নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

আমি একটি পথ, আপনি চাইলে হেঁটে দেখতে পারেন....

জীয়ন আমাঞ্জা

পৃথিবীর সবচেয়ে বড় দর্শন হল হিসাব বিজ্ঞানের ডেবিট এবং ক্রেডিট । সবসময় যতখানি ডেবিট, ঠিক ততখানিই ক্রেডিট হয় । পরকালের হিসেব যা-ই হোক, এই ইহকালে আমরা ঠিক যেভাবে শূন্য হাতে পৃথিবীতে এসেছি, সেভাবে শূন্য হাতেই পৃথিবী ছেড়ে যাব । এটাই পৃথিবীর আবর্তনিক নিয়ম । অনেকে আমরা এটা বুঝতে ব্যর্থ হই ।আপনি কারো ক্ষতি করবেন তো আজ অথবা কাল আপনার ক্ষতি হবেই হবে । ভালো করলেও তার ফল আপনি জীবদ্দশাতেই পাবেন ।অনেকে দেখবেন রাস্তাঘাটে অযথা হোঁচট খায়, অসুখে ভোগে- এসব এমনি এমনি নয়, হয় এর অতীত, নয়তো ভবিষ্যৎ প্রসারী কোন কারণ আছে । যদি আপনি কারো ক্ষতি না করেন, তবে আমি নিশ্চয়তা দিচ্ছি, আপনার কোন ক্ষতি হবে না । কেউ চেষ্টা করলেও আপনার ক্ষতি করতে পারবে না ।শুদ্ধ থাকুন, শুদ্ধতার শুভ্রতাকে উপভোগ করুন । জীবন সুন্দর হবে ।আমি সবার মতের প্রতিই শ্রদ্ধাশীল।আশা করি আপনিও তাই।সৌজন্যবোধ ও মানবতার জয় হোক !

জীয়ন আমাঞ্জা › বিস্তারিত পোস্টঃ

¤¤¤¤দেহের দাম¤¤¤¤

০৭ ই নভেম্বর, ২০১৩ রাত ১২:৩২

বন্ধ দরজার দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে ফোঁস ফোঁস করে নিঃশ্বাস নিচ্ছে ছালেহা। আঁচল দিয়ে মুখের ঘামটা একবার মুছে নিল ও। হাপরের মত ওঠা নামা করছে বুক। লেখকের ললিত ভাষায় ওর বুককে ভরাট বুক, পয়োধর যুগল- ইত্যাদি ইত্যাদি বলে আখ্যায়িত করা যেত, কিন্তু এখন তা অসমীচীন বোধ হয়। অন্তত খানিক আগে ও যে মূর্তি দেখিয়েছে, তার পরে আর এ সাহস দেখানো চলে না।

তেইশ বছরের উদ্ধতযৌবনা ছালেহা। শ্যামবর্ণা কালোশশী প্রকৃতির শরীর। তার পরিচয় সে কাজের মেয়ে। এর আগে সে আরো তিন জায়গায় কাজ করেছে। এবং সবগুলোই ছেড়ে এসেছে শেষমেশ। কারণ একটাই- তার শরীর।
"আপণা মাংসে হরিণা বৈরি"।
ছালেহা নারী; নারী মানেই নরম মাংস। এই নরম মাংসই হয়েছে ওর কাল।

বাড়ির সাহেবগুলো প্রথম কয়দিন পীরানি ভাব দেখিয়ে পরে সেই ক্রমে ক্রমে ওর শরীরের দিকেই ঘেঁষতে চেয়েছে। অগত্যা ও কাজ ছেড়েছে, তবু মান বিকোয়নি।

মার্জিত রুচিবোধ কী, নীতি শাস্ত্র কী-সে সম্পর্কে ছালেহা কোন বই-ছাপা জ্ঞান পায়নি, সতীত্ব সর্ম্পকে কোন সিনেমাটিক ভাষ্যও তার আত্মস্থ নেই, সে শুধু এটুকু বোঝে, এ মানুষগুলোর এই স্পর্শে তার গা ঘিন ঘিন করে। বার বার ওর মনে প্রশ্ন জাগে, এরা না শিক্ষিত? এরা না মুখে কত বড় বড় কথা পিটিয়ে বেড়ায়?

