নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

শিক্ষার্থী, ইংরেজি বিভাগ, শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়।

Asif Ajhar

শিক্ষার্থী, ইংরেজি বিভাগ, শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়।

Asif Ajhar › বিস্তারিত পোস্টঃ

ইতিহাসের পাঠশালায়: পর্ব-৬ | প্রাচীন আর্যভাষীদের গল্প

১১ ই ডিসেম্বর, ২০১৮ দুপুর ২:৩৮


প্রাচীন পৃথিবীর ইতিহাসে সভ্যতার যে অগ্রযাত্রা আমরা দেখেছি তাতে বারবার ঘুরেফিরে এসেছে প্রাচীন মিসরীয় সভ্যতা, মেসোপটেমীয় সভ্যতা, পারস্য সভ্যতা এবং হিব্রুভাষীদের কথা। তৎকালীন পৃথিবীতে আফ্রিকা মহাদেশের একমাত্র সমৃদ্ধ সভ্যতা ছিলো মিসরীয় সভ্যতা। মিসরীয় সভ্যতার মতোই তৎকালীন এশিয়া মহাদেশের মধ্যে সবচেয়ে সমৃদ্ধ সভ্যতাগুলো গড়ে উঠেছিলো প্রাচীন মেসোপটেমিয়ায়। মেসোপটেমীয়ায় সর্বপ্রথম কিছু বিচ্ছিন্ন শহর নিয়ে গড়ে উঠেছিলো প্রাচীন সুমেরীয় সভ্যতা। এরপর প্রাচীন ব্যাবিলন নগরীকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে আমোরীয়দের প্রাচীন ব্যাবিলনীয় সভ্যতা, নিনেভা শহরকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে অ্যাসিরীয় সভ্যতা এবং নতুন ব্যাবিলন নগরীকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে ক্যালদীয় সভ্যতা।

মেসোপটোমীয় সভ্যতাগুলোর পরে আসে আর্য পারস্য সভ্যতা। তখনও পর্যন্ত দুনিয়ার আর কোথাও এতো জমজমাট সভ্যতার দেখা পাওয়া যায় না। তখনও সিন্ধু ও চৈনিক সভ্যতা ছাড়া এশিয়ার আর কোথাও উল্লেখযোগ্য কোনো নগর সভ্যতা গড়ে ওঠেনি। এশিয়ার সিন্ধু সভ্যতাও দীর্ঘ সময় টিকে থাকেনি; খ্রিস্টপূর্বে ৩২৫০ থেকে ২৭৫০ সালের মধ্যে বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছিলো। কোন এক অজানা কারণে এশিয়ার অনেক অঞ্চলে তখনও সভ্যতার আলো পৌঁছায়নি; তবুও এশিয়ার কয়েকটি অঞ্চলে গড়ে ওঠা সভ্যতাগুলোই ছিলো পৃথিবীর সেরা সভ্যতা।

অন্যদিকে আফ্রিকা ও ইউরোপের সামান্য জায়গা ছাড়া বাকী পুরোটাই ছিলো ঘোর অন্ধকারে ঢাকা। আফ্রিকার মিসর ছাড়া বাকী পুরো মহাদেশটাই ছিলো অন্ধকারে! এ সময় সভ্যতায় সবচেয়ে পিছিয়ে ছিলো ইউরোপ। গোটা ইউরোপ জুড়ে তখন অন্ধকারের রাজত্ব। ইউরোপের মূল ভূখণ্ডে তখন ঘুরে বেড়াচ্ছে বিভিন্ন যাযাবর জাতির লোকেরা। আর্যদের আগমনের পূর্ব পর্যন্ত ইউরোপের উল্লেখযোগ্য কোনো ইতিহাস নেই, কারণ আদিম জীবনের তেমন কোনো ইতিহাস থাকে না।


চিত্র: শিল্পীর তুলিতে আদিম ইউরোপের যাযাবর জীবন

ইউরোপের মূল ভূখণ্ডে সভ্যতার সূচনা ঘটায় এশিয়া মাইনর থেকে আসা আর্যরা। ‘আর্য’ বলতে এখন আর জাতি বোঝায় না; বরং ছাড়াছাড়ি হওয়ার আগে এশিয়া মাইনরের উত্তরের অধিবাসীরা যে ভাষায় কথা বলত, সেই ভাষাটিকে ‘আর্য’ ভাষা বললে বেশি সঠিক বলা হয়। আর্যরা ছিলো মেষপালক ও যাযাবর প্রকৃতির। সম্ভবত খাদ্যাভাবের ফলে তারা আনুমানিক ৩৪০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের দিকে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে, যা চলতে থাকে পরবর্তী ২০০০ বছর ধরে। ২০০০ থেকে ১৮০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের মধ্যে তারা এশিয়ার ভারত, মধ্যপ্রাচ্যের পারস্য অর্থাৎ ইরান, এশিয়া মাইনরের পশ্চিম অংশ অর্থাৎ তুরস্ক এবং ইউরোপের দক্ষিণে গ্রিস ও ইতালিতে বসতি গড়ে তোলে।

ছাড়াছাড়ি হবার পর এই দলগুলো আলাদা আলাদা এক একটি জাতি হিসেবে গড়ে উঠেছিলো। প্রত্যেকের আলাদা আলাদা ভাষাও তৈরি হয়েছিলো; যেমন - সংস্কৃত, ফারসি, হিট্টীয়, গ্রিক, ল্যাটিন প্রভৃতি ভাষা। ছাড়াছাড়ি হবার আগ পর্যন্ত এরা সকলেই যে একই ভাষায় কথা বলত, তা এই ক’টি প্রাচীন ভাষার অনেক মিল দেখে বোঝা যায়। পৃথিবীর সকল ভাষার মূলে যে সাতটি ভাষাবংশ চিহ্নিত করা হয়েছে তার মধ্যে অন্যতম হলো আর্যদের ভাষা; এ ভাষার নাম ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষা।


চিত্র: Routes of Arian migration অর্থাৎ আর্যদের দেশান্তরের বিভিন্ন পথ। মাঝখানের গোল জায়গাটি ছিলো আর্যদের আদি নিবাস। এখান থেকে তারা বিভিন্ন দিকে ছড়িয়ে পড়ে। সংখ্যা ও তীরচিহ্ন দ্বারা আর্যদের বিভিন্ন শাখার গন্তব্য বোঝানো হয়েছে। ১ ও ২ দ্বারা ভারতে আসা আর্যদের দুটি গোষ্ঠীকে চিহ্নিত করা হয়েছে। ৩ ও ৪ দ্বারা ইরানে প্রবেশকারী পারসীয় (Persian) ও মিডীয় (Medes) আর্যদের চিহ্নিত করা হয়েছে। ৫ দ্বারা হিট্টীয় (Hittite) ও মিতানীয় (Mitanni) আর্যদের চিহ্নিত করা হয়েছে। ৬ দ্বারা ইজিয়ান (Aegean) ও ডোরীয়সহ (Dorian) বিভিন্ন আর্যগোষ্ঠীকে চিহ্নিত করা হয়েছে। ৭ দ্বারা ল্যাটিন (Latin) গোষ্ঠীকে চিহ্নিত করা হয়েছে। ১ ও ২ চিহ্নিত আর্যরা গড়ে তুলেছিলো ভারতের বৈদিক সভ্যতা। ৩ ও ৪ চিহ্নিত আর্যরা গড়ে তুলেছিলো মিডীয় ও পারস্য সভ্যতা। ৫ চিহ্নিত আর্যরা গড়ে তুলেছিলো হিট্টীয় ও মিতানীয় সভ্যতা। ৬ চিহ্নিত আর্যরা গড়ে তুলেছিলো মাইসেনীয় ও গ্রিক সভ্যতা এবং ৭ দ্বারা চিহ্নিত আর্যরা গড়ে তুলেছিলো রোমান সভ্যতা। আর্যদের গতিপথগুলো কিছু ক্ষেত্রে অনুমান করে নেওয়া হয়েছে।

