নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

চেতনায় মুক্তিযোদ্ধা

সায়েমুজজ্জামান

কাজী সায়েমুজ্জামান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লোক প্রশাসন বিভাগ থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর। দক্ষিণ কোরিয়া সরকারের স্কলারশিপ নিয়ে কিউং হি বিশ্ববিদ্যালয়ে ইন্ডাস্ট্রি অ্যান্ড ট্রেড পলিসি বিষয়ে মাস্টার্স। জন্ম ১৯৮১ সালে চট্টগ্রাম শহরের দামপাড়ায়। তার পূর্বপুরুষ ছিলেন দক্ষিণাঞ্চলের বাউফলের ঐতিহ্যবাহী জমিদার কাজী পরিবার। ছাত্রজীবন থেকেই লেখালেখিতে হাতে খড়ি। তবে ১৯৯৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে তিনি সাংবাদিকতার সঙ্গে জড়িত হন। তিনি যুগান্তর স্বজন সমাবেশের প্রতিষ্ঠাতা যুগ্ম আহবায়ক। ২০০৪ সালে তিনি দৈনিক মানবজমিন পত্রিকায় স্টাফ রিপোর্টার হিসেবে যোগ দেন। পরে ইংরেজী দৈনিক নিউ এজ এ সিনিয়র প্রতিবেদক হিসেবে কাজ করেন। পরবর্তীতে ২৮ তম বিসিএস (প্রশাসন) ক্যাডারের একজন সদস্য হিসেবে সহকারী কমিশনার ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট, সহকারী কমিশনার (ভূমি), সিনিয়র সহকারী কমিশনার, সিনিয়র সহকারী সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এছাড়াও তিনি বাংলাদেশ লোক প্রশাসন প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে রেক্টর (সচিব) এর একান্ত সচিব হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। জাতিসংঘের সংস্থা ইউএনডিপিতে লিয়েনে চাকরি করেছেন। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের এটুআই প্রোগ্রামে ন্যাশনাল কনসালটেন্ট হিসেবে কাজ করেছেন। শিল্প সচিবের একান্ত সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন৷বর্তমানে সরকারের উপসচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি বাংলা ছাড়াও ইংরেজী, আরবী, উর্দ্দু ও হিন্দী ভাষা জানেন। ছোটবেলা থেকেই কমার্শিয়াল আর্টিস্ট হিসেবে পরিচিত ছিলেন। যেকোনো প্রয়োজনে ইমেইল করতে পারেন। [email protected]

সায়েমুজজ্জামান › বিস্তারিত পোস্টঃ

জাম গাছ (জামুন কা পেড়)

০৭ ই মে, ২০২৪ সকাল ৯:০৩

মূল: কৃষণ চন্দর
অনুবাদ: কাজী সায়েমুজ্জামান

গত রাতে ভয়াবহ ঝড় হয়েছে। সেই ঝড়ে সচিবালয়ের লনে একটি জাম গাছ পড়ে গেছে। সকালে মালী দেখলো এক লোক গাছের নিচে চাপা পড়ে আছে।

মালী দৌড়ে গেল পিয়নের কাছে; পিয়ন দৌড়ে গেল কেরানির কাছে; কেরানি গেলো সুপারিন্টেন্ডেন্টের কাছে; এবং সুপারিনটেন্ডেন্ট দ্রুত বাইরের লনের দিকে চলে গেল। এভাবে কয়েক মিনিটের মধ্যে গাছের নিচে চাপা পড়া লোকটির চারপাশে একটি ভিড় জমে গেলো।

একজন কেরানি বললেন, 'আহা, বেচারা জাম গাছ, কত ফল দিতো',
দ্বিতীয় কেরানি স্মৃতি হাতড়ে বললেন, 'ইস, জামগুলো কতটা রসালো ছিল'৷
তৃতীয় কেরানি প্রায় কান্নার স্বরে বললেন, ‘আমি ফলের মৌসুমে বাড়িতে এক ব্যাগ জাম নিয়ে যেতাম। আমার সন্তানেরা কত আনন্দে এই গাছের জাম খেয়েছে ’।

