নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
১৯৮৭ সালে আইনজীবী হিসাবে ময়মনসিংহ বারে এবং পরে ঢাকা বারে যোগদান করি। ১৯৯২ সালে সুপ্রিম কোর্ট বারে যোগ দেই।
সংবিধানের ত্রুটি-বিচ্যুতি, অসঙ্গতি: (১২)
রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি: শুভঙ্করের ফাঁকি: (৫)
পুনরাবৃত্তি: সংবিধানের প্রস্তাবনায় ও দ্বিতীয় ভাগে রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি সমূহ বর্ণনা করা হয়েছে। দ্বিতীয় ভাগে মোট ১৮টি ধারায় মূলনীতিগুলো বর্ণনা করা হয়েছে। এই মূলনীতিগুলিতে এত অসঙ্গতি ও ফাঁকি বিদ্যমান যে হাজার হাজার পৃষ্ঠা লিখেও শেষ করা যাবে না। আমি বিদগ্ধ পাঠকদের শুধু মনোযোগ আকর্ষণ করার জন্য খুব সংক্ষেপে আলোকপাত করবো।
"জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার সেই সকল আদর্শ এই সংবিধানের মূলনীতি হইবে"
জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র, এবং ধর্মনিরপেক্ষতা—এই চারটি মতবাদই আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থার গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ হিসেবে বিবেচিত হয়। তবে এদের মধ্যে একাধিক দিক দিয়ে মতানৈক্য এবং বৈপরীত্য দেখা যায়। তাই কোন সংবিধানে এই ধরণের বিপরীত মতাদর্শকে একত্রে সন্নিবেশিত করা একটি মারাত্মক ত্রুটি।
আমরা খুব সংক্ষেপে সংবিধানের এই চারটি মূলনীতির বৈপরীত্য নিয়ে আলোচনা করবো।
জাতীয়তাবাদের সাথে সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার বৈপরীত্য:
জাতীয়তাবাদ এমন একটি মতবাদ যা জাতি, জাতীয় সত্তা, এবং একটি নির্দিষ্ট ভৌগোলিক সীমানার জনগণের মধ্যে ঐক্য ও সংহতি গড়ে তোলে। এটি সাধারণত একটি জাতির ভাষা, সংস্কৃতি, ইতিহাস এবং স্বার্থকে অগ্রাধিকার দেওয়ার মাধ্যমে প্রতিফলিত হয়। অর্থাৎ জাতীয়তাবাদ একটি নির্দিষ্ট জাতির স্বার্থকে অগ্রাধিকার দেয়, কিন্তু সমাজতন্ত্র জাতিগত বা জাতীয় স্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠতে বলে। এ কারণে অনেক জাতিরাষ্ট্র এই মতবাদকে তাদের সার্বভৌমত্বের জন্য হুমকি হিসেবে দেখে।
জাতীয়তাবাদ গণতন্ত্রের বিপরীত অবস্থানে দাঁড়িয়ে জাতিগত ও ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের অধিকারকে হুমকির মুখে ফেলে দেয়। এটি গণতন্ত্রের সার্বজনীনতার মূলনীতির সঙ্গে বৈপরীত্য সৃষ্টি করে।
জাতীয়তাবাদ একটি নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর স্বার্থকে অগ্রাধিকার দেয়, ফলে অন্য গোষ্ঠী বা জাতির প্রতি বৈষম্য সৃষ্টি করে। অন্যদিকে, গণতন্ত্রের সার্বজনীনতা সব নাগরিকের সমান অধিকার ও সুযোগের ওপর জোর দেয়। গণতান্ত্রিক মতাদর্শে জাতিগত বা সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যকে স্বীকার করে এবং সকলের প্রতি সমান আচরণ করে। তাই জাতীয়তাবাদের পক্ষপাতিত্ব গণতান্ত্রিক সমতার নীতির বিপরীত।