কাস্পিয়ান সাগর ও কৃষ্ণসাগর সংলগ্ন এশিয়া মাইনরের উত্তরের তৃণভূমি এলাকা ছিলো আর্যদের আদি নিবাস। সংখ্যায় বেড়ে গেলে একসময় তারা ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে পৃথিবীর বিভিন্ন দিকে। একটি শাখা দক্ষিণ পুর্ব দিকে অগ্রসর হয়ে এসে পৌঁছায় ভারতে; যাদের দ্বারা গড়ে উঠেছিলো বৈদিক সভ্যতা। একটি শাখা দক্ষিণ-পশ্চিমে অগ্রসর হয়ে ইরান অঞ্চলে বসতি গড়ে তোলে; এদের মধ্য দিয়েই বিকাশ লাভ করে পারস্য সভ্যতা।

আরেকটি শাখা দানিয়ুব নদী অতিক্রম করে ২০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের দিকে দক্ষিণ ইউরোপের বলকান উপদ্বীপে এসে পৌঁছায়; এরাই গ্রিকো-রোমান জাতির পূর্বপুরুষ, এদের বংশধররাই একসময় গড়ে তোলে গ্রিকো-রোমান সভ্যতা। এরও আগে তারা গড়ে তোলেছিলো ইজিয়ান সভ্যতার অন্যতম অংশ মাইসেনীয় সভ্যতা। এ সময় ইউরোপের অন্ধকার ইতিহাস বাঁক নেয় আলোর দিকে।

গ্রিক সভ্যতার সূচনার বেশ কয়েক শতক পুর্বে ইউরোপ ও এশিয়ার মধ্যবর্তী ইজিয়ান সাগরকে ঘিরে গড়ে উঠেছিলো ইউরো-এশীয় ইজিয়ান সভ্যতা, এ সভ্যতা ছিলো দুটি অংশে বিভক্ত।: একটি ছিলো ইজিয়ান সাগরের দ্বীপমালা ও তুরস্কের উপকূল এলাকা নিয়ে গড়ে ওঠা মিনীয় সভ্যতা এবং অপরটি ছিলো গ্রিসের উপকূলবর্তী মাইসেনিয়া শহরকে কেন্দ্র করে বিকশিত মাইসেনীয় সভ্যতা।


চিত্র: ক্রিট দ্বীপ ও মিনীয় সভ্যতার নিদর্শন। ইউরোপের মূল ভূখণ্ডে সভ্যতা গড়ে ওঠারও বহু আগে এই দ্বীপ গড়ে উঠেছিল মিনীয় সভ্যতা

ইজিয়ান সাগরের প্রশস্ত দ্বীপ-‘ক্রীট’ দ্বীপকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছিলো মিনীয় সভ্যতা। ক্রীট দ্বীপের ‘নসাস’ শহর ছিলো মিনীয় সভ্যতার মূল কেন্দ্র। শহরটি ছিলো সাগর থেকে ৩ মাইল ভেতরে। দেয়াল ঘেরা এই শহরে ছিলো চমৎকার সব প্রাসাদ। ক্রীটের ভৌগলিক অবস্থা ছিলো ক্রীটের ভৌগলিক অবস্থা ছিলো বানিজ্যের জন্য অনুকূল। আবার পাহাড় আর সাগরের বেষ্টনী বিদেশী আক্রমণের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার সুযোগ করে দিয়েছিল।

ধারণা করা হয়, একটি কৃষক সম্প্রদায় ৪০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে প্রথম ক্রীটে বসতি গড়ে তোলে। শহর সমূহ গড়ে ওঠে ৩০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের দিকে, অর্থাৎ মিসরীয় ও সুমেরীয়দের প্রাচীন শহরগুলোর সমসাময়িক ছিলো সেগুলো। ক্রীটের রাজাদের উপাধি ছিলো ‘মিনস’ আর এ থেকেই তাদের রাজ্যের নাম হয় মিনীয় রাজ্য। মিনীয়দের যেসব লেখা পাওয়া গেছে, তা আজও পাঠোদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। সেসব লিখন পদ্ধতি পাঠোদ্ধারের বাইরে রয়ে গেছে তার মধ্যে অন্যতম হলো এইসব মিনীয় লিপি। ক্রীটবাসীদের বাণিজ্যপোত যাতায়াত করতো মিসর এবং পূর্ব ও পশ্চিম ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলে।


চিত্র: ডোরীয় রীতির থাম (Column) ছিল গ্রিক স্থাপত্যের অন্যতম বৈশিষ্ট্য

অন্যদিকে ইজিয়ান সভ্যতার অন্য অংশটি গড়ে তোলে ইউরোপে আসা প্রথম দিকের আর্যভাষীরা। ১৯০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের দিকে আর্যভাষী জনগোষ্ঠী গ্রিসের মূল ভূখণ্ডে বসতি গড়ে তোলে। এই অঞ্চলের সাথে মিনীয়দের বাণিজ্যিক সম্পর্কে ছিলো। ক্রমে এখানে মিনীয় সংস্কৃতি প্রবেশ করতে থাকে। গ্রিসের উপকূলবর্তী মাইসেনিয়া শহর ছিলো এই সংস্কৃতি বিকাশের কেন্দ্র। তাই এ অঞ্চলে গড়ে ওঠা সভ্যতা মাইসেনীয় সভ্যতা নামে পরিচিত হয়। মিনীয়দের সংস্পর্শে আসা আর্যভাষীরা উপকূলীয় শহর মাইসেনিয়াকে কেন্দ্র করে গড়ে তোলে মিনীয় প্রভাব সমৃদ্ধ এই সভ্যতা।

এটাই ইউরোপর মূল ভূখণ্ডের সর্বপ্রাচীন সভ্যতা, যা ছিলো আর্যদের অবদান। মাইসেনিয়াতে ইজিয়ান সংস্কৃতি উন্নতির চরমে পৌঁছে ১৫০০ থেকে ১০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের মধ্যে। মিসর, ক্রীট, সাইপ্রাস ও উত্তরের বিভিন্ন নগরের সাথে মাইসেনিয়ার বাণিজ্যিক সম্পর্ক ছিলো। এক সময় মাইসেনীয় সভ্যতারও অবসান ঘটে। আর্যদের অন্য একটি আক্রমণকারি গোষ্ঠী উত্তর দিক থেকে এগিয়ে আসে মাইসেনিয়ায়। এরা ছিলো ডোরীয় ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাভাষী গোষ্ঠী। ১২০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের দিকে সমগ্র ইজিয়ান অঞ্চলে এদের আধিপত্য বিস্তৃত হয়।


চিত্র: গ্রিস ও ইজিয়ান সাগরের মানচিত্র

ইজিয়ান অঞ্চলে আরও বিভিন্ন ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাভাষী আর্যরা ছড়িয়ে ছিলো, এরা বিভিন্ন নামে পরিচিত ছিলো।; যেমন-এচীয়, আইওলীয়, ইওলীয় প্রভৃতি। ১১৫০ থেকে ১০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের মধ্যে সমগ্র গ্রিস চলে যায় ডোরীয়দের দখলে। এই ডোরীয়দের সাথে মিশ্রণ ঘটেছিলো ইজিয়ান আর্যদের; ফলে একটি শক্তিশালী জাতির উদ্ভব হয়।, গ্রিস জুড়ে তারা ক্রমে একটি নতুন সভ্যতা গড়ে তোলতে শুরু করে। এ সভ্যতার একটি বিশেষত্ব ছিলো, তা হলো- এটি কোন নদীতীরে গড়ে ওঠেনি।; তখন পর্যন্ত সবগুলো সভ্যতাই নদীতীর বা সমুদ্রতীরে গড়ে উঠতে দেখা গেছে।

গ্রিক সভ্যতাই প্রথম, যা ভূখণ্ডের গভীরে গড়ে উঠেছে পাহাড়ী এলাকার কাছে। ভৌগলিকভাবে গ্রিস দেশটা ছিলো কিছ্টুা ভিন্ন। খাড়া খাড়া পাহাড়ের কারণে দেশটি ছিলো ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অঞ্চলে বিভক্ত।; ফলে জন্ম হয় অনেকগুলো নগর রাষ্ট্রের। ১১০০ থেকে ৭৫০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ পর্যন্ত সময়কাল গ্রিসের ইতিহাসে হোমারীয় যুগ নামে পরিচিত। এ যুগে গ্রিসের ইতিহাসের তেমন কোনো উপাদান পাওয়া যায় না। একমাত্র হোমারের ইলিয়াড ও ওডিসিতে এ সময়ের কথা কাহিনীর চিত্র খুঁজে পাওয়া যায়। গ্রিসে নগর সভ্যতার বিকাশ শুরু হয় মূলত এ যুগের শেষ দিকেই।