'কিন্তু এই মানুষ', মালী পিষ্ট লোকটির দিকে ইঙ্গিত করলেন।
‘হ্যাঁ, এই লোক…!’ সুপারিনটেন্ডেন্ট চিন্তা করতে লাগলেন।
দ্বিতীয় কেরানি বললেন, 'তিনি নিশ্চয়ই মারা গেছেন ... যদি এইরকম ভারী গাছের বড় কান্ড কারও পিঠের ওপর পড়ে ... তাহলে তার বেঁচে থাকা সম্ভব নয়'৷

এর মধ্যে বিধ্বস্ত লোকটি কষ্টের সাথে হাহাকার করে বলল, 'না, আমি বেঁচে আছি'৷
মালী পরামর্শ দিলেন- 'গাছটি সরিয়ে তাকে দ্রুত বের করে আনা উচিত',
একজন অলস ও পেটমোটা পিয়ন বলল, 'কঠিন মনে হচ্ছে', 'গাছের কাণ্ডটি অনেকটা ভারির ওপরেও ভারি।'

'এটা কতটা কঠিন', মালী উত্তর দিল। যদি সুপারিনটেনডেন্ট সাহেব নির্দেশ দেন, তাহলে গাছের নিচে চ্যাপ্টা হওয়া মানুষটিকে এখনই ১৫-২০ জন মালী, পিয়ন এবং কেরানি ব্যবহার করে বের করা যেতে পারে।

‘মালী ঠিক বলেছে!’ অনেক কেরানি হঠাৎ একসঙ্গে বলল। 'আসুন আমরা চেষ্টা করি, আমরা প্রস্তুত।'

সাথে সাথে অনেকে গাছ তুলতে প্রস্তুত হল।

সুপারিনটেনডেন্ট বললেন, ‘অপেক্ষা করুন!’ 'আমাকে আন্ডার সেক্রেটারির সঙ্গে পরামর্শ করতে দিন।'
সুপারিনটেনডেন্ট আন্ডার সেক্রেটারির কাছে গেলেন; আন্ডার সেক্রেটারি উপসচিবের কাছে গেলেন; উপসচিব যুগ্ম সচিবের কাছে গেলেন; যুগ্ম সচিব মুখ্যসচিবের কাছে গেলেন; মুখ্য সচিব মন্ত্রীর কাছে। এবার মন্ত্রী মুখ্যসচিবকে বললেন; মুখ্য সচিব যুগ্ম সচিবকে; যুগ্ম সচিব উপসচিবকে; পরে উপ -সচিবের উপসচিব। ফাইলটি চলতে থাকে, আর এতে অর্ধেক দিন লেগে যায়।

দুপুরের খাবারের বিরতিতে অনেক লোকজন পিষ্ট ব্যক্তির চারপাশে জড়ো হলো৷ তারা নিজেরা এই বিষয়ে কিছু বলার জন্য চেষ্টা করলো। কয়েকজন বেয়ারা কেরানি বিষয়টি নিজেদের হাতে নেওয়ার চেষ্টা করেন। তারা সরকারের সিদ্ধান্তের অপেক্ষা না করে নিজেরাই গাছটি সরানোর সিদ্ধান্ত নিচ্ছিলেন৷ ঠিক তখনি সুপারিনটেনডেন্ট ফাইল নিয়ে দৌড়ে এসে বললেন, ‘আমরা নিজেরাই এই গাছটি এখান থেকে অপসারণ করতে পারি না। আমরা বাণিজ্য বিভাগের সাথে সংশ্লিষ্ট। আর এটি একটি গাছের বিষয় যা কৃষি বিভাগের তত্ত্বাবধানে রয়েছে। অতএব আমি এই ফাইলটিকে 'জরুরী' হিসেবে চিহ্নিত করে কৃষি বিভাগে পাঠাচ্ছি। আমরা তাদের প্রতিক্রিয়া পাওয়ার সাথে সাথেই এই গাছটি সরিয়ে ফেলা হবে। ’

