নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

নেশা সাহিত্য, পেশা শিক্ষকতা।

সুব্রত দত্ত

পরিশ্রমকে সঙ্গী করে কত মানুষ উর্ধ্বে গেলো, আকাশের ঐ তারার দলে/ চিরদিনই অলস আমি, আছি পড়ে অনন্তকাল এই ধরনীর গাছের তলে।

সুব্রত দত্ত › বিস্তারিত পোস্টঃ

আমার সাহিত্যের শিক্ষাগুরু: আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ

১৭ ই নভেম্বর, ২০২০ রাত ৮:০৩

গতকাল রাতে ঘুমোতে ঘুমোতে একটু দেরিই হয়ে যায়। ফেসবু্কে স্ক্রল করতে করতে দেখি সুমন ভাইসহ বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের বড় ভাইয়া-আপু, বন্ধুরা আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ স্যারের জন্মদিন উপলক্ষে ছবিসহ শুভেচ্ছা বার্তা লিখছেন। মনে পড়ল আজ স্যারের জন্মদিন। আরেকটা মজার ব্যাপার হলো আমার বাবা একশোটি রবীন্দ্র সঙ্গীতের একটা তালিকা দিয়েছেন যে গানগুলো সংগ্রহ করে একসঙ্গে ফাইল-আপ করে তার গানের মেমোরি কার্ডে ভরে দিতে হবে। গান সংগ্রহ করতে করতে রবীন্দ্রনাথের ‘এই লভিনু সঙ্গ তব/সুন্দর হে সুন্দর…..’ গানটা অনেকদিন পর শুনি। ছোটবেলায় বাবার অডিও ফিতা ক্যাসেটে গানটা শুনেছিলাম কিন্তু তারপর আর মনে থাকেনি। গানটা প্রেম সঙ্গীত মনে হলেও প্রকৃতপক্ষে এটি পূজাপর্বের গান। ধর্মীয় মত অনুসারে যেমন দেবতা পূজা প্রাপ্তির অধিকারী আবার ঐ ধর্মই জানায় দেবতা তো অবতারও হন সময়ের প্রয়োজনে। পূজার অর্ঘ তাই কখনো কখনো মানুষেরও প্রাপ্য হতে পারে যদি তিনি দেবতাতুল্য হন। এত কথা বলার উদ্দেশ্য এই যে রবীন্দ্রনাথের এই গানটার উপর আমার যদিও কোনো অধিকার নেই কিন্তু তবু আমি এই চরণ দুটো স্যারকে উৎসর্গ করতে চাই। প্রতিবন্ধকতা অবশ্য আরেকটা আছে- প্রথমেই সুমন ভাই ঠিক এই চরণগুলো লিখেই স্যারকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানিয়ে ফেলেছেন। সেদিক বিচারে আমার কী বা রইলো? দুঃখের অন্ত কিন্তু নাই। দুঃখ কখনো একক সংখ্যাবিশিষ্ট হয় না। তাই তো আমার আরেক দুঃখ ২০০৭ এর সেপ্টেম্বর থেকে ২০০৯-এর শেষ অবধি দুই বছরের অধিক সময় বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের সঙ্গে যুক্ত থেকেও, স্যারকে খুব কাছ থেকে বারংবার পেয়েও, স্যারের সঙ্গে কথা বলার পরও আজ সংগৃহীত ছবিমালা থেকে ছবি খুঁজতে গেলে স্যার আর আমার দুজনের কোনো আলাদা ছবি খুঁজে পাওয়া যায় না। ছবি তোলার থেকে তুলে দেয়ার দিকে ঝোঁকটা আমার বরাবরই ছিল। তার ফলস্বরূপ আজ স্যারের ছবিও নিতে হচ্ছে ইন্টারনেটের কাছ থেকে। আমার রইলো বা কী?