আর্যদের একটি শাখা যখন এভাবে অন্ধকার ইউরোপকে নিয়ে চলেছে ইতিহাসের পথে, তখন আর্যদের আরেকটি শাখা মেসোপটেমীয় সভ্যতার অবসান ঘটিয়ে গড়ে তোলেছে বিশাল পারস্য সাম্রাজ্য। ইউরোপে গ্রিক সভ্যতার উত্থানের সময় মধ্যপ্রাচ্যের পারস্য সভ্যতা ছিলো শক্তিতে দুনিয়ার সেরা। ৫৩৮ খ্রিস্টপূর্বাব্দে পারস্য সম্রাট সাইরাস এ শক্তিশালী সাম্রাজ্য গড়ে তোলেন। পারস্য সাম্রাজ্য ছড়িয়ে পড়েছিলো মিসর থেকে শুরু করে ভারতবর্ষের সিন্ধু নদ পর্যন্ত।! এর আগে এত বড় সাম্রাজ্যের অস্তিত্ব পৃথিবীতে আর দেখা যায় না।

গ্রিকদের সাথে পারসীয়দের সম্পর্ক মধুর হয়নি। পরস্পরের সাথে তারা যুদ্ধে জড়িয়েছে বারবার। যুদ্ধে অবিশ্বাস্যভাবে প্রত্যেকবারই পারসীয়রা হেরে গিয়েছে গ্রিকদের কাছে, পারসীয়দের বিপুল সৈন্যশক্তি থাকা সত্ত্বেও। পারসীয়দের এ পরাজয় গ্রিকদের উত্থানের পথ সুগম করে। পারস্য সভ্যতাকে ফেলে গ্রিক সভ্যতা পৌছে যায় সভ্য দুনিয়ার শীর্ষে। খ্রিস্টপুর্বে ৪৮০ থেকে ৪৩০ সাল পর্যন্ত এই দীর্ঘ ৫০ বছর গ্রিকরা সভ্যতায় দুনিয়ার শীর্ষে থাকলেও, তাদের প্রতিপক্ষ পারসীয়রা তাদের সাথে আর কোন যুদ্ধে জড়ায়নি।

আর্যভাষীদের সাথে সভ্যতার ইতিহাস ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে গিয়েছে। প্রাচীন পৃথিবীর বিশাল আকারের সভ্যতাগুলো গড়ে তোলেছিলো তারাই। প্রচন্ড যুদ্ধবাজ চরিত্রের হওয়ায় তারা অনেক দেশ দখল করে নিতে পেরেছিলো। ভারতবর্ষে আসা আর্যদের রচিত রামায়ন-মহাভারতে তাদের এই চরিত্রটিই প্রকটভাবে ফুটে উঠেছে। রামায়নে যে লঙ্কার রাজা রাবনের উল্লেখ রয়েছে তিনি ছিলেন এ ভূখণ্ডের প্রকৃত অধিবাসী এবং সেই সাথে বলা যায়, এ ভূখণ্ডের স্বাধীনতা রক্ষার যুদ্ধের সবচেয়ে পুরনো বীর।

আর্য দখলদার বাহিনীর বিরুদ্ধে স্বাধীনতা যুদ্ধে প্রাণ দেওয়া এই অনার্য বীরকে আর্যরা রাক্ষস বলে চিহ্নিত করেছে। স্বাধীনতাকামী অনার্যদেরকে আধিপত্যবাদী আর্যরা রাক্ষস-খোক্ষস অভিধায় ভূষিত করেছে। ভারতে আসা আর্যদের সাথে এখানকার অনার্যদের রক্তের সংমিশ্রণের ফলে বাঙালী জাতির মতো বহু মিশ্র জাতির সৃষ্টি হয়েছে। সংমিশ্রণ ঘটেনি এমন জাতিও রয়েছে; যেমন- তামিল, দ্রাবিড় ইত্যাদি।

এখানকার আর্যদের রচিত রামায়ন-মহাভারতের সাথে গ্রিক আর্যদের রচিত ইলিয়াড-ওডিসির দারুণ মিল দেখা যায়। রামায়নের সীতা ছিলেন রাজা রামের স্ত্রী আর ইলিয়াড-ওডিসির হেলেন ছিলেন রাজা মেনিলাসের স্ত্রী।; উভয়েই অপহৃত ও মুক্ত হয়েছিলেন দীর্ঘ যুদ্ধের মধ্য দিয়ে। এসব পৌরাণিক কাহিনীতে দেখা যায়, দেব-দেবী আর মানুষে মাখামাখি সম্পর্ক। সেমেটিকদের মতো একক কোন সৃষ্টিকর্তার অনুশাসন মেনে চলার কোন ব্যাপার আর্যদের মাঝে ছিলো না। ইলিয়াড-ওডিসি ও রামায়ন-মহাভারতে তৎকালীন সময়ের বহুদেবতাবাদী ও সর্বেশ্বরবাদী পৌরাণিক ধর্মের চিত্র ফুটে উঠেছে। গ্রিকদের সেই পৌরাণিক ধর্ম বিলুপ্ত হয়ে যাওয়ায় ইলিয়াড ও ওডিসি এখন আর ধর্মগ্রন্থের মর্যাদা পায় না বরং সাহিত্যের মর্যাদা পায়; অন্যদিকে রামায়ন-মহাভারত এখনও সনাতন ধর্মের অনুসারিদের কাছে ধর্মীয়ভাবে পাঠ্য ।


চিত্র: মানুষের চরিত্রের একেকটি দিককেই একেকজন গ্রিক দেবতা হিসেবে খুঁজে পাওয়া যায়

ইলিয়াড-ওডিসি এবং রামায়ন-মহাভারতের দেব-দেবীদের মিল এতো বেশি যে, দুই অঞ্চলের ধর্ম দুটি আলাদা ধর্ম নাকি একই ধর্ম তা নিরূপণ করা মুশকিল হয়ে দাঁড়ায়। শুধুমাত্র গ্রিক দেব-দেবীদের ক্ষেত্রেই নয়, সিরিয়ার উত্তরের আর্যদের আরেকটি গোষ্ঠী মিতানীয়দের ধর্মবিশ্বাসেও ভারতীয় বৈদিক দেব-দেবীর অস্তিত্ব দেখা যায়। তুরস্কের বোগাজকুই নামক জায়গায় প্রত্নতাত্ত্বিক খননের ফলে আর্যভাষী মিতানীয়দের সম্বন্ধে যেসব তথ্য পাওয়া যায় তাতে দেখা যায় ইন্দ্র, বরুণ, মিত্র প্রভৃতি বৈদিক দেবতারা মিতানীদেরও দেবতা ছিলেন।

একসময় পৃথিবীতে এসব আর্য দেব-দেবীদের ধর্মের ওপরে নিরংকুশ প্রভাব বিস্তার করে সেমেটিক ধর্মের ধারাসমূহ। সেমেটিক ধর্মের অন্যতম ধারা খ্রিস্টধর্মের তোড়ে গ্রিক ও রোমান দেব-দেবীরা ভেসে গেছেন ইতিহাসের বিস্মৃতির আড়ালে। আর সর্বশেষ সেমেটিক ধারা ইসলাম ধর্মে প্রবেশ করেছে পারসীয়, মিতানীয় প্রভৃতি ধারার আর্যভাষীরা। এছাড়াও ভারতীয় অনার্যদের পাশাপাশি আর্যদেরও অনেকে প্রবেশ করেছে সেমেটিক ইসলাম ধর্মে। ভারতীয় আর্যদের বর্ণবাদী নিপীড়ণের শিকার অনার্য সম্প্রদায়ের মানুষ একসময় আর্য দেব-দেবীদের বাদ দিয়ে ব্যাপকহারে ইসলামে প্রবেশ করেছিলো।

