নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
১৯৮৭ সালে আইনজীবী হিসাবে ময়মনসিংহ বারে এবং পরে ঢাকা বারে যোগদান করি। ১৯৯২ সালে সুপ্রিম কোর্ট বারে যোগ দেই।
সংবিধানের ত্রুটি-বিচ্যুতি, অসঙ্গতি: (১৬)
প্রধানমন্ত্রী: সাংবিধানিক স্বৈরাচার
এই সংবিধান প্রধানমন্ত্রীকে স্বৈরাচারী শাসক বানানোর একটা মেশিন। এই সংবিধানের অধীনে যদি একজন সাধু বা সন্ন্যাসীকে প্রধানমন্ত্রী পদে বসানো হয় তাহলে সে পৃথিবীর নিকৃষ্টতম স্বৈরাচারে রূপান্তরিত হবে, ইতিহাস তার প্রমাণ।
সংবিধানে প্রধানমন্ত্রী শব্দটা ব্যবহার করা হয়েছে মাত্র ২৯ বার কিন্তু রাষ্ট্রপতি শব্দটা ১৬৩ বার। শব্দ সংখ্যা দিয়ে বিবেচনা করা হলে মনে হতে পারে প্রধানমন্ত্রী নিতান্ত ক্ষমতাহীন পক্ষান্তরে রাষ্ট্রপতি মহা পরাক্রমশালী।
১৬৩ বার রাষ্ট্রপতির নাম ব্যবহার থেকেই বুঝা যায় যে সংবিধানে রাষ্ট্রপতির উপর অনেক ক্ষমতা অর্পণ করা হয়েছে। কিন্তু রাষ্ট্রপতিকে যেসব ক্ষমতা দেয়া হয়েছিল ২৯ বার প্রধানমন্ত্রী নাম ব্যবহার করে তার "সব" আবার কেড়ে নেয়া হয়েছে। "সব" শব্দটা সচেতন ভাবে ব্যবহার করা হয়েছে। হা, রাষ্ট্রপতির "সব" ক্ষমতা কেড়ে নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে।
রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা কেড়ে নেয়ার সাংবিধানিক বিধান সমূহ:
৪৮ ধারা (৩) উপধারা: এই সংবিধানের ৫৬ অনুচ্ছেদের (৩) দফা অনুসারে কেবল প্রধানমন্ত্রী ও ৯৫ অনুচ্ছেদের (১) দফা অনুসারে প্রধান বিচারপতি নিয়োগের ক্ষেত্র ব্যতীত রাষ্ট্রপতি তাঁহার অন্য সকল দায়িত্ব পালনে প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ অনুযায়ী কার্য করিবেন:
তবে শর্ত থাকে যে, প্রধানমন্ত্রী রাষ্ট্রপতিকে আদৌ কোন পরামর্শদান করিয়াছেন কি না এবং করিয়া থাকিলে কি পরামর্শ দান করিয়াছেন, কোন আদালত সেই সম্পর্কে কোন প্রশ্নের তদন্ত করিতে পারিবেন না।
৪৮ ধারার বিধানের মাধ্যমে কার্যত রাষ্ট্রপতির সব ক্ষমতা কেড়ে নেয়া হয়েছে। রাষ্ট্রপতি যাবতীয় কাজ করবেন প্রধানমন্ত্রী পরামর্শে (কার্যত নির্দেশে); এই ধারাতে যদিও রাষ্ট্রপতির দুইটি ক্ষমতার কথা বলা হয়েছে কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এই দুইটি ক্ষমতাও পরোক্ষ ভাবে প্রধানমন্ত্রীর উপর ন্যস্ত তা আগেই আলোচনা করা হয়েছে।
৫৫ ধারা (২) উপধারা: প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক বা তাঁহার কর্তৃত্বে এই সংবিধান-অনুযায়ী প্রজাতন্ত্রের নির্বাহী ক্ষমতা প্রযুক্ত হইবে।
এই ধারার মাধ্যমে এটা নিশ্চিত করা হয়েছে নির্বাহী ক্ষমতা একক ভাবে প্রধানমন্ত্রীর উপর ন্যস্ত। এখানে "কর্তৃত্বে" শব্দটা খুব তাৎপর্যপূর্ণ। "প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক" বললেই যথেষ্ট কিন্তু "কর্তৃত্বে" শব্দটি ব্যবহার করে প্রধানমন্ত্রী ক্ষমতাকে নিরঙ্কুশ করা হয়েছে।
৫৬ ধারা (১) উপধারা: একজন প্রধানমন্ত্রী থাকিবেন এবং প্রধানমন্ত্রী যেরূপ নির্ধারণ করিবেন, সেইরূপ অন্যান্য মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী ও উপ-মন্ত্রী থাকিবেন।
(২) প্রধানমন্ত্রী ও অন্যান্য মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী ও উপ-মন্ত্রীদিগকে রাষ্ট্রপতি নিয়োগ দান করিবেন:
(৩) যে সংসদ-সদস্য সংসদের সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের আস্থাভাজন বলিয়া রাষ্ট্রপতির নিকট প্রতীয়মান হইবেন, রাষ্ট্রপতি তাঁহাকে প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ করিবেন।
এই ধারার বিধান অনুসারে মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী ও উপ-মন্ত্রী কে বা কারা হবেন তা নির্ধারণ করবেন প্রধানমন্ত্রী। এক্ষেত্রে আর কারো কোন ক্ষমতা, এমনকি ইচ্ছাও কাজ করবে না। একজন কেরানীর মত রাষ্ট্রপতির কাজ হচ্ছে নিয়ম রক্ষার জন্য কিছু নথিতে সাক্ষর করা।
