নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

চেতনায় মুক্তিযোদ্ধা

সায়েমুজজ্জামান

কাজী সায়েমুজ্জামান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লোক প্রশাসন বিভাগ থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর। দক্ষিণ কোরিয়া সরকারের স্কলারশিপ নিয়ে কিউং হি বিশ্ববিদ্যালয়ে ইন্ডাস্ট্রি অ্যান্ড ট্রেড পলিসি বিষয়ে মাস্টার্স। জন্ম ১৯৮১ সালে চট্টগ্রাম শহরের দামপাড়ায়। তার পূর্বপুরুষ ছিলেন দক্ষিণাঞ্চলের বাউফলের ঐতিহ্যবাহী জমিদার কাজী পরিবার। ছাত্রজীবন থেকেই লেখালেখিতে হাতে খড়ি। তবে ১৯৯৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে তিনি সাংবাদিকতার সঙ্গে জড়িত হন। তিনি যুগান্তর স্বজন সমাবেশের প্রতিষ্ঠাতা যুগ্ম আহবায়ক। ২০০৪ সালে তিনি দৈনিক মানবজমিন পত্রিকায় স্টাফ রিপোর্টার হিসেবে যোগ দেন। পরে ইংরেজী দৈনিক নিউ এজ এ সিনিয়র প্রতিবেদক হিসেবে কাজ করেন। পরবর্তীতে ২৮ তম বিসিএস (প্রশাসন) ক্যাডারের একজন সদস্য হিসেবে সহকারী কমিশনার ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট, সহকারী কমিশনার (ভূমি), সিনিয়র সহকারী কমিশনার, সিনিয়র সহকারী সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এছাড়াও তিনি বাংলাদেশ লোক প্রশাসন প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে রেক্টর (সচিব) এর একান্ত সচিব হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। জাতিসংঘের সংস্থা ইউএনডিপিতে লিয়েনে চাকরি করেছেন। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের এটুআই প্রোগ্রামে ন্যাশনাল কনসালটেন্ট হিসেবে কাজ করেছেন। শিল্প সচিবের একান্ত সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন৷বর্তমানে সরকারের উপসচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি বাংলা ছাড়াও ইংরেজী, আরবী, উর্দ্দু ও হিন্দী ভাষা জানেন। ছোটবেলা থেকেই কমার্শিয়াল আর্টিস্ট হিসেবে পরিচিত ছিলেন। যেকোনো প্রয়োজনে ইমেইল করতে পারেন। [email protected]

সায়েমুজজ্জামান › বিস্তারিত পোস্টঃ

অপরাধের সেকাল ও একাল

০৮ ই মে, ২০২৪ সকাল ৯:১০

সেকাল
--------------------------------------------------------
স্কটল্যান্ডের বাসিন্দা হেনরি বেভারিজ ছিলেন বৃটিশ-ভারতীয় সিভিল সার্ভিসের একজন সদস্য৷বেভারিজ ১৮৭০ সালের মার্চ হতে ১৮৭১ সালের মার্চ এবং ১৮৭১ সালের জুন থেকে ১৮৭৫ সাল পর্যন্ত বৃহত্তর বরিশালের জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ও কালেক্টর ছিলেন৷ তখনকার দিনে বরিশাল বাকেরগঞ্জ জেলা হিসেবে পরিচিত ছিল৷ বরিশালে পাঁচ বছরের দায়িত্ব পালনের সময় তিনি প্রথম বই লেখেন৷ বইটির নাম ডিক্ট্রিক্ট অব বাকেরগঞ্জ: ইটস হিস্ট্রি এন্ড স্টাটিস্টিকস৷ ১৮৭৬ সালে লন্ডন থেকে বইটি প্রকাশিত হয়৷ বইটিতে বরিশাল সম্পর্কে তৎকালীন সমাজ ব্যবস্খার ধারণা পাওয়া যায়৷ তিনি তার ওই বইয়ে দুইটি সত্যি গল্প তুলে ধরেছেন৷ এর মাধ্যমে বাংলাদেশের মানুষের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও বিচার ব্যবস্থার চিত্র তুলে ধরেছেন৷ আজ তার বই থেকে দুইটি গল্প শেয়ার করবো৷ গল্প দুটি সরাসরি তার বই থেকে অনুবাদ করেছি৷ চলুন সেকালের গল্প দুটি শুনে আসি৷