পরের দিন কৃষি বিভাগ উত্তর দিল, যে গাছটি বাণিজ্য বিভাগের লনে পড়েছিল, গাছটি অপসারণের দায়িত্ব তাদের নয় বরং বাণিজ্য বিভাগের ওপর৷ কৃষি বিভাগের এই প্রতিক্রিয়ায় বাণিজ্য বিভাগ ক্ষোভে ফেটে পড়ে। তারা তাৎক্ষণিকভাবে লিখলো যে গাছটি অপসারণের দায়িত্ব কৃষি বিভাগের উপর বর্তায়। ট্রেড ডিপার্টমেন্টের সাথে সংশ্লিষ্ট কোন বিষয় নয়।

ফাইলটি দ্বিতীয় দিনেও চলতে থাকে। সন্ধ্যায় কৃষি বিভাগ থেকে সাড়া এল। আমরা এই বিষয়টি হর্টিকালচার বিভাগে জমা দিচ্ছি৷ কৃষি বিভাগ কেবল খাদ্য এবং কৃষিকাজের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য বৈধ কর্তৃপক্ষ৷ যেহেতু এটি একটি ফলবান গাছের বিষয় সেজন্য এই গাছটি হর্টিকালচার বিভাগের কর্তৃত্বের মধ্যে পড়ে।

তৃতীয় দিনে হর্টিকালচার বিভাগের প্রতিক্রিয়া এল৷ খুব কঠোর প্রতিক্রিয়া৷ বিদ্রূপ মিশ্রিত। হর্টিকালচার বিভাগের সচিব সাহিত্যিক মেজাজের মানুষ। তিনি লিখেছিলেন, ‘কী আশ্চর্য! যেই সময়ে, আমরা বড় আকারে 'দারখত উগাও' (বৃক্ষ রোপন) কর্মসূচি চালাচ্ছি, সেই সময় আমাদের দেশে এমন সরকারি কর্মকর্তারা আছেন যারা গাছ কাটার পরামর্শ দেন এবং সেটাও একটি ফলদায়ক গাছ এবং এমনকি একটি জাম গাছ, যার ফল মানুষ খুব আনন্দের সাথে খায়। '
এ কারণে আমাদের বিভাগ কোনো অবস্থাতেই এই ফলবান গাছ কাটার অনুমতি দিতে পারে না।

একজন তটস্থ হয়ে বললেন। 'এখন কি করতে হবে', যদি গাছটি কাটা না যায়, তাহলে এই লোকটিকে তো বের করতে হবে।

লোকটি ইশারা করে বললো, 'এখানে দেখুন'৷ যদি এই লোকটি মাঝখান থেকে ঠিক অর্থাৎ ধড়ের জায়গা থেকে কাটা হয়, তাহলে মানুষটির অর্ধেক সেখান থেকে বেরিয়ে আসবে। অর্ধেক মানুষ সেখান থেকে বেরিয়ে আসলে যেখানের গাছ সেখানেই থাকবে। ’
পিষ্ট মানুষ প্রতিবাদ করল৷ বললো, 'ধড় কাটলে কিন্তু আমি সত্যিই মারা যাব৷'

‘সেও ঠিক!’ একজন কেরানি বললেন।

যে লোকটি কাটার পরামর্শ দিচ্ছিল সে প্রতিবাদ করে বললো, 'আপনি জানেন না, আজকাল প্লাস্টিক সার্জারি কতটা এগিয়েছে, আমি মনে করি এই মানুষটিকে যদি মাঝখান থেকে কেটে বের করা হয়, তাহলে এই মানুষটিকে প্লাস্টিক সার্জারির মাধ্যমে আবার ধড়ের জায়গায় বসিয়ে দেয়া যাবে। '