৫৭ ধারা (২) উপধারা: সংসদের সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের সমর্থন হারাইলে প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগ করিবেন কিংবা সংসদ ভাঙ্গিয়া দিবার জন্য লিখিতভাবে রাষ্ট্রপতিকে পরামর্শদান করিবেন এবং তিনি অনুরূপ পরামর্শদান করিলে রাষ্ট্রপতি, অন্য কোন সংসদ-সদস্য সংসদের সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের আস্থাভাজন নহেন এই মর্মে সন্তুষ্ট হইলে, সংসদ ভাঙ্গিয়া দিবেন।
এই ধারার বিধান দ্বারা এটা স্পষ্ট করা হয়েছে যে রাষ্ট্রপতির কোন ক্ষমতা নাই প্রধানমন্ত্রীকে বরখাস্ত করার বা সংসদ ভেঙে দেয়ার। সংসদ ভাঙতে হলে প্রধানমন্ত্রীর লিখিত পরামর্শের প্রয়োজন হবে।
৭২ ধারা: সংসদের অধিবেশন
তবে আরও শর্ত থাকে যে, এই দফার অধীন তাঁহার দায়িত্ব পালনে রাষ্ট্রপতি প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক লিখিতভাবে প্রদত্ত পরামর্শ অনুযায়ী কার্য করিবেন।
এই ধারায় এটা নিশ্চিত করা হয়েছে যে সংসদ আহবান, স্থগিত বা ভঙ্গ করার কোন নিজস্ব ক্ষমতা রাষ্ট্রপতির নাই। এইসব ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতি প্রধানমন্ত্রীর লিখিত পরামর্শ অনুযায়ী কাজ করবেন। রাষ্ট্রপতির প্রতি ন্যূনতম বিশ্বাসটুকু পর্যন্ত নাই। তাই অনেক জায়গায়ই লিখিত পরামর্শের কথা বলা হয়েছে।
৯২ ধারা: হিসাব, ঋণ প্রভৃতির উপর ভোট
তাহা হইলে রাষ্ট্রপতি প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শক্রমে, আদেশের দ্বারা অনুরূপ মঞ্জুরীদান না করা এবং আইন গৃহীত না হওয়া পর্যন্ত, ঐ বৎসরের অনধিক ষাট দিন মেয়াদ পর্যন্ত উক্ত বৎসরের আর্থিক বিবৃতিতে উল্লিখিত ব্যয় নির্বাহের জন্য সংযুক্ত তহবিল হইতে অর্থ প্রত্যাহারের কর্তৃত্ব প্রদান করিতে পারিবেন।
এই ধারাতেও হিসাব, ঋণ প্রভৃতির ব্যাপারে রাষ্ট্রপতিকে কিছু ক্ষমতা দেয়া হয়েছিল। কিন্তু পরে শর্ত যোগ করে বলা হয়েছে যে রাষ্ট্রপতিকে এই কাজগুলি করতে হবে প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ (প্রকৃত অর্থে নির্দেশে) অনুসারে।
১৪১ক ধারা: তবে শর্ত থাকে যে, অনুরূপ ঘোষণার বৈধতার জন্য ঘোষণার পূর্বেই প্রধানমন্ত্রীর প্রতি-স্বাক্ষর প্রয়োজন হইবে।
১৪১গ ধারা (১) উপধারা: জরুরী-অবস্থা ঘোষণার কার্যকরতা-কালে প্রধানমন্ত্রীর লিখিত পরামর্শ অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি আদেশের দ্বারা ঘোষণা করিতে পারিবেন যে,
১৪১ক, ১৪১ খ, ও ১৪১গ ধারা সমূহে রাষ্ট্রে জরুরী অবস্থা ঘোষণার বিধান রাখা হয়েছে। অনেকের ধারণা জরুরী অবস্থা ঘোষণার ক্ষমতা রাষ্ট্রপতির উপর ন্যস্ত। কিন্তু না, প্রধানমন্ত্রীর লিখিত পরামর্শ ও স্বাক্ষর ছাড়া রাষ্ট্রপতি জরুরী অবস্থা ঘোষণা এবং মৌলিক অধিকার স্থগিত করতে পারবেন না।
সংবিধানে বর্ণিত রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী সংক্রান্ত সবগুলি বিধান একত্রে পর্যালোচনা করলে এটা পরিষ্কার যে রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা একেবারে শূন্য এবং প্রধানমন্ত্রী ক্ষমতা কানায় কানায় পূর্ণ। রাষ্ট্রপতি যেন প্রধানমন্ত্রীর একজন কেরানী। বস (প্রধানমন্ত্রী) কখন মৌখিক, কখন লিখিত পরামর্শ (নির্দেশ) দিবেন আর বড় কেরানী (রাষ্ট্রপতি) সেই ভাবে কাজ করবেন। এইরূপ হওয়ার পিছনে মূল কারণ হচ্ছে সংবিধান প্রণেতাদের মনস্তত্ব ও উদ্দেশ্য। তাদের মনস্তত্ব ও উদ্দেশ্য নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে তাই বিস্তারিত আলোচনা না করে শুধু আরেকটি কথা যোগ করা যায় যে সংবিধান প্রণয়নের সময় মূল উদ্দেশ্য ছিল নাগরিকদের পরিবর্তে একজন ব্যক্তিকে সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী করা। তার প্রতিফলন এই সংবিধান।
জনরাষ্ট্র ভাবনা-২০
©somewhere in net ltd.