নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
ছবি - momjunction.com
উৎসর্গ - আমাদের সমাজ-দেশে বর্তমানে সবচেয়ে বেশী যে জিনিষের অভাব তা হলো ''শুদ্ধাচার''। আর শুদ্ধাচার হারিয়ে যাবার পিছনে যে বা যারা সবচেয়ে বেশী দায়ী তারা হলো "ষড়-রিপু"। ষড়-রিপু'র প্রভাবে আমরা যারা সমাজ ও পরিবেশের নানা উপকরন ব্যবহার করে নিজের জীবনে কিংবা চলার পথে অবৈধভাবে সীমাহীন সুযোগ-সম্পদ অর্জনের পাশাপাশি রাজনৈতিক-প্রশাসনিক ক্ষমতা ব্যবহার করে সমাজে-দেশের সামনে ভাল মানুষের ("শুদ্ধাচারের বিমূর্ত প্রতিকে"র) মুখোশ পরে ভাল মানুষ হিসাবে নিজেকে তুলে ধরে বে-নজীর ( নজিরবিহীন) উদাহরন স্থাপন করেছি - সেই সব সফল মহা নায়ক ও তাদের অনুসারীদের ।
''শুদ্ধাচার'' যদিও একটি মানুষের জীবনে জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত এবং রাষ্ট্রীয় জীবনে প্রতি মুহূর্তে দরকার তথাপি আমাদের দেশে জাতীয় শুদ্ধাচার কৌশল প্রবর্তন হয় ২০১৮ সালে। এর আওতায় গত কয়েক বছরে এমন অনেকেই এ পুরস্কার পেয়েছেন, যারা বিভিন্ন সময় দুর্নীতি, অসততা ও নৈতিকতাহীনতার অভিযোগে অভিযুক্ত হয়েছেন। গণরোষে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী সরকারের ক্ষমতাঘনিষ্ঠ যেসব কর্মকর্তা এ পুরস্কার পেয়েছেন তাদের মধ্যে দুর্নীতির দায় মাথায় নিয়ে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাওয়া সাবেক পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বেনজীর আহমেদ যেমন আছেন ঠিক তেমনি আছেন চারিত্রিক পদস্খলনের দায়ে ওএসডি হওয়া মাদারীপুরের সাবেক জেলা প্রশাসক আহমেদ কবীরও। এছাড়া গত কয়েক বছরে আলোচিত যেসব সরকারি কর্মকর্তা এ পুরস্কার পেয়েছেন, সে তালিকায় নাম রয়েছে পুলিশের সদ্যসাবেক আইজিপি চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন, সাবেক পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার, মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের (মাউশি) সাবেক মহাপরিচালক অধ্যাপক নেহাল আহমেদ, সোনালী ব্যাংকের এমডি মো. আফজাল করিম, এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান আবু হেনা মো. রহমাতুল,যারা একেক জন অশুদ্ধাচারের জীবন্ত কিংবদন্তি। লিংক - Click This Link
আসুন দেখি - শুদ্ধাচার বলতে আমরা কি বুঝি?
শুদ্ধাচার বলতে সাধারণভাবে একজন মানুষের নৈতিকতা ও সততা প্রভাবিত আচরণগত উৎকর্ষ বোঝায়,যেখানে একজন মানুষ তার যেকোন কাজ আচরনে নৈতিকতা ও সততাকে লালন করে থাকে । এর মাধ্যমে একটি সমাজের প্রতিষ্ঠিত কালোত্তীর্ণ মানদণ্ড, নীতি ও প্রথার প্রতি আনুগত্যও বোঝানো হয়।আর ব্যক্তিপর্যায়ে শুদ্ধাচার অর্থে বোঝানো হয় সেই ব্যক্তির কর্তব্যনিষ্ঠা, সততা ও চরিত্রনিষ্ঠা।অর্থ্যাৎ যিনি বাক্য-চিন্তুায়-কর্মে সকল প্রকার লোভ-লালসার উর্ধে নিজেকে নিয়ে যান এবং কামনা-বাসনা তথা ষড়-রিপু'র তাড়নাকে পরাজিত করে নীতি-নৈতিকতা-মানবিকতাকে সবার উপরে স্থান দেন।
এবার আসুন দেখি -"ষড়-রিপু" কে বা কারা :
রিপু শব্দের অর্থ শত্রু বা দুশমন। মানুষের চলার পথে যে মানুষ-জিনিষ-বস্তু মানুষের জন্য ক্ষতিকর বলে বিবেচিত হয় তাই মানুষের শত্রু বা দুশমন বলে বিবেচিত হয়। সাধারনভাবে আমরা নিজেদের চলার পথে একের প্রতি অন্যের বিরুপ ধারনাকারীকেই শত্রু বা দুশমন বলে বিবেচিত করে থাকি। এসব কিছু বাহ্যিক শত্রু বা দুশমন । তবে এ সব কিছু থেকে, একজন মানুষের জন্য সবচেয়ে বড় শত্রু বা দুশমন সে নিজেই তথা তার নফস প্রাণ-আত্মা বা তার কাজ কর্ম। মানুষের আত্মিক উন্নতির পথে যে সব আচরন মানুষের জন্য বাঁধা বলে বিবেচিত করা হয় সে গুলিই আসল রিপু এবং এই রিপু গুলিই একজন মানুষের জীবনে সবচেয়ে বড় শত্রু বা দুশমন। যাকে আরবীতে নফস বলা হয়ে থাকে। আরবীতে নফস শব্দের অর্থ রুহ-প্রাণ-আত্মা, যা সকল প্রাণির দেহেই বিরাজমান এবং মৃত্যুর সময় যা দেহ থেকে বেরিয়ে যায়। মানুষের স্বভাবগত চাহিদা হলো মন্দ কাজ ও কামনা, শয়তানের অনুসরণ,কু-প্রবৃত্তির বাসনা চরিতার্থ করা। যাতে করে যে কোন অবৈধ-হারাম কাজ করা তার জন্য সহজ হয়। তবে যে ব্যক্তি তার নফসকে বা আত্মাকে পরিশুদ্ধ করেছে সেই আল্লাহর রহমত বরকত লাভ করেছেন। এ ব্যাপারে আল কোরআনে মহান আল্লাহপাক বলেন, "সে-ই সফলকাম হয়েছে, যে নিজেকে পবিত্র করেছে।আর সে-ই ব্যর্থ হয়েছে,যে নিজেকে কলুষিত করেছে"। (সুরা আশ শামস,আয়াত - ৯ - ১০)।
পৃথিবীতে সৃষ্ট সকল প্রাণীর মধ্যে মানুষই সর্বশ্রেষ্ঠ। এই শ্রেষ্ঠত্ব অর্জনের পেছনে মানুষের মধ্যে যে বিষয়গুলো ভূমিকা রাখছে তা হলো তার বিবেক, বুদ্ধি, বিচক্ষণতা ও আত্মনিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা। এই সব বিষয়ের প্রভাবের দ্বারা মানুষ ন্যায়-অন্যায়, ভাল-মন্দ, ধর্ম-অধর্মের বিচার বিশ্লেষণ করার ক্ষমতা অর্জন করে করে। এসব বিষয়ের কারনেই মানুষ লাভ করে বিচার শক্তি বা বোধশক্তি যার দ্বারা মানুষ পেয়ে থাকে জীবন ও জগতে সংগঠিত যাবতীয় ক্রিয়াকলাপে নিজেকে খাপ খাইয়ে নেওয়ার বিজ্ঞানসম্মত ক্ষমতা ও দক্ষতা । আবার বিচক্ষণতা বোধের কারনে মানুষ জীবনে আগত ও অনাগত বিষয়ে জ্ঞান অর্জন করে নিজেকে সর্বত্র সাবলীল ও সফল করে তুলতে সক্ষম হয় ও মানুষ তার জীবনের সর্বত্র সংযত,সুসংবদ্ধ ও শৃঙ্খলিত জীবন অনুধাবনে সক্ষম হয়। আর সুন্দর ও আদর্শ জীবন গঠনের উল্লেখিত সূচকগুলো যার কারণে প্রায়ই বাধাপ্রাপ্ত হয় তাদের নামই হলো ষড়রিপু ।এই আমরা সর্বশ্রেষ্ঠ মানুষ, আমাদের মনের অজান্তেই, নফস বা ষড়রিপুর এতখানি বশীভূত হয়ে যাই যে, আমরা আমাদের আত্মীয়, প্রতিবেশী, সমাজ এমনকি দেশের ভয়ঙ্কর ক্ষতি করতে দ্বিধা বোধ করি না নীতি-নৈতিকতা ভূলে।
ষড়রিপু কি -
