নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
পরিশ্রমকে সঙ্গী করে কত মানুষ উর্ধ্বে গেলো, আকাশের ঐ তারার দলে/ চিরদিনই অলস আমি, আছি পড়ে অনন্তকাল এই ধরনীর গাছের তলে।
ছাত্র-শিক্ষকের সম্পর্কটা ঠিক কী রকম হবে- এনিয়ে প্রাচীনকাল থেকেই ব্যাপক আলাপ-আলোচনা হয়েছে। দাঁড়িয়েছে বিভিন্ন মতবাদ। ছোটবেলা থেকেই মনে করতাম, ভাবতাম শিক্ষক মাতা-পিতা স্থানীয়। তাকে শ্রদ্ধা করতে হয়, সম্মান করতে হয়, ভালোও বাসতে হয়, ভয় পেতে হয়। আমার পুরো শিক্ষাজীবনে অসংখ্য শিক্ষক-শিক্ষিকার প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ নিদের্শনা পেয়েছি। অনেকে ভালোবেসেন, অনেকে স্নেহের পরশ বুলিয়েছেন। আজ এই লেখা লিখতে বসে একেবারে ছোট্টবেলার সেই শিক্ষককের কথাও মনে পড়ছে যাকে দেখে ভেবেছিলাম বড় হয়ে শিক্ষক হবে। ঐ শিক্ষককের নাম, পরিচয় এমনকি চেহারাটুকুও স্মৃতি হাতড়ে খুঁজে পাই না। কিন্তু মন থেকে বারংবার শ্রদ্ধা জানাই, ভালোবাসা জানাই- তার মুগ্ধ করার গুণেই তো আজকের আমি হয়ে উঠতে পেরেছি। তবে আজ এখানে বিশেষ একজনকে নিয়ে লিখতে বসলাম। আমার জীবনে তিনি নিঃসন্দেহে বিশেষ। আমার বিভাগের শিক্ষক, সাহিত্যের ও ব্যক্তি-ভাবনার শিক্ষক, আমার স্নাতকোত্তর শ্রেণির অভিসন্দর্ভের তত্ত্বাবধায়ক, আমার পিএইচডি গবেষণার তত্ত্বাবধায়ক জনাব ড. মোঃ খোরশেদ আলম, শিক্ষক , বাংলা বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।
একদিন ক্লাসে আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের ‘খোয়াবনামা’ পড়াচ্ছিলেন স্যার। ঐ সেমিস্টারেই স্যারের প্রথম কোর্স শুরু হয় আমার ব্যাচে। চমৎকার বলছিলেন স্যার কিন্তু আমি সহজাত পণ্ডিতিতে স্যারের সঙ্গে বিরোধিতা করি। লিও টলস্টয়ের ‘What is Art?’ প্রবন্ধকে ভিত্তি করে জানাই সাহিত্য যদি পাঠকের কাছে পৌঁছাতেই না পারে তবে তো তা সাহিত্যই হলো না। স্যার বিরক্ত হলেন না। ক্লাসে সেদিন সময় ছিল কম। স্যার হাসিমুখে বললেন, ‘আমার রুমে এসো কথা হবে।’ ব্যস্ ঐ প্রথম স্যারের রুমে যাওয়া এমনকি আমার নিজে থেকে কোনো শিক্ষকের সঙ্গে আলাপে যাওয়া। এরপর সহজাত-স্বাভাবিক পথেই স্যারের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে ওঠা। খোয়াবনামা নিয়ে শেষ পর্যন্ত স্যারের সঙ্গে একমতই হয়েছিলাম যে পাঠকেরও কিছুটা দায়িত্ব থাকে। সাহিত্যের ভাষা, আঙ্গিক পাঠ করে নিতে হয়। আর এখন এও বুঝি পাঠক যদি সত্যিকারের পাঠক হয় তবে সে আপনাতেই বুঝতে পারবে বাংলাদেশের তথা বাংলা সাহিত্যে ‘খোয়াবনামা’ কতটা গুরুত্বপূর্ণ উপন্যাস।