করিমুদ্দীনের গল্প
বাঙালিরা মাঝে মাঝে তাদের প্রতিশোধের আগুনে কতটা মরিয়া হয়ে ওঠে তা দেখানোর জন্য আমি এই গল্পটি উল্লেখ করছি। করিমউদ্দীন একজন নিষ্কর্মা, অলস ও চোর। এক রাতে তাকে কিছু গ্রামবাসী তাদের জাল থেকে মাছ চুরি করতে দেখে ধাওয়া দেয়৷ কিন্তু তাকে ধরতে পারেনি৷ ফলে গালাগালি দিয়েই তাদের সন্তুষ্ট থাকতে হয়। কারিমুদ্দিন গালাগালির প্রতিশোধ নেওয়ার সংকল্প করে৷ পরে সে প্রতিশোধের যে পদ্ধতি অবলম্বন করেছিল তা এককথায় ভয়াবহ। তার বৃদ্ধ বাবা দুই বা তিন বছর ধরে শয্যাশায়ী ছিলেন৷ করিমুদ্দীন তাকে বোঝা মনে করতো৷ সে একটি মুগুর দিয়ে আঘাত করে তার বাবার মাথার খুলি ভেঙে ফেলে৷ তারপরে লাশটি থানায় নিয়ে যায়। যারা তাকে গালাগালি করেছিল তাদের বিরুদ্ধে হত্যার অভিযোগ আনে।
পরবর্তীতে মামলাটি তদন্ত করা হয়৷ আমি এটা বলতে পেরে খুশি যে তদন্তে সত্য বেরিয়ে আসে৷ করিমুদ্দিনকে আজীবনের জন্য দ্বীপান্তরের শাস্তি দেয়া হয়।

জবর উলার গল্প।
প্রায় তিন বছর আগে জবর উলা নামের এক মুসলিম কৃষক তার স্ত্রী ও পরিবার নিয়ে মেঘনা নদীর তীরে বাস করতেন। তার বসতবাড়িটি ছিল যৌথ-অর্থাৎ, তিনি ও তার পরিবার এর একটি অংশে বসবাস করতেন এবং দূর সম্পর্কের আরেকটি পরিবার অবশিষ্ট অংশে দখলে ছিল। বসতবাড়ি লাগোয়া জমি দুটি পরিবার দ্বারা অভিন্নভাবে চাষাবাদ করা হতো৷ এর ফলে ফসল নিয়ে মাঝে মাঝে বিবাদও হতো। উঠানে শুকানোর জন্য বিছিয়ে রাখা তিল ভাগাভাগি নিয়ে প্রতিবেশী পরিবারের এক মহিলার সঙ্গে একদিন জবর উলার ঝগড়া হয়। জবর উলা তার অংশ নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন এবং মহিলা বলেছিলেন যে তিনি তার অংশের চেয়ে বেশি নিচ্ছেন। আমার বিশ্বাস মহিলা তার জিহ্বা বেশ স্বাধীনভাবে ব্যবহার করে৷ যার ফলে শেষ পর্যন্ত জবার উলা এতটাই রেগে যান যে তিনি তাকে আঘাত করার চেষ্টা করেন৷ আর এটি করতে গিয়ে তিনি মহিলার উপরের পোশাকটি ছিড়ে ফেলেন। মহিলার ভাইয়েরা সবেমাত্র ক্ষেত থেকে এসেছিল৷ এসময়মহিলা তাদের কাছে ছুটে গিয়ে তাকে অপমান করার অভিযোগ করে। তার দুই ভাই তৎক্ষণাৎ উঠানে এসে জবর উলাকে ধরে এমন মারধর করে যে সে সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়ে যায়। এতে আতঙ্কিত হয়ে দুজনে তাকে উঠিয়ে মাথায় পানি দেয় এবং শুশ্রুষা শেষে তাকে তার ঘরে নিয়ে তার বিছানায় শুইয়ে দেয়। এর কিছু দিন পর জবর উলার স্ত্রী গ্রামের চৌকিদারের মাধ্যমে থানায় খবর পাঠায় যে তার স্বামীকে পিটিয়ে মেরে ফেলা হয়েছে এবং হত্যাকারীরা তার ঘরে ঢুকে লাশ নিয়ে গেছে। পুলিশ গ্রামে যায়৷ এবং তদন্ত শুরু করে।