ঘেন্নায় থুতু জমে ছালেহার মুখে।
ওর এখনকার ঘাম ঝরার কারণ আকমল সাহেব। হ্যাঁ, সাহেব। সাহেব নয়তো কী। একেবারে কেতা দুরস্ত সাহেব। প্রতিদিন স্যুট টাই পরে গায়ে সুগন্ধি মেখে অফিসে যাওয়া সাহেব। ছুটির দিনে আতর মাখা পাঞ্জাবি পরে আকমল সাহেবও জুম্মার ঘরে যান এবং বেশ কয়েকটি সালাম কুড়িয়ে ঘরে ফেরেন অন্যসব সাহেবদের মত। খালাম্মার কাছে শুনেছে সাব নাকি অনেক শিক্ষিত। এই বিরাট শিক্ষিত সম্মানধারী সাহেবটিই একটু আগে ওকে জড়িয়ে ধরার চেষ্টা করেছে। সাপের মত হিসহিসিয়ে ফনা তুলে কড়া চোখের অনুচ্চ প্রতিবাদে দ্রুত সে কামরা থেকে বেরিয়ে এসেছে ও। এখন আরেকটি কামরায় দরজা বন্ধ করে দাঁড়িয়ে আছে। আকমল সাহেব অবশ্য দুবার এসে মান ভাঙ্গানোর চেষ্টা করে গেছেন। ও নড়ে নি।

অজান্তেই নিজের শরীরে চোখ বুলায় একবার ছালেহা। এই শরীর, এই শরীরই যত কাল ওর।

কুমু অবশ্য এটা স্বীকার করে না। সেও অনেকটা ছালেহার মত দেহ লাবন্যের অধিকারিনী, তবে কালোশশী-তুল্য নয়। কুমুও বাসায় কাজ করে এবং বড় চতুরা। সে তার কোমল শরীরকে বিড়ম্বনা নয়, বরদান মূল্য করে। সে এই শরীরের সুবিধা লোটে। বলে, "এই শরীর আছে বলেই তার কদর আছে, এই শরীর আছে বলেই সে সাহেবগুলোর কাছ থেকে বাড়তি টাকা বাগাতে পারে সুযোগ মতো।"

ছালেহার সঙ্গে ওর লেগেছিল একদিন এ নিয়ে। স্বভাববশতঃ কুমুর এই ঘৃণ্য রোজগার নিয়ে বিষাক্ত গালাগালি করতে ছাড়ে নি ছালেহা। উত্তরে অধিক মুখরা কুমু যা যা বলেছিল তা আর এখানে প্রকাশে কাজ নেই।

অথচ তার দুইদিন পরে যখন ছালেহার পুত্র ছাইফুলের মারাত্মক জ্বর হয়। আর তখন টাকা দিয়ে অষুধ কিনতে সাহায্য করে ঐ কুমু-ই। টাকা দেওয়ার দিন কুমু ঈষত্‍ নরম সুরে ছালেহাকে বলেছিল, "বইন, আমরা গরীব অইয়া জরমাইছি দুনিয়াত। কী পাইছি আমরা জীবনডাত? কিচ্ছু পাই নাই। তয় পামু না ক্যান? আদায় করতে ছাড়ুম ক্যান? যেই কয়দিন বাঁচুম শক আল্লাদ মিটাইয়াই বাঁচুম। আমার পোলা মাইয়্যাঁগো যাতে কারো বাইত্তে কাম না করন লাগে হেই বেবস্তা কইরা যামু।"

সত্যিই কুমু পেরেছে। তার ছেলেমেয়ে দুটোই স্কুলে যায়। সপ্তাহে ভালোমন্দ খেতে পায়।

এসব এমনি দেড় হাজার টাকার মাসিক মাহিনায় সম্ভব হত না- যদি না কুমুর এই বাড়তি আয় থাকত।