আর্যভাষা ও আর্য দেব-দেবীদের অস্তিত্ব অবশ্য ভারতীয়দের একটি উল্লেখযোগ্য অংশের মধ্যে এখনও টিকে আছে। এখনও ভারতীয় ব্রাহ্মণরা আর্য দেব-দেবীদের উদ্দেশ্যে মন্ত্র পাঠ করেন আর্যভাষার অন্যতম নির্দশন সংস্কৃত ভাষায়। প্রাচীন ভারতীয় আর্যভাষীদের সাথে পৃথিবীর অন্যান্য আর্যভাষীদের একটি জায়গায় বেমিল পাওয়া যায়; সেটি হলো বর্ণবাদ। বর্ণবাদ হলো সামাজিক শোষণ-নিপীড়নের একটি প্রাচীন পদ্ধতি। পৃথিবীর অন্যান্য আর্যভাষীদের সমাজে শোষণের পদ্ধতি হিসেবে প্রচলিত ছিলো দাসব্যবস্থা; আর প্রাচীন ভারতে শোষণের পদ্ধতি হিসেবে প্রচলিত হয়েছিলো বর্ণবাদ।

প্রাচীন জীবন ও অর্থনীতিতে শ্রেণি বিভাজনের ব্যাপারটি খুবই স্পষ্ট। প্রাচীন সভ্যতাগুলোতে দেখা যায়, সমাজের একদিকে অপ্রয়োজনীয় ফূর্তি-বিলাসের বিপুল আয়োজন, আর অন্যদিকে এসবের মূল্য দিতে গিয়ে তিলে তিলে মরছে ক্রীতদাস-কারিগর-শ্রমিক ও প্রজাসাধারণ। যে ক্রীতদাস ও প্রজাদের শ্রমে মালিকশ্রেণি ও বড়লোকদের এতো বিলাসিতা সেই ক্রীতদাস ও প্রজারা প্রতিদানে পেতো বড়লোকের চাবুকের ঘা, নিষ্ঠুর শোষণ ও অত্যাচারে তিলে তিলে মৃত্যু। এ অবস্থাটা বজায় রাখার জন্য সুবিধাভোগী বড়লোক শ্রেণির হাতে যেসব শক্তিশালী অস্ত্র ছিলো তার অন্যতম হলো তাদের স্বরচিত ধর্ম।

সেই সব ধর্মে দেখা যায় খড়গহস্ত আর বল্লমধারী দেবতাদের ছড়াছড়ি। শোষণের ওপর গড়ে ওঠা সমাজ ব্যবস্থাটাকে এসব দেব-দেবীরা পাহারা দিতেন। বড়লোকদের সাথে শোষণের অংশীদার ধর্মযাজক পুরহিতকূল শোষণে জর্জরিত মানুষদের বোঝাত, তাদের দুর্গতির কারণ হলো দৈব বিধানের প্রতি অশ্রদ্ধা, পূর্বজন্মের পাপ, ইত্যাদি। দেবতাদের তৈরি করে দেওয়া সমাজবিধির লংঘন কিংবা বিদ্রোহের শাস্তি হিসাবে দেখানো হতো দেব-দেবীর বল্লমের ভয়, অভিশাপের ভয়; এ ভয়ে জবুথবু হয়ে থাকতো শোষিত মানুষেরা।

প্রাচীন ভারতীয় সমাজ জীবনে শোষণ ও বর্বরতার প্রতীক বর্ণবাদের আমদানী ঘটে মনুর বিধানের মধ্য দিয়ে। ইহুদি আচার্য ইষ্রার জাতিগত শ্রেষ্ঠত্ব ও বিশুদ্ধতার বিধানের আর্য সংস্করণ যিনি নিয়ে এলেন তার নাম মনু। ভারতীয় আর্য ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয় রাজ-রাজড়াদের শোষণের দৈব অধিকার প্রতিষ্ঠায় তিনি সবচেয়ে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন। আর্যরক্তের বিশুদ্ধতা ও শ্রেষ্ঠত্ব রক্ষার জন্য তিনি ফিরিয়ে আনলেন বেদের বর্ণবাদী অনুশাসন।

এ অনুশাসন পালনে কঠোরতা আরোপ করতে গিয়ে তিনি যে সংহিতা রচনা করলেন তার নাম মনুসংহিতা। অকল্পনীয় নিষ্ঠুরতায় অনার্যদের জন্য একটি নরকতুল্য পৃথিবী সৃষ্টি করলেন মনু তাঁর এই সংহিতায়; তাদেরকে বানালেন আর্যদের ক্রীতদাস, অস্পৃশ্য ও অপবিত্র জীব।, এরা হলো শূদ্র। অন্যদিকে আর্যদের বানালেন সৃষ্টির প্রভু। এরা হলো ব্রাহ্মণ - প্রভুর জাত। এদেরকে স্পর্শ করাও শূদ্রের জন্য মহাপাপ। অন্যদিকে কোন ব্রাহ্মণ যদি নিকৃষ্ট জাত শূদ্রদের কাউকে মেরেও ফেলে তাহলে যে সামান্য পাপ হবে তা মোচনের জন্য তিন রাত দুধ পান করা বা এক যোজন রাস্তা হাটা অথবা নদী স্নান করাই যথেষ্ট। এছাড়াও বিড়াল, নেউল, কুকুর, গোসাপ, প্যাঁচা বা কাক মেরেও শূদ্র হত্যার প্রায়শ্চিত্ত করা যাবে (মনুসংহিতা, শ্লোক ১৩১ ও ১৩২)।

হাম্মুরাবির আইনসংহিতায় নিম্নজাত মুশকেলুমের ওপর উচ্চজাত আওএলুমের যে দৈব শ্রেষ্ঠত্ব দেওয়া হয়েছে তার সাথে মনুর বিধানের মিল পাওয়া যায়। তবে মনুর বিধান তার চেয়েও অনেক বেশী অন্যায়ের ও পক্ষপাতদুষ্ট। মনুর কথায় দাসত্বের জন্যই শূদ্রের সৃষ্টি (মনুসংহিতা ৮:৪১৩)। ক্ষুন্ন না হয়ে প্রসন্নমনে ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় ও বৈশ্যদের সেবা করা শূদ্রগণের প্রধান কর্তব্য (মনুসংহিতা ১:৯৯)। শূদ্র নামের এই দাসদের কোন পারিশ্রমিক দিতে হতো না। কিন্তু গতর খাটাবার জন্যই তো এদের বাঁচিয়ে রাখতে হবে।; তাই মনু বিধান দিলেন-শূদ্রভৃত্যকে উচ্ছিষ্ট অন্ন, জীর্ণ বসন, জীর্ণ শয্যা বা কুটির দান করিবে (মনুসংহিতা ১০:১২৫)।

ভারতবর্ষের আদিসন্তান এই শূদ্রদের সম্পদ সৃষ্টির অধিকার ছিলো, কিন্তু ভোগের অধিকার ছিলো না। ভোগের অধিকার ছিলো মালিকদের (মনুসংহিতা ৮: ৪১৬ এবং ৪১৭)। তিন বর্ণের মানুষদের চেয়ে যাতে শূদ্রদের আলাদাভাবে চেনা যায় সেজন্য প্রতি মাসে তাদের কেশ মুন্ডনের নির্দেশ দিলেন মনু (মনুসংহিতা ৫:১৪০)। এটাই হলো মোটামোটিভাবে ভারতীয় বর্ণবাদের নিষ্ঠুর চেহারা।

আধুনিক ভারতের সংবিধান রচয়িতা শূদ্রজাত ড.বি.আর. আম্বেদকর ১৯৪৮ সালে অস্পৃশ্যদেরকে আধুনিক আইনের মারপ্যাঁচে মনুবাদের বেড়াজালে আটকানোর জন্য মহাত্মা গান্ধী কর্তৃক তাদের হরিজন নামে অভিহিত করার কৌশলের প্রতিবাদ জানাতে গিয়ে তাঁর The Untouchables: A Thesis on the Orgins of untouchabitity গ্রন্থে বলেন, “.... মানব সভ্যতাকে ক্রীতদাস বানাবার একটি কৌশল। এর যথার্থ নামকরণ হওয়া উচিত ‘কলঙ্ক’। একটি সভ্যতাকে আর কী অভিধায় চিহ্নিত করা যায়, যা সাধারণ মানুষকে .... যাদের অস্তিত্বকে দেখা হয় সামাজিক মেলামেশা থেকে বাইরের কোন প্রাণী হিসেবে .... যাদের একটুখানি স্পর্শ অপবিত্র বলে বিবেচিত হয়।”