জবর উলার মৃতদেহের হদিশ পাওয়া যায়না৷ তবে তার বিধবা স্ত্রী পুলিশকে একটি ধারাবাহিক বিবরণ দেয় যে কীভাবে তার স্বামীকে মারধরের পর দুই বা তিন দিন ধরে অবস্থা খারাপ হয়ে পড়ে এবং সে ও তার মা তার পাশে রাতের পর রাত জেগে সেবা শুশ্রুষা করে। জবর উলা মারা যাওয়ার পর যখন তারা দেখল যে তাদের সব শেষ হয়ে গেছে, এবং নিঃসন্তান অবস্খায় সে বিধবা হয়ে গেছে তখন দুই মহিলা তাদের শোকগাঁথায় কান্না জুড়ে দেয়৷ বাঙালি মহিলারা কান্নার সময় এক ধরনের শোকগাঁথায় তাদের শোকপ্রকাশ করে থাকে। অভিযুক্তরা তাদের কান্না শুনতে পায় এবং চিৎকারের অর্থ কী ছিল তা জানতে পারে৷ জবর উলার মৃতদেহ যেখানে ছিল সেখানে থাকলে তাদের জন্য কোন রক্ষা ছিল না৷ কারণ তাকে মারধরের চিহ্ণ কর্তৃপক্ষ এসে দেখতে পাবে৷ একারণে তারা জবর উলার ঘরের ভেতরে ঢুকে পড়ে। ঘরে শুধু মাদুরের দেয়াল ছিল৷ ফলে তারা সহজেই মৃতদেহ নিয়ে যায়৷ বিধবা আর কিছু বলতে পারেনি৷তবে অভিযুক্তদের ধরার পর বাকী গল্প তারা বলে। অভিযুক্তরা পুলিশের কাছে স্বীকার করে- বিধবা যা বলেছে তার সবই সত্য৷ তারা আরো যোগ করে যে তারা একটি ছোট নৌকায় করে মৃতদেহটি নদীর স্রোতের মাঝখানে নিয়ে যায়৷ যেখানে নদী দুই বা তিন মাইল চওড়া৷ তারপর তারা লাশ নদীতে ফেলে দেয়। এই বিষয়ে আসামীদের ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে হাজির করার জন্য বরিশালে পাঠানো হয়৷ আমার মনে আছে যে তাদের স্বীকারোক্তি আমার উপস্থিতিতে রেকর্ড করা হয়েছিল৷ তাদের দেয়া বক্তব্য স্বয়ংসম্পূর্ণ ও নির্দিষ্ট ছিল৷এছাড়াও প্রত্যেক বন্দী একই গল্প বলে। মামলাটি অন্য ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে হস্তান্তর করা হয়৷যিনি সাক্ষীদের পরীক্ষা করেন এবং হত্যার অভিযোগে অভিযুক্তদেরকে দায়রা আদালতে প্রেরণ করেন। বিচার শুরু হওয়ার আগে বন্দিরা তাদের নিযুক্ত উকিলকে জানায় তারা নির্দোষ এবং জবার উলা সত্যিই মারা যায়নি।

