নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
পৃথিবীর সবচেয়ে বড় দর্শন হল হিসাব বিজ্ঞানের ডেবিট এবং ক্রেডিট । সবসময় যতখানি ডেবিট, ঠিক ততখানিই ক্রেডিট হয় । পরকালের হিসেব যা-ই হোক, এই ইহকালে আমরা ঠিক যেভাবে শূন্য হাতে পৃথিবীতে এসেছি, সেভাবে শূন্য হাতেই পৃথিবী ছেড়ে যাব । এটাই পৃথিবীর আবর্তনিক নিয়ম । অনেকে আমরা এটা বুঝতে ব্যর্থ হই ।আপনি কারো ক্ষতি করবেন তো আজ অথবা কাল আপনার ক্ষতি হবেই হবে । ভালো করলেও তার ফল আপনি জীবদ্দশাতেই পাবেন ।অনেকে দেখবেন রাস্তাঘাটে অযথা হোঁচট খায়, অসুখে ভোগে- এসব এমনি এমনি নয়, হয় এর অতীত, নয়তো ভবিষ্যৎ প্রসারী কোন কারণ আছে । যদি আপনি কারো ক্ষতি না করেন, তবে আমি নিশ্চয়তা দিচ্ছি, আপনার কোন ক্ষতি হবে না । কেউ চেষ্টা করলেও আপনার ক্ষতি করতে পারবে না ।শুদ্ধ থাকুন, শুদ্ধতার শুভ্রতাকে উপভোগ করুন । জীবন সুন্দর হবে ।আমি সবার মতের প্রতিই শ্রদ্ধাশীল।আশা করি আপনিও তাই।সৌজন্যবোধ ও মানবতার জয় হোক !
টিভি সেট তখনও ঘরে ঘরে ছেয়ে যায়নি, এটা ছিল কেবল বড়োলোকেদের দখলে । রঙিন টিভি সারা এলাকায় ছিল মাত্র দুইটি । চৌদ্দ ইঞ্চি একটি সাদাকালো নিপ্পন বা প্যানাসনিক টিভি হলেই ব্যস, সে ঘরের সদস্যদের মাটিতে আর পা পড়ে না !
এই থেকে টিভির বিজ্ঞাপনও হয়েছিল— বাচ্চারা পাশের বাসায় টিভি দেখতে গেলে তারা টিভি দেখতে দেয় না, হিংসে করে বের করে দেয় ! বাচ্চারা এসে কেঁদেকেটে চেহারা ভিজিয়ে ফেলেছে একদম ! অতএব, একটা টিভি আর না কিনলেই নয় ! এটা ছিল দু বছরের গ্যারান্টিসহ কিস্তিতে বিক্রয়যোগ্য নিপ্পন টিভির বিজ্ঞাপন ।
যাইহোক, আমরা বড়োলোক ছিলাম না, এর ওর ঘরে গিয়ে টিভি দেখতাম লজ্জায় মাথা নীচু করে । কেউ অবশ্য বলত না কিছু, উল্টো পিঁড়িটা মোড়াটা এগিয়ে দিত বসার জন্য, কিংবা কারও বাড়ির খাটে উঠে একদম কোণায় গিয়ে সেঁটে যেতাম । সবাই সমাদর করত, এলাকায় পিতার বেশ নামডাক ছিল, ওরকম একটা টিভি যে বাবা চাইলেই কিনতে পারেন এটা সবার জানা । আমাদের বাইরের ঠাঁট যতটা, ঘরে সচ্ছলতা ততটা ছিল না । সেসব বাইরের লোকের জানার কথাও নয় ।
তবু একটা টিভি কেনা বাবার পক্ষে অসম্ভব কিছু ছিল না । কিন্তু বাবা কঠিন, ঘরে টিভি আনলে ছেলেদের লেখাপড়া লাটে উঠবে । যে ঘরে টিভি থাকে সে ঘরের ছেলেপেলে মানুষ হয় না— এরকমটাই ছিল তখনকার মধ্যবিত্ত পরিবারের দর্শন ।
ফল হত উল্টোটা । গুরুত্বপূর্ণ নাটক বা অনুষ্ঠান দেখতে চলে যেতাম বিরাট বিরাট ঝুঁকি নিয়ে । আর বাসায় ফিরে ঢুপুস ঢুপুস কিল হজম করতাম ।
অবশেষে বাবার মত ফিরল, ঘরে টিভি থাকলে ছেলেরা তো আর বাইরে যাবে না, কেবল নিয়ম করে টিভি ছাড়লেই হলো !