মনুর পরে বর্ণবাদী নিষ্ঠুরতায় যিনি সবচেয়ে বেশী কৃতিত্বের পরিচয় দেন তিনি হলেন শংকরাচার্য। তার আবির্ভাবকাল ৬৭৭-৭২০ খ্রিস্টাব্দ। শশাংকের রাজত্বকালের শেষদিকে ব্রাহ্মণ্যবাদের বিজয় পতাকা উড়িয়ে তিনি কেরালা থেকে বের হন ভারতভূমি পরিক্রমণে। তার এই পরিক্রমণ সম্পর্কে তিব্বতীয় বৌদ্ধধর্মীয় পুস্তকে বলা হয়েছে- “শংকরের আগমণে বৌদ্ধবিহারগুলি কম্পমান হইত এবং ভিক্ষুগণ ছত্রভঙ্গ হইয়া পলায়ন করিত।” - ড. মনিকুন্ত হালদার, বৌদ্ধধর্মের ইতিহাস। পৃষ্ঠা ৩২৩।

মনুর বিধানে শূদ্ররা অস্পৃশ্য হলেও তবু তো তারা ব্রাহ্মণ্যধর্মের অন্তর্ভূক্ত। কিন্তু বৌদ্ধ? সে তো বর্ণেরই বাইরে। অতএব সে কদাচারী, পাপিষ্ঠ এবং একদমই পরিত্যাজ্য। তাকে হত্যা করলে পাপ তো হবেই না, বরং দ্বিজ ব্রাহ্মণের অর্জিত হবে পূণ্য। এর মানে হলো যারা ব্রাহ্মণ্যধর্ম মানে না, তারা কুকুর, সাপ বা বেজীরও অধম। এদেরকে শায়েস্তা করার জন্য মহাব্রাহ্মণ শংকরাচার্য ভারতজুড়ে চালালেন নারকীয় বৌদ্ধ হত্যাযজ্ঞ। ১৮৫ খ্রিস্টপূর্বাদে আর্য ব্রাহ্মণ পুষ্যমিত্র শুঙ্গ যে বৌদ্ধ নিধনযজ্ঞ শুরু করেন তার দানবিক ব্যাপ্তি ঘটিয়ে শংকরাচার্য রাজকীয় সৈন্য সহযোগে হত্যা করলেন অসংখ্য বৌদ্ধধর্মাবলম্বীকে। শংকরাচার্যের আজ্ঞাবহ রাজা সুধন্বা প্রভৃতির মতো রাজাদের হত্যার শিকার ৬৪০০০ বৌদ্ধের কথা উদ্ধৃত হয়েছে প্রাচীন শিলালিপিগুলোতে (রাহুল সাংকৃত্যায়ন : ভারতে বৌদ্ধ ধর্মের উত্থান পতন, পৃষ্ঠা ১২)।

শংকরাচার্য যে রাজ্যে পা রাখতেন সেখানকার বৌদ্ধধর্মীরা প্রাণভয়ে বনেজঙ্গলে গিয়ে আশ্রয় নিতেন। বিরুদ্ধবাদীদের প্রতি তাঁর নিষ্ঠুরতার নমুনা হলো, তাঁর নির্দেশে ওদের হাত পা বেঁধে নিক্ষেপ করা হতো ফুটন্ত তেলভর্তি কড়াইয়ে। যে বর্ণের ভিত্তিতে আর্য ব্রাহ্মণ্যবাদের এত নিষ্ঠুরতা সেই বর্ণের বিশুদ্ধতার ভিত্তি কতটুকু ছিলো? ইহুদি রক্তের বিশুদ্ধতার ভিত্তি যেভাবে মুখ থুবড়ে পড়ে ইব্রাহিম-মুসা-দাউদ-সলোমনের পরজাতীয় কন্য বিবাহের ঘটনায়, ঠিক সেভাবেই আর্য বর্ণবাদের ভিত্তিও খসে পড়ে-খোদ মহাভারতের রচয়িতা ব্যাস দ্বৈপায়নের শূদ্র মায়ের গর্ভে জন্ম নেওয়ার ঘটনায় এবং বেদের অন্যতম রচয়িতা ঋষি বশিষ্ঠর বৈশ্যা গর্ভজাত হওয়ার ঘটনায় (দীনেশচন্দ্র সেন : বৃহৎ বঙ্গ, প্রথমখ-, পৃষ্ঠা ১২০)।

ব্যাস দ্বৈপায়ন এবং ঋষি বশিষ্ঠ দুজনেই ব্রাহ্মণ্যধর্মের ইতিহাসে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, যদিও তাদের মধ্যকার সময়ের ব্যবধান অনেক। একজন মহাভারতের রচয়িতা, অপরজন বেদের রচয়িতা। দুজনকেই ব্রাহ্মণ্যধর্মে অত্যন্ত শ্রদ্ধার সংগে বলা হয়-মহর্ষি অর্থাৎ মহা ঋষি। ঋষি নামক এই শ্রেণিটির সৃষ্টি আর্যরা ভারতে আসার ২০০ বছর পরে।


চিত্র: আর্যভাষীদের ভারতে আসার দুটি পথ

আর্যভাষীরা হিন্দুকুশ পর্বতমালা পেরিয়ে উপমহাদেশে প্রবেশ করে ১৮০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের দিকে। তারা প্রথমে এসে পৌঁছায় গান্ধার রাজ্যের তক্ষশিলায়। তক্ষশিলার অবস্থান বর্তমান পাকিস্তানে এবং গান্ধার রাজ্যের বর্তমান নাম আফগানিস্তানের কান্দাহার। সেই সময়ে আর্যরা ছিলো নিরক্ষর কিন্তু ভারতভূমির অধিবাসীদের মধ্যে প্রচলন ছিলো লেখার। লেখ্য সংকেত লিপির সাহায্যে তারা লেখত। অথচ আর্যরা ভারতভূমির এই প্রাকৃতজনদেরকে অভিহিত করল ‘অনার্য’ নামে যার আভিধানিক অর্থ অসভ্য-অসুর এবং নিজেদেরকে অভিহিত করল ‘আর্য’ নামে যার অর্থ সুসভ্য-শ্রেষ্ঠ।

ভারতভূমিতে এসে কালক্রমে পশুপালনই হয়ে ওঠে আর্যদের প্রধান জীবিকা। পশুপালক আর্যদের চেয়ে কৃষিজীবী অনার্যদের সমাজ ব্যবস্থা ছিলো উন্নত; যদিও তখনও রাষ্ট্র গড়ে ওঠেনি। রাষ্ট্র না থাকায় দাসতন্ত্র বা সামন্ততন্ত্রও সৃষ্টি হয়নি। দাসশ্রম শোষণের ওপর ভিত্তি করে যে সমাজ গড়ে ওঠে তা দাসতন্ত্রী সমাজ আর কৃষক প্রজাদের ফসলী কর ভাগাভাগির ভিত্তিতে যে কৃষিনির্ভর সমাজব্যবস্থা গড়ে ওঠে তার নাম সামন্ততন্ত্র। ভারতবর্ষের প্রাচীন অনার্য সমাজে তখনও এরকম ভাঙন সৃষ্টি হয়নি। শ্রেণি শোষণের উপযোগী অর্থনীতি তখনও যথেষ্ট বিকশিত হওয়ার বাকী। তাই কৃষিজীবী অনার্যদের মাঝে প্রচলিত ছিলো এক ধরনের গুচ্ছগ্রাম ব্যবস্থা।