তবে তাকে মারধর করেছে বলে স্বীকার করে৷ তবে তারা জবর উলাকে আদালতে হাজির করতে পারেনি। তাদের উকিল দোষ স্বীকার এবং আদালতের করুণার উপর নিজেদের সোপর্দ করার পরামর্শ দেন। উকিল তাদের বললেন, "অপরাধ অস্বীকারে কোন কাজ হবেনা৷ তারচেয়ে অপরাধ স্বীকার করে নেন৷ কারণ জবর উলাকে আদালতে হাজির করতে পারবেন না, এবং আপনার কাছে কোন সাক্ষী নেই যে বলতে পারে সে কোথায় আছে। অন্যদিকে, তার বিধবা স্ত্রী ও তার মা শপথ করতে প্রস্তুত যে তারা তাকে মরতে দেখেছে৷ আর আপনাদের তার মৃতদেহ নিয়ে যেতে দেখেছে। আপনাদের সর্বোত্তম কাজ হবে দোষ স্বীকার করা, এবং আপনার বোনকে অপমান করে জবর উলা যে উস্কানি দিয়েছিলেন তা স্বীকার করা।” অভিযুক্তরা উকিলের পরামর্শ গ্রহণ করে এবং ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে তাদের স্বীকারোক্তির সত্যতা স্বীকার করে। প্রসিকিউশনের সাক্ষীদের পুনরায় পরীক্ষা করা হয়। তারা ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে সাক্ষ্য দেয় এবং বিচারক বন্দীদের দোষী সাব্যস্ত করেন। কিন্তু তুলনামূলকভাবে হালকা সাজা দেন। লাশ না পাওয়ায় তিনি আসামীদের হত্যার অভিযোগ থেকে খালাস দেন৷ তবে গুরুতর আঘাতের জন্য তাদের ছয় মাসের কারাদণ্ড দেন। এছাড়াও প্রমাণ গোপন করার জন্য ছয় মাস কারাদণ্ড দেয়া হয়৷ কারণ তারা লাশ নদীতে ফেলেছিল বলে স্বীকার করে। সব মিলিয়ে তারা এক বছরের সাজা পেল। বন্দীরা জেলে গেল৷ তারা আর কোন আপিল করেনি৷ কিন্তু সাত-আট মাস পর বরিশাল কারাগারে বন্দীরা যখন তাদের সময় কাটাচ্ছিল, আমরা সবাই একটি গুজব শুনে চমকে উঠলাম যে জবর উলা জীবিত ও সুস্থ৷ গ্রামবাসী তাকে জবর উলা বলে চিনতে পেরেছে। সে তার নাম পরিবর্তন করে এবং সবার সামনে আসতে অস্বীকার করে৷

সামনে আসতে না চাইলেও গ্রামের চৌকিদার তাকে জোর করে থানায় নিয়ে যায়। সেখানে সে প্রকৃতপক্ষে জবর উলা বলে স্বীকার করে৷ পরে তার পুনরাবির্ভাবের একটি বিস্ময়কর গল্প উপস্থাপন। জবর উলা বলে, মার খাওয়ার পর সে অজ্ঞান হয়ে যায়৷ তার আর কিছু মনে নেই যতক্ষণ না সে তার পিঠে একটা ঝাঁঝালো আঘাত অনুভব না করে৷ এতে সে জেগে ওঠে এবং সে দেখতে পায় যে, একটি বালির ধারে অগভীর জলে শুয়ে আছে এবং একটি শিয়াল তাকে কামড়াচ্ছে। প্রাণীটি পানি পান করতে নেমেছিল এবং জবর উলাকে দেখে ভেবেছিল সে মারা গেছে। এরপর জবর উলা একটি নৌকা যেতে দেখে তাদের সাহায্য চায় এবং তারা তাকে নোয়াখালী জেলায় নিয়ে যায়। তারপরে সে বিভিন্ন জায়গায় আত্মগোপন করে থাকে৷ পাছে তার আততায়ীরা তাকে খুঁজে না পায় ও হত্যা না করা হয়।