এজন্য ফাইলটি মেডিকেল বিভাগে পাঠানো হয়েছে। মেডিক্যাল ডিপার্টমেন্ট একযোগে এজন্য ব্যবস্থা নেয়৷ যেদিন ফাইলটি তাদের ডিপার্টমেন্টে পৌঁছায়, পরের দিনই তারা তাদের বিভাগের সবচেয়ে যোগ্য প্লাস্টিক সার্জনকে তদন্তের জন্য পাঠায়। সার্জন চূর্ণবিচূর্ণ ব্যক্তিকে আস্তে আস্তে চেপে ধরেন, তার স্বাস্থ্য, রক্তচাপ, শ্বাস -প্রশ্বাসের সঞ্চালন, তার হৃদয় এবং ফুসফুস পরীক্ষা করে রিপোর্ট পাঠান যে আসলেই পরীক্ষামূলক একটি প্লাস্টিকের অস্ত্রোপচার করা যেতে পারে এবং শরীর জোড়া দেয়া সফল হবে৷ কিন্তু মানুষটি মারা যাবে৷

এ কারণে এই প্রস্তাবটিও প্রত্যাখ্যাত হলো।

রাতে মালী পিষ্ট মানুষকে খিচুরি খাওয়ালেন৷ যদিও তাদের চারপাশে পুলিশ প্রহরী ছিল পাছে মানুষ আইন নিজের হাতে তুলে নেয়; এবং নিজেরাই গাছটি সরানোর চেষ্টা করে। কিন্তু একজন পুলিশ কনস্টেবল করুণা করলেন এবং তিনি বাগান মালীকে পিষ্ট লোকটিকে রাতের খাবার খাওয়ানোর অনুমতি দিলেন।

মালী বিধ্বস্ত লোকটিকে বলল, 'তোমার ফাইল নড়াচড়া করছে, আশা করছি কালকের মধ্যেই সিদ্ধান্ত হয়ে যাবে।'

বিধ্বস্ত মানুষটি কোনো কথা বলেননি।

মালী আবার বলল, ‘তোমার কি এখানে কোন উত্তরাধিকারী আছে? আমাকে একটি সূত্র দাও। আমি তাদের জানানোর চেষ্টা করব। ’

‘কেউ নাই।’ পিষ্ট মানুষটি অনেক কষ্টে বলল। মালী দুঃখ প্রকাশ করে সেখান থেকে সরে গেলেন।

রাতে মালী আবার আসলেন৷ মুখে খিচুড়ি তুলে দিতে বললেন, এখন ব্যাপারটা উচ্চতর পর্যায়ে চলে গেছে। বলা হয়েছে, আগামীকাল সচিবালয়ের সকল সচিবদের বৈঠক হবে। আপনার প্রসঙ্গ সেখানে আলোচনা করা হবে। আশা করছি সব ঠিক হয়ে যাবে। ’

বিধ্বস্ত ব্যক্তি ধীরে ধীরে দীর্ঘশ্বাস নিয়ে গালিবের কবিতায় বললেন, 'হাম নে মানা কি তাগাফল না করো লেকিন, খাক হো জায়েনগে হাম তুম কো খবর হোনে তক৷'

''আমি জানি তুমি আমাকে হয়ত অস্বীকার করবেনা, তবে তোমার কাছে যখন খবর যাবে আমি তখন মাটি হয়ে যাবো৷''

মালী বিস্ময়ে আঙুল তার মুখে চেপে ধরে, 'তুমি কি কবি?'

পিষ্ট মানুষটা ধীরে ধীরে মাথা নাড়লেন।

পরদিন মালী পিয়নকে বলল; পিয়ন কেরানিকে বলল। অল্প সময়ের মধ্যে গোটা সচিবালয়ে খবর রটে গেলে যে গাছের নিচে পিষ্ট মানুষটি একজন কবি৷ এ খবরে লোকজন কবিকে দেখতে ভিড় করতে শুরু করে।

