন কৌতূহল উদ্দীপক লেখা লেখেন, আপনি তাঁর মধ্যে একজন, আপনার লেখা সময় পেলে পড়ি, আলোচনায় অংশ নেয়া উঠে না। ক্যাম্পাস জীবনের প্রেম আরো একটি লেখা লিখেছি এর আগে,ভবিষ্যতে আরো কিছু লেখার ইচ্ছা আছে।
ভালো থাকুন, অগ্রিম ঈদ মুবারক, আপনার জন্য স্পেশাল "হারি রায়া"।

৪| ০৭ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:৪৯

মিরোরডডল বলেছেন:




গোলাপ, অনেকদিন পর ব্লগে একটা চমৎকার প্রেমের গল্প পড়লাম। আমারতো খুবই ভালো লেগেছে।
এটা কি জীবনের গল্প, আই মিন সত্যি ঘটনা বলেই মনে হয়েছে।

আমি দোকানির কাছে সকালের নাস্তার কথা উল্লেখ করে কিছু টাকা দিয়ে বললাম, “ভাই আমি পেটের ভিতরের খাবার হারাম করতে চাই না, টাকাটা রাখেন প্লিজ।”

গল্পের নায়ক যে অতি ভালো একজন মানুষ, সেটা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।

মালা থেকে কয়েকটি ফুল ছিঁড়ে ‘ক্যাপিটল’ বইয়ের ভিতরে রেখে দিলাম, সাথে ভালোবাসার এক ছোট্ট চিরকুট,
“ভালোবেসে, সখী, নিভৃতে যতনে
আমার নামটি লিখো - - তোমার মনের মন্দিরে।”


এটা অনেক রোম্যান্টিক ছিলো।

গল্পের শেষের টুইস্ট টা এক কথায় দারুণ!!!!

গোলাপের কাছ থেকে এরকম গল্প আরও চাই।


০৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৭:২৭

হাসান জামাল গোলাপ বলেছেন: অনেক ধন্যবাদ মিরোরডডল। আপনার মন্তব্য বরাবরই অত্যন্ত উৎসাহবাঞ্জক। ঘটনাগুলো মোটামুটি সত্য, প্রেমের ঘটনায় কিছুটা রং মাখিয়েছি। আশা করছি, এরকম গল্প আরো কিছু লিখবো।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.