প্রিয় পাঠক, এই যে আমার নাই নাই করছি শুধু, এটা কিন্তু সত্যিকারের হাহাকার না। ছল মাত্র। আমার আছে, সেটা বাহ্যিক না অভ্যন্তরীণ। আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ স্যার এমন একজন আদর্শ মানুষ, মহাপুরুষ যিনি নিজের অজান্তেই লাখ লাখ কিশোর-তরুণ-যুবকের আদর্শ এমনকি জীবনের প্রধান পথপ্রদর্শক হয়ে উঠেছেন তাঁর কর্ম দিয়ে, তাঁর বাণী দিয়ে। সেই লাখের একজন সামান্য মানুষ আমি। স্যারকে আমি আমার সাহিত্যের শিক্ষাগুরুর মর্যাদা দিতে আগ্রহী। আমার বহু লেখায় আমি ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে সাহিত্যের প্রতি ভালোবাসা জন্মানোর গল্পটা শুনিয়েছি। সত্যি বলতে এই সাহিত্যের প্রতি আগ্রহের সৃষ্টির সঙ্গে পারিবারিক জীনগত বৈশিষ্ট্য প্রচ্ছন্ন আছে নিঃসন্দেহে। বাবাও সাহিত্যের ছাত্র ছিলেন। তাকে এককথায় আমি বলি ‘অন্ধ রবীন্দ্রভক্ত’। সেসূত্রে সাহিত্য ঢুকেছে আমার ভেতর। শৈশবে ঈশপের গল্পগুলো প্রভাব ফেলেছে। এসএসসি পরবর্তী সময়ে উইলিয়াম শেক্সপীয়রের রচনাসমগ্র সাহিত্যের জগতে ঢোকার বাসনা তৈরি করেছে আর কলেজে ভর্তির পর পর কোনো এক বন্ধুর হাতে দেখা বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের বইপড়া কর্মসূচির প্রজ্ঞাপনপত্র আমাকে পৌঁছে দিয়েছে শিক্ষাগুরুর কাছে। ২৪তম ব্যাচের পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানের দিন সুমন ভাই, রবি ভাই আমাকে কিছু কথা বলার সুযোগ দিয়েছিলেন। বক্তা হিসেবে আমি যারপরনাই খারাপ। নার্ভাসনেসের কারণে কথাগুলো জড়িয়ে যায়। তবু ভাইয়ারা আমাকে সুযোগটা দেন। সহজ স্বীকারোক্তি করি সেদিন যে, ঐ বইপড়া কর্মসূচিতে যাওয়ার প্রাথমিক লোভটা ছিল পুরস্কার পাওয়া কিন্তু যাওয়ার পর চমৎকার ২৮টি বই এবং স্যারের ক্লাসগুলো করে উপলব্ধি হয় যে পুরস্কার তো পেয়েই গেছি অজান্তে। অবশ্য বইও পেয়েছিলাম এক হাজার টাকার অনেকগুলো। এই যে এলোমেলো গল্প করে যাচ্ছি কিন্তু শিক্ষাগুরুর কথাটাই তো বোধ হয় কম করে বলছি। এ আমার বলার দোষ। ভণিতার বেড়াজালে প্রায়ই হারিয়ে যায় আসল কথা। আবার এও তো হতে পারে জগতে আসল কথা বলে কিছু নেই, হৃদয়কে উন্মোচিত করার সুযোগ পেলেই আসল কথা বেরিয়ে আসে।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগে আমার ভর্তি হতে পারাটা ছিল একেবারে ভাগ্যের উপর। ২য় ওয়েটিং লিস্ট থেকে ভর্তি হতে পারে মাত্র ৩ জন এবং আমি ছিলাম মাঝের জন। মনে আছে ৮০টি এমসিকিউ-এর মধ্যে আমার ৪০টি এমসিকিউ-এর উত্তর সঠিক হয়েছিল। নেগেটিভ মার্কিং ছিল না তখন। পরীক্ষায় আসা ঐ এমসিকিউর অনেকগুলোই ছিল হুমায়ূন কবীরের ‘বাংলার কাব্য’ এবং হুমায়ূন আজাদের ‘লাল নীল দীপাবলী’ বই থেকে। সৌভাগ্যবশত দুটো বইই বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র আমাকে পড়িয়েছিল। স্যারকে সাহিত্যের শিক্ষাগুরু মানি এজন্য যে তিনি কলেজ পড়ুয়া উঠতি তরুণদের জন্য এমন সব চমৎকার বইয়ের তালিকা তৈরি করেছিলেন যা একজন তরুণকে জীবনকে দেখার ভঙ্গি বদলে দিতে পারে, সাহিত্যকে ভালোবাসতে শিখিয়ে দিতে পারে। এখনও বইগুলোর কথা মনে পড়ে- তারাস বুলবা, সপ্তপদী, কবি, গাদ্দার, অল কোয়াইট অন দ্য ওয়েস্টার্ন ফন্ট, পারস্যপ্রতিভা- ইত্যাদি। বইগুলো আমার পাঠ-অভ্যাস তৈরি করে দিয়েছিল, পাঠের রুচি নির্মাণ করে দিয়েছিল। এসবের একক কৃর্তিত্ব নিঃসন্দেহে স্যারের। আজ দেখলে স্যার আমাকে চিনবেন কিনা জানি না। কিন্তু কি অভূর্তপূর্ব ক্ষমতাই না তাঁর- একজন মানুষকে নতুন এক রূপ দান করে দিলেন। আমি তো সামান্য একজন। আরো কত মানুষই না আছে এমন। মজার বিষয় আমার বাবাও স্যারের ক্লাস করেছিলেন। আমার বাবা স্যারের থেকে বছর দশেকের ছোট হবেন। কিন্তু তবু স্যারের বক্তব্য, স্যারের ভাবনা-দর্শনের গল্প তিনি এখনোও করেন।

