নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
রঙমালা আদর্শ হাইস্কুলের শিক্ষক নূরউল্লাহ বিএসসি কে দেখলে যে কেউ গ্রাম্য চাষা বলে ভুল করবে। সকালে ফজরের নামাজ পড়ে মাথায় গামছা বেঁধে হাতে কাস্তে কোদাল নিয়ে বাড়ির সামনে বেগুন ক্ষেত নিড়াতে ব্যস্ত তিনি। বাড়ির সাথে লাগোয়া জমিটাকে পাঁচ খন্ডে ভাগ করে এখানে চার কিসিমের সবজি আর মরিচ লাগিয়েছেন। চার পাশে উঁচু আইলে শিম। ছোট ছোট চারা গুলোতে সবে নতুন কুঁড়ি আশা শুরু করেছে। ছাই ছিটিয়ে দিতে হবে, নইলে কচি পাতার লোভে পোকারা ছুটে আসবে। ছাই ছিটিয়ে কোদাল হাতে মাটি কোপাতে থাকেন পাশের ক্ষেতে অলু মুন্সিও ক্ষেতের আইলের কাছায় গজিয়ে উঠা শক্ত শক্ত ঘাস লতা কোদাল দিয়ে কেটে কেটে আইলের উপর রাখছেন। অলু মুন্সি পুরনো চাষা বিএসসির বাপের সাথে এক সাথে চাষ বাস করত।
‘খবর কি মাস্টর? চারা ত জিয়ে গেছে। গোবর মারি দিও।’
‘ভাল। কি লাগাইবেন, চাচা?’
‘কপ্পি লাগামু। কিন্তুক বীজের যা দাম, খরচাপাতি দিয়া আগের মত পোষায় না। না করিও আর কি করমু। তোমার মত আমার ত আর চাকরি বাকরি নাই। পোলাপাইনও কথা শুনে না। যা করার নিজেরে করন লাগে। একেক জন লাট সাবের বেটা, ন টার আগে ঘুম ভাঙে না। এদিকে মাইয়া নাইয়ুর আইছে, সেখানেও ঝামেলা। পুকুরে জাল নামাইতে অইব, বাজার ঘাট করা লাগবে।’
‘মলির কি খবর? সুখে শান্তিতে আছে?’
‘হ আছে, বেয়ায় বেয়াইন মাডির মানষ। জামাইর আয় রোজগার ভাল আছে।’
‘কি করে?’
‘বাজারে তরি তরকারির দোকান আছে, ক্ষেত গিরস্তিও আছে। তোমার বাড়ির খবর কি? শুনলাম বউয়ের অসুখ নাকি বেড়েছে।’
‘জি, চাচা। দুই দিন ধরে অসুখ টা বেড়েছে।’
মিলির মায়ের হাঁপানির সমস্যা। আছে মাঝে মাঝে খুব বেড়ে যায়। তখন ঘরের কেউ আর ঘুমাতে পারে না। ঢাকা চট্টগ্রাম নিয়ে ভাল চিকিৎসা করানো দরকার। টাকাপয়সার ব্যপার। জমানোর চেষ্টা যে করছে না তা নয়। বর্গা দেয়া জমি গুলো ছড়িয়ে নিয়েছেন। আগে টিউওশনি করতেন না, কেমন যেন বিবেকে লাগত। কোন ছেলে মেয়ে প্রাইভেট পড়তে চাইলে ধমকে উঠতেন। এখন বিকেলে স্কুল শেষে ব্যাচ পড়ানো শুরু করেছে। তাতে খুব লাভ হচ্ছে বলা যাবে না। ছেলেমেয় গুলো ঠিকমত টাকা দেয় না। ছাত্রছাত্রীদের সাথে টাকা পয়সা নিয়ে খটমট করতে পারেন না। মাছ বাজারের মত মূলামূলিও না। আর এসব না হয়ে পয়সাও আসে না। সংসারে খরচের যত খাত আছে তার মাঝে মাস্টারের বেতন সবচেয়ে নিকৃষ্ট খাত। নিজে থেকে না চাইলে গার্ডিয়ানরা কখনো টাকা পাঠিয়ে দেয় না। স্কুলের বেতন ঠিকমত পাওয়া যাচ্ছে না। কমিটির লোকজন স্কুলের উন্নয়ন নিয়ে ব্যস্ত। স্কুলের উন্নয়ন দরকার। স্কুল ঘর পাকা করতে হবে, দোতলা তিনতলা করতে হবে। খুব জরুরী, মাস্টারদের বেতন জরুরী না। মাস্টার গেলে মাস্টার আসে, বিল্ডিং এত সহজ না।
অলু মুন্সি গুছিয়ে উঠেন। ‘যাই গো মাস্টর, ডুবলার চরে যাইতে অইব, কামলারা আওনের সময় অই গেছে।’