একগুচ্ছ গ্রাম নিয়ে একেকটি স্বাধীন মানব বসতি গড়ে উঠত। এর নাম ছিলো ‘জন’। আর জনের শাসক ছিলেন জনপতি। জনপতি নির্বাচিত হতেন জনের সকল সদস্যের সম্মতিতে। এসব জনপতিদের কেউ কেউ সাম্যবাদী নিয়ম ভঙ্গ করে সামন্ত হয়ে উঠতে চেয়েছেন; বাড়তি সুবিধা ও বিলাসীতার আশায়। কিন্তু জমিতে দাস খাটিয়ে কিংবা প্রজা বসিয়ে ফসলী কর আদায়ের মত উন্নত পর্যায়ের অর্থনীতি বিকশিত না হওয়ায় এসব স্বৈরাচারী জনপতিদের প্রধান কাজ হয়ে দাঁড়াত সৈন্যবল নিয়ে বিভিন্ন জনের গরু-মোষ লুট করা। আর অনার্যদের সব কিছুর চেয়ে এই ব্যাপারটাই সবচেয়ে বেশি আকর্ষণ করল কিছু আর্য গোত্রপতিদের। আর্য গোত্রপতিদের মধ্যে যারা শারীরিকভাবে ছিলেন বলশালী তারা একসময় হয়ে উঠলেন গরু-মোষ লুটের সর্দার।

অনার্যদের কাছ থেকে আর্যরা অনেক কিছুই শেখে। আর্যদের মধ্যেও অনার্যদের মত সমাজব্যবস্থা গড়ে ওঠে। তবে একটি ব্যাপারে তারা অবশ্যই অনার্যদের চেয়ে অনেক এগিয়ে গিয়েছিলো। এটি হলো ক্ষমতা ও আধিপত্যকে চিরস্থায়ী করার কাজে ধর্মের ব্যবহার। অনার্য স্বৈরাচারী জনপতিরা একাধিপত্যকে চিরস্থায়ী করার কোন আধ্যাত্মিক কৌশল আবিষ্কার করতে পারেনি। ফলে যখনই তাদের ‘জন’ বিদ্রোহী হয়ে উঠেছে তাদেরকে নেতৃত্ব থেকে পালাতে হয়েছে। অন্যদিকে আর্য গোত্রপতিরা রাজত্বকে বিদ্রোহের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য নিযুক্ত করলেন ঋষি নামক শ্রেণিটিকে।


চিত্র: বৈদিক যুগের স্থাপত্য

ততদিনে আর্য গোত্রপতিরা ফুলে ফেঁপে হয়ে উঠেছেন ছোট ছোট সামন্ত বা রাজা। আর তাদের রাজত্বকে আধ্যাত্মিক কৌশলে নিরাপদে রাখার কাজে নিযুক্ত ঋষিরা নিজেরাই সৃষ্টি করলেন বেশ কিছু দেবতা যাদের বাস মর্ত্যে নয়, স্বর্গে। এরা অপরিমেয় ক্ষমতার অধিকারী। আর্য গোত্রপতিদের যারা পরিণত হয়েছেন রাজায় তাদের লাঠিয়াল ও বল্লমধারী বাহিনীর শক্তির সাথে এবার যুক্ত হলো ঋষিদের সৃষ্ট এসব দেবতাদের শক্তি। রাজভক্তিতে ঘাটতি থাকলে এসব দেবতারা অসন্তুষ্ট হন। মৃত্যুর পরে যেতে হবে দেবতাদের কাছেই। রাজদ্রোহী পাপীদের জন্য তখন ভয়ংকর শাস্তির ব্যবস্থা করে রেখেছেন এসব দেবতারা।

এসব ঘটনার মধ্য দিয়ে ভারত ভূখণ্ডের আর্যধর্ম কালক্রমে একটি শোষণবাদী চরিত্র ধারন করতে থাকে। ইতোমধ্যে আর্যরা ভারতবর্ষে আসার পরে পেরিয়ে গেছে প্রায় ৩০০ বছর। সমান্ততন্ত্র তখন দানা বাঁধছে ভারতের মাটিতে। স্বয়ংসম্পূর্ণ গুচ্ছগ্রাম অর্থনীতি যাচ্ছে হারিয়ে। তার জায়গায় আসছে ছোট ছোট রাজা, ছোট ছোট রাজ্য। অনার্য জন এর জনপতিরা রাজা হয়ে উঠতে পারেন নি স্থায়ীভাবে। কিন্তু আর্য গোত্রপতিরা পান্ডা-পুরুত সমেত দস্তুরমত রাজা হয়ে উঠেন। তাই ক্ষমতার লড়াইয়ে শক্তিশালী আর্য রাজাদের কাছে অনার্য জনপতিরা পরাজিত হতে থাকেন। ক্ষমতার প্রশ্নে আর্য গোত্রপতি-রাজারাও পরস্পরের সাথে লিপ্ত হতেন যুদ্ধে।

ক্ষমতার লড়াইয়ে যেসব আর্য রাজারা টিকে থাকতেন তাদের শাসনের ভিত মজবুত করার জন্য ঋষিরা নানা দৈব বিধি-বিধান প্রবর্তন করতেন দেবতাদের নামে। এসব দৈব বিধি-বিধানই সংকলিত হয় ঋকবেদে। ততদিনে প্রাথমিক যুগের যেসব আর্য গোত্রপতি গরু-মোষ হরণের ঘটনায় বিশেষ কৃতিত্ব দেখিয়েছিলেন তারা পরিণত হয়েছেন কিংবদন্তিতে। যুদ্ধবিজয়ী এসব আর্য গোত্রপতিরা হয়ে উঠেন কিংবদন্তির বীরপুরুষ। আরো কয়েক পা এগিয়ে ঋকবেদের রচয়িতা তিন ঋষি - বশিষ্ঠ, বিশ্বামিত্র ও ভরদ্বাজ এদেরকে দান করে ফেলেন দেবতার মর্যাদা।

দেবতার মর্যাদায় ভূষিত এসব বীররা হলেন - ইন্দ্র, বরুণ, মিত্র, অগ্নি প্রমুখ। এরা প্রত্যেকেই সুদুর অতীতে ছিলেন আর্য গোত্রপতি বীর এবং সকলেই ছিলেন গরু-মোষ হরণের জন্য বিখ্যাত। স্বয়ং ইন্দ্র, যিনি স্বগের্র দেবতাদের রাজা, তাঁর সকল কৃতিত্বের মধ্যে প্রধান কৃতিত্ব ছিলো গরু-মোষ হরণ (দিনেশচন্দ্র সেন; বৃহৎ বঙ্গ, প্রথম খ-, পৃষ্ঠা-২৪৪)। পশুপালন ভিত্তিক আর্য সমাজে ধনসম্পদ বলতে একমাত্র গরু-মোষকেই বুঝতো। এমন কি আর্যভাষায় যুদ্ধ আর গরুলাভের ইচ্ছা বোঝাতে একটিই শব্দ প্রচলিত ছিলো।

আর্য ইতিহাসের এসব গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়কে অত্যন্ত চমৎকার ভাষায় ফুটিয়ে তুলেছেন পন্ডিত রাহুল সাংকৃতায়ন তাঁর ভোলগা থেকে গঙ্গা’ বইটিতে:

ঋকবেদ রচনা শুরুর সময়কাল ১৫০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের দিকে। গঙ্গা-যমুনার সন্নিহিত উত্তর-পশ্চিম ভারতের প্রাচীন দেশ রোহিলখন্ড ও মধ্যদোয়াব অঞ্চলের নাম তখন পঞ্চাল। পঞ্চালের রাজা দিবোদাসের রাজবেদী নিরাপদ রাখতে এগিয়ে এলেন তিন ঋষি। এরাই হলেন বশিষ্ট, বিশ্বামিত্র ও ভরদ্বাজ। পুরনো দিনের বিখ্যাত আর্য বীরদেরকে তারা বানালেন পরম ক্ষমতাধর দেবতা। এমনকি এসব দেবতাদেরও পেছনে একজন স্রষ্টা নির্ধারণ করলেন। তাঁর নাম ঈশ্বর। তিনি দেবতাদেরও স্রষ্টা। দেবতারাও তাঁর অনুগ্রহ প্রার্থী। তাঁর বিধানই দেবতাদের বিধান। কী সেই বিধান?