ষড় অর্থ ছয় আর রিপু অর্থ শত্রু। অর্থাৎ ষড়রিপু অর্থ হলো ছয়টি শত্রু। মানব জীবনে কাম-ক্রোধ-লোভ-মোহ-অহংকার (মদ) ও হিংসা (মাৎসর্য্য) কে একত্রে ষড়রিপু বলা হয়।
ছবি - istockphoto.com
১। কাম রিপু (lust) -
ষড়-রিপুর প্রথম রিপু হলো কাম। কাম শব্দের আভিধানিক অর্থ হলো যৌন সঙ্গকামনা, যৌনক্ষুধা,যৌন বাসনা ইত্যাদি। কাম শব্দের অর্থ যেমন কামনা, আবার মনে যে ভাবের উদয় হলে নারী পুরুষের প্রতি ও পুরুষ নারীর প্রতি আকৃষ্ট হয় তাকেও বলে কাম। কাম শব্দের আভিধানিক প্রতিশব্দ হলো সম্ভোগেচ্ছা। এই কামশক্তি মানুষের জন্য অপরিহার্য। কামশক্তি নেই সম্ভবত এমন কোন প্রাণীই পৃথিবীতে নেই।এই শক্তি ব্যতিরেকে যে কোন জীব এবং একজন মানুষ স্বাভাবিক জীবনে অপূর্ণ জীব-মানুষ বলে বিবেচিত হয়। সুতরাং, প্রত্যেক মানুষের মধ্যেই থাকা দরকার কামশক্তি তবে সেই কামশক্তি হতে হবে নিয়ন্ত্রিত। এই নিয়ন্ত্রিত কামশক্তি যখন অনিয়ন্ত্রিত, বেপরোয়া ও বেসামাল হয়ে যায় তখনই তা হয়ে যায় মানুষের শত্রু বলে বিবেচিত হয়। অনিয়ন্ত্রিত কামশক্তি জন্ম দেয় পারিবারিক অশান্তি ও ভাংগন ও সামাজিক জীবনে তৈরী করে নানা সমস্যা ও জীবনকে করে তোলে জটিল।
মানুষ যদি কাম রিপুর বশীভূত হয়ে কাম রিপুর দাসত্ব করে তাহলে সে চরিত্রহীন হয়ে পড়ে এবং জ্ঞান শুন্য হয়ে অমানুষে পরিণত হয় ও পরে ধর্মহীন হয়ে সে পাষণ্ডে রূপান্তরিত হয়। সে সমাজে নানা রকমের অসামাজিক কাজ করে সমাজ কে কলুষিত বা দূষিত করে । ষড়রিপুর মধ্যে কাম রিপু-ই সর্বাপেক্ষা দুর্জয় রিপু। ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে কাম রিপু মানুষের সকল ভাল কাজকর্ম ,সৃষ্টিকর্তার ইবাদত-উপাসনা মানুষের প্রতি দয়া-মায়া ইত্যাদি সব ভাল কাজে বাধা প্রদান করে।আর যে হৃদয় ভালো-মন্দ নিরূপণ করতে পারে না। সব কিছু স্পষ্ট হলেও সে থাকে অন্ধের মতো। এ ব্যাপারে আল্লাহ বলেন, "তারা কি দেশ ভ্রমণ করেনি? তাহলে তারা জ্ঞান-বুদ্ধিসম্পন্ন হৃদয় ও শ্রুতি-শক্তিসম্পন্ন কর্ণের অধিকারী হতে পারতো। বস্তুতঃ চক্ষু তো অন্ধ নয়, বরং অন্ধ হচ্ছে বক্ষস্থিত হৃদয়"। (সুরা হজ, আয়াত - ৪৬)
ছবি - zeenews.india.com
আবার অন্যদিকে কাম শব্দের অর্থ কামনা - কামনার দ্বারা মানুষ জীবনে বেঁচে থাকার শক্তি পায়। কামনা আছে বলেই মানুষ মানুষকে ভালবাসে, ঘর বাঁধে, সংসারধর্ম পালন করে। কামনা আছে বলেই মানুষ ব্যক্তিগত বা সমষ্টিগত ভাবে বড় বড় মহৎ উদ্দেশ্য গ্রহণ ও তা বাস্তবায়নের আপ্রাণ চেষ্টা করে। তাই , কাম একেবারে খারাপ কিছুও নয় তবে কামের নিয়ন্ত্রিত ব্যবহারই জীবনের সাফল্যের মূলমন্ত্র।
কাম রিপু থেকে মুক্তির উপায় -
কাম বা আসক্তি থেকে মুক্তির উপায় একমাত্র আমি-আপনি এবং আমাদের মন নিজেই। আর তাই আমাদের মনকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করতে হবে যেন কাম আমাদেরকে নিয়ন্ত্রণ না করতে পারে। যে জিনিসে আমাদের আসক্তি অনুভব হয় সেটা থেকে দূরে থাকতে হবে ।
যে অন্তর আল্লাহর পথে পরিচালিত,সে নিশ্চিন্ত মনে সব কিছু আল্লাহর কাছে সোপর্দ করে দেয়। আর যখন কেহ আল্লাহর সব কিছুতে সন্তুষ্ট থাকে তখান তাহার নিকট কোন রিপু আসতে পারেনা। এ ব্যাপারে আল্লাহ বলেন,"আল্লাহর অনুমতি ছাড়া কোন বিপদই আপতিত হয় না এবং কেউ আল্লাহর উপর ঈমান রাখলে তিনি তার অন্তরকে সুপথে পরিচালিত করেন। আর আল্লাহ্ সবকিছু সম্পর্কে সম্যক অবগত"।(সুরা তাগাবুন,আয়াত - ১১)।
কাম সর্বপ্রথম ইন্দ্রিয়ে প্রবিষ্ট হয়ে মন ও বুদ্ধিকে মোহিত করে এবং এর দ্বারা মানুষকে মোহিত করে। মন, বুদ্ধি ও ইন্দ্রিয়গুলো হচ্ছে এর আবাসস্থল বা অবলম্বন। তাই প্রথমে ইন্দ্রিয়গুলোকে নিজের বশে এনে এই কাম রুপী শত্রুর বিনাশ করতে হবে।যদিও, কাম কে জয় করা যায় না কারন কাম আল্লাহ-ঈশ্বরের সৃষ্টি এবং প্রানী জগৎকে রক্ষার জন্য এর প্রয়োজনীয়তাও আছে, তবে তাকে নিয়ন্ত্রিত করা যায় এবং কামের নিয়ন্ত্রিত ব্যাবহারই মানুষের জন্য মংগল। অন্যদিকে সকল মানুষকেই নিজ নিজ ধর্ম মতে এবং ধর্ম নির্দেশিত পথে নিয়মিত প্রার্থনা করলে ,তাকওয়া অবলম্বন করেল, সংযত জীবন যাপন করলে এবং অন্যকে নিঃস্বার্থ ভালবাসতে শিখলে ও ভাল কর্ম করলে - কাম নিজে পথ ছেড়ে দেয়। আর তাই, মানব জীবনে যারা এই কামশক্তিকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে তারাই জীবনে সুখ, সমৃদ্ধি,মান,সম্মান লাভ করে ও তারাই পৌছাতে পারে সফলতার শীর্ষে এবং পাওয়া যায় কামাসক্তি থেকে মুক্তি ।
=================================================================
ছবি - prothomalo.com
২। ক্রোধ রিপু (anger) -
ষড় রিপুর দ্বিতীয় রিপু হলো ক্রোধ। ক্রোধ শব্দের অর্থ হলো রোষ,দ্বেষ,ক্ষিপ্ততা,উষ্মা,গর্জন করা,উন্মাদনা,প্রতিশোধ নেবার ইচছা প্রভৃতি। ক্রোধের অপর নাম রাগ। রাগ ধ্বংস করে দিতে পারে একজন মানুষের জীবন,সম্পদ,সম্মান এবং পারিবারিক ও সামাজিক সম্পর্ক। জীবনে নেমে আসতে পারে বিপর্যয়। ক্রোধ বা রাগের ব্যাপারে আল কোরআনে বলা হয়েছে,"যারা সচ্ছল ও অসচ্ছল অবস্থায় দান করে, ক্রোধ সংবরণ করে এবং মানুষকে ক্ষমা করে থাকে।আর আল্লাহ (বিশুদ্ধচিত্ত) সৎকর্মশীলদেরকে ভালবাসেন"।(সুরা আলে ইমরান, আয়াত - ১৩৪)।
ক্রোধ বা রাগ দুই প্রকার। যথা - ১। রাগ ২। অনুরাগ।
ছবি - jagonews24.com