বিএসসি ও গুছিয়ে উঠেন। সকালে কিছুক্ষণ মিলিকে নিয়ে বসেন। নাইনে পড়া মেয়ে পড়ালেখায় একদম জুত না। এখনো উৎপাদকের একটা অংক করতে গেলে তিনবার ভুল করে মিলি। (a-b)2 আর a2-b2 এর পার্থক্য করতে পারে না। দুটারই একই মানে ধরে নিয়ে অংক করে আর বারবার ভুল করে। তিনি স্কুলের বিএসসি শিক্ষক আর তার মেয়ে এই অবস্থা। মনটা ভেঙে যায়। শুধু অংক নয় ইংরেজীতে ‘সে স্কুলে যায়’ ট্রান্সলেশন করতে বললে বলবে ‘হি গো টু স্কুল’। এস বা ইএস এর একটা বিষয় তার মাথায়ই থাকে না। মেয়ের পিছনেও তাই একটু বেশি সময় দিতে হয়। হাত মুখ ধুয়ে মিলিকে ডাকেন। কাচুমাচু ভঙ্গিতে মিলি বইখাতা নিয়ে বসে। বাবার সামনে বসলে মিলির বুক ধড়পড় করতে থাকে। তিনি যে খুব বকাঝকা মারধোর করেন তা কিন্তু না। তবুও মিলির ছোট থেকেই ভয় করে। ‘নিউটনের তৃতীয় সুত্রটি বল্’
ভয়ে ভয়ে এ্যাঁ এ্যাঁ করতে করতে ঠিক মত বলে ফেলে।
ভূগোল নে। ঢাকায় যখন সন্ধ্যা ছয়টা তখন নিউইয়র্কের সময় কত বের কর।
মিলিকে পড়তে লাগিয়ে তিনি গোসল করে এসে খেতে বসেন। মিলি বাবাকে খাবার এগিয়ে দিতে থাকে।
‘রুটি কে বানিয়েছে?’
‘আমি’
বিএসসি সাহেবের মনটা ভীষণ ভাল হয়ে যায়। কাল সারারাত বলতে গেলে ঘুমাতে পারেনি মেয়েটা। সকালে উঠে আবার বাবার জন্য নাস্তা তৈরি করেছে। পড়ালেখায় একটু খারাপ তাতে কি? পড়ালেখা কি জীবনের সব কিছু? মেয়েটাকে ভীষণ আদর করতে ইচ্ছে করে। মাঝে মাঝে পড়া লেখা নিয়ে বকাঝকার কথা মনে করে মনটা খারাপ হয়। তাঁর নিজের বাবা বেশ কষ্ট করে তাঁকে বিএসসি পাশ করিয়েছেন। বাবা বলতেন, ‘পড়া লেখা করে যে গাড়ি ঘোড়া চড়ে সে।’ নিজে সারাজীবন রোদে বৃষ্টিতে হাল লাঙল নিয়ে পার করতে করতে ভেবেছেন নিজের ছেলেটা গাড়ি ঘোড়া চড়বে। গাড়ি ঘোড়ার বদলে আবার সেই ক্ষেত খামারি করতে হচ্ছে। তীব্র আগ্রহ আর উত্তেজনা নিয়েই স্কুলে মাস্টারি শুরু করেছিলেন। নিজের ঊনত্রিশটা বইকে মূলধন করে স্কুলে লাইব্রেরি শুরু করেছিলেন। সপ্তায় সপ্তায় ছেলেমেয়েদের কে নিয়ে স্কুলে বিতর্ক সভা বসাতেন। সবশেষে নীতি, দেশপ্রেম নিয়ে বিরাট লেকচার দিতেন। তাঁর দৃড় বিশ্বাস ছিল স্কুল কলেজে নীতি শিখানো হয় না। পরের ছেলে মানুষ করার অদম্য আগ্রহ এখন আর নাই।
‘বাবা, আজ আমি স্কুলে যাব না।’
‘আচ্ছা।’
‘মা নিষেদ করেছে।’ কৈফিয়তের সুরের আবার বলে মিলি।
বাড়ি থেকে বের হলে মতিন বেপারির সাথে দেখা। বেপারির ছেলে তাঁর ছাত্র। গত দুই মাস কোন টাকা পয়সা দেয় নাই। পাঁচশ টাকার একটা নোট বের করে দেন বেপারি। ‘ছেলেটার দিকে একটু খিয়াল রাইখেন মাস্টার সাব। পড়া লেখায় মন নাই। বজ্জাত।’
কাল কি করে বাজার হবে সে টেনশন দূর হয়। ইচ্ছে ছিল টিউশনির একটা পয়সাও সংসারে খরচ করবেন না। মিলির মার জন্য জমা থাকবে। কাল বাজারের চিন্তায় সে কথা মনে থাকে না।
মোড়ের দোকানে বসে চায়ের অর্ডার করেন। প্রতিদিনের নিয়ম। টুকটাক কথা হয় এর তার সাথে। হাসিনা খালেদাকে নিয়ে ভেতরে বেশ তর্কাতর্কি চলছে। বাইরে পাতা টুলে বসে চা শেষ করতে থাকেন। নজু শেখ বলে, ‘খবর শুনছনি মাস্টার?’ তার পর গলা নামিয়ে গোপন খবর দেয়ার মত বলেন, ‘ছিদ্দিক মাস্টরের মাইয়া পলাইছে। দেলু মাঝির পোলার সাথে। গেডগেডিয়া কালা পোলাডা। ছি! ছি!’ যেন পালিয়ে যাওয়াটা দোষের নয়। কালো ছেলের সাথে পালানোটাই দোষের। এই সব গ্রাম্য বিষয়ে উৎসাহ পাননা বিএসসি। নজু শেখ দমে যায়।