ঋষিরা জানিয়ে দিলেন রাজাকে দেবতারা পাঠিয়েছেন শাসন করতে। তার বিরুদ্ধাচরণ করলে দেবতারা ক্রুদ্ধ হবেন, ঈশ্বরও ক্ষিপ্ত হবেন। আর ঈশ্বর ক্ষিপ্ত হলে নেমে আসবে বিপর্যয়। এই ঘোষণা দেওয়া হলো যজ্ঞ করে, যার নাম অশ্বমেধ যজ্ঞ। এই ঘোষণার সাথে শুরু হলো সামন্তবাদী শোষণের জন্য প্রয়োজনীয় দৈব বিধি-বিধান ও সামাজিক নিয়ম সংকলনের কাজ। এ সংকলনের নাম ঋকবেদ। এভাবে তৈরি হয়ে গেল সামন্তবাদী শোষণের বৈদিক ভিত। ঋকবেদে সংকলিত সকল বিধি-বিধান ও নিয়মকে দেবতাদের সৃষ্ট বলে চালিয়ে দেওয়া হলো। এর বিরুদ্ধাচরণের কঠিন পরিণতি সম্পর্কেও বিশদ বলে দিলেন ঋষিরা।

চারটি বর্ণের বিভাজন তখনও সৃষ্টি হয়নি। তবে ক্ষত্রিয় ও ব্রাহ্মণের-প্রাথমিক চেহারাটি দেখা দিচ্ছিল ধীরে ধীরে। এদের কর্মক্ষেত্রেও এসে গিয়েছিলো বিভাজন। একজনের কাজ রাজপাট করা, দখল-লুন্ঠন-যুদ্ধে নেতৃত্ব দেওয়া আর অন্যজনের কাজ রাজ-রাজড়াদের শোষণ-নিপীড়ন ও অন্যায়কে ঈশ্বরের বিধান বলে প্রচার করা। পঞ্চালভূমির রাজা দিবোদাসের রাজবেদীকে নিরাপদ করার জন্য ঋষি বশিষ্ঠ, বিশ্বামিত্র ও ভরদ্বাজ যে কৌশলটি কাজে লাগিয়েছিলেন তা শত শত বছর ধরে নিরাপদে রেখেছে দিবোদাসের বংশধারার রাজত্বকে।

কিন্তু কৌশলটি দূর্বল হয়ে দেখা দিল দিবোদাসের উত্তর পুরুষ রাজা প্রবাহনের সময়। কারণ শোষিত মানুষের পাঁজরের ওপর চেপে বসা দেবতাদের বিধানগুলো খুবই দুঃসহ হয়ে উঠছিলো। তাই মানুষ দৈব বিধানের জাল কেটে বেরিয়ে পড়তে চাইছিলো। দেবতারাই রাজাকে পাঠিয়েছেন সাধারণ মানুষকে শাসন ও শোষণ করতে - এই দৈব বিধান আর কাজ দিচ্ছিল না। শোষণে জর্জরিত সাধারণ মানুষের মনের খটকা ক্রমেই বাড়ছিলো। অতএব শঙ্কিত রাজার রাজবেদী রক্ষার জন্য নতুন কৌশল জরুরি হয়ে উঠল। আর তা আবিষ্কারও হয়ে গেল একসময়। আবিষ্কার করলেন স্বয়ং রাজা। তবে ঘোষিত হলো পুরোহিতের মুখ দিয়ে; শত শত গো-মহিষ বলি দিয়ে যাগযজ্ঞের আয়োজন করে।

এসব ঘটনা ঘটল ঈশ্বরের সৃষ্টি ও ঋকবেদ রচনার কয়েকশ’ বছর পরে। দেবতা নামক অদৃশ্য সত্ত্বার নামে চালু করা বৈদিক বিধানের প্রতি মানুষের অবিশ্বাস বেড়ে যাচ্ছিল। তাই রাজা প্রবাহন রাজত্বকে মজবুত অবলম্বন দেওয়ার উদ্দেশ্যে সৃষ্টি করলেন ব্রহ্মাকে। এর আগের ইন্দ্র, বরুণ, অগ্নি প্রভৃতি দেবতাদের কেউ দেখেনি। তাই লোকের মনে সন্দেহ তৈরি হচ্ছিল। এজন্য প্রবাহন সাকার দেবতাদের স্থলে নিরাকার ব্রহ্মার আমদানি করলেন; যাকে প্রত্যক্ষ দেখার কথাই উঠে না। ব্রহ্মের দর্শন পেতে হলে চাই সূক্ষ্ম ইন্দ্রিয়। আর সূক্ষ্ম ইন্দ্রিয় লাভ করতে হলে চাই সাধনা। আর সাধনার যে কঠোর বিবরণ দেওয়া হলো তাতে ছাপ্পান্ন পুরুষ ধরে সাধনা করেও মানুষ সফল হতে পারবে না; ভ্রমাচ্ছন্ন থেকে যাবে (রাহুল সাংকৃত্যায়ন: ভোগলা থেকে গঙ্গা, পৃষ্ঠা ১৩৮-১০৯,১১০)।

বশিষ্ঠ, বিশ্বামিত্র ও ভরদ্বাজের কৌশলের চেয়ে প্রবাহণের আবিষ্কৃত কৌশল ছিলো অনেকগুণ শক্তিশালী। কিন্তু ব্রহ্মের চেয়েও বড় ছিলো প্রবাহনের দ্বিতীয় আবিষ্কার (প্রাগুক্ত)। আবিষ্কারটি হলো, মরে গিয়ে আবার পৃথিবীতে ফিরে আসা - অর্থাৎ পূণর্জন্মের ধারণা। এতদিন বৈষম্য ও শোষণের পক্ষে খাটানো হয়েছিলো শুধু মাত্র দৈব বিধানের যুক্তি। এবার আমদানী করা হলো অনেকগুণ শক্তিশালী যুক্তির। ধনীদের বিলাসীতার বিপরীতে শোষিত মানুষের জীবনে যে দুঃখ ও দুর্দশা নেমে আসে তা ব্যাখ্যা করা হলো পূর্বজন্মকৃত ফল হিসেবে।

শোষিত মানুষের দুঃখ ও দারিদ্রতাকে আগের জন্মের দুষ্কর্মের ফল হিসেবে দেখানো হলো। অন্যদিকে শোষকের ধন শুধু দেব কৃপায় পাওয়া বস্তু নয় বরং পূর্বজন্মের সুকর্ম ও দেবভক্তির পুরষ্কার। আর গরীবের দুর্দশা পূর্বজন্মের পাপের শাস্তি। এর ফলে দরিদ্র প্রজারা পূণর্জন্মের আশায় সারা জীবনের তিক্ততা, কষ্ট এবং অন্যায়কে হাসিমুখে মেনে নিতে শিখল। আর্য ইতিহাসের এই কুৎসিত অধ্যায়- যা সম্পন্ন হয়েছিলো আনুমানিক ৭০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের দিকে; সে সম্পর্কে প্রখ্যাত শেকড় সন্ধানী লেখক মাসুদুল হক বলেছেন: “এবং এসে গেলেন ব্রহ্মা। এসে গেল পূণর্জন্মবাদ, তৈরি হয়ে গেল মানুষকে চিরকালের মত শৃঙ্খলিত করার ... দলিল। যদিও সাহিত্যের মানদণ্ডে এটি-এই বেদ, তৎকালীন মানুষের এক অনন্য সাধারণ সৃষ্টি তথাপি সভ্যতার ইতিহাসে মানুষকে শৃঙ্খলিত করার, মনুষ্যত্বের লাঞ্ছনা আর অবমাননার এই চিরকালীন দলিলের তুল্য দ্বিতীয়টি মেলা ভার।”- মৌলবাদ, পৃষ্ঠা-১৩৪।

প্রবাহণের আবিষ্কৃত কৌশলের বিরুদ্ধে কেউ কোন প্রশ্ন তুলতে পারেনি। একমাত্র একজনই সেই কৌশলের বিরুদ্ধে প্রশ্ন করার দুঃসাহস দেখালেন। তাঁর নাম গৌতম বুদ্ধ। তাঁর জন্ম ৫৬৬ খ্রিস্টপূর্বাব্দে; মৃত্যু ৪৮৩ খ্রিস্টপূর্বাব্দে। ৫১৪ খ্রিস্টপূর্বাব্দে ২৯ বছর বয়সী গৌতম বুদ্ধ সংসার ছেড়ে ধ্যান করতে চলে যান নির্জনে। ছয় বছর ধ্যানের পর হলেন বিশেষ জ্ঞানপ্রাপ্ত। এর পর নামলেন নতুন ধর্ম প্রচারে। এই নতুন ধর্মে শোষিতরা দলে দলে দীক্ষা নিতে আসলেও ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয়ের জন্য তা হুমকি হয়ে দেখা দিল। ততদিনে ক্ষমতার দৌড়ে ক্ষত্রিয়কে ফেলে এগিয়ে গিয়েছেন ব্রাহ্মণ।