১। রাগ - মানুষ রাগের বশীভূত হয়ে অতিতুচ্ছ বিষয় নিয়ে লঙ্কাকাণ্ড ঘটিয়ে ফেলে, যার ফলশ্রুতিতে সে তার নিজের জীবনে, সংসারে, সমাজে অশান্তি বয়ে আনে। তাই রাগ কে সম্বরণ করে ধৈর্য্য ধারণ করাই জ্ঞানীর পরিচয়। রাগ হচ্ছে ধ্বংসাত্মক বা ক্ষতিকারক আর অনুরাগ হচ্ছে সৃজনশীল ও কোন মহৎ উদ্দেশ্য বা সাধনা বাস্তবায়নের সোপান স্বরূপ। রাগ নিয়ন্ত্রণ আল্লাহকে সন্তুষ্ট করে। যে ব্যক্তি রাগ নিয়ন্ত্রণ করে, সে আধ্যাত্মিকভাবে এবং জাগতিকভাবেও পুরস্কৃত হয়। নবীজি (সাঃ) বলেন,"যে ব্যক্তি নিজের ক্রোধ চরিতার্থ করার ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও তা সংবরণ করে, আল্লাহ তাকে কিয়ামতের দিন সমগ্র সৃষ্টির সামনে ডেকে আনবেন এবং জান্নাতের যেকোনো হুর নিজের ইচ্ছামতো বেছে নেওয়ার অধিকার দান করবেন"।(ইবনে মাজাহ, হাদীস নং - ৪১৮৬)। রাসুলুল্লাহ (সাঃ) আরও বলেন,"আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য বান্দার ক্রোধ সংবরণে যে মহান প্রতিদান রয়েছে, তা অন্য কিছুতে নেই।’ (ইবনে মাজাহ,হাদীস নং - ৪১৮৯)।
এ ব্যাপারে আল্লাহপাক আল কোরআনে বলেন,"সুতরাং তোমাদেরকে যা কিছু দেয়া হয়েছে তা দুনিয়ার জীবনের ভোগ্য সামগ্রী মাত্র। আর আল্লাহর কাছে যা আছে তা উত্তম ও স্থায়ী, তাদের জন্য যারা ঈমান আনে এবং তাদের রবের উপর নির্ভর করে। আর যারা কবীরা গোনাহ ও অশ্লীল কাজ থেকে বেঁচে থাকে এবং যখন রাগান্বিত হয় তখন তারা ক্ষমা করে দেয়"।(সুরা আশ-শুরা,আয়াত-৩৬ - ৩৭)।
ছবি - gettyimages
২। অনুরাগ - অনুরাগ হলো বাস্তব বা কাল্পনিক কোনাে বস্তু বা অবস্থার প্রতি এক বিশেষ অনুভূতি যা ব্যক্তিকে কিছু করতে অনুপ্রাণিত করে। কোন মহৎ কাজে সফল হতে হলে তার জন্য অনুরাগ থাকতেই হবে, অনুরাগ না থাকলে বিপথগামী রিপু ও ইন্দ্রিয়কে বশীভূত করা যায় না। মানুষ তার জীবনে রাগের বশবর্তী হয়ে যত কাজ করে তার সামান্যতম যদি অনুরাগের সাথে মহৎ উদ্দেশ্য গ্রহণ ও তা বাস্তবায়নের চেষ্টা করে তাহলে সে মহৎ কাজে সিদ্ধিলাভ করে। অনুরাগের একটি ভালো উদাহরণ হলো কালিদাসের কাহিনী।পূর্বে মূর্খ কালিদাস এই অনুরাগের জন্যই কবিত্বশক্তি অর্জন করেন এবং মহাকবি হন এবং রাজা বিক্রমাদিত্যের সভায় তিনি নবরত্ন হিসাবে বিশেষায়িত হন ।
ক্রোধ রিপু থেকে মুক্তির উপায় -
ক্রোধ খুবই দুর্জয় রিপু। ক্রোধ রিপুকে বশীভূত করতে না পারলে জীবনের কোন কাজেই সফলতা আসে না। ক্রোধকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারলে তার মধ্যে শিষ্টাচার,ভদ্রতা,আত্মপ্রতিষ্ঠা বাড়ে এবং সে সহজে সাফল্য অর্জন করতে পারে। ক্রোধ রিপুকে বশীভূত করতে হলে ধৈর্য্য, সহনশীলতা ও ক্ষমা গুণের অধিকারী হতে হয়। মনকে সব সময় শান্ত রাখার চেষ্টা করতে হবে এবং হঠাৎ করে বা রাগের মাথায় কোন কাজ করা থেকে বিরত থাকতে হবে। যে কোন সমস্যারই সমাধান আছে এবং ঠান্ডা মাথায় ভাবলে সকল সমস্যারই সমাধান মিলে। আর তাই আমাদের সকলকে ঠান্ডা মাথায় ভেবে সমস্যার সমাধানের চেষ্টা করা উচিত। (যে কোন সমস্যায় বা সিদ্ধান্ত গ্রহনের সময় তড়িঘড়ি কিংবা রাগ-অনুরাগে প্রভাবিত না হয়ে ধীর-শান্ত ভাবে ভেবে কমপক্ষে ৬ ঘন্টা সময় নিয়ে সিদ্ধান্ত নিলে ভাল ফল লাভ করা যায়)।
=================================================================
ছবি - svpow.com
৩। লোভ রিপু (greed) -
ষড় রিপুর তৃতীয় রিপু হলো লোভ। অতৃপ্ত কামনা-বাসনা-রসনাকে তৃপ্ত করার ও অপ্রাপ্তি বস্তুকে প্রাপ্তির প্রবল ইচ্ছার নাম লোভ। মানুষ যখন লোভের বশীভূত হয়ে পড়ে তখন তার মানবতা,বিবেক, বিচক্ষণতা,আত্মনিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা ও সৎ বুদ্ধি লোপ পায়। সে স্বপ্নচারী হয়ে স্বপ্নের সংসারের রাজা হয়ে লোভে অন্ধ হয়ে পরে। তখনই সে লোভের নরকে নিক্ষিপ্ত হয়ে যায় এবং সমস্ত বিপদ ও ভয়াল সর্বনাশ তাকে ঘিরে ফেলে। লোভ-লালসা মানুষের অন্তরের মারাত্মক ব্যাধি। সীমাহীন লোভ-লালসা মানুষকে তার সামর্থ্যের বাইরে ঠেলে দেয়। তার বিবেক-বুদ্ধি লোপ করে তাকে দুর্নীতি ও পাপের পথে পরিচালিত করে। দূর্নীতি,চুরি-ডাকাতি, ছিনতাই-চাঁদাবাজি সহ অধিকাংশ সামাজিক অনাচার বা বিপর্যয়ের পেছনে লোভ-লালসার বিরাট প্রভাব রয়েছে। তাই রাসুলুল্লাহ (সাঃ) লোভ-লালসাকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে বলেছেন,"তোমরা লোভ-লালসা থেকে বেঁচে থাকো, কেননা এ জিনিসই তোমাদের পূর্ববর্তীদের ধ্বংস করেছে এবং পরস্পরকে রক্তপাত ঘটানোর ব্যাপারে উসকিয়ে দিয়েছে। লোভ-লালসার কারণেই তারা হারামকে হালাল সাব্যস্ত করেছে"। (মুসলিম শরীফ) ।
লোভের ব্যাপারে সতর্কতা অবলম্বনের জন্য পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, " আর যা দ্বারা আল্লাহ তোমাদের কাউকে কারো উপর শ্রেষ্ঠত্ব দিয়েছেন তোমরা তার লালসা করো না। পুরুষ যা অর্জন করে তা তার প্রাপ্য অংশ এবং নারী যা অর্জন করে তা তার প্রাপ্য অংশ । আর আল্লাহর কাছে তার অনুগ্রহ প্রার্থনা কর, নিশ্চয় আল্লাহ সবকিছু সম্পর্কে সর্বজ্ঞ"।(সূরা আন-নিসা, আয়াত - ৩২)। এ ব্যাপারে আল কোরআনে আরো বলা হয়েছে, " আর আপনি আপনার দু'চোখ কখনো প্রসারিত করবেন না সে সবের প্রতি, যা আমরা বিভিন্ন শ্রেণীকে দুনিয়ার জীবনের সৌন্দর্যস্বরূপ উপভগের উপকরণ হিসেবে দিয়েছি, তা দ্বারা তাদেরকে পরীক্ষা করার জন্য। আর আপনার রব-এর দেয়া রিযিকই সর্বোৎকৃষ্ট ও অধিক স্থায়ী "।(সূরা ত্বাহা, আয়াত - ১৩১)।
ছবি - pixabay.com
লোভ রিপু থেকে মুক্তির উপায় -
লোভ খুবই দুর্দমনীয় রিপু। অতিরিক্ত লোভের কারণে মানুষ বিবেকহীন হয়ে মনুষ্যত্ব, ধর্ম-কর্ম হারিয়ে ফেলে। লোভ রিপুকে বশীভূত করতে হলে একান্তভাবে ধৈর্যশীল-আত্মসংযমী হতে হবে। ধৈর্য-সংযম অভ্যাস দ্বারা ও বিবেক বোধকে জাগ্রত করে লোভ রিপুকে বশীভূত করা যায়।যেহেতু লোভ মানুষের সব দুর্নীতি ও অপকর্মের মূল উৎস, তাই ইহলৌকিক ও পরকালীন জীবনে সাফল্যের জন্য লোভ-লালসার কবল থেকে নিজেকে রক্ষা করতে আপ্রাণ চেষ্টা চালাতে হবে। মানুষকে সৎ চরিত্রবান হতে হলে, মনুষ্যত্ব অর্জন করতে হলে ও আদর্শ সুশীল সমাজ গড়তে হলে প্রত্যেক ধর্মপ্রাণ মানুষ তথা মুমিন মুসলমানের উচিত জীবনের সর্বক্ষেত্রে লোভ-লালসা বর্জন করে দুর্নীতিমুক্ত জীবনযাপনে সততা ও ন্যায়নিষ্ঠার অনুশীলন করা এবং নিজ নিজ ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলা।