বিভাগে খোরশেদ স্যারের অনেক সুনাম। তার সহকর্মীরা যেমন তাকে ভালোবাসেন, পছন্দ করেন শিক্ষার্থীরাও তেমনই শ্রদ্ধা করে, ভালোবাসে। তবে আমাদের সময় কারো কারো মুখে শুনতাম ‘স্যার মানুষ হিসেবে চমৎকার কিন্তু স্যারের লেকচারটা তেমন বোঝা যায় না’। আমি বরাবরই স্যারের ক্লাস কিংবা স্যারের সঙ্গে আলাপচারিতা পছন্দ করি। স্যারের সব কথাই সহজে বুঝি। অন্য অনেকে কেন বুঝতো না সেটা ভাবতাম। তবে আজ এই দীর্ঘদিন পর মনে হচ্ছে সমস্যার জায়গাটা একটু একটু আঁচ করতে পারছি। শিক্ষককের লেকচার নিয়ে সমালোচনা কিংবা প্রশ্ন তোলাটা কতটুকু সমীচীন এবং বেয়াদবি পর্যায়ভুক্ত কিনা- সেটা ভাবার মতো। আমি বিনয়ী মানুষ অন্তত স্যার সেটা জানেন সুতরাং একটু সাহস করে আমার ব্যাখ্যা আমি লিখেই ফেলছি। আশা করছি অন্যরাও আমার বিভাগীয় শিক্ষকরাও আমাকে ক্ষমাসুন্দর চোখে এই অমার্জনীয় অপরাধে বিনা শর্তে মুক্তি দেবে।
ক্লাস নেয়া একটি পুরোপুরি একাডেমিক কাজ। নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে নির্দিষ্ট টপিকের উপর লেকচার দিতে হয় একজন শিক্ষককে। সেক্ষেত্রে বেশ কয়েকটি বাইনারি কোড অনুসরণ করেই শিক্ষকের লেকচার প্ল্যান তৈরি করতে হয়। আর যেহেতু যত যা-ই হোক শিক্ষার্থীর অনুসন্ধানী মন থাকে পরীক্ষার উপকরণ সংগ্রহে তাই শিক্ষককে খানিকটা পরীক্ষক হয়েই পরীক্ষার্থীদের কাছে জ্ঞান পরিবেশন করতে হয়। ঠিক এইটুকু ক্ষেত্রেই আমার মনে হয়েছে খোরশেদ স্যারের কিছুটা সীমাবদ্ধতা ছিল সেসময়। এখন তার শিক্ষকতার বয়স বেড়েছে, অভিজ্ঞতাও বেড়েছে তাই বর্তমানের শিক্ষার্থীরাই তার ক্লাস নিয়ে ভালো বলতে পারবেন। তবে এই সীমাবদ্ধতার ভেতর একধরণের বহুপ্রসারিত ভাবনা জগৎ যেকোনো শিক্ষার্থী লুফে নেয়ার সুযোগ পেতে। ঐ যে বললাম বাইনারি কোড। বাইনারি কোড মানে নির্দিষ্ট টপিকের উপর সুনির্দিষ্ট অবস্থান। যেমন কোনো ক্লাসে যদি মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের পুতুলনাচের ইতিকথা উপন্যাসের অস্তিত্ববাদের প্রতিফলন নিয়ে লেকচার হয় তবে সেখানে উপন্যাসের অস্তিত্ববাদী অংশগুলোই প্রাধান্য পাবে এবং অন্যকোনো অস্তিত্ববাদ বিরোধী কথা অথবা ভিন্নচোখে পুতুলনাচের ইতিকথা উপন্যাসের ব্যাখ্যা আলোচিত হবে না। স্যারের ক্ষেত্রে স্যারকে বিভ্রান্ত করা সহজ ছিল আমাদের। স্যার যথাযথভাবেই লেকচার শুরু করতেন, বাইনারি কোড মেনেই ক্লাস এগোতে কিন্তু আমি কিংবা জীবু অথবা অন্য যে কেউ অন্যধারার টপিক প্রবাহিত করার চেষ্টা করত, বুঝে হোক বা না-বুঝে স্যার তাকে থামিয়ে দিতেন না। স্যার সে আলাপেও চলে যেতেন। বাইনারি কোড যেত ভেঙে। সচেতন পরীক্ষার্থীসুলভ অনেক শিক্ষার্থী তখন বিভ্রান্ত হত এবং একটি ক্লাসের পড়া তখন পরবর্তী ক্লাসের টপিকে চলে যেত। কিন্তু আমাদের জীবনের দিকেও তো তাঁকানো প্রয়োজন। অনার্স-মাস্টার্স সম্পন্ন করে বড় চাকরি পেয়ে অর্থনৈতিক নিশ্চয়তা বিধান করেই জীবন ক্ষান্ত হতে