তার খবরও শহরে ছড়িয়ে পড়ে এবং সন্ধ্যা নাগাদ শহরের অলিতে গলিতে যত কবির বসবাস; তারা এসে জড়ো হতে থাকেন৷ সচিবালয়ের লন বিভিন্ন প্রকারের কবিদের নিয়ে ভরে যায় এবং পিষ্ট মানুষটিকে ঘিরে একটি মুশায়রার (কাব্যিক সমাবেশ) আয়োজন করা হয়। অনেক কেরানি এমনকি সচিবালয়ের আন্ডার সেক্রেটারি যাদের সাহিত্য ও পদ্যের রুচি ছিল তারা থেকে গেলেন। কয়েকজন কবি তাদের গজল ও কবিতা আবৃত্তি করতে শুরু করেন।

পিষ্ট মানুষটি একজন কবি জানার পর সচিবালয়ের সাব-কমিটি সিদ্ধান্ত নেয় যে যেহেতু পিষ্ট মানুষটি একজন কবি, তাই এই ফাইলটি না কৃষি বিভাগ বা উদ্যানপালন বিভাগের সাথে সম্পর্কিত, এটি শুধু সংস্কৃতি বিভাগের সাথে সম্পর্কিত। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এই বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে যাতে দুর্ভাগা কবিকে এই ছায়াময় গাছ থেকে উদ্ধার করা যায় সেজন্য সংস্কৃতি বিভাগকে অনুরোধ করা হলো৷

সংস্কৃতি বিভাগের বিভিন্ন বিভাগ থেকে ফাইলটি সাহিত্য একাডেমির সচিবের কাছে পৌঁছেছে। বেচারা সেক্রেটারি তার গাড়িতে করে সচিবালয়ে পৌঁছান এবং পিষ্ট লোকটির সাক্ষাৎকার নিতে শুরু করেন।

‘আপনি কি কবি?’ তিনি জিজ্ঞেস করলেন।
‘ওহ হ্যাঁ!’ বিধ্বস্ত মানুষটি উত্তর দিল।
'আপনি কোনো ছদ্ম নাম ব্যবহার করেন?'
'ওস!'
‘ওস।’ সচিব চিৎকার করলেন। ‘আপনি কি সেই একই ওস যার কাব্য সংকলন ওস কে ফুল (শিশিরের ফুল) সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে?’

পিষ্ট লোকটি সম্মতি দিয়ে মাথা নাড়লেন।

‘আপনি কি আমাদের একাডেমির সদস্য?’ সচিব জিজ্ঞাসা করলেন।
'না'
'অদ্ভুত'
সচিব এবার জোরে চিৎকার করে বললেন, ‘এত বড় কবি, ফুল অফ ডিউ এর লেখক এবং আমাদের একাডেমির সদস্য নন। উফফ, উফফ! আমরা কত বড় ভুল করেছি, এত বড় কবি এবং কীভাবে তিনি অস্পষ্টতার আড়ালে এক কোণে একা বিচূর্ণ হয়ে গেছেন। ’
'অস্পষ্টতার মধ্যে নয়! একটি গাছের নিচে চূর্ণ। দয়া করে আমাকে এই গাছের নিচে থেকে বের করে দিন। ’
‘আমি এখন ব্যবস্থা করব!’ সচিব বললেন। পরে তিনি দ্রুত ফিরে গিয়ে তার ডিপার্টমেন্টকে রিপোর্ট করেন৷

পরদিন সচিব আবারো ছুটে এসে কবির কাছে এসে বললেন, ‘অভিনন্দন! মিষ্টি এখন আপনার প্রাপ্য। আমাদের একাডেমি অফিসিয়ালি আপনাকে এর কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য হিসেবে বেছে নিয়েছে। এই আপনার অফিস আদেশ নিন। ’

‘কিন্তু আগে আমাকে এই গাছের নিচে থেকে বের করে দিন।’ চূর্ণবিচূর্ণ লোকটি হাহাকার করে বলল।

পিষ্ট কবি খুব কষ্টে জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিচ্ছিলেন এবং তার চোখের দিকে তাকালেই বুঝা যায় তিনি চরম খিঁচুনি আর যন্ত্রণায় কাতর৷