====================================================================
ছবি - helpguide.org
৪। মোহ রিপু (attachment)-
ষড় রিপুর চতুর্থ রিপু হলো মোহ। স্বপ্ন কে সত্যি, অবাস্তবকে বাস্তব মনে করে এবং ইন্দ্রিয় গ্রাহ্য ক্ষণস্থায়ী কিছু কিছু বিষয়ের উপর ভ্রান্তধারণা পোষন করে তাতে মোহিত হয়ে থাকার নামই মোহ। যেমন অর্থ-সম্পদের মোহ, রূপের মোহ, পূরুষের পরস্ত্রীতে মোহ, নারীর পরপূরুষের উপর মোহ,সংসারের মোহ, নেশার মোহ ইত্যাদি। মোহ শব্দটি অজ্ঞানতা, অবিদ্যা, মুর্খতা, মূঢ়তা, নির্বুদ্ধিতা, ভ্রান্তি, মুগ্ধতা, মায়া, ইত্যাদি অর্থেও ব্যবহৃত হয়ে থাকে। মোহ ষড় রিপুর মধ্যে অন্যতম একটি রিপু। কাম, ক্রোধ, লোভ, মদ ও মাৎসর্য এ সবকটির উপর মোহ প্রভাব খাঁটিয়ে থাকে। অর্থাৎ মোহ দোষে দূষিত ব্যক্তি বাকি পাঁচটি রিপুকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। তাকে যে কোন রিপু অতি সহজেই গ্রাস করতে পারে।
মায়া হলো মোহ রিপুর একটি অন্যতম বৈশিষ্ট্য। অতিমায়া বা দয়া ক্ষেত্র বিশেষে এতই ক্ষতিকর যে তা আর পুষিয়ে নেয়ার কোন উপায় থাকে না। যেমন- জীব হত্যা মহাপাপ। কিন্তু কোন বিষধর সাপকে যদি কেউ মায়া করে ছেড়ে দেয় তাহলে সে সাপটিই তাকে কামড় দিয়ে হত্যা করতে দ্বিধান্বিত হবে না। কাজেই মোহ বা মায়া সর্বত্রই গ্রহণযোগ্যতা পায় না। একজন অধার্মিক বা মুর্খকে তার গুরুতর কোন অপরাধের পর নিঃশর্ত বা শুধু শুধুই ছেড়ে দিলে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই সে তার মূল্য রক্ষা করে না। কারণ সে মুর্খ বা মোহাবিষ্ট। সে তার নিজের সর্ম্পকে, সমাজ, পরিবেশ সম্বন্ধে যথাযথ জ্ঞানসম্পন্ন নয়।
মোহ বা সুপ্তবাসনা মানুষের মনের মাঝে লুকিয়ে থাকে, অনুকূল পরিবেশ পেলে সেই সুপ্ত বাসনা জেগে উঠে। মোহ বা লালসা দু’প্রকার।
১। প্রথম প্রকার - রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা ও ধন-সম্পদ অর্জনের মাধ্যমে সম্মান লাভের প্রয়াস। এটি খুবই মারাত্মক। কেননা অধিকাংশ ক্ষেত্রে এ ক্ষমতা মানুষকে আখেরাতের কল্যাণ ও মান-সম্মান থেকে বিরত রাখে। এ ব্যাপারে আল্লাহপাক আল কোরআনে বলেছেন , " এটা আখেরাতের সে আবাস যা আমরা নির্ধারিত করি তাদের জন্য যারা যমীনে উদ্ধত হতে ও বিপর্যয় সৃষ্টি করতে চায় না। আর শুভ পরিণাম মুত্তাকীদের জন্য''। (সুরা ক্বাছাছ,আয়াত - ৮৩)।
২। দ্বিতীয় প্রকার - ধর্মীয় বিষয়াদির মাধ্যমে সম্মান অর্জনের প্রয়াস। যেমন দ্বীনী বিদ্যা, আমল-আখলাক, তাক্বওয়া-পরহেযগারিতা,সংসারে অনাসক্তি ইত্যাদির মাধ্যমে জনগণের নযর নিজের দিকে ফেরাতে চেষ্টা করা। এটি প্রথম প্রকারের থেকেও জঘন্য ও কদর্য। এর বিপর্যয় ও ভয়াবহতা আরো মারাত্মক। তাদের মনে এরকম মোহ থাকে যে, তারা দ্বীনী বিদ্যা, আমল ও পরহেযগারিতা দ্বারা মানুষের উপর তাদের নেতৃত্ব ও শ্রেষ্ঠত্ব যাহির করা যাতে মানুষ তাদের প্রতি অনুগত থাকে। তাদের সামনে মাথা নত করে এবং তাদের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ রাখে এই শ্রেণীর বিদ্বানরা সেটাই আশা করে। এ ব্যাপারে আল কোরআনে বলা হয়েছে, "কেউ পার্থিব সুখ-সম্ভোগ কামনা করলে আমি যাকে যা ইচ্ছা সত্বর দিয়ে থাকি, পরে তার জন্য জাহান্নাম নির্ধারিত করি, সেখানে সে প্রবেশ করবে নিন্দিত ও অনুগ্রহ হতে দূরীকৃত অবস্থায় "।( সুরা ইসরাঈল,আয়াত - ১৮)
মোহ রিপু থেকে মুক্তির উপায়-
মোহমুক্তির প্রধান উপায় হলো তাওবাহ ও ইস্তিগফার করা। তওবা মানে হলো পাপ ছেড়ে পুণ্যে মনোনিবেশ করা। ইস্তিগফার হলো কৃত অপরাধের জন্য লজ্জিত ও অনুতপ্ত হয়ে ক্ষমা প্রার্থনা করা এবং পুনরায় ওই অপরাধ বা পাপ না করার অঙ্গীকার করা ও দৃঢ়সংকল্প হওয়া।মানুষ যে কোন সময়ই শয়তানের ধোঁকায় বা রিপুর তাড়নায় অথবা পারিপার্শ্বিক পরিবেশ ও পরিস্থিতির প্রভাবে পাপ করে এবং পাপ করার পর লজ্জিত, অনুতপ্ত হয়ে আল্লাহপাকের নিকট তওবা করা। তাছাড়াও-
জ্ঞানীজনের উপদেশ,সৎসঙ্গ,সৎগুরু ও সাধুসঙ্গ ছাড়া মোহ রিপু থেকে মুক্তি পাওয়া যায় না,আর তাই সবসময় মানুষের উচিত জ্ঞানী-গুনীদের সাথে চলা এবং ধর্মীয় বিধি-বিধান অনুসরন করা। মানুষ মোহের বশবর্তী হয়ে যখন তার জীবন অতিবাহিত করে,তখন যদি সে কোন ভাবে তার মনের সামান্যতম অংশে সে মানুষ ও প্রকৃতিকে ভালবাসা ও ঈশ্বরকে পাওয়ার মোহ সৃষ্টি করতে পারে,তাহলে সে ধীরে ধীরে মোহ রিপু থেকে মুক্তি পায় এবং মানব জীবনে আসে পরম শান্তি ।
===================================================================
ছবি - shutterstock.com
৫। মদ রিপু বা অহংকার রিপু -
ষড় রিপুর পঞ্চম রিপু হলো মদ বা অহংকার। অহংকার হলো দম্ভ,গর্ব, আত্মগৌরব ইত্যাদি। অহংকার রিপু হচ্ছে কাম-ক্রোধ-লোভের অতি মাত্রার বহিঃ প্রকাশ। অহংকার মানুষকে তার প্রকৃত অবস্থা থেকে বিকৃত করে দেয় এবং তার আসল রূপটি লোপ পায়। অহংকারী মানুষদের অধিকাংশই আত্মশ্লাঘায় ভোগে। এই আত্মশ্লাঘা (নিজের প্রশংসা) তার নিজের মধ্যে নিহিত আত্মবোধ বা আত্মদৃষ্টিকে ধ্বংস করে দেয়। ফলে সে পৃথিবীর সবকিছুকেই সে তুচ্ছ-তাচছিল্য মনে করে ধরাকে সরাজ্ঞান করে থাকে। অহংকার জীবনের অর্জিত বা সঞ্চিত যাবতীয় সম্পদকে চোখের নিমেষে ধ্বংস করে দিতে পারে। যার ভেতর অহংকারে পরিপূর্ণ,সে ভালো জিনিসের অনুসরণ করতে পারে না। এমনকি আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের আনুগত্য তার জন্য অহংকার অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়। নিজেকে প্রবল ক্ষমতাধর মনে করে। এ ব্যআপারে আল্লাহপাক বলেন,''যারা নিজেদের কাছে (তাদের দাবীর সমর্থনে) কোন দলীল-প্রমাণ না আসলেও আল্লাহর নিদর্শনাবলী সম্পর্কে বিতণ্ডায় লিপ্ত হয়। তাদের এ কাজ আল্লাহ্ ও মুমিনদের দৃষ্টিতে খুবই ঘৃণার যোগ্য। এভাবে আল্লাহ্ মোহর করে দেন প্রত্যেক অহংকারী, স্বৈরাচারী ব্যক্তির হৃদয়ে''। (সুরা গাফের, আয়াত - ৩৫)।