পারে না। জীবনের আরো কিছু প্রয়োজন। আমাদের ভাবনার জগতে বাইনারি দর্শনের অবসান প্রয়োজন। জীবনে বহুরৈখিক, বহুমাত্রিক দৃষ্টিতে দেখতে শেখা, ভাবতে শেখা প্রয়োজন। তার জন্য প্রথমত প্রয়োজন ভিন্ন মতকে শোনা, সেটাকে বোঝার চেষ্টা করা এবং সহনশীল হওয়া- স্যারের ক্লাস থেকে সেটা আমি সবচেয়ে বেশি শিখেছি। হ্যাঁ, স্যারও কিছু কিছু ব্যাপারে রক্ষণশীলতা দেখাতেন কিন্তু তা কখনোই আক্রমণাত্মক হয়নি এবং অন্যকে ডোমিনেটধর্মী আচরণ তার মধ্যে লক্ষ করিনি। মনে মনে সবসময় ভেবেছি স্যারের এই গুণটা অন্তত আমি শিখে নেবো। তবে আমি শিক্ষক হিসেবে ভয়ঙ্কর একাডেমিক। একাডেমিক চাহিদা আমার কাছে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ তাই বাইনারি কোড মেনেই আমার ক্লাস নেয়া। অবশ্য স্কুল শিক্ষকের সেটাই হওয়া উচিত বলে মনে করি।
মোহাম্মদ বরকতুল্লাহর ‘পারস্যপ্রতিভা’ বইয়ের একটা লাইন আমার খুব প্রিয়। ‘বড় লেখক হওয়ার থেকে বড় কথা বড় মানুষ হওয়া’- আজন্ম এই বিশ্বাস নিয়ে আমার বেঁচে থাকা। খোরশেদ স্যার একজন বড় মানুষ। তাই তিনি শিক্ষকের আগে একজন চমৎকার মানুষ।
২০১৫। তখন চাকরিতে ঢুকে গেছি। মাস্টার্সের থিসিসও করছি। সত্যি বলতে অনেকটাই ফাঁকি দিয়ে থিসিসটা শেষ করি। ডেডলাইন অনুসারে পুরো পেপার রেডি করতে হিমশিম খাচ্ছি। মাত্র এক রাতে স্যার আমার পুরো থিসিস পেপার চেক করে প্রয়োজনীয় কারেকশন রেডমার্ক করে পাঠিয়ে দেন। স্যারের ছেলে তখন খুব ছোট। সারাদিন আব্বু, আব্বু করে। স্যার রুমের দরজা বন্ধ করে দীর্ঘক্ষণ কাব্যের কান্না শুনে শুনে আমার কাজটা করেন। পুরো ব্যাপারটা আমাকে অভিভূত করে। স্যারের প্রত্যাশা ছিল অন্তত ‘এ-’ পাবো থিসিসে কিন্তু তথ্যসূত্রের আর রেফারেন্সের অভাবে সেটা ‘বি+’ এর উপরে উঠতে পারেনি। মন খারাপ করিনি। স্যার বলেছিলেন পেপারটা নিয়ে আরেকটু কাজ করে বই আকারে প্রকাশ করতে। আমার ইচ্ছে, সাহস কিংবা আগ্রহ কোনোটাই না হওয়ায় সেটা অবহেলিত থেকে গেছে।
বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে দু’তিন শিক্ষককের বাসায় যাওয়ার সুযোগ হয়েছিল মাত্র। আমার আগ্রহটাই ছিল না সেসবে। কিন্তু স্যারের বাসায় যেতে অস্বস্তি লাগেনি কখনো। মনে পড়ে একবার কোরবানি ঈদের দিন জীবু আর আমি মিলে স্যারের বাসায় লাঞ্চও করেছিলাম। সেই সব স্মৃতিগুলো পরম ভালো লাগার।