আমরা তার গল্প পরীক্ষা করি৷ তার সাথে একজন অফিসারকে পাঠিয়ে বিভিন্ন জায়গায় অনুসন্ধান করাই৷ ফলাফলটি তার গল্পকে সমর্থন করেনি৷ পরে সে যেসব জায়গায় গেছে সেগুলোর নাম নিয়ে পরস্পরবিরোধী গল্প বলতে শুরু করে। অন্যান্য জিনিসের মধ্যে সে শেয়ালের গল্পটি বাদ দেয়৷ এবং বলে যে নদীতে ভেসে আসা একটি কলাগাছ আঁকড়ে ধরে সে জীবন রক্ষা করেছে। তাকে নোয়াখালীতে নিয়ে যাওয়ার গল্পও বাদ দেয়। পরে যখন দায়রা আদালতে সাক্ষীদের সাক্ষ্যগুলো আরও গভীরভাবে পরীক্ষা করা হয় তখন দেখা গেছে যে জবর উলার পরিবারের মহিলারা ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে দেওয়া জবানবন্দি বস্তুগতভাবে পরিবর্তন করেছে। ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে তারা শপথ করেছিল যে তারা বন্দীদের জবার উলার লাশ নিয়ে যেতে দেখেছে। তবে জজ বা বিচারকের সামনে তারা বলেছিল যে তারা ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিল৷ পরে তারা আবার জেগে উঠে দেখতে পায় যে লাশটি নেই।

যাই হেক, এটা স্পষ্ট যে বন্দীদের তাৎক্ষণিক স্বীকারোক্তি অবশ্যই মিথ্যা ছিল৷ কারণ তারা বলেছিল যে তারা জবর উলার লাশ মেঘনার মাঝখানে ফেলে দিয়েছিল৷ যদি তাকে সেখানে ছুড়ে ফেলা হয়, বিশেষ করে অসুস্থতার মধ্যে সেখান থেকে বেঁচে ফেরা সম্পূর্ণ অসম্ভব৷ ইতোমধ্যে বন্দীরা জবর উলার পুনঃআবির্ভাবের কথা জানতে পারে এবং তাদের নির্দোষ ঘোষণার পিটিশন দাখিল করে৷ এতে তারা জবর উলা ও তার পরিবারের বিরুদ্ধে তাদের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা এবং তাদের স্বীকারোক্তি আদায়ে পুলিশী নির্যাতনের অভিযোগ করে।

বন্দীদের ফের আদালতে পাঠানো হয়৷ তারা ব্যক্তিগতভাবে সবাই যে বিবৃতি দেয় তা নিঃসন্দেহে বাস্তব পরিস্থিতি ছিল। অবশ্য পুলিশ নির্যাতনের বিষয়টি অস্বীকার করে৷ তবে তারা বন্দীদের বিরুদ্ধে কোনো সহিংসতা ব্যবহার করেছে কীনা ঘটনার এতদিন পর তার প্রমাণ পাওয়া অসম্ভব ছিল৷ কিন্তু একই সাথে পুলিশ এই কষ্ট থেকে বের হতে পারেনি যে জবর উলা বেঁচে আছে৷ কারণ স্বীকারোক্তি সত্য হলে জবর উলা অবশ্যই মৃত। ব্যাপারটা কখনই পুরোপুরি পরিষ্কার হয়নি৷ তবে জনসাধারণের মনে সন্দেহই রয়ে গেছে যে, মারধর ছাড়া পুরা মামলাটিই মিথ্যা ছিল৷ আর জবর উলা তার মারধরের প্রতিশোধ নিতে স্ত্রী ও বন্ধুবান্ধবদের সাথে পরামর্শক্রমে রাতের বেলা পালিয়ে যায়৷ এবং কয়েক মাস ধরে নিজেকে লুকিয়ে রাখে৷ যাওয়ার আগে তার স্ত্রী এবং বন্ধুদের সাথে এমন ব্যবস্থা করে যাতে তারা বলতে পারে যে সে মারা গেছে এবং বন্দীদের অভিযুক্ত করে যেন বলা হয় তারা তাকে হত্যা করেছেন।

এইভাবে কেসটি প্রতিশোধ মেটানোর এবং অপরাধ স্বীকারের উপর অত্যধিক নির্ভর করতে গিয়ে যে কতবড় দৈর্ঘ্যের বিপদ হতে পারে তার একটি স্মরণীয় উদাহরণ হিসাবে রয়ে গেছে।