কথায় বলে- অহংকার পতনের মূল। অনেক সময় লক্ষ্য করা যায় যে, মানুষ অনেক সাধনা করে, ত্যাগ করে যা কিছু অর্জন করে তা সে অহংকারের কারণে ধরে রাখতে পারে না। তার অহংকার ধীরে ধীরে তাকে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যায়। অহংকারী মানুষ আত্মপ্রতিষ্ঠার জন্য খুব বেশি পীড়াপীড়ি করে থাকে। সর্বত্রই চায় তার সর্বোচ্চ সাফল্য এবং তাতে আত্মঅহংকারে স্ফীত হয়ে নিজের শ্রেষ্ঠত্ব জাহির করার প্রাণান্ত চেষ্টায় বিভোর-বিহবল হয়ে পড়ে। ফলে শ্রেষ্ঠত্বের স্বীকৃতি তো পায়ই না উপরন্তু হীন ও ক্ষুদ্র বলেই স্বীকৃতি পায়। অহংকার রিপুর বশবর্তী মানুষের সাধারণত সৃষ্টিকর্তা-আল্লাহ-ইশ্বরে ভক্তি থাকে না, তার অতিদ্রুত মতিভ্রম ঘটে এবং এক পর্যায়ে মানুষের কাছে হেয় প্রতিপন্ন হয়।
ইসলামের দৃষ্টিতে অহংকার একটি কবিরা গুনাহ। অহংকার মানুষকে জাহান্নাম পর্যন্ত পৌঁছিয়ে দেয়।আল কোরআনে আল্লাহ মানুষকে অহংকারের পাপ ও তার ভয়াবহ পরিণতি বিষয়ে সাবধান করে বলেন, "নিশ্চয় যারা আমার আয়াতসমূহে মিথ্যারোপ করে এবং তা সম্বন্ধে অহংকার করে তাদের জন্য আকাশের দরজা খোলা হবে না এবং তারা জান্নাতেও প্রবেশ করতে পারবে না যতক্ষন না সূঁচের ছিদ্র দিয়ে উট প্রবেশ করে।আর এভাবেই আমরা অপরাধীদেরকে প্রতিফল দেব"। (সূরা আরাফ,আয়াত - ৪০)।
"অহংকার পতনের মূল "- এ কথা দুনিয়ায় প্রচলিত সকল ধর্মে ও সমাজে প্রচলিত। নৈতিক মূল্যবোধের জায়গা থেকে এটি যেমন সত্য, ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকেও এ কথা প্রমাণিত যে অহংকার ও দাম্ভিকতা পতন ডেকে আনে। আত্ম-অহমিকা, দাম্ভিকতা ও অহংকার গর্হিত অপরাধ। অহংকারী মানুষকে আল্লাহ খুব অপছন্দ করেন।এ ব্যাপারে আল কোরআনে বলা হয়েছে, " নিঃসন্দেহ যে, আল্লাহ জানেন যা তারা গোপন করে এবং যা তারা ঘোষণা করে। নিশ্চয় তিনি অহংকারীদের পছন্দ করেন না"। (সুরা নাহল, আয়াত - ২৩)।
অহংকার রিপু থেকে মুক্তির উপায় -
অহংকার রিপু থেকে মুক্তি পেতে হলে সৃষ্টিকর্তা-আল্লাহ-ইশ্বরে ভক্তি এবং বিশ্বাস প্রয়োজন। মনের মধ্যে ভাবা দরকার আমি জীবনে যা কিছু পেয়েছি তাহা সব সৃষ্টিকর্তা-আল্লাহ-ইশ্বরের দয়ায়। সমাজের উচুতলার ধনী লোকের দিকে নজর না দিয়ে, গরীব-দুঃখী ও শারীরিক ভাবে প্রতিবন্ধীদের দিকে গভীরভাবে মনযোগ নিবিষ্ট করলে ক্রমে-ক্রমে অহংকার রিপু থেকে মুক্তি পাওয়া যায়। এছাড়া অহংকার রিপু থেকে মুক্তি পেতে হলে আমাদের বিশুদ্ধ (আসল) জ্ঞান ও মানবিকতাকে বাড়াতে হবে । কারণ - প্রকৃত বা বিশুদ্ধ (আসল) জ্ঞান ও মানবিকতা যত বাড়বে অহংকার তত কমবে এবং অসম্পূর্ণ বা অপ্রকৃত জ্ঞান (নকল জ্ঞান) যত বাড়বে অহংকার তত বাড়বে।
=================================================================
ছবি - momjunction.com
৬। হিংসা রিপু -
ষড় রিপুর ষষ্ঠ রিপু হলো মাৎসর্য বা হিংসা (মাৎসর্য্য রিপু)। হিংসার আভিধানিক অর্থ হলো ধ্বংসাত্মক,পরশ্রীকাতরতা, অন্যের ভালো দেখতে না পারা ইতাদি। হিংসার একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো পরশ্রীকাতরতা। পরশ্রীকাতরতা আমাদের প্রাত্যহিক জীবনে চরম অশান্তি ডেকে আনে।কারও জ্ঞান-গরিমা, ইজ্জত-সম্মান, ধন-সম্পদ, সুখ-সমৃদ্ধি ও উন্নতি দেখে মনে মনে তার ধ্বংস কামনা করা হিংসা। এটি মানবাত্মার মারাত্মক এক ব্যাধি। ইসলামের দৃষ্টিতে তা অত্যন্ত নিন্দনীয় ও কবিরা গুনাহ। হিংসাকারীকে আল্লাহ তায়ালা অপছন্দ করেন। কারণ, প্রকৃতপক্ষে হিংসা আল্লাহর তাকদিরের ওপর আপত্তির শামিল। যার ব্যাপারে হিংসা করা হয় তার কোনো ক্ষতি হয় না বরং হিংসুক নিজেই হিংসার আগুনে দগ্ধ হয়। তা ছাড়া হিংসার ফলে তার নেক আমলসমূহ বরবাদ হয়ে যায়। এ ব্যাপারে রাসুলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, ''তোমরা হিংসা থেকে বেঁচে থাক। কেননা, আগুন যেমন লাকড়ি ভষ্মিভূত করে দেয়, তেমনি হিংসা মানুষের নেক আমল বরবাদ করে ফেলে''। (আবু দাউদ শরীফ)।
হিংসা বা পরশ্রীকাতরতার তিনটি দিক রয়েছে।
এক - অন্যের ভাল কিছু দেখলে তার গা জ্বলে যাওয়া।
দুই - অপর কেউ ভাল কিছু করলে তার বিরোধিতা করা কিংবা ভাল কাজটির নেতিবাচক দিকগুলো খুটিয়ে খুটিয়ে অন্যের সামনে হাজির করা।
তিন - বেঁকে বসা /অমান্য করা(উর্ধ্বতন এর বেলায় ), ঘৃণা করা /অবজ্ঞা করা (অধস্তনদের বেলায়) ।
হিংসা রিপুর বশবর্তী মানুষের মন হিংসার আগুনে দাউ দাউ করে প্রতিনিয়ত জ্বলতে থাকে। অন্যের ভাল সহ্য করতে না পারা এবং অতি আপন জনকেও অযথা সন্দেহের চোখে দেখা হিংসা রিপুর কাজ। হিংসা রিপুর বশবর্তী মানুষ অন্যের ভাল সহ্য করতে না পারার কারণে অপরের দুঃখে আনন্দিত হয়,অপরের আনন্দে হিংসা হয় এবং মনে মনে অপরের অনিষ্ট চিন্তা করে, কুট-কৌশলে অপরের ক্ষতি সাধন করে। হিংসা রিপুর বশবর্তী মানুষ মায়াবী কাল সাপের মতো। হিংসা রিপুর বশবর্তী মানুষ এতই কুটিল স্বভাবের হয় যে,সে অতি আপন জনের ভালও সহ্য করতে পারে না এবং তার ক্ষতি সাধন করতে দ্বিধাবোধ করে না। হিংসা রিপুর বশবর্তী মানুষের ধর্মে কর্মে বিশ্বাস-প্রভাব থাকে না এবং জীবনে কোন কাজে দীর্ঘস্থায়ী সফলতা পায় না।যে হৃদয়ে কখনো ভালো জিনিস বা ভালো পথ দেখে না,সত্যটা সামনে এলেও সে বাঁকা পথে চলতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে -তাদের ব্যাপারে আল্লাহপাক বলেন, ''তিনিই তোমার প্রতি এই কিতাব (কুরআন) অবতীর্ণ করেছেন; যার কিছু আয়াত সুস্পষ্ট, দ্ব্যর্থহীন, এগুলি কিতাবের মূল অংশ; যার অন্যগুলি রূপক; যাদের মনে বক্রতা আছে, তারা ফিতনা (বিশৃংখলা) সৃষ্টি ও ভুল ব্যাখ্যার উদ্দেশ্যে যা রূপক তার অনুসরণ করে। বস্তুতঃ আল্লাহ ব্যতীত অন্য কেউ এর ব্যাখ্যা জানে না।আর যারা সুবিজ্ঞ তারা বলে, আমরা এ বিশ্বাস করি। সমস্তই আমাদের প্রতিপালকের নিকট থেকে আগত। বস্তুতঃ বুদ্ধিমান লোকেরাই উপদেশ গ্রহণ করে'।' (সুরা আলে ইমরান, আয়াত - ৭)।