এত এত কথা বলেও স্যারের মূল পরিচয়, তার বিশেষত্ব ও ব্যক্তিত্বের স্বরূপটা তুলে ধরতে পারলাম না। সেটা আমার ভাষার সীমাবদ্ধতা। খোরশেদ আলম নামটা শুনলেই আমার একজন শিক্ষকের হাসিমাখা মুখটা মনে ভেসে ওঠে আর তার পাশাপাশি দেখতে পাই একজন নিভৃতচারী গল্পকারকে। ঈশ্বর বললেন ‘হও’ আর সমগ্র পৃথিবী ধীরে ধীরে সৃষ্টি হয়ে গেলো। ঈশ্বরের জন্য সেটা যতটা সহজ ছিল মানুষের সভ্যতার বিকাশ, জীবন-ব্যবস্থা গড়ে তোলা ছিল ঠিক ততটাই কঠিন, শ্রম ও সময়সাপেক্ষ। ঈশ্বরকে জানতে এবং একই সঙ্গে ঈশ্বরের অস্তিত্ব অস্বীকার করতে মানুষকে প্রজন্মের পর প্রজন্ম, জীবনের পর জীবন দিয়ে যেতে হয়েছে। এই যে পৃথিবীতে এতসব সৃষ্টি লক্ষাধিক বছর ধরে চলে আসছে, চলছে তার সব-ই যে সবসময় সরবে, ঢাকঢোল-দামামা বাজিয়ে হয়েছে তা নয়, কিছু সৃষ্টি হয়েছে গোপনে, নিভৃতে, অজানিতে। মানব স্রষ্টা তাই দু’প্রজাতির। একজন সরব স্রষ্টা অপরজন নিভৃতচারী। আমার প্রিয় শিক্ষক খোরশেদ স্যার নিভৃতচারী। জীবনকে, দর্শনকে এবং সর্বাপরি সাহিত্য-শিল্প পাঠজাত অভিজ্ঞতা ও জ্ঞানকে তিনি নিভৃতে ব্যবহার করে যাচ্ছেন তার গল্পে। জানি না স্যার কোনোদিন উপন্যাস লিখবেন কিনা অথবা সম্প্রতি লিখছেন কিনা কিন্তু তার ছোটগল্প ইতোমধ্যে প্রকাশিত হয়েছে, জমাও হচ্ছে অনেক। অনলাইনসহ বিভিন্ন সাময়িকীতেও প্রকাশ পাচ্ছে কালেভদ্রে। স্যারের কোনো বিশেষ শিষ্যগোষ্ঠী নেই। স্যারের প্রচারমুখী সাহিত্যজগতে তেমন কোনো অবস্থান নেই। স্যার নিভৃতেই লিখে চলছেন জীবনের গল্প। মনে পড়ে স্যারের ‘উত্তরমেঘে শিলাবৃষ্টি’ প্রথম গল্পগ্রন্থ প্রকাশিত হওয়ার পরই আমি একটা রিভিউ লিখেছিলাম। এগারোটি গল্পের সবগুলোতেই জীবনের প্রতি নির্মোহ কিন্তু অত্যন্ত সচেতন সজাগ দৃষ্টি লক্ষ করেছিলাম। একবিংশ শতাব্দীর এই পর্যায়ে এসে জীবন যখন বিপন্ন অজানা ভাইরাসে তখন আমাদের জীবন নিয়ে, দর্শন নিয়ে আবার নতুন করে ভাবতে হচ্ছে, আমাদের শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির নবদিগন্ত উন্মোচনের সম্ভাবনা জাগ্রত হয়েছে। আমি বিশ্বাস করি পরবর্তী দশকে এক ঝাঁক নবীন শিল্পী-সাহিত্যিকের প্রবেশ ঘটবে বাংলাদেশের শিল্প-সাহিত্য জগতে সেখানে স্যারের অবস্থান হবে সুদৃঢ়। জীবনকে দেখা ও বোঝার নানা সূত্র তিনি জানিয়ে দেবেন নিভৃতে।
স্যারের জন্য, স্যারের সাহিত্যচর্চার জন্য, স্যারের পরিবার এবং বিশেষত কাব্যের জন্য অনেক অনেক শুভ কামনা আমার।
সুব্রত দত্ত
মিরপুর, ঢাকা
জুন ২৫, ২০২০ খ্রিস্টাব্দ
০২ রা ডিসেম্বর, ২০২০ বিকাল ৫:৪৩
সুব্রত দত্ত বলেছেন: আমিও ওয়েটিং থেকে চান্স পেয়েই পড়েছিলাম। ধন্যবাদ মন্তব্যের জন্য।
২| ০২ রা ডিসেম্বর, ২০২০ দুপুর ১:৫২
রাজীব নুর বলেছেন: পোষ্ট টি পড়ে ভালো লাগলো।
০২ রা ডিসেম্বর, ২০২০ বিকাল ৫:৪৪
সুব্রত দত্ত বলেছেন: আপনি আমার সব লেখাই পড়েন। এটা আমার সৌভাগ্য। আপনাকে অনেক ধন্যবাদ। শুভ কামনা আপনার জন্য।
©somewhere in net ltd.
১| ০২ রা ডিসেম্বর, ২০২০ সকাল ১১:৫১
ফয়সাল রকি বলেছেন: নিভৃতচারী স্যারের প্রতি শ্রদ্ধা রইলো।
ওয়েটিং থেকে বাংলায় চান্স পেয়েছিলাম কিন্তু পড়া হয়নি। হয়তো আরো কাছে থেকে দেখার সুযোগ পেতাম।