‘আমরা এটা করতে পারব না!’ সচিব বললেন, 'আমরা যা করতে পারতাম, আমরা তা করেছি। আসলে আমরা এতটুকু করতে পারি যে আপনি মারা গেলে আমরা আপনার স্ত্রীকে উপবৃত্তি দিতে পারি। আপনি যদি একটি আবেদন জমা দেন, তাহলে আমরাও তা করতে পারি।’

‘আমি এখনো বেঁচে আছি’, কবি থেমে থেমে বললেন, ‘আমাকে বাঁচিয়ে রাখুন’।

'সমস্যা হল এই', অফিসিয়াল লিটারারি একাডেমির সেক্রেটারি তার হাত ঘষতে ঘষতে বললেন, 'আমাদের বিভাগ শুধু সংস্কৃতির সঙ্গে সম্পর্কিত। গাছ কাটার বিষয়টি কলম এবং কালির পাত্রের সাথে নয় বরং করাত এবং কুড়ালের সাথে সম্পর্কিত৷ এজন্য আমরা বন দফতরে জরুরিভাবে চিঠি লিখেছি। ’

পরের দিনে যখন বন বিভাগের লোকজন করাত এবং কুড়াল নিয়ে আসলো, তখন তাদের গাছ কাটতে বাধা দেওয়া হলো। তারা জানতে পারল, পররাষ্ট্র দপ্তর গাছ কাটা নিষিদ্ধ করেছে। কারণটি ছিল এক দশক আগে পেটুনিয়ার প্রধানমন্ত্রী সচিবালয়ের লনে গাছটি রোপণ করেছিলেন। এখন যদি গাছটি কেটে ফেলা হয়, তাহলে পেটুনিয়া সরকারের সাথে আমাদের সম্পর্ক চিরতরে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার বড় ঝুঁকি রয়েছে। 'কিন্তু এটা একজন মানুষের জীবনের প্রশ্ন', কেরানি রাগে চেঁচিয়ে উঠলেন। 'অন্যদিকে, দুই দেশের সম্পর্কের প্রশ্ন', দ্বিতীয় কেরানি প্রথম কেরানিকে উপদেশ দিলেন, 'এবং পেটুনিয়ান সরকার আমাদের সরকারকে কতটা সহায়তা দেয় তা বোঝার চেষ্টা করুন।

আমরা কি তাদের বন্ধুত্বের জন্য একজন মানুষের জীবন পর্যন্ত উৎসর্গ করতে পারি না? ’
‘কবির মৃত্যু হওয়া উচিত’
'নিসন্দেহে।'

আন্ডার সেক্রেটারি সুপারিনটেনডেন্টকে বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী আজ সকালে বিদেশ সফর থেকে ফিরে এসেছেন। পররাষ্ট্র বিষয়ক বিভাগ আজ বিকালে তার সামনে এই গাছের ফাইল উপস্থাপন করবে, এবং তিনি যা সিদ্ধান্ত নেবেন তা সকলে গ্রহণ করবে। ’

বিকেল ৫ টায় সুপারিনটেনডেন্ট নিজেই কবির ফাইলটি নিয়ে আসলেন, 'আপনি কি শুনছেন?' তিনি চিৎকার করে ফাইলটি নাড়িয়ে বললেন, 'প্রধানমন্ত্রী এই গাছটি কাটার হুকুম দিয়েছেন এবং এজন্য আন্তর্জাতিক সম্পর্কের দায় দায়িত্ব তিনি নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছেন৷ আগামীকাল এই গাছটি কেটে ফেলা হবে এবং আপনি এই ঝামেলা থেকে মুক্তি পাবেন। ’
কবির হাত সরিয়ে সুপারিনটেন্ডেন্ট বললেন, 'আপনি কী শুনতে পাচ্ছেন? আজ আপনার ফাইল সম্পূর্ণ হয়ে গেছে৷' ’