মানবচরিত্রে যেসব খারাপ দিক আছে, তার মধ্যে হিংসা-বিদ্বেষ মারাত্মক ক্ষতিকারক। ব্যক্তি, পরিবার ও সমাজে পারস্পরিক হিংসা-বিদ্বেষ, ঈর্ষাকাতরতা, কলহ-বিবাদ প্রভৃতি মানুষের শান্তিপূর্ণ জীবনকে অত্যন্ত বিষময় করে তোলে। মানুষের মধ্যে পারস্পরিক হিংসা-বিদ্বেষের স্থলে সামাজিক শান্তি ও সম্প্রীতি বজায় রাখার উদ্দেশ্যে পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তাআলা সতর্ক করে বলেছেন, "অথবা আল্লাহ নিজ অনুগ্রহে মানুষকে যা দিয়েছেন সে জন্য কি তারা তাদেরকে ঈর্ষা করে? তবে আমরা তো ইবরাহীমের বংশধরকেও কিতাব ও হিকমত দিয়েছিলাম এবং আমরা তাদেরকে বিশাল রাজ্য করেছিলাম "। (সূরা আন-নিসা, আয়াত - ৫৪)।
ছবি - momjunction.com
হিংসা রিপু থেকে মুক্তির উপায় -
যে যেই ধর্মেরই অনুসারী হোক না কেন - কোন ধর্মের বিধি-বিধান মেনে চলা, জ্ঞানী ও সৎ মানুষের উপদেশ অনুসরন করা,সৎসঙ্গ-সাধু সঙ্গ ব্যতিত হিংসা (মাৎসর্য্য) রিপু কোন ভাবেই বশীভূত হয় না। যার প্রতি হিংসা হবে তার জন্য আল্লাহর কাছে দোয়া করতে থাকা। সালামের আদান-প্রদান করা,কারন - সালাম দ্বারা পরস্পর মুহাব্বত বৃদ্ধি পায় এবং মনে মনে এই চিন্তা করা যে, আল্লাহ তায়ালা আমাকে এমন কিছু দিয়েছেন যা তাকে দেননি। আর আমি তো হিংসা করে তার নেয়ামত দূর করতে পারব না। সুতরাং, আত্মশুদ্ধি অর্জন করতে হলে সকল ধর্মপ্রাণ মানুষকে অবশ্যই সর্বাবস্থায় হিংসা-বিদ্বেষ পরিহার করে সুন্দর মনমানসিকতায় সৎভাবে পরিশীলিত জীবনযাপন করা একান্ত বাঞ্ছনীয়।
ঈর্ষা ও হিংসা -
আভিধানিক অর্থে 'ঈর্ষা' আর 'হিংসা' প্রায় সমার্থক হলেও শব্দ দুটির প্রায়োগিক অর্থে বিস্তর পার্থক্য রয়েছে। ঈর্ষা ও হিংসা প্রায় একই রকমের আবেগ, তবে হিংসাকে বলা হয় ঈর্ষার চরম পর্যায় বা ঈর্ষার চরম বহিঃপ্রকাশ।
অর্থ-বিত্ত-বুদ্ধি-মেধা-রূপ ও সৌন্দর্য ইত্যাদি থেকেই যাবতীয় ঈর্ষার উৎপত্তি । নিজের যা আছে তাকে রক্ষা করার চেষ্টা থেকেও ঈর্ষার জন্ম হয়,আবার অন্যের সাথে নিজেকে তুলনা থেকেও ঈর্ষার জন্ম হয়। কিছু হারানোর আশঙ্কায় অস্বাভাবিক এবং অপ্রত্যাশিত প্রতিক্রিয়াও হলো ঈর্ষা। আর এই প্রতিক্রিয়া যখন মনে অন্যের ক্ষতি করার ইচ্ছে তৈরী করে, তখন তা হলো ধ্বংসাত্মক ঈর্ষা বা হিংসা।
ঈর্ষা থেকে মুক্তির উপায় -
ঈর্ষা থেকে মুক্তির জন্য সুস্থ সমাজ, সমবণ্টন ও সুস্থ পরিবেশ প্রয়োজন। চাহিদা ও যোগানের মধ্যে সমতা রাখাটাও জরুরি।এছাড়া নিজের বিবেক বোধ,বিবেচনা,বুদ্ধি দিয়ে বাস্তবের সঙ্গে নিজেকে যুক্ত করতে পারলে ঈর্ষাকে নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব।
==============================================================
ছবি - momjunction.com
মানব জীবন এবং ষড়রিপু -
যে অন্তর আল্লাহ তাআলার প্রতি পূর্ণরূপে অর্পিত,আল্লাহর বিধি-বিধানে পূর্ণরূপে বিশ্বাসী - সে অন্তর শয়তানের কুমন্ত্রণায় কর্ণপাত করে না তথা ষড়-রিপু তাদের উপর কোন প্রভাব বিস্তার করতে পারেনা। এ ব্যাপারে আল্লাহপাক বলেন,"আর যাদের জ্ঞান দেওয়া হয়েছে তারা যেন জেনে নেয় এটাই (অর্থাৎ এ কালামই) সত্য, যা তোমার প্রতিপালকের পক্ষ থেকে এসেছে অতঃপর তারা যেন তাতে ঈমান আনে এবং তাদের অন্তর তার প্রতি ঝুঁকে পড়ে। নিশ্চয়ই আল্লাহ মুমিনদের জন্য সরল পথের হিদায়াতদাতা"( সুরা হজ, আয়াত - ৫৪)
মানব জীবন বড়ই বিচিত্র । জীবনে নানা ঘাত প্রতিঘাত জীবনকে প্রতিনিয়ত যেমনি শুধরিয়ে দেয় তেমনি আবার কলুষিত ও করে থাকে। আমাদের জীবনে চলার পথে ষড়রিপু প্রতিনিয়ত ক্রিয়াশীল। জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত আমাদেরকে ষড়রিপুর মুখোমুখি হতে হয়। যদিও জ্ঞানী মানুষরা ষড়রিপুকে নিয়ন্ত্রণ করে সাধারন মানব থেকে মহামানব হতে পারেন-পেরেছেন তবে সাধারন মানুষ সবর্দা হাবুডুবু খায় ষড়রিপুর ভয়াল গ্রাসে। আমাদের জীবনে সবসময় ষড়রিপুর প্রভাব মোকাবিলা, ষড়রিপু কে নিয়ন্ত্রণ বা দমন করার জন্য আমাদের মন কে শান্ত ও পরিষ্কার রাখতে হবে। কারন-
প্রথমতঃ - প্রত্যেক নফস তথা প্রাণকেই মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করতে হবে। আর মৃত্যু এমন এক ধ্রুব সত্য বিষয় যে, তা থেকে নিষ্কৃতির কোন পথ নেই।(আল কোরআন)।
দ্বিতীয়ত - দুনিয়াতে ভাল-মন্দ যে যা-ই করুক না কেন, তাকে তার পরিপূর্ণ প্রতিদান পরকালে দেওয়া হবে।(আল কোরআন)।
তৃতীয়ত - প্রকৃত সফলতা সেই অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে, যে দুনিয়াতে থাকাকালীন স্বীয় প্রতিপালককে সন্তুষ্ট করে নিয়েছে এবং যার ফল স্বরূপ তাকে জাহান্নাম থেকে দূর করে জান্নাতে প্রবেশ করিয়ে দেওয়া হয়েছে।(আল কোরআন)।
চতুর্থত - পার্থিব জীবন হল ধোঁকার সম্পদ। এই ধোঁকা থেকে যে নিজেকে বাঁচিয়ে নিতে পারবে, সেই হবে ভাগ্যবান।আর যে এই ধোঁকার জালে ফেঁসে যাবে, সেই হবে ব্যর্থ ও হতভাগা।(আল কোরআন)।