(দ্রষ্টব্য।-এটা যোগ করা সঙ্গত মনে হয় যে আমি এই মামলায় বন্দীদের নির্দোষিতা সম্পর্কে এতটাই নিশ্চিত ছিলাম যে আমি সরকারের আদেশের প্রত্যাশায় তাদের মুক্তি দেওয়ার দায়িত্ব নিয়েছিলাম। এই অনিয়মের জন্য আমি প্রাপ্যভাবে সেন্সরড হয়েছিলাম এবং পরবর্তীতে হাইকোর্টের তিনজন বিচারক সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন যে মূল রায়ে দোষী সাব্যস্ত হওয়ার সাথে হস্তক্ষেপ করার কোন ভিত্তি নেই। যাই হোক, বন্দীদের হাইকোর্টে পুনরায় প্রেরণ করা হয়নি, এবং এতে কোন সন্দেহ নেই যে জেলার সাধারণ মতামত হল জবর উলাকে কখনোই নদীতে ফেলা হয়নি।)

এ কাল
----------------------------------------------------------------------
প্রায় দেড়শ বছর আগে বেভারিজ যে দুটো গল্প লিখে গেছেন, যে অপরাধের চিত্র তুলে ধরেছিলেন তার বর্তমান হাল হাকিকত কী! চলুন একটু জেনে আসি৷ অগণিত ঘটনার মধ্যে কয়েকটা উদাহরণ দেই৷

গত ৬ সেপ্টেম্বর ২০২২ তারিখে গাইবান্ধার সাদুল্যাপুরের বৈষ্ণব দাস গ্রামে জমিজমা সংক্রান্ত বিরোধ ও পূর্ব শত্রুতার জেরে প্রতিপক্ষকে ফাঁসাতে পুত্র জাহিদুল তার বাবা আলী বাদশাকে হত্যা করে৷

এভাবে গত ২৫ এপ্রিল ২০২১ সালের খবরে দেখা যায় নবীগঞ্জের বাশডর গ্রামে ১৫ জুলাই প্রতিপক্ষকে ফাঁসাতে জহির আলী তার পুত্র মো. আরশ আলীর হাতে খুন হন৷ ১৬ অক্টোবর ২০১৯ তারিখের সংবাদে দেখা যায়, প্রতিপক্ষকে ফাঁসাতে সুনামগঞ্জ জেলায় তুহিন নামের সাত বছর বয়সী এক শিশুকে তার বাবা ও চাচা মিলে হত্যা করে৷ গত ১৯ মে ২০২৩ তারিখের সংবাদ মাধ্যমে জানা যায়, ভোলা জেলার পূর্ব ইলিশা ইউনিয়নের রামদাসকান্দি গ্রামের সাজি বাড়ির তছির সাজি তার চাচাতো ভাইদের ফাঁসাতে অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী কুলসুমকে হত্যা করে৷

আর আত্মগোপন করে অপহরণ, গুম ও খুনের মামলাও অনেক৷ কয়েকটা উল্লেখ করছি৷ গত বছরের অক্টোবর মাসে খুলনার দৌলতপুরে মরিয়ম মান্নানের মা রহিমা বেগমের আত্মগোপন এবং নীরিহ কিছু মানুষের জেল খাটা নিয়ে দেশব্যাপী আলোড়ন তৈরি হয়েছিল৷ গত বছরের জুন মাসে সিলেটের ফেঞ্চুগঞ্জের আলোচিত জুলমত অপহরণ মামলার তদন্তে জানা যায়- দেনা থেকে বাঁচতে আত্মগোপনে ছিল জুলমত৷ পরে তার স্ত্রী পাওনাদারদের বিরুদ্ধে অপহরণ ও হত্যা মামলা করেন৷

গত ২২ সেপ্টেম্বর ২০২২ তারিখে প্রকাশিত খবরে দেখা যায়, প্রতিপক্ষকে ফাঁসাতে ৯ বছর আত্মগোপনে ছিল বরিশালের গৌরনদী উপজেলার নলচিড়া ইউনিয়নের কলাবাড়িয়া গ্রামের জালাল মৃধার সপ্তম শ্রেণি পড়ুয়া রাসেল৷ বাবা মা তাকে ঢাকার একটি স্কুলে ভর্তি করে দেয়৷ পরে আদালতে অপহরণ ও গুমের মামলা দায়ের করে৷ এ মামলায় ১৪ জন আসামীর মধ্যে ১২ জন ৯ বছরের বেশি হাজতবাস করে৷ একজন আত্মগোপনে গিয়ে হৃদরোগে মারাও গেছেন৷