মায়ের মুখ উজ্জ্বল করে ঘরে টিভি এলো । উজ্জ্বল হল পড়শীদের মুখও । আমরা দেখলাম "সংশপ্তক" নাটক, "আজ রবি বার", আরও যেন কী কী সব নাম এখনও মনে থাকার কথা নয় । তবে রূপনগর নাটকটার কথা কেউ ভুলবে বলে মনে হয় না ! মনে আছে বদি আর বাকের ভাইয়ের কথা । এগুলো হয়ত আরো পরের কথা, টিভি আনার পর ঘরে অনেক উৎসুক মানুষের ভীড়সহ একসঙ্গে দেখা একটি নাটক এখনও একটা বড়োসড়ো দাগ কেটে আছে মনে ! নাম মনে নেই, অভিনেতাকেও মনে নেই, শুধু মনে আছে, পেটমোটা এক লোক তার মেয়েকে নিয়ে ভিক্ষা করে বেড়ায়, গান ছিল দুইটা— "দ্বীনের নবী মোস্তফায় রাস্তা দিয়া হাঁইটা যায়...", আর— "তুই যদি আমার হইতি রে.. ও বন্ধু.."।
সারাদিন ভিক্ষা করে পেটমোটা লোকটা বেশ ক্ষুধার্ত আর ক্লান্ত । তারা থাকে সিমেন্টের যে গোল গোল পাইপের মতো চাঁই থাকে, ওগুলোর মধ্যে । লোকটা তার মেয়েকে নিয়ে পাইপের দেয়ালে ঠেস দিয়ে বসে আছে । বৌটা পাইপের বাইরে অদূরে ভাত চড়াতে বসেছে । টগবগ করে ফুটছে চাল । মেয়েটা করুণ সুরে গেয়ে চলেছে—
"তুই যদি আমার হইতি রে
ও বন্ধু,
আমি হইতাম তোর..."
আর একটু পর পর লোকটা গলা উঁচিয়ে জিজ্ঞেস করে, বৌ রে, ভাত হয় নাই ?
বৌ বিরক্ত স্বরে জবাব দেয়, না । হয় নাই ।
মেয়েটা আবার গান ধরে । লোকটা আবার একটু পর জিজ্ঞেস করে, কই গো ? ভাত হইছেনি ?
বৌ কটমট করে তাকায় ।
গান আবারও চলে । এভাবে পুরো গানটা শেষ হয়, লোকটাও জিজ্ঞেস করে করে হাঁপাতে থাকে । আর বৌটা গানের শেষে ভাতের হাঁড়িটা চুলা থেকে তুলে অমনি স্বামীটার গায়ে ঢেলে দেয় !
ফ্যানের সঙ্গে গরম ভাত গড়িয়ে নামে গা থেকে লোকটার । একটি ভাত গা হতে তুলে নিয়ে করুণ চোখে টিপে দেখে লোকটা, কান্নাভাঙা কণ্ঠে কী যেন বৌকে বলে ওঠে, তাও আর মনে নেই ।
সেই পেলাম অভাবের পরিচয় । আমরাও অভাবী ছিলাম, তবে নিজেদের পিঠ দেখতে না পাওয়ার মতোই অভাবের রূপ সেভাবে উপলব্ধি করতে পারিনি তখনও, যা ওই নাটকটা দেখে পেরেছিলাম !