আর তাই আমাদের সবাইকে সবসময় প্রতিটা কাজের পর পরই নিজের বিবেকের কাঠগড়ায় দাড়াতে হবে। ভাবতে হবে নিজের কাজ-কর্ম নিয়ে, নিরীক্ষণ করতে হবে জীবন-জগতকে। আমাদের চাইতে হবে এবং আকড়ে ধরতে হবে সত্য-সুন্দরকে আর পরিত্যাগ করতে হবে মিথ্যা ও অসুন্দরকে। তার সাথে সাথে আমাদের মনে রাখতে হবে যে, মানব জীবনের সাফল্যের জন্য প্রয়োজন অটুট সংযমের সাথে সাথে দৃঢ় প্রতিজ্ঞা ও কঠোর সাধনা (পরিশ্রম)। সংযমের সাধনার মাধ্যমেই ষড়রিপুকে নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব , করা সম্ভব । সমাজের প্রতিটা স্তরে , প্রতিটা মানুষ ষড়রিপুকে নিয়ন্ত্রণ করে চলার চেষ্টা করলে ও নিয়ম-নীতি মেনে চললে সমাজ ও জীবনে সুখ-শান্তি ও সমৃদ্ধি বিরাজ করবে। মানব জীবন হয়ে উঠবে নির্মল, শান্ত ও পরিষ্কার এবং পরকালে মিলবে সৃষ্টিকর্তার ক্ষমার সাথে চিরস্থায়ী জান্নাত ।এ ব্যাপারে আল কোরআনে আল্লাহপাক বলেন, " হে প্রশান্ত আত্মা, তুমি তোমার রবের কাছে ফিরে আস সন্তুষ্ট ও সন্তোষভাজন হয়ে। অতঃপর তুমি আমার বান্দাদের অর্ন্তভুক্ত হয়ে যাও এবং আমার জান্নাতে প্রবেশ করো"।(সূরা ফজর, আয়াত - ২৭ - ৩০)।
আর তাই আমাদের সকলকে নফস তথা ষড়রিপুকে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে এবং হযরত ইউসুফ (আঃ) ও হযরত ইবরাহীম (আঃ) এর মত আল্লাহপাকের নিকট দোয়া করতে হবে নেককার সৎ বান্দাদের অন্তর্ভুক্ত হওয়ার জন্য। হযরত ইউসুফ (আঃ) যেভাবে দোয়া করেছেন, "হে আমার রব! আপনি আমাকে রাজ্য দান করেছেন এবং স্বপ্নের ব্যাখ্যা শিক্ষা দিয়েছেন। হে আসমানসমূহ ও যমীনের স্রষ্টা! আপনিই দুনিয়া ও আখিরাতে আমার অভিভাবক। আপনি আমাকে মুসলিম হিসেবে মৃত্যু দিন এবং আমাকে সৎকর্মপরায়ণদের অন্তর্ভুক্ত করুন "। - (সূরা ইউসুফ, আয়াত - ১০১) । হযরত ইবরাহীম (আঃ) আল্লাহপাকের নিকট দোয়া করে বলেন,"হে আমার রব! আমাকে প্রজ্ঞা দান করুন এবং সৎকর্মশীলদের সাথে মিলিয়ে দিন"। (সূরা আশ-শু'আরা, আয়াত - ৮৩)।
পরিশেষে - পৃথিবীর এমন কোন মানুষ নেই যে সফলতা চায় না। আর এ সফলতাকে একেক জন একেক দৃষ্টিকোণ থেকে নির্ধারণ করে। কেউ দুনিয়ার সাফল্য প্রচুর সম্পদ, সুন্দরী নারী, গাড়ী-বাড়ী, ক্ষমতা, প্রভাব-প্রতিপত্তি ইত্যাদির মাধ্যমে নির্ধারণ করে। কেউ আবার সুস্বাস্থ্যকে সাফল্য হিসাবে নির্ধারণ করে,কেউ আবার অন্যকিছু। আর এসব চাহিদা পূরন করতে গিয়ে মানুষ ষড়রিপু'র বশবর্তী নানা রকম অন্যায় কাজ করেও দুনিয়াতে সফল হতে চায় কিন্তু প্রকৃতপক্ষে মানুষের সফলতা কিসে এ ব্যাপারে আল কোরআনে আল্লাহপাক বলেন," জীবমাত্রই মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করবে। কেবলমাত্র কেয়ামতের দিনই তোমাদেরকে তোমাদের কর্মফল পূর্ণ মাত্রায় দেয়া হবে। অতঃপর যাকে আগুন থেকে দূরে রাখা হবে এবং জান্নাতে প্রবেশ করানো হবে সে-ই সফলকাম। আর পার্থিব জীবন ছলনাময় ভোগ ছাড়া আর কিছু নয়"। (সূরা আলে-ইমরান, আয়াত - ১৮৫)।
উল্লিখিত,সুস্পষ্টভাবে আয়াতে বলে দেয়া হয়েছে যে, প্রত্যেক প্রাণীই মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করবে। আর আখেরাতে সবাই নিজেদের কৃতকর্মের প্রতিদান ও শাস্তি প্রাপ্ত হবে, যা কঠিন ও হবে আবার দীর্ঘ ও হবে। আর তাই,আমাদের ক্ষণস্থায়ী এ জীবনে অসীম চাহিদাকে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে এবং চাহিদা যত কম থাকবে আমরা ততটাই সুখী হতে পারব। আল্লাহ-ঈশ্বর-সৃষ্টিকর্তা আমাদেরকে যেভাবে রাখেন তা মেনে নেওয়া বা মানিয়ে নিতে শিখলেও জীবনে না পাওয়ার হাহাকার কমে যায়। এজন্য অন্যের প্রতি দয়ালু, নিজের সাধ্যের মধ্যে তৃপ্ত বা খুশি থাকা, ধর্মের নিয়ম নীতি মেনে চলা ,সামাজিক নিয়ম নীতি অনুসরন এবং সাধ্যানুযায়ী দানশীলতা এগুলোর চর্চা যদি আমরা করতে পারি এবং এ কাজগুলি করে মনে আনন্দ পেলে বুঝতে হবে আমরা সুখী এবং সঠিক পথে আছি । আবার , দুনিয়ায় প্রচলিত সকল ধর্ম - ধর্মগ্রন্থ ও সকল জীবন দর্শনের অন্যতম উপদেশ হলো আমাদের নফস তথা কাম-ক্রোধ-লোভ-মোহ-অহংকার ও হিংসা কে নিয়ন্ত্রণ করা। তাই মানব জীবনে সুখ-শান্তি -সমৃদ্ধি তথা মহৎ কার্যাবলী,সৃজনশীলতা এবং মানব জীবনের চরম-পরম উদ্দেশ্য প্রাপ্তি (আল্লাহ - ঈশ্বর - সৃষ্টিকর্তার) খুশির জন্যও ষড়রিপু দমন আবশ্যক।
আসুন, আমরা সবাই ষড়রিপুকে নিয়ন্ত্রণ করি এবং মানুষের দুনিয়াবী জীবনের সুখ-শান্তি-সমৃদ্ধি ,মহৎ কার্যাবলী,সৃজনশীলতা এবং মানব জীবনের মূল উদ্দেশ্য আল্লাহ-ঈশ্বর-সৃষ্টিকর্তার সন্তুষ্টি অর্জনের চেষ্টা করি। যাতে করে আমাদের ইহকালীন-দুনিয়ার শান্তির সাথে সাথে পরকালীন মুক্তিও মিলে।
=============================================
তথ্যসূত্র -
১। আল কোরআন।
২। হাদীস।
৩। পৌরাণিক কাহিনী ও ধার্মিক তথ্য (Prbir Kumar Mahanti) - Click This Link
৪। ষড়রিপু-থেকে-মুক্তি-কী - https://bn.quora.com/
৫।The Six Enemies of The Mind(Arishadvarga/Shadripu) - Click This Link
৬।wikipedia
৭। The Six Internal Enemies of Human Beings - Click This Link
================================================================
জবাবদিহীতা - আমার এ লেখায় অনেকখানি সাহায্য ও শব্দচয়ন উপরের লেখক ভাই (Prbir Kumar Mahanti) এবং
hindupedia থেকে নেয়া হয়েছে । কারন, আমার মনে হয়েছে ,আলোচ্য বিষয়ে আমি যেভাবেই বলতে চাইনা কেন আমাদের উভয়ের লেখার মূল বিষয়টা একই। আর তাই, আমি তাদের কাছে কৃতজ্ঞ এ লেখা শেষ করায় তাদের লেখা থেকে সাহায্য পাওয়ার-নেয়ার জন্য । আমরা যে যেই ধর্মেরই হইনা কেন, সব ধর্মের উপদেশ যেহেতু ভাল কাজ করা ও খারাপ কাজ বর্জন করা এবং উভয়ের লেখার বিষয় একই, কাজেই ধর্ম আলাদা আলাদা হলেও হিন্দুপিডিয়া কিংবা প্রবীর ভাই ও আরো অনেকের লেখার থেকে সাহায্য নেয়া আমার কাছে দোষের কিছু মনে হয়নি। এ ব্যাপারে ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখার অনুরোধ রইলো।
==================================================================
পূর্ববর্তী পোস্ট -
মানব জীবন - ২৫ - " পুরুষ "- Click This Link