জাতীয়তাবাদ সংখ্যাগরিষ্ঠের স্বার্থকে প্রাধান্য দিয়ে সংখ্যালঘুদের অধিকার হরণ করে। তাই জাতীয়তাবাদী সরকারগুলো বিভিন্ন সময়ে অভিবাসী, আদিবাসী, নৃগোষ্ঠী , ধর্মীয় সংখ্যালঘু, বা ভিন্নমতের মানুষদের অধিকারকে ক্ষুণ্ণ করেছে। এর বিপরীতে গণতন্ত্র সকলের অধিকার সুরক্ষিত রাখার চেষ্টা করে, যার ফলে এখানে জাতীয়তাবাদ ও গণতন্ত্রের মধ্যে স্পষ্ট বৈপরীত্য দেখা দেয়।
গণতন্ত্রের সার্বজনীনতা আন্তর্জাতিক নীতি ও সহযোগিতার ওপর জোর দেয়, যেখানে মানবাধিকার ও ন্যায়বিচারের আদর্শকে সর্বত্র সমানভাবে প্রযোজ্য বলে মনে করা হয়। জাতীয়তাবাদ এই আন্তর্জাতিক সংহতির নীতির বিরোধী অবস্থান নেয় এবং কেবল নিজ জাতির স্বার্থকেই অগ্রাধিকার দেয়, যা গণতন্ত্রের সার্বজনীন নীতির সঙ্গে বিরোধ সৃষ্টি করে।
জাতীয়তাবাদের একটি নেতিবাচক দিক হলো বহিরাগতদের প্রতি বিদ্বেষ, যা অভিবাসন বিরোধী নীতি, বর্ণবাদ, এবং জেনোফোবিয়ার মতো প্রবণতাকে উস্কে দেয়। গণতন্ত্র, বিপরীতভাবে, সহিষ্ণুতা, মানবিক মর্যাদা, এবং ব্যক্তিগত স্বাধীনতার পক্ষে দাঁড়ায়, যা জাতীয়তাবাদের সংকীর্ণ মনোভাবের সঙ্গে সাংঘর্ষিক।
জাতীয়তাবাদ ধর্মনিরপেক্ষতার বিরোধী, কারণ এটি একটি নির্দিষ্ট ধর্মকে জাতীয় পরিচয়ের অংশ করে তোলে।
সমাজতন্ত্রের সাথে জাতীয়তাবাদ ও গণতন্ত্রের বৈপরীত্য:
সমাজতন্ত্র হলো এমন একটি অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ব্যবস্থা যা সমাজের সকলের মধ্যে সম্পদের সমান বণ্টন এবং সমষ্টিগত মালিকানার উপর জোর দেয়। সমাজতন্ত্র ব্যক্তিগত সম্পত্তির উপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করে এবং সম্পদের বণ্টনের ক্ষেত্রে সামাজিক ন্যায়বিচারের উপর গুরুত্বারোপ করে।
সমাজতন্ত্র ব্যক্তিগত উদ্যোগ এবং মালিকানার বিরোধিতা করে যা জাতীয়তাবাদের মূল প্রবণতার সঙ্গে বৈপরীত্য সৃষ্টি করে, কারণ জাতীয়তাবাদ একটি নির্দিষ্ট জাতির অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক প্রভাব বিস্তারের ওপর জোর দেয়।
সমাজতন্ত্রের কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ ও সম্পদ বণ্টনের ধারণা গণতান্ত্রিক বাজার ব্যবস্থার সঙ্গে সাংঘর্ষিক । সমাজতান্ত্রিক মতাদর্শ ব্যক্তিগত স্বাধীনতা এবং উদ্ভাবনের পরিপন্থী, ফলে সমাজতান্ত্রিক মতবাদ গণতন্ত্রের পরিপন্থী।
সমাজতান্ত্রিক মতাদর্শ রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থা যা সম্পদের সম বণ্টন, সমতা, এবং সমষ্টিগত মালিকানার ওপর জোর দেয়। এই মতাদর্শ ব্যক্তিগত মালিকানা ও সম্পদের প্রতি নিয়ন্ত্রণ আরোপ করে এবং সমাজের সবার জন্য সমান সুযোগ নিশ্চিত করার চেষ্টা করে।
গণতন্ত্র হলো এমন একটি রাজনৈতিক ব্যবস্থা যা ব্যক্তিগত স্বাধীনতা, মত প্রকাশের স্বাধীনতা, এবং জনগণের দ্বারা নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে শাসন প্রতিষ্ঠার ওপর নির্ভর করে। গণতন্ত্রের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো ব্যক্তির স্বাধীনতা ও সৃজনশীলতা এবং ব্যক্তিগত উদ্যোগকে উৎসাহিত করা।
সমাজতান্ত্রিক মতাদর্শ ব্যক্তিগত সম্পত্তির অধিকার এবং ব্যক্তিগত উদ্যোগের ওপর সীমাবদ্ধতা আরোপ করে। সম্পদ ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে সরকারের কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ ও পরিকল্পনা থাকে। ফলে, ব্যক্তি তার ইচ্ছা অনুযায়ী সম্পদ ব্যবহার করতে বা ব্যবসা পরিচালনা করতে পারে না। এই নিয়ন্ত্রণ ব্যক্তির স্বাধীনতার উপর সীমাবদ্ধতা আরোপ করে, যা গণতন্ত্রের ব্যক্তিস্বাধীনতার মূলনীতির পরিপন্থী।
গণতন্ত্রের মূলনীতি ব্যক্তিগত অধিকার, স্বাধীনতা, এবং মত প্রকাশের স্বাধীনতা সুরক্ষিত করে। এটি বিশ্বাস করে যে ব্যক্তি তার স্বাধীনতা এবং সৃজনশীলতার মাধ্যমে সমাজে অবদান রাখবে। সমাজতান্ত্রিক নিয়ন্ত্রণ এই ব্যক্তিস্বাধীনতাকে হ্রাস করে, যা গণতান্ত্রিক নীতির বিরোধী।
সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থায় উদ্ভাবনের প্রণোদনা কম থাকে, কারণ ব্যক্তি বা সংস্থা তাদের উদ্ভাবনের ফলাফল থেকে সরাসরি আর্থিক বা ব্যক্তিগত লাভবান হতে পারে না। সমাজতন্ত্রে সম্পদ সম-বণ্টন করা হয় এবং লাভের একটি বড় অংশ রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণে থাকে, যা ব্যক্তিগত উদ্যোগকে নিরুৎসাহিত করে। উদ্ভাবন এবং প্রযুক্তিগত অগ্রগতি সাধারণত ব্যক্তিগত লাভের মাধ্যমে পরিচালিত হয়, যা এই ধরনের সিস্টেমে বাধাগ্রস্ত হয়।
গণতন্ত্রে ব্যক্তিগত উদ্ভাবন ও উদ্যোগকে উৎসাহিত করা হয়। ব্যক্তির সৃজনশীলতা এবং উদ্যোগকে স্বাধীনভাবে বিকশিত হওয়ার সুযোগ দেয়া হয় এবং ব্যক্তি তার উদ্ভাবনের মাধ্যমে অর্থনৈতিক ও সামাজিকভাবে লাভবান হতে পারে। এই স্বাধীনতা গণতন্ত্রের অন্যতম ভিত্তি, যা সমাজতন্ত্রের সীমাবদ্ধতার বিপরীত।
সমাজতান্ত্রিক মতাদর্শ কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণের ওপর ভিত্তি করে একদলীয় বা স্বৈরাচারী শাসনের দিকে ধাবিত হয়। এর ফলে ব্যক্তির রাজনৈতিক স্বাধীনতা সীমিত হয়ে যায় এবং ভিন্নমতের প্রতি সহনশীলতা কমে যায়। অনেক সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থায় বিরোধী মতামত দমন করা হয়, যা গণতন্ত্রের বহুত্ববাদ ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতার পরিপন্থী।
গণতন্ত্রে রাজনৈতিক ক্ষমতা জনগণের হাতে থাকে এবং মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, বহুদলীয় নির্বাচন, এবং সরকারের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার নীতি সমুন্নত থাকে। গণতন্ত্র জনগণের স্বাধীন মতামতের ওপর ভিত্তি করে রাষ্ট্র পরিচালনা করে।
সমাজতন্ত্রে পরিকল্পিত অর্থনীতির ওপর জোর দেওয়া হয়, যেখানে সরকারের নিয়ন্ত্রণে সম্পদ বণ্টন এবং উৎপাদন সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এই নিয়ন্ত্রিত অর্থনীতিতে ব্যক্তিগত ব্যবসা বা উদ্যোক্তাদের উদ্যোগ নেয়ার সুযোগ কম থাকে, যা ব্যক্তিগত স্বাধীনতা ও উদ্ভাবনের পরিপন্থী।
গণতন্ত্রের বাজার অর্থনীতি ব্যক্তিগত মালিকানা, বাজারের স্বাধীনতা এবং প্রতিযোগিতার ওপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠে, যা ব্যক্তিকে স্বাধীনভাবে কাজ করার, সৃজনশীল হওয়ার, এবং উদ্ভাবন করার সুযোগ দেয়। এই অর্থনৈতিক স্বাধীনতা গণতন্ত্রের সার্বজনীন নীতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ।
জনরাষ্ট্র ভাবনা-১৬
©somewhere in net ltd.