কুমুর স্বামীও কুমুকে লক্ষ্মী বলে মানে। একেবারে ওর কথায় ওঠবস করে।
করবে না-ই বা কেন। নারায়ণ যে ওরই হাতে। কুমু ঠিক করেছে এবারে ওর অকর্মা স্বামীকে একটি দোকান গড়ে দেবে।

কী-ই বা দোষ তবে কুমুর? আসলে কুমুই হয়তো বুদ্ধিমতী। নিজের আখের গোছাতে পারছে। কী দোষ এতে? কোন দোষ নেই বলেই এবার ছালেহার মনে হয়।

কুমুই বুদ্ধিমতি, ছালেহা বোকা। কুমুর সঙ্গতির সাথে নিজের সঙ্গতির তুলনা করে ছালেহা।
কী হয়, যদি ছালেহাও তার স্বামীকে একটি রিক্সা কিনে দিতে পারে? বেচারার কতদিনের শখ নিজের একটি রিক্সা হয়! তাহলে রিক্সাভাড়া বাবদ দিন দিন এতগুলো টাকা গেরেজ মালিককে দিতে হত না।

কুমুর যুক্তি, সরাসরি বেশ্যাবৃত্তির চেয়ে এই বর্ণচৌর্যই নাকি ভাল। সব গোপন থাকে। তবে কি ছালেহাও ওর মত গোপনে গোপনে বেশ্যা হবে?

নাহ, তা ছালেহা ভাবতে পারে না। তবে ও ভাবছে, অন্তত একটি রিক্সা কেনার ব্যবস্থা ও করবে। একবারই করবে ও। শক্ত হয় ছালেহা। আঁচল দিয়ে আবার ঘাম মোছে, চুল ঠিক করে নেয়। যন্ত্রচালিতের মত এসে দাঁড়ায় আকমল সাহেবের দরজায়।

সারা বাড়ি খালি । বাড়ির বেগমসাহেবা মেয়েকে নিয়ে গেছেন স্কুলে। আকমল সাহেব তখন আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে টাই ঠিক করছিলেন আর মনে মনে এই বিপজ্জনক কাজের মেয়েকে বিদেয় করার পাঁয়তারা করছিলেন। এমন সময় আয়নায় ছালেহাকে দেখতে পেয়ে চোখে তাঁর সবুজ আলো ঝিলিক দেয়। লালসার হাসি হেসে ঘুরে দাঁড়ান তিনি।

"সা..ব... আমাগো ছাইফুলের বাপের... ম্যালা দিন ধইরা... একটা রিশ...কা... কিনোনের শখ আছিল... । যদি.. একখান রিশকা..." কোনমতে কাঠ গলায় জড়িয়ে জড়িয়ে এ পর্যন্তই বলতে পারল ছালেহা। আকমল সাহেবের বুঝতে একটুও দেরী হল না। নিমেষেই গায়ের সাথে সেঁটে এলেন ছালেহার। নোংরামির হাত দিয়ে ওর কাঁধ বেয়ে পিঠ অবধি চেটে চেটে বললেন, "টাকা লাগবে এই তো? তা আগে বলবে তো। পাবে.. যা চাও সব পাবে.. আমি থাকতে কোন চিন্তা নেই তোমার।"

ছালেহাকে বুকের দিকে টানতে থাকেন আকমল সাহেব। ছালেহা হিংস্র হাতে তাঁর কলার খামচে ধরে বিপরীত দিকে ঠেলে রেখে সংকোচ ঝাড়ার প্রাণপণ চেষ্টা নিয়ে বলে ওঠে, "আগেহ.. আগেহ টাকাহহ..."

হকচকিয়ে গেলেন আকমল সাহেব, দাঁত মুখ খিঁচিয়ে বললেন নিকৃষ্ট হাসি দিয়ে, "এহহে.. এ যে তলে তলে পাঁড় খানকি ! অথচ উপরে এত ঠাঁট ! বেশ বেশ, তোকে আমি টাকা দিয়েই কিনব । নেহ টাকা । আয় এবার..."