কিন্তু কবির হাত ছিল বরফের মতো ঠান্ডা। তার চোখের পাতা নড়াচড়া বন্ধ৷ কবি নিষ্প্রাণ হয়ে গেছেন৷ পিঁপড়ার একটি দীর্ঘ লাইন তার মুখে ঢুকে যাচ্ছিল।

তার জীবনের ফাইলও শেষ হয়ে গিয়েছিল।
-----------------------------------------------------------------------------------------

কেন গল্পটি অনুবাদ করলাম:
কৃষণ চন্দর লেখা 'জামুন কা পেড়' এর বাংলায় অনুবাদ করলাম৷ কেন করেছি; কারণটা বলছি৷ ইদানিং দেশে বহুসংখ্যক ফেসবুক বুদ্ধিজীবীর দেখা মিলছে৷ তারা একযোগে ব্যুরোক্রেসির গোষ্ঠি উদ্ধারে নেমেছেন৷ তবে তা অসার ও সারবত্তা শূন্য৷ এক কথায় খিস্তি খেউর লেখা৷ কোনটাই পড়তে রুচি হয়না৷ ১৯৬০ এর দশকে পাঞ্জাবে জন্ম নেয়া কৃষণ চন্দরও ব্যুরোক্রেসির লাল ফিতার দৌরত্ম্য নিয়ে স্যাটায়ার করেছিলেন৷ আর তাতে সাহিত্য সমৃদ্ধ হয়েছে৷ ভারতে বিভিন্ন সরকারি কর্মকর্তাদের বিভিন্ন ট্রেনিংয়েও এটি নাটিকা হিসেবে পরিবেশন করতে দেখেছি৷

গল্পটি ভারতে হিন্দী সিলেবাসের ক্লাস টেনের সিলেবাসভুক্ত ছিলো৷ বড়দের কাছে মজার হলেও ছোটদের কাছে তা সম্পূর্ণ বিপরীত৷ ব্যুরোক্রেসি সম্পর্কে কোমলমতি শিক্ষার্থীদের মনের ওপর একটা নেতিবাচক প্রভাব পড়ে বলে বিভিন্ন গবেষণায় তথ্য পাওয়া যায়৷ পরবর্তীতে কাউন্সিল ফর দ্যা ইন্ডিয়ান স্কুল সার্টিফিকেট এক্সামিনেশনস (সিআইএসসিই) এই গল্পটি চলতি শিক্ষাবর্ষ থেকে বাদ দিয়েছে৷ ভারতের মতো একটা বৃহৎ গণতন্ত্রের দেশে ব্যুরোক্রেসির সম্মানকে অহেতুক জুজুর হাত থেকে রক্ষার জন্য সরকার এগিয়ে এসেছে৷ যদিও গল্প তো গল্পই৷ বাস্তবে এটা সম্ভবও নয়৷ তথাপি শিক্ষার্থীদের মনে ব্যুরোক্রেসির সম্পর্কে যাতে নেতিবাচক ধারণা তৈরি না হয় সেজন্যই এটিকে সিলেবাস থেকে বাদ দেয়া হয়েছে৷ কারণ দেশ গঠনে ব্যুরোক্রেসির ভূমিকা রয়েছে৷ ব্যুরোক্রেসি যত শক্ত হবে, গণতন্ত্র তত টেকসই হয়৷

বহুদিন আগে দৈনিক ইত্তেফাকে আমলাতন্ত্রের পাগলা ঘোড়া শীর্ষক একটি নিবন্ধ প্রকাশ হয়৷ পরে একে কেন্দ্র করে প্রচুর লেখালেখি হয়৷ দেশের বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবীরা আমলাতন্ত্র সম্পর্কে পক্ষে বিপক্ষে লেখালেখি করেন৷ এই লেখাগুলো নিয়ে একটা বইও প্রকাশিত হয়৷ সেখানে অগ্রজ সাবেক সচিব হাসনাত আবদুল হাইও লিখেছেন৷ সাংবাদিক আমীর খসরুও লিখেছেন বলে মনে পড়ে৷ সবাই স্বীকার করেছেন, দেশের উন্নয়নের জন্য দক্ষ যোগ্য আমলাতন্ত্রের প্রয়োজন রয়েছে৷ অথচ তুমুল প্রতিযোগিতামূলক একটি পরীক্ষার মাধ্যমে যখন ভালো শিক্ষার্থীদের নিয়োগ দেয়া হচ্ছে একটা শ্রেণি সেটাও বাঁকা দৃষ্টিতে দেখতে শুরু করেছেন৷ অথচ দক্ষ ব্যুরোক্রেসির জন্য প্রতিযোগিতার বিকল্প নেই৷