শেষকথা
যাই হোক লেখাটা কলেবরে বাড়াতে চাইনা৷ প্রচুর উদাহরণ দিয়ে লেখাটা ভারাক্রান্তও করতে চাইনা৷ যেটা বলতে চাই, জেলা ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে বেভারেজ কাজ করেছিলেন তা প্রায় দেড়শ বছর পার হয়ে গেছে৷ অথচ ইংরেজরা যেসব অপরাধ দেখে অবাক হয়েছিলো তা এখনো বিদ্যমান৷ করিমুদ্দীন ও জবর উলারা এখনো দাপিয়ে বেড়াচ্ছে৷

এদেশে এই অপরাধ প্রবণতা নিয়ে গবেষণা করে লর্ড মেকলে দণ্ডবিধি প্রণয়ন করেছিলেন৷এদেশের মানুষ সম্পর্কে তিনি লিখেছিলেন, ''বাঙালিরা দৈহিকভাবে ভঙ্গুর ও দূর্বল, নৈতিক দিক থেকে কাপুরুষ৷ বাঙালিরা অভ্যাসগত মিথ্যাবাদী, প্রতারক, যোগসাজশকারী জালিয়াত৷'' অনেক ভাবতে পারেন, আমি নেতিবাচক হলাম কেন! তবে এই লেখাটার একটা উদ্দেশ্য আছে৷ এদেশে নীতি নির্ধারণ বা আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে মানুষের বৈশিষ্ট্য মাথায় রাখা প্রয়োজন৷ নিজেদের ভালো করে চেনা দরকার৷

মন্তব্য ৬ টি রেটিং +২/-০

মন্তব্য (৬) মন্তব্য লিখুন

১| ০৮ ই মে, ২০২৪ সকাল ১০:১২

কামাল১৮ বলেছেন: লর্ড মেকলের মন্তব্যটি সমর্থন করি।তিনি অনেকাংশে সঠিক বলেছেন।

০৮ ই মে, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:০৮

সায়েমুজজ্জামান বলেছেন: লর্ড মেকলে তার এই পর্যবেক্ষণের ওপর ভিত্তি করেই দণ্ডবিধি তৈরি করেছেন। এর মতো আরেকটা আইন তৈরি করা সম্ভব নয়। যদিও তিনি এসব মন্তব্যে একটি জাতিকে ছোট করেছেন্ তবে বাস্তবতা মেনে নেয়াটাই ভালো। আমাদের এই সাব কন্টিনেন্টে যে ধরণের অপরাধ রয়েছে তা পৃথিবীর অন্য প্রান্তে দেখা যায়না।
ধন্যবাদ মন্তব্যের জন্য।

২| ০৮ ই মে, ২০২৪ সকাল ১১:২৯

নতুন বলেছেন: মানুষের খেয়ে দেয়ে কাজ না থাকলে মানুষ সম্ভবত বেশি আকাজ করে।

নিজের নাক কেটে পরের যাত্রা ভঙ্গ করার মতন প্রবাদ সম্ভবত অন্য সমাজে নাই।

০৮ ই মে, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:১০

সায়েমুজজ্জামান বলেছেন: অন্যকে ফাঁসাতে নিজের জন্মদাতা পিতা বা আত্মজ সন্তানকে হত্য্ পৃথিবীর অন্য প্রন্তে দেখা যায়না। এই অঞ্চলে যে ধরণের অপরাধ তার স্বকীয় বৈশিষ্ট্য রয়েছে।

৩| ০৮ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৩:৪৬

নয়ন বিন বাহার বলেছেন: তুলনামূলক গল্প উপস্থাপন। ভালোই।

০৮ ই মে, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:১১

সায়েমুজজ্জামান বলেছেন: মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.