ছালেহা আরো অবাক হয়ে ভাবল, "হায়রে শিক্ষিতি ! আমার অশিক্ষিত রিশকা অলা স্বামীও তো এমুন জানোয়ারের লাহান কতা কয় নাই কোনদিন । হায়রে ভদ্দর নোক !"

ঘন্টাখানেক পর ক্লান্ত ছালেহা ওই বাড়ির গেট ঠেলে বের হয় । নিজের আঁচলে আরেকবার হাত বুলিয়ে টাকাগুলোর অস্তিত্ব সম্পর্কে নিশ্চিত হয়ে নেয় । খুব ক্লান্তি লাগে ওর, তাই অন্যান্য দিন হেঁটে আসা-যাওয়া করলেও আজ একটা রিক্সা নেয় । প্রাণান্ত চেষ্টা করছে ঘটনাটা ভুলে যেতে । খানিক পর পর কাঁপুনি বোধ করে ও । বুকের ভেতরটা মোচর দিয়ে উঠছে বারবার ।

"নিজের জন্যে তো নয়, যা করেছে স্বামী সন্তানের জন্যে করেছে" -এই যুক্তি দিয়ে ঘেন্না আর গ্লানিকে গলা টিপে মারতে চাইছে।
না, ভুল নয় । স্বামীর জন্য একটা রিক্সা কেনার টাকা যোগাড় করতে পেরেছে ও । নিজেকে একটা জানোয়ারের লালায়িত মুখের সামনে পেতে দিয়ে নিদারুণ নির্যাতন সয়ে ও দশটি হাজার টাকা কামিয়ছে ! নিজের জন্যে নয়, সংসারের জন্য !

শক্ত করে আঁচলে বাঁধা টাকাগুলো আরেকবার চেপে ধরে ছালেহা । যেন, এ কষ্টের টাকা সে কিছুতেই খোয়াতে দেবে না । যেন অমূল্য সম্পত্তি এটি । অনেক দামে কেনা অনেক বড় সম্পত্তি ।

ভাবতে ভাবতে নিজেদের বস্তির কাছাকাছি চলে এসেছে ।
ওর সাত বছরের ছেলে ছাইফুলকে দেখা যায় একটি রিক্সার ড্রাইভিং সিটে বসে বেল বাজানোর চেষ্টা করছে, আর চেঁচিয়ে চলেছে, "টিং টিং... টিডিং.. টিডিং.. যাইব নি ছায়দাবাজ... যাইব নি ছায়দাবাজ...?"

দূর হতে মাকে দেখতে পেয়ে তড়িঘড়ি করে রিক্সা থেকে নেমে চেঁচাতে চেঁচাতে এল ছাইফুল, "মা... মা... লিশকা.. লতুন লিশকা.. আমাগো নতুন লিশকা.. বাজানে আনছে.." ছাইফুলের মুখভর্তি হাসি ।
ধরাস করে ওঠে ছালেহার বুক । "ছাইফুলের বাপে রিশকা কিনছে ? কিনছে তাইলে..? হায় হায়... ! তাইলে ? তাইলে আমি কী করলাম ? ক্যান করলাম... ?"
ঝাপসা হয়ে আসে চোখের সামনের সবকিছু । রিক্সা থেকে থপ করে মুখ থুবড়ে পড়ে ছালেহার নিথর দেহ ।
এ জ্ঞান আর ফিরবে না । ফিরবে বলে মনে হয় না ।

আঁচলে এখনো টাকাগুলো বাঁধা । ছাইফুল হতভম্ব ।

মন্তব্য ১ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (১) মন্তব্য লিখুন

১| ০৫ ই অক্টোবর, ২০১৭ বিকাল ৪:০১

জীয়ন আমাঞ্জা বলেছেন: ড্রাফ্ট হতে মূল পোস্টে আনা হল।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.