যাই হোক গল্পে আসি৷ আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে লোক প্রশাসন বিভাগের ছাত্র ছিলাম৷ এই গল্পটা প্রথম শুনেছিলাম আমার শ্রদ্ধেয় শিক্ষক বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের চেয়ারম্যান প্রয়াত প্রফেসর আসাদুজ্জামান স্যারের কাছে৷ একদিন ক্লাসে তিনি শুনিয়েছিলেন গল্পটি৷ যারা আমলা বিরোধী লেখালেখি করেন তাদের কাজে লাগবে৷ অন্তত একটা রেফারেন্স দিতে পারবেন৷ আমলা বিরোধী অখাদ্য আর পড়তে হবেনা৷ সেই লক্ষ্যই গল্পটা মূল হিন্দী থেকে অনুবাদ করলাম৷

মন্তব্য ৮ টি রেটিং +১/-০

মন্তব্য (৮) মন্তব্য লিখুন

১| ০৭ ই মে, ২০২৪ সকাল ৯:৩২

রানার ব্লগ বলেছেন: শিরনাম ঠিক করুন। "যামুন কা পেড়" হবে, হিন্দী ভাষায় 'ড়' শব্দ টি নাই।

০৭ ই মে, ২০২৪ সকাল ৯:৪৮

সায়েমুজজ্জামান বলেছেন: আপনি সঠিক। পেড় হবে। ঠিক করে দিয়েছি। ধন্যবাদ।

২| ০৭ ই মে, ২০২৪ সকাল ১০:৪২

কামাল১৮ বলেছেন: কৃষণ চন্দর একজন মানবতাবাদী লেখক ছিলেন।তার লেখায় মানুষের প্রতি মানুষের ভালোবাসা ও মানবিক দায়িত্ববোদ দেখা যায়।তিনি একজন বামবন্থী লেখক ছিলেন।

০৭ ই মে, ২০২৪ সকাল ১০:৪৭

সায়েমুজজ্জামান বলেছেন: কৃষণ চন্দর সম্পর্কে আপনার দেয়া তথ্য সঠিক। ধন্যবাদ আপনাকে। আসলেই বামপন্থী লেখকরা বিশ্ব সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছে।

৩| ০৭ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৫:১৬

নয়ন বিন বাহার বলেছেন: এভাবেই অক্ষমের ফাইল শুধু নড়াচড়াই করে।

০৭ ই মে, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:৩৯

সায়েমুজজ্জামান বলেছেন: কোনো ফাইলই থেমে থাকেনা। পিলো পাস গেমের মতো। চলতে থাকে। অনেকক্ষেত্রে কাজের কাজ কিছু হয়না। যখন হয় তখন দীর্ঘ সময় চলে যায়। কারো কোনো কাজে আসেনা।

৪| ১০ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১:৪৪

রূপক বিধৌত সাধু বলেছেন: যত যাই হোক, নিয়ম ভাঙা যাবে না। মানুষের জীবন থাকলে থাকুক না থাকলে নাই। সরকারি নিয়ম বলে কথা।

১০ ই মে, ২০২৪ দুপুর ২:২১

সায়েমুজজ্জামান বলেছেন: মানুষের জন্য নিয়ম। নিয়মের জন্য মানুষ নয়। এটা বুঝতে না পারলেই সমস্যা।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.