মানব জীবন - ২৪ - " নারীর প্রতি সদ্ব্যবহার / ভাল আচরন ও শিষ্টাচার " Click This Link
মানব জীবন - ২৩ - " নারী " Click This Link
মানব জীবন - ২২ -" স্ত্রী / সংগী অদল-বদল করে যৌনসহবাস" Click This Link
মানব জীবন - ২১ -"পরকীয়া ও লিভ টুগেদার " Click This Link
মানব জীবন - ২০ -"সমকামীতা বা সমকামী বিয়ে" Click This Link
মানব জীবন - ১৯ - " আত্মসম্মান-নীতি-নৈতিকতা " Click This Link
মানব জীবন - ১৮ - " ধর্মহীনতা " Click This Link
মানব জীবন - ১৭ - " ধৈর্য " Click This Link
মানব জীবন - ১৬ -" সততা " Click This Link
মানব জীবন - ১৫ - " লজ্জা " Click This Link
মানব জীবন - ১৪ - "পর্দা " Click This Link
মানব জীবন - ১৩ - "ধর্ম " Click This Link
মানব জীবন - ১২ " সহ শিক্ষা " Click This Link
মানব জীবন - ১১ " শিক্ষা " - Click This Link
মানব জীবন - ১০ "পরিবার " - Click This Link
মানব জীবন - ৯ "বিবাহের পরে" - Click This Link
মানব জীবন - ৮ " মানব জীবনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য " - Click This Link
মানব জীবন - ৭ " তালাক " - Click This Link
মানব জীবন - ৬ "দেনমোহর - স্ত্রীর হক" - Click This Link
মানব জীবন - ৫ "বিবাহ" - Click This Link
মানব জীবন - ৪ " মাতৃত্ব " - Click This Link
মানব জীবন - ৩ Click This Link
"নারী স্বাধীনতা বনাম নারী(জরায়ু)'র পবিত্রতা "
মানব জীবন - ২ " মাতৃগর্ভ (জরায়ু)"- Click This Link
মানব জীবন - ১ "মানুষের জন্ম প্রক্রিয়ার ইতিকথা"- Click This Link
১৭ ই অক্টোবর, ২০২৪ বিকাল ৩:৪৫
মোহামমদ কামরুজজামান বলেছেন: সোনাগাজী বলেছেন - ইহা অনেক বড় গরুর রচনা
- ধন্যবাদ সোনাগাজী ভাই, আপনার জোস মন্তব্যের জন্য।
আরও ধন্যবাদ সামু কর্তৃপক্ষকে আপনাকে মুক্ত রাখার জন্য। এই কারনে (আপনি মুক্ত থাকার কারনে) অন্ততঃ একটা মন্তব্য পেলাম
২| ১৭ ই অক্টোবর, ২০২৪ বিকাল ৫:৩১
কাজী ফাতেমা ছবি বলেছেন: আপনার পোস্ট দেখলেই ডর লাগে
২০ শে অক্টোবর, ২০২৪ বিকাল ৪:৫৬
মোহামমদ কামরুজজামান বলেছেন: কাজী ফাতেমা ছবি বলেছেন: আপনার পোস্ট দেখলেই ডর লাগে
- ধন্যবাদ বোন কাজী ফাতেমা ছবি , আপনার মন্তব্যের জন্য।
কি আর করা ,যে যেমন সে তেমন ই।
আমি লিখতে পারিনা কম লেখা,এ আমার ব্যর্থতা
৩| ১৭ ই অক্টোবর, ২০২৪ রাত ৯:০১
কামাল১৮ বলেছেন: এ সব পুরনো দর্শন এখন অচল।গীতা থেকে নেয়া।
২১ শে অক্টোবর, ২০২৪ দুপুর ২:০৬
মোহামমদ কামরুজজামান বলেছেন: - ধন্যবাদ কামাল১৮ ভাই, আপনার মন্তব্যের জন্য।
এ সব পুরনো দর্শন এখন অচল।গীতা থেকে নেয়া।
-যে কোন জীবন দর্শনই গড়ে উঠে মানুষের বহু দিনের অর্জিত অভিজ্ঞতার আলোকে সকল ধর্ম-মতের উপরে উঠে।
এখন বাইবেল-গীতা কিংবা আল কোরআন যে কোন ধর্মীয় কিতাব থেকেই জীবন দর্শন নেয়া হোক না কেন - সবার মূল সূর ভাই একই।
সৎকাজ করা আর অসৎ কাজ বর্জন করা তথা মানবতার লালন।
৪| ২১ শে অক্টোবর, ২০২৪ দুপুর ২:২৫
নতুন বলেছেন: ভাল টপিকস কিন্তু অনেক বড় হয়ে গেছে।
এই জিনিস গুলি মানুষ বুঝতে পারে ৪০ বছরের পরে এসে, তার আগে বেশির ভাগ মানুষই বুঝতে পারেনা।
২১ শে অক্টোবর, ২০২৪ বিকাল ৪:৪১
মোহামমদ কামরুজজামান বলেছেন: ধন্যবাদ নতুন ভাই, আপনার মন্তব্যের জন্য।
ভাল টপিকস কিন্তু অনেক বড় হয়ে গেছে।
- ভাই, আমি সামুতে লেখাই শুরু করেছিলাম মানব জীবন সিরিজটা লেখার জন্য। আড় এর প্রত্যেকটা বিষয়ের লেখাই না চাইতেও বড় হয়ে যায়।
এই সিরিজের সবর্শেষ পোস্ট পুরুষ লিখেছিলাম ২০ শে মার্চ, ২০২২। তার পর ২ বছরের অধিক সময় লেগে গেছে এই পোস্ট "ষড়-রিপু" শেষ করতে তথা গুছিয়ে আনতে। আপাত দৃষ্ঠিতে মূল্যহীন তবে বিষয়ের গুরুত্বতা, তথ্যের ব্যাপকতা এবং ধর্মের সংযুক্তির তথ্য সংগ্রহ ও সংযোজনের কারনেই এত সময় ও লেখার বিশালতা
একবার ভেবেছিলাম ২/৩ পর্বে দিব তবে কোন এক অজানা কারনে তথা তথ্যের ধারাবাহিকতা রক্ষার জন্য সে ইচছা থেকে পিছু হটেছি।
এই জিনিস গুলি মানুষ বুঝতে পারে ৪০ বছরের পরে এসে, তার আগে বেশির ভাগ মানুষই বুঝতে পারেনা।
-এটা হয়ত আপনি সঠিক বলেছেন।
আসলে বিষয়টা হয়ত অনেকটা এমন, '' আগে যে কোন ভাবে কামাই, পরে কাফফারা দিব'' টাইপের।
এই কামানোর জন্য জীবনের শুরুতে আমরা এসব (ন্যায়-অন্যায়) বিষয়ে ভাবতেই রাজী নই। অথচ জীবনের প্রথম এবং সমাজের সবজায়গায় এগুলি (ন্যায়-অন্যায়) নিয়ে ভাবলে তথা চর্চা-প্রয়োগ করলে সমাজের বর্তমান অবস্থান এরকমই হতোনা।
তখন সমাজ অনেকটা মানবিক এবং আমাদের পূর্বসূরীদের দানব হিসাবে নয় মানবীয় হিসাবেই পেতাম।
৫| ২১ শে অক্টোবর, ২০২৪ বিকাল ৪:৪৫
নতুন বলেছেন: বর্তমানে মানুষের ধর্য কমে যাচ্ছে, তাই লেখা বেশি বড় হলে পড়ে না।
২১ শে অক্টোবর, ২০২৪ বিকাল ৫:১০
মোহামমদ কামরুজজামান বলেছেন: আবারো ধন্যবাদ নতুন ভাই, আপনার প্রতি-মন্তব্যের জন্য।
বর্তমানে মানুষের ধৈর্য কমে যাচ্ছে, তাই লেখা বেশি বড় হলে পড়ে না।
- জী ভাই।
এটা আপনি শতভাগ সঠিক বলেছেন।
বর্তমানে জেন-জি তথা আধুনিক মানুষের ধৈর্য নেই কিংবা কমে গেছে। সবাই এখন অধৈর্য তথা কম সময়ে অধিক পাবার আশায় মশগুল। আর তাইতো পরিবার-সমাজ-দেশে এত বৈপরিত্য ও হানা-হানি কিংবা মানহানী। সাথে সাথে দূর্নীতির সমারোহ।
আর তাইতো এসব থেকে বেরিয়ে আসার জন্য এবং ষড় রিপু দমনের জন্য ধৈর্যের কোন বিকল্প নেই। আবার জানা-বুঝার জন্য ও ধৈর্যের চেয়ে ভাল কোন পথ নেই।
ভাই, সবাই সব কিছু পড়েনা, তা বড় কিংবা ছোট কোন বিষয় নয়। আবার আমার-আপনার মত কিছু প্রাচীন মানুষ হয়ত কচচপ কামড় দিয়ে পড়ে নেয়-নেবে। এই আশায় -------------
ধন্যবাদ ভাই।
©somewhere in net ltd.
১| ১৭ ই অক্টোবর, ২০২৪ বিকাল ৩:৩০
সোনাগাজী বলেছেন:
ইহা অনেক বড় গরুর রচনা