চিত্র: বুদ্ধ

রাজা প্রবাহনের পর ধীরে ধীরে ক্ষমতাবান হয়ে ওঠা ব্রাহ্মণের কাছে অসহায় আত্মসমর্পনে বাধ্য হন ক্ষত্রিয় রাজা। একসময় ধর্মের বাণীর জালে ক্ষত্রিয় রাজাকে আটকে ফেলে ব্রাহ্মণরা নিজেরাই হয়ে ওঠেন সর্বেসর্বা। কারণ ব্রাহ্মণের মুখ নিঃসৃত বাণীই তখন হয়ে উঠেছিলো অলঙ্ঘনীয় ধর্মীয় বিধান। ব্রাহ্মণরা পরিণত হন অবতারে। ব্রাহ্মণ্যবাদের এই সোনালী যুগেই বুদ্ধের আগমণ। তাই বুদ্ধের দর্শন হয়ে উঠেছিলো তাদের ঘোরতর শত্রু। তবে ব্রাক্ষণ্যবাদ সমাজে প্রতিষ্ঠিত হলেও বেদের অনুশাসন পালনে বুদ্ধের সময়েও যথেষ্ট শিথিলতা দেখা যায়।

মহাভারতের রচনাকাল ৪০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের দিকে। সে সময়ে বেদ নির্দেশিত বর্ণভেদ পালনে কঠোরতা দেখা যায় না। শোষিতের সম্পদ গ্রাস করেই ব্রাহ্মণ-ক্ষত্রিয়রা সন্তুষ্ট ছিলেন; বাড়তি ঘৃণা প্রদর্শনের এত প্রয়োজন ছিলো না। তাই উচ্চ বর্ণের সাথে নিম্ন বর্ণের বেদ বিরোধী দৈহিক সম্পর্কও প্রচলিত ছিলো। সে সময়ের নিয়োগ প্রথা এর সাক্ষ্য। নিয়োগ প্রথা অনুসারে সন্তান জন্ম দানে অক্ষম ব্রাহ্মণ-ক্ষত্রিয় রমণীর স্বামী তার বংশ রক্ষার্থে নিম্ন বর্ণের রমণীর গর্ভে সন্তান জন্মদান করতো। একে ব্যভিচার মনে করা হতো না। খোদ মহাভারতের রচয়িতা মহাকবি ব্যাস দ্বৈপায়নের জন্ম শূদ্রা মায়ের গর্ভে এবং তিনি নিজেও নিম্নজাত মহিলার গর্ভের সন্তানের জনক। এমনকি ব্যাস দ্বৈপায়নের পিতার জন্মও নিম্ন বর্ণের মহিলার গর্ভে।

তিন পুরুষের এই বিচ্যুতি দেখে বোঝা যায় বর্ণবাদ তখন শাস্ত্রের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিলো। ব্যাস দ্বৈপায়নের পিতা মহর্ষি পরাশর ছিলেন নিখাঁদ ব্রাহ্মণ। তারই ঔরসে খাঁটি শূদ্র ধীবর কন্যা সত্যাবতীর গর্ভজাত ব্যাস দ্বৈপায়ন লিখেছেন পৃথিবীর পাঁচটি মহাকাব্যের একটি। এর ২০০ বছর পরে ভারতীয় সমাজকে বর্ণবাদের শেকলে বাঁধতে চালু হলো মনুর বিধান। আনুমানিক ২০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের দিকে রচিত হয় মনুসংহিতা এবং বৈদিক সভ্যতার ইতিহাসের সবচেয়ে অমানবিক অধ্যায়ের সূচনা ঘটে। এর পরবর্তী সময়ে খ্রিস্টপূর্ব ১৮৫ সালে ভারতভূমিতে বৌদ্ধ নিধনযজ্ঞ শুরু করেন পুষ্যমিত্র শুঙ্গ। এরও দীর্ঘদিন পরে আবির্ভূত হন শংকরাচার্য। রাজকীয় ও নিজস্ব সৈন্যবাহিনী নিয়ে তাঁর বৌদ্ধ হত্যাযজ্ঞের ঘটনা বৈদিক সভ্যতার ইতিহাসের পরবর্তী নিষ্ঠুরতম ঘটনা।


চিত্র: কর্ণাক সূর্য মন্দিরের দেয়ালে খোদিত রথচক্র

এরও পরবর্তী সময়ে খ্রিস্টীয় সপ্তম শতক থেকে দ্বাদশ শতক পর্যন্ত উদয়নাচার্য, রামানুচার্য, বাচষ্পতি মিশ্র প্রমুখ ব্রাহ্মণাচার্যরা বৌদ্ধ নিধন ও ভারতভূমি থেকে বৌদ্ধধর্মের বিলুপ্তি ঘটানোর প্রচেষ্টায় নেতৃত্ব দেন। চৈনিক পরিব্রাজক হিউয়েন সাঙ এর বর্ণনায় ব্রাহ্মণ্যবাদী হত্যাযজ্ঞ ও নিষ্ঠুরতার শিকার বৌদ্ধদের কথা পাওয়া যায়। বৌদ্ধদের উপর ব্রাহ্মণ্যবাদের এই সহিংসতা বন্ধ হয় ভারতবর্ষে মুসলিম আগমনের পরে।

১১৯২ সালে গজনী সাম্রাজ্যের অধিপতি মুহাম্মদ ঘুরী উত্তর ভারতের দিল্লী এবং আজমীরের শাসনকর্তা পৃথ্বিরাজ চৌহানের বিরুদ্ধে তরাইনের দ্বিতীয় যুদ্ধে বিজয় লাভ করেন। বিজিত অঞ্চলের শাসনভার তিনি অর্পন করেন তাঁর জামাতা ও সেনাপতি কুতুবউদ্দিন আইবেকের হাতে। অন্যদিকে ১২০৩ থেকে ১২০৫ সালের মধ্যে পূর্ব-ভারতে হিন্দু শাসনের অবসান ঘটান আরেক তুর্কি সেনাপতি ইখতিয়ার উদ্দীন মুহাম্মদ বিন বখতিয়ার খলজী। ১২০৬ সালে মুহাম্মদ ঘুরীর মৃত্যুর পর কুতুবউদ্দিন আইবেক ভারতে স্বাধীন মুসলিম সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। এভাবে ভারতবর্ষে হিন্দু শাসনের স্থলে শুরু হয় মুসলিম শাসন। সেই সাথে সমাপ্তি ঘটে যায় ভারতবর্ষের ইতিহাসের প্রাচীন যুগের; সূচনা হয় ভারতীয় মধ্যযুগের।

লেখক: আসিফ আযহার
শিক্ষার্থী, ইংরেজি বিভাগ, শাবিপ্রবি
ই-মেইল: [email protected]
ওয়েবসাইট: http://www.asifajhar.wordpress.com
ফেসবুক: Asif Ajhar, যোগাযোগ: 01785 066 880

মন্তব্য ৩ টি রেটিং +৩/-০

মন্তব্য (৩) মন্তব্য লিখুন

১| ১১ ই ডিসেম্বর, ২০১৮ দুপুর ২:৫৭

রাজীব নুর বলেছেন: যত পড়ছি, তত জানছি।আর যত জানছি তত বিচলিত হয়ে পড়ছি।

২| ১১ ই ডিসেম্বর, ২০১৮ বিকাল ৪:১০

ঝড়ের পাখি বলেছেন: ধন্যবাদ! কিছুদিন ধরে এমন লেখা খুজছিলাম। আর্য এবং অনার্দেয দের স্ম্পর্কে আরো জানতে চাই

৩| ২৯ শে ডিসেম্বর, ২০১৮ রাত ১০:১০

পুকু বলেছেন: মহাভারত ও রামায়ণকে ক্লাস ওয়ানের বাচ্চার পাঠযোগ্য করে লিখলে যেরকম দাড়ায়,আপনার এই অধ্যায়টি ঠিক সেই রকম মনে হল। আর্য সভ্যতার প্রতি আপনার দৃষ্টিভঙ্গি কেমন যেন একপেশে ও বেশি সরলীকরণ মনে হল।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.