নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

নেশা সাহিত্য, পেশা শিক্ষকতা।

সুব্রত দত্ত

পরিশ্রমকে সঙ্গী করে কত মানুষ উর্ধ্বে গেলো, আকাশের ঐ তারার দলে/ চিরদিনই অলস আমি, আছি পড়ে অনন্তকাল এই ধরনীর গাছের তলে।

সুব্রত দত্ত › বিস্তারিত পোস্টঃ

ছোটগল্প: রেল স্টেশনে

০৮ ই নভেম্বর, ২০১৮ সকাল ১১:১৭

রেল লাইনের পাশে আমাদের এলাকা। বহু বছর ধরে এই ছোট্ট সুন্দর শহরটিতে আমাদের বসবাস। সত্যি বলতে শহরটা ঠিক শহর না, একটা এলাকা বা মহল্লা মাত্র আর খুব বেশি সুন্দরও না। বিসিক এলাকা, মানে শিল্পনগরী। সারি সারি বিল্ডিং-এ ফ্যাক্টরী আর ফ্যাক্টরী। ফ্যাক্টরীর আওয়াজ আর কালো ধোঁয়ায় পুরো পরিবেশটা বিপর্যস্ত। তার সাথে পুরো শহরটাকে ঘিরে রাখা সুন্দর নদীতে বর্জ্য পদার্থের ভীড়। দেখতে দেখতে কয়েকটি বছরেই নদীটি মরে গেলো। পানি দূষিত, বিদ্ঘুটে কালো আর অসহনীয় দুর্গন্ধ। সবমিলিয়ে একে স্বাস্থ্যকর পরিবেশ বলা চলে না। তবু, তবু আমি ভালোবাসি এই জায়গাটাকে। আজ একযুগ হয়ে গেলো এখানে এসেছি। সেই সব পুরোনো দিনের কথা মনে পড়তেই এক অজানা ভালো লাগা দুলে ওঠে আমার প্রাণে। প্রথম যে দিন এখানে আসি- ঈদের সময়, ঈদ কার্ডের দোকান দিয়েছে এলাকার ছেলেরা। ইফতারের পরই দোকান খুলে, সাউন্ড বক্সে গান বাজিয়েছে। আমরা মানে বাবা-মা আর আমার বোন আমি বেবিট্যাক্সিতে করে এলাকায় আসলাম। সন্ধ্যা হয়ে এসেছে, গান বাজছে। অদ্ভূত এক সময় আর অদ্ভূত এক অনুভূতি আমার হৃদয়ে। মাত্র ৮/১০ বছরের বালক আমি। তারপর কতগুলো দিন কেটে গেলো এখানে। বড় হলাম। আজও সেদিনটা আমার চোখে উজ্জ্বল।

কিন্তু গল্পটা ঠিক এ জায়গাটাকে নিয়ে নয়। গল্পটা খুব সাধারণ আর সস্তা। পৃথিবীর সব সাধারণই কিন্তু সস্তা নয়। তাহলে প্রেমকে এত মহৎ বলতো না কেউ। যাহোক, আমার গল্পটা বলি। আমি ছিলাম দুর্বল আর ভীতু প্রকৃতির ছেলে। বাসা থেকে বের হতাম না বেশি। বাসা থেকে স্কুল আর স্কুল থেকে বাসা- এই ছিল আমার যাওয়া আসা। তারপর একটু বড় হই, তার থেকেও সামান্য একটু সাহস আসে বুকে। দুটো বন্ধু হয় এলাকায়। ওরা ছিল অদ্ভুত রকমের। একজন এলাকার স্থানীয় ছিল। মস্তান টাইপের। মারামারি আর স্কুল পালানোতে সে ছিল ওস্তাদ। কীভাবে যে আমার বন্ধু হলো তা কেউ বলতে পারবে না। আমার প্রতি ওর আচরণটা ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। অন্যজন ছিল পড়ালেখা ছেড়ে দেয়া কিশোর। ফ্যাক্টরীতে কাজ করতো। কিন্তু ও দারুণ ছবি আঁকতে পারতো। কবিতাও লিখতো টুকটাক। ওকে খুব ভালো লাগতো আমার। আমাদের তিনজনের মধ্যে বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। ওরা দুজনেই আমাকে খুব সম্মান করতো। আমি ছিলাম পড়ুয়া, শান্ত আর ভালো ছেলে। বলা চলে গোবেচারা ছেলে। প্রতিদিন রেললাইনে হাঁটতাম আমরা। রেললাইন ধরে হেঁটে চলে যেতাম অনেকদূর। ফিরতাম সন্ধ্যায়। কত শত গল্প হতো আমাদের। কখনো মেয়ে নিয়ে, কখনো বা খেলাধূলা নিয়ে। সবেমাত্র কৈশোরে পা দিয়েছি কি-বা এমন কথা থাকতো আমাদের, তবু প্রতিদিন যাওয়া চাই রেললাইনে। আমি স্কুল থেকে ফিরে বের হতাম। আর একজন তো স্কুল পালিয়ে অনেক আগেই এলাকায় এসে বসে থাকতো। অন্যজন আসতো ফ্যাক্টরী থেকে। তিনজনে মিলিত হতাম রেললাইনে। তারপর হাঁটতাম, গল্প করতাম, বাদাম খেতাম। ওরা অবশ্য লুকিয়ে লুকিয়ে সিগেরেটও খেতো। আমাকে কখনো দিতো না। আর সবসময় বলতো আমি যেন কোনদিন সিগেরেট না ধরি। ওদের সাথে সিগেরেট কেনার চিপাতেও আমি যেতাম কিন্তু কখনো সিগেরেট খাই নি। অবশ্য এখন বিশ্ববিদ্যালয়ের জীবনে মাঝেমধ্যে দু’এক টান দেই, তবে আমি সিগেরেটখোর না। জীবনের সেই দিনগুলো আজও আমাকে আন্দোলিত করে। কিন্তু এখানেও গল্প নেই। এখানে গল্প আছে তবে আমি যে গল্পটা বলবো, সেটা এখানে নেই। গল্পটা খুব সাধারণ আর সস্তা।

মাঝেমাঝে আমি রেললাইনে একাই হাঁটতাম, যখন ওদের পেতাম না। এমনই একদিন হাঁটছিলাম রেললাইন দিয়ে। দিনটা ছিল ঠিক ঈদের আগের দিন। আমরা সাধারণত রেললাইনের ঐ দিকটাতে হাঁটতাম না যেদিকটা এগিয়ে গেছে স্টেশনের দিকে, কারণ ওদিকটা ছিল নোংরা আর বাজে মানুষের আখড়া। বরং তার উল্টোদিকটা ছিল গাছগাছালিময় আর নির্জন। কিছুটা পরিষ্কারও। কিন্তু যেদিন একা হাঁটছিলাম সেদিন কেন যেন রেল স্টেশনে যেতে মন চাইলো। ঈদের আগের দিন স্টেশনে মানুষের উপচে পড়া ভীড়। মানুষ আর মানুষ। সেসময়তে রেল ব্যবস্থা তