নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
মনের আনন্দে লিখতে থাকি, আনন্দ শেষ তো লেখাও শেষ! কেও না পড়লেও কোন অসুবিধে নেই! সবাইকে শুভেচ্ছা!
অপু ভাইয়ের আকার আকৃতি খুব একটা চোখে পড়ার মত নয়। চারফুটের একটু বেশি হবে এবং সর্বসাকুল্যে ওজন ৪৫ থেকে ৫০! চোখে আবার হাই পাওয়ারের চশমা। ছোটবেলা থেকেই বিভিন্ন রোগে ভুগে তিনি ক্লান্ত। তা সেই অপু ভাই শোয়েব আক্তারের অনুকরণে পেস বোলিংএ নিজেকে নিবেদন করলেন। ভীষণ বেগে দৌড়ে এসে ‘আক’ করে একটা আর্তনাদ; এবং হাতটা ঊর্ধ্বমুখী রেখে পিচের উপর ধরাশায়ী অপু ভাই। আমরা সবাই ছুটে গেলাম, দেখি তিনি ক্রমাগত চিৎকার করে যাচ্ছেন। হাত টা নাকি আর নামছে না। ধরাধরি করে তাকে নিকটস্থ ফার্মেসিতে স্থানান্তর করা হল; বেচারার কাঁধের জোড়া টা তার অদম্য স্পৃহার সাথে তাল মেলাতে না পেরে স্থানচ্যুত হয়েছে। ভেবেছিলাম সেই বুঝি শেষ, মাঠের দিকে আর হয়তো পা বাড়াবেন না তিনি। কিন্তু আমরা আসলে তখনও বুঝিনি তিনি কোন ধাতুতে গড়া। দুদিন বাদেই দেখি তিনি ব্যান্ডেজ সহ মাঠে এসে আম্পায়ার হিসেবে দাঁড়িয়ে গেছেন। আমাদের অবশ্য তাতে ক্ষতি হচ্ছিল না। অপু ভাই আম্পায়ার হিসেবেও নিবেদত “টিম প্লেয়ার”। আমাদের কারও পায়ে বল লেগে আবেদন উঠলেই অপু ভাই গম্ভীর মুখে বলে উঠেন, “মিসিং লেগ”। অপু ভাই অনেক সিনিয়র, তাই বোলার গজ গজ করতে করতে ফেরত যেত, কিন্তু প্রতিবাদ করার সাহস পেতোনা। আমরা একদঙ্গল পিচ্চি আর অপু ভাই আমাদের কাপ্তান। অপু ভাই কি পড়ত, অথবা কি করত সেটা আমরা জানতাম না। তবে উনাকে আমরা অসম্ভব পছন্দ করতাম।
আমাদের পাড়ায় গলি বনাম গলি কোক বাজি খেলা হত। আমাদের স্পন্সর অপু ভাই। কোক বাজি হারলে তিনি ফিরতি ম্যাচ ঠিক করে ফেলতেন কিভাবে যেন। আমাদের কখনও তাই কোক খাওয়া হয়নি বাজি জিতে এবং কাওকে খাওয়াতেও হয়নি। অপু ভাইদের বাসার ঠিক সামনের গলিতে আমাদের প্র্যাকটিস চলত। একটা ভালো ব্যাট ছিল, যেটা ম্যাচের দিন বের হত। আমরা প্র্যাকটিস করতাম নারিকেল গাছের ডাল কেটে বানানো ব্যাট দিয়ে। প্র্যাকটিস শেষে অপু ভাই সবার জন্যে লেবু আর আদা নিয়ে আসতেন। অপু ভাইয়ের মত মানুষেরা আসলে স্বপ্নদ্রষ্টা; আমাদের মত না। তাই আস্তে আস্তে আমাদের পিচ্চি এই দলটার জন্যে তিনি প্যাড, গ্লাভস, ব্যাট, হেলমেট সব কিভাবে যেন যোগাড় করে ফেললেন। টেপ টেনিস ছেঁড়ে আমরা কাঠের বল ধরলাম। কিন্তু এত দাম দিয়ে কাঠের বল কেনা আমাদের সাধ্যের বাইরে ছিল। অপু ভাই কোথা থেকে যেন আমাদের জন্যে পুরনো কাঠের বল যোগাড় করলেন। সেটা দিয়েই শুরু হল, কিছুদিনের মধ্যে কাঠের বলের উপরের খোসা ছিরে বের হয়ে এল আসল “কাঠের বল”। কাল কুচকুচে সেই নিরেট কাঠের পিণ্ডটি আমাকে বেশ কিছুদিন ভুগিয়েছে ভাঙ্গা নখের যন্ত্রণায়। আমাদের এত উৎসাহের পেছনে ছিল, “খালেদ মাসুদের ছক্কা”। কিলাত কিলাব মাঠের “করদমাক্ত আকাশ আর মেঘাচ্ছন মাঠ” আসলে ছড়িয়ে পরেছিল পুরো বাংলাদেশে। অপু ভাই বললেন, আমরা একটা দল বানিয়ে তৃতীয় বিভাগের বাছাইয়ে খেলব। দলের নাম হবে “ইয়াং স্টারস ক্রিকেট ক্লাব”।
সেগুলো অবশ্য আরও পরের কাহিনী। অপু ভাইয়ের আসল অবদান ছিল অন্য জায়গায়। তিনি আমাদের নির্মল বিনোদনের উৎস ছিলেন। কাঁধের জোড়ার ঘটনার পর তিনি বোলিঙে ক্ষ্যন্ত দিয়ে নিয়মিত উইকেট কিপিং শুরু করলেন। বল শুধু উনার বরাবর আসলেই তিনি ধরতেন। বাকি সময় উনাকে কাভার করতে আরও দুজন ফিল্ডার লাগত। উনার উইকেট কিপিং ক্যরিয়ারের সমাপ্তি ঘটাল আমাদের দ্রুত গতির বোলার জনি ভাই। উনার বল ব্যাটসম্যান অনেক কষ্টে দেখতে পেত, আর অপু ভাইত চোখে চশমা পড়া! বল ব্যাটসম্যান এবং অপু ভাইয়ের গ্লাভস ফাঁকি দিয়ে আঘাত করলো নিখুঁত নিশানায়, যাকে বলে বুলস আই! মাঠের সকলে একযোগে ‘আউ’ বলে হাক ছাড়ল, আর অপু ভাই আবার ধরাশায়ী। ভাগ্যিস টেপ টেনিস ছিল, নাহলে...। যাই হোক এরপর থেকে তিনি মিডঅফ ছাড়া অন্য কোথাও দাঁড়াতেন না। ব্যাটসম্যান হিসেবে তিনি টেন্ডুলকারের অনুসরন করতেন, মানে ভাবে আরকি। বোলার উনার ভাবেই অর্ধেক ভয় খেয়ে যেত। অবশ্য সেটা ক্ষণিকের জন্যে। অপু ভাই কখনও দুই অঙ্কে পৌছাতে পাড়েননি। একবার মিরপুর আউটার স্টেডিয়ামে খেলা হচ্ছিল, অপুভাই সকল ধরনের গ্লাভস প্যাড জড়িয়ে ভাবের সাথে একটা বল পুল করলেন! ঠকাস করে শব্দ হল কিন্তু আমরা আর বল দেখছিলাম না। অপু ভাই রানের জন্যে দৌড়াচ্ছেন আর উনার পেছনে ফিল্ডার দৌড়াচ্ছে। মধ্য পিচে ওনাকে জড়িয়ে ধরে কুপোকাত করে ফেলল ফিল্ডারটি। আমরা হই হই করে উঠতেই দেখি, ফিল্ডারটা কোথা থেকে যেন বল বের করে অপু ভাইকে রান আউট করে দিল। অপু ভাই গজ গজ করতে করতে ফিরলেন! “ এইসব অভদ্র পোলাপাইনের লগে আর খেলা ফালাইবি না! মুরুব্বী মানে না, বেয়াদ্দপ!” আমরা অনেক কষ্টে হাসি চেপে অপু ভাইরে বললাম, অপু ভাই, পুলটা কিন্তু একেবারে লারার মত মারছিলেন! অপু ভাই ব্যাট নিয়ে তাড়া করলেন আমাদের।
অপু ভাই মানুষকে খুব সুন্দর পটাতে পারতেন। তাই উনি ছিলেন আমাদের মুখপাত্র! গলিতে খেলার সময় বিভিন্ন রকমের ইমারজেন্সি দেখা দিত, এগুলো সব অপু ভাই সামাল দিতেন। যেমন একবার কামরুল বল ঢুকিয়ে দিল ইন্ডিয়ান এক বুড়ির টয়লেটে! বল উদ্ধার করতে গিয়ে সে ফেরত এসে ঘোষণা দিল, ঐ বলের মায়া ত্যাগ করতে। তা সেটা আমরা করলাম, কিন্তু পরদিন বুড়ির চিৎকারে পাড়া গরম হয়ে গেল!
-এই হারামজাদার দল, তরা খেলস ভালো কথা, আমার হাগা বন্ধ করে দিলি ক্যান!!!
তা অপু ভাইয়ের কুইক রিএকশনে সেদিন মান সম্মান বেঁচেছিল। সুইপার এসে সেই বল বের করে দিল, আর আমাদের কপালে জুটল আরও কিছু গালি। অপু ভাই বুড়িরে এমন তেল দিল যে বুড়ি পরে আমাদের ডেকে বলল, বাবারা তোমরা তো পুলাপাইন, খেলবাই। মনে কষ্ট নিয় না!
টেস্ট পরিক্ষার মৌসুম চলে এল, মাঠে গিয়ে খেলার উপর নিষেধাজ্ঞ্যা আরোপিত হল। কি আর করা, অপু ভাই ফিঙ্গার ক্রিকেট আবিষ্কার করলেন। দুইজনে খেলা যায়। ফিল্ডার হল সব ফেলে দেয়া ওল্ড স্পাইসের শিশি। কাঠের ব্যাট আর মার্বেলের বল। সিগারেটের প্যকেট কেটে বানানো হল গ্লাভস, আঙ্গুলে পুড়ে ভেতরে তুলা গুজে দেয়া। জনি ভাইয়ের বাসায় শুরু হল এই খেলা, এতটাই জমে গেল যে আমরা ফিঙ্গার ক্রিকেটের বিশ্বকাপ আয়োজন করে ফেললাম। জনি ভাইদের ছাদের সাথে ঝুল বারান্দা হল আমাদের স্টেডিয়াম। ঢালাই করে পিচ বানান হল। অপু ভাই পোস্টার ছাপালেন, দর্শক গ্যলারি হল। চরম উত্তেজনা।
তখন আবার বাংলাদেশের প্রথম বারের মত বিশ্বকাপে গমনের বছর। অঙ্ক পরীক্ষার আগের দিন রাতে বাংলাদেশ পাকিস্তানের সেই ঐতিহাসিক ম্যাচ। আমাদের বাসায় কি কারণে যেন আবার বিদ্যুৎ নেই। হারিকেন জ্বেলে অঙ্ক দেখতেসি। মন পড়ে আছে খেলায়। একটা করে উইকেট পড়ে আর পুরা পাড়ায় চিল্লাচিল্লি, আনন্দউল্লাস! আমি দৌড়ে বারান্দায় যাই। আবার ফিরে আসি। আব্বু আমার অবস্থা দেখে ডাকল
-অঙ্ক সব দেখস?
-দেখসি আব্বু (আর দ্যাখা!)
-পারবা সব?
-পারব (ঘোড়ার ডিম পারব!)
-যাও, খেলা দেইখা আস!
আমি নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারতেছিলাম না। আকর্ণ বিস্তৃত হাসি দিয়ে দৌড়ে বের হয়ে গেলাম। জনি ভাইয়ের বাসায় খেলা দেখতে বসলাম, অপু ভাইও আছেন! আন্টি বললেন, কিরে ব্যটা, পরীক্ষা না! আমি হাসি দিলাম, পড়া শেষ! অপু ভাই বললেন, তরে দিয়েই হবে!
আমারে দিয়ে হয়নি! ইয়াং স্টার ক্রিকেট ক্লাব হল, আমরা খেলা শুরু করলাম নিয়মিত। এরপর হটাত করেই চলে আসলাম অন্যজগতে। সবাই ছাড়া ছাড়া হয়ে গেল, আসলে সবাই বড় হয়ে গেল। শুধু অপু ভাই বড় হলেন না। আমাদের সবাইকে ছেঁড়ে তিনি অন্যদুনিয়ায় পাড়ি জমালেন। কিছু মানুষ চির কিশোর থেকে যায়, উনি সেই ভাগ্যবানদের একজন! অপু ভাইয়ের মৃত্যুর খবর শুনে মনে হয়েছিল খুব আপন কোনও একজন চলে গেছেন। অনেকদিন পর পাড়ায় ঢোকার সময় অপু ভাইয়ের বাসার সামনে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলাম। ভেতরে ঢুকতে ইচ্ছে হয়নি। অপু ভাইকে আমি মনে রাখতে চাই, উনি নেই এটা মেনে নিতে ইচ্ছে করেনি। পাড়ার ছেলে গুল এখন ক্রিকেট খেলেনা, মোড়ে মোড়ে দাঁড়িয়ে মোবাইল টেপে। এরা দুর্ভাগা, এদের অপু ভাই নেই!
উৎসর্গঃ অপু ভাইকে, আল্লাহ্ আপনাকে অনেক ভালো রাখুন!
০৪ ঠা ফেব্রুয়ারি, ২০১৩ সন্ধ্যা ৬:১০
এই সব দিন রাত্রি বলেছেন: অপু ভাইরা নেই বলেই আমাদের আজ এই অবস্থা!
২| ০৪ ঠা ফেব্রুয়ারি, ২০১৩ বিকাল ৩:০০
মোহাম্মদ একরাম হোসেন বলেছেন: অসাধারন লেখা
০৪ ঠা ফেব্রুয়ারি, ২০১৩ সন্ধ্যা ৬:১০
এই সব দিন রাত্রি বলেছেন: ধন্যবাদ ভাই
৩| ০৪ ঠা ফেব্রুয়ারি, ২০১৩ বিকাল ৩:০০
মোহাম্মদ একরাম হোসেন বলেছেন: অসাধারন লেখা
০৪ ঠা ফেব্রুয়ারি, ২০১৩ সন্ধ্যা ৬:১০
এই সব দিন রাত্রি বলেছেন:
৪| ০৪ ঠা ফেব্রুয়ারি, ২০১৩ বিকাল ৩:২৮
হাসান মাহবুব বলেছেন: অপু ভাইয়ের মত মানুষদের চলে যাবার এত তাড়া থাকে কেন বুঝি না। ভালো থাকুন অপু ভাই।
০৪ ঠা ফেব্রুয়ারি, ২০১৩ সন্ধ্যা ৬:১১
এই সব দিন রাত্রি বলেছেন: আমার মা বলেন, ভাল মানুষেরা পৃথিবীতে বেশিদিন থাকেন না
৫| ০৪ ঠা ফেব্রুয়ারি, ২০১৩ বিকাল ৩:৪২
নাজিম-উদ-দৌলা বলেছেন: ভাল থাকুন অপু ভাই, হোক না সেটা অন্য কোনও জগতে!
০৪ ঠা ফেব্রুয়ারি, ২০১৩ সন্ধ্যা ৬:১১
এই সব দিন রাত্রি বলেছেন: আল্লাহ উনাকে জান্নাত নসিব করুন
৬| ০৪ ঠা ফেব্রুয়ারি, ২০১৩ বিকাল ৪:৫৩
শুকনোপাতা০০৭ বলেছেন: খুব সুন্দর গল্প...ভালো থাকুক অপু ভাই
০৪ ঠা ফেব্রুয়ারি, ২০১৩ সন্ধ্যা ৬:১৫
এই সব দিন রাত্রি বলেছেন: জীবন থেকে নেয়া, গল্পের মতই বলতে পারেন! ভাল থাকুন অপু ভাই!
৭| ০৫ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৩ দুপুর ১২:১৪
মহামহোপাধ্যায় বলেছেন: সব পাড়া মহল্লায় একজন করে অপুভাই থাকেন। মুরুব্বীরা তাকে বলেন ভাদাইম্যা আর আমাদের কাছে তিনি সর্বজ্ঞ। অপু ভাইদের খুব মিস করি
০৫ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৩ সন্ধ্যা ৬:১৬
এই সব দিন রাত্রি বলেছেন: আজকের পোলাপাইনরা অপু ভাইদের খুব মিস করে, উনাদের কি ফিরিয়ে আনার কোন ব্যবস্থা করা যায়!
©somewhere in net ltd.
১| ০৪ ঠা ফেব্রুয়ারি, ২০১৩ দুপুর ২:৫৭
তোমার গল্পের মৃত রাজকন্যা বলেছেন:
মন খারাপ হল ...