‘আরে কি খবর মিয়া?’ বলে হটাৎ করে হাঁক ছাড়ে নজু শেখ। হালাদারদের বাড়ির আবুল মাঝির ছেলে স্বপন রিকসা করে ইয়া বড় এক বোয়াল মাছ নিয়ে যাচ্ছিল। মাছ রিকসায় ধরেন না। মাছের মাথা একদিকে আর লেজ আরেক দিকে বের হয়ে আছে। একগাল হেসে সবার উদ্দেশ্যে লম্বা সালাম দিয়ে যায়। ছেলেটা চট্টগ্রাম থাকে। টেনেটুনে ম্যাট্রিক পাশ করেছিল। এখন পিডিবি’র মিটার রিডার। সমবেত চা খোরদের আলোচনা তখন স্বপনের দিকে মোড় নেয়। ম্যালা টাকা পয়সার মালিক হইছে। বাড়িতে বিল্ডিং উঠাচ্ছে। গত বছর বাপেরে হজ্ব করিয়ে এনেছে। কে একজন বলে, ‘এই গ্রামে মানুষ হইলে একজনই হইছে; মাঝির পোলা স্বপন।’ সকলে একবাক্যে সায় দেয়। স্বপনের কীর্তিগাঁথা চলতে থাকে।
আর নূরউল্লাহ বিএসসি চায়ের কাপ রেখে মানুষ না হতে পারার দুঃখ ভুলতে পরের ছেলে মানুষ করতে ছুটতে থাকেন।
১১ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৫ সকাল ১১:২০
আনু মোল্লাহ বলেছেন: অনেক ধন্যবাদ প্রিয় বিদ্রোহী ভৃগু
আপনার মন্তব্য পেয়ে বরাবরের মত উৎসাহিত বোধ করছি।
শুভ কামনা রইল। ভাল থাকবেন সব সময়।
২| ০৯ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৫ রাত ১১:৪৫
আরণ্যক রাখাল বলেছেন: ভাল লিখেছেন| বিশেষ করে গ্রামের মানুষের ভাষাটা সুন্দরভাবে উঠে এসেছে
১১ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৫ সকাল ১১:২২
আনু মোল্লাহ বলেছেন: অনেক ধন্যবাদ ও শুভেচ্ছা নিবেন প্রিয় আরণ্যক রাখাল ভাই
৩| ১০ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৫ দুপুর ২:১৩
মনিরা সুলতানা বলেছেন: সত্যি তো মিটার রিডাররাই এখন উপরি পয়সার গুনে মানুষের মত মানুষ
অবক্ষয়ের চিত্র ...
লেখায় ভাললাগা
১১ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৫ সকাল ১১:২৫
আনু মোল্লাহ বলেছেন:
এক সময় ছিল যখন মানুষ ঘুষখোরদের ঘৃণা করত। এখন উলটো তারা সম্মানের পাত্র!
অনেক ধন্যবাদ ও শুভেচ্ছা নিবেন প্রিয় মনিরা সুলতানা আপু।
৪| ১০ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৫ দুপুর ২:১৭
লাইলী আরজুমান খানম লায়লা বলেছেন: অনেক সুন্দর আর সাবলীল লেগেছে -- ভাষার প্রয়োগ হয়েছে চমৎকার
১১ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৫ সকাল ১১:২৬
আনু মোল্লাহ বলেছেন: আপনার প্রশংসা হাতপেতে নিলাম প্রিয় লাইলী আরজুমান খানম লায়লা আপু।
অনেক ভাল থাকুন, শুভেচ্ছা রইল
©somewhere in net ltd.
১| ০৯ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৫ রাত ৮:৩৬
বিদ্রোহী ভৃগু বলেছেন: সামাজিক অবক্ষয়ের এক দারুন বাস্তব চিত্র!
কর্পোরেট কালচার যখন ব্যাকবেঞ্চারদের প্রমোট করে .. তখন কে আর ফ্রন্ট বেঞ্চে থাকতে চাইবে!!!
গল্পে ভাল লাগা
+++++++++++++++++++++++