প্রতি শুক্রবার আমাদের বইপড়া কর্মসূচির ক্লাস হতো। এক এক সপ্তাহে এক একটি বই পড়তাম আমরা। তারপর প্রিয় লাইনগুলো টুকে রাখতাম ডাইরীতে। শুক্রবার স্যার আসতেন। ঐ বইটা নিয়ে আলাপ করতেন। প্রিয় লাইন পড়ে শোনানোর সুযোগ দিতেন এবং তারপর আলোচনার ভেতরে প্রবেশ করতেন। আমি প্রায়শই আগ বাড়িয়ে বলতে যেতাম। কখনোই আমার মতের প্রতি স্যারের অশ্রদ্ধা কিংবা সেই মতকে উড়িয়ে দেওয়ার স্বভাব স্যারের ভেতর দেখিনি। ছোট মানুষ, ভুল বলতেই পারি- স্যার সুন্দর করে শুধরে দিতেন, তাচ্ছিল্য করতেন না। শিক্ষকের এই গুণটা বোধ করি আমাদের অনেকেরই শেখা প্রয়োজন। আমি অনেক জানি, তুমি তো মূর্খ হে- এমন মনোভাব ক্ষণিকের জন্যও স্যারের ভেতর লক্ষ করিনি। বেশ কয়েকবার বেশ কয়েকটা অনুষ্ঠানে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ করেছি, অনেক জ্ঞানী-গুণী ব্যক্তিদের সামনে থেকে দেখার সুযোগ পেয়েছি কিন্তু সবার মাঝে একজন হিসেবে বসে থাকা স্যারকে অহংকারহীন, সৌম্য এবং নিজের জনই মনে হয়েছে। স্যারের জন্য শুভকামনা নিরন্তন। দীর্ঘজীবী হউন। আপনাকে আরো অনেকটা পথ যেতে হবে আমাদেরকে সঙ্গে নিয়ে।

শেষ যেদিন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে যাওয়া হয় সেদিনকার কথাটাও স্পষ্ট মনে আছে। কলেজ পর্যায়ের বইপড়া কর্মসূচির পর আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের পাঠচক্র করা হয় তখন। অল্প কয়েকজনকেই নির্বাচিত করা হয়। আমি আবেদন করি। এবার স্যার একটু যাচাই বাছাই করেই সদস্য নেন। আমি তো সাহিত্য কেন্দ্র থেকে প্রায় ২৭/২৮টা বই পড়েছিলাম। এছাড়া আলাদা করে তো কিছুই পড়িনি। তখন সবেমাত্র বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছি। সিলেবাসভুক্ত বইগুলো সংগ্রহ করছি মাত্র। ভাইভা দেয়ার জন্য তাই সাহিত্য কেন্দ্র থেকে পড়া বইগুলোকে ভালো করে রিভাইস করি, বিভাগের সিলেবাসটাকে ভালো করে পড়ে নেই। মনে হয় এসবই হয়তো জানতে চাইবেন স্যার। ভাইভা বোর্ডে ঢুকতেই স্যারের প্রথম প্রশ্ন- বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের নির্বাচিত বই ছাড়া আর কী কী বই পড়েছো? ব্যস্, আমার ভাগ্য ভিন্নপথে রওনা দিলো। বুঝলাম এ যাত্রা ভাইভা ফেল। তবু একটু গোপন করে চর্যাপদ, শ্রীকৃষ্ণকীর্তন ও বৈষ্ণব পদাবলীর কথা বললাম। স্যার হেসে বললেন- এসব তো তোমার বিভাগের বই। বিভাগের বাইরে কী পড়ছো? গোপন কথাটি রবে না গোপন। স্বীকার করতে হলো পাঠ-অভ্যাস নেই। স্যার বোঝালেন সিলেবাসভুক্ত বই পড়লেই তো হবে না। বই পড়তে হবে নিজে পছন্দ করে, নিজের পছন্দ তালিকা তৈরি করে। সেদিন মন খারাপ করেই ফিরতে হয়েছিল যদিও স্যার মন খারাপ করিয়ে দেননি। আজ গর্ব করেই বলতে ইচ্ছে হয়- স্যার ২০২০-এর এই জুলাইতেই আমার নিজস্ব তালিকা থেকে ৩২টি বই পড়ে ফেলেছি। দোয়া করবেন আরো পড়তে পারি যেন।

এরপর বোধ হয় এমনিতেই এক দু’বার সাহিত্য কেন্দ্রে যাওয়া হয়েছিল কিন্তু আর ধারাবাহিকতা থাকেনি। দশ বছরে বদলে গেছে অনেক কিছু। সুমন ভাই, রবি ভাই হয়তো ফেসবুকের কল্যাণে নাম ও চেহারা দেখে একটু একটু চিনতে পারবেন আমাকে, এর বেশি না। তবে আমার হৃদয়ে, আমার চৈতন্যে আমার সাহিত্যের শিক্ষাগুরু আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ স্যার, বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র, সুমন ভাই, রবি ভাই, মিম আপু, ২৪তম ব্যাচের বন্ধুরা বিশেষত খুব ভালোবাসত যে সেই মুনীর, যাকে দেখে বিস্মিত হতাম সেই শফিকুল ইসলাম প্রিন্স- এরা প্রবল আধিপত্যে আজীবন গেঁথে থাকবেন।

আজ স্যারের জন্মদিন। সম্ভবত ২০০৯ সালের এই দিন স্যারকে আমরা সবাই মিলে শুভেচ্ছা জানিয়েছিলাম। সেদিন গল্প হচ্ছিল অমিত-লাবণ্যকে নিয়ে। স্যার বলেছিলেন লাবণ্য অতি সামান্য মেয়ে। অনেকেই মেনে নিতে, মনে নিতে পারেনি সেদিন। আজ দীর্ঘ এগারো বছর পর তাদের মনোভাব বদলেছে কিনা জানি না তবে আমি তখনও লাবণ্যের মতো মেয়ের সন্ধান করতাম, আজ আর করি না। পৃথিবীতে কেতকীরাই সত্যি হয়ে থাকে চিরদিন।

আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ স্যারকে প্রাণঢালা ভক্তি জানাই। স্যার ভালো থাকুন। আপনার জন্য অনেক অনেক শুভ কামনা আমার।


সুব্রত দত্ত
উত্তরখান, উত্তরা, ঢাকা
জুলাই ২৫, ২০২০ খ্রিস্টাব্দ।

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.