সেই রাতে বাবা আমাদের শেখ সাদী'র গল্প বললেন । ভ্রমণকালে শেখ সাদী একবার এক আরব মকানে আশ্রয় নেন । আরবদের আতিথেয়তার সুনাম বিশ্বজুড়ে । তারা মেহমানকে নিজে না খেয়ে খাওয়ায়, চাই কি বিদেয় বেলায় যাত্রার সুবিধার্থে যথাসম্ভব দিয়েও দেয় ।
সেরকমই একটি হাবেলীতে উঠলেন তিনি । ভেতর হতে গোশতের কড়া ঘ্রাণ ভেসে আসছে । সে ঘ্রাণে পেট আরো চনমন করে ওঠে, ক্ষুধা বৃদ্ধি পেয়ে রাক্ষসাকৃতি ধারণ করে । গৃহপতি খুশি মনে তাঁকে বসিয়ে রেখে সেই যে উধাও হয়েছেন আর খবর নেই ।
ব্যাপারটা একজন অতিথির পক্ষে দৃষ্টিকটু এবং অবমাননাকর । রাত মোটামুটি অনেক হয়েছে, ভেতর হতে বাচ্চাদের গোশত নিয়ে কামড়াকামড়ির শব্দ ক্ষান্ত হয়েছে বেশ আগে । শুনতে পাচ্ছিলেন তিনি । এতক্ষণে ওরা হয়ত ঘুমিয়েও পড়েছে ।
এমন সময় অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে গৃহপতিটি হন্তদন্ত হয়ে এলেন, দুইটি শুকনো রুটি আর এক মশক জল । —এই খাবার নিয়ে এসেছেন তিনি সম্মানিত অতিথির জন্য !
মুখ তাঁর লজ্জিত, অবনত ।
তাঁর চেহারায় লজ্জা দেখেই কবি জিজ্ঞেস করতে সাহস পেলেন ঘরে গোশত রেখে অতিথিকে কেবল শুকনো রুটি দেবার কারণ !
গৃহপতি এবার কেঁদে ফেললেন । পর্দার ওপাশ হতে জেনানারও ফুঁপিয়ে ক্রন্দন ভেসে এলো ।
কবি আরো সহমর্মী হলেন । কসম দিয়ে জানতে চাইলেন কী এই রহস্য ।
গৃহপতি তখন জানান, ঘরে খাবার নেই তিনদিন যাবত । অনেক চেষ্টা করেও বাচ্চাদের মুখে দেবার মতো দানার যোগাড় করা যায়নি । অবশেষে আজ বাড়ি ফেরার পথে কোথাও একটি মৃত দুম্বা খুঁজে পান তিনি । অতঃপর অসহায় গৃহপতি সন্তানদের বুঝ দিতে, ওদের কান্না থামাবার কথা চিন্তা করে সেই মৃত দুম্বারই কতক গোশত কেটে নিয়ে আসেন ঘরের বাচ্চাদের জন্য । কবি এতক্ষণ সেই গোশতেরই ঘ্রাণ পেয়েছিলেন । আর গৃহপতিটি আবার বের হয়ে গিয়েছিলেন অতিথির জন্য যেভাবেই হোক কিছু খাবার সংগ্রহ করে আনতে !
কবি শেখ সাদী চোখের পানি ছেড়ে দিয়েছিলেন । আচিন হতে জলদি কিছু মোহর বের করে খাবার আনিয়েছিলেন তখনই ঘরের সবার জন্য ।
বাবা বলেছিলেন, এই হল অভাব ।
হুম । সন্তানদের অভাব চেনানো খুবই জরুরী । আমরা অভাব চিনেছি । দেখেছি । মুখোমুখি হয়েছি । এবং অভাবের সঙ্গে লড়াইও করেছি, করছি নিরন্তর !
জিততে পারি আর না পারি টিকে তো আছি । এটুকুই বা কম কী ?
২| ১০ ই মার্চ, ২০১৪ বিকাল ৪:৪১
জীয়ন আমাঞ্জা বলেছেন: ধন্যবাদ, সাবির ।
আমরা মধ্যবিত্তের বলেই আর কি ।
©somewhere in net ltd.
১| ০৬ ই মার্চ, ২০১৪ রাত ১০:৫১
এহসান সাবির বলেছেন: আমরা অভাব চিনেছি । দেখেছি । মুখোমুখি হয়েছি । এবং অভাবের সঙ্গে লড়াইও করেছি, করছি নিরন্তর !
জিততে পারি আর না পারি টিকে তো আছি । এটুকুই বা কম কী ?
খুব ভালো লিখেছেন.....
আমার কিছু স্মৃতির সাথে মিলে যায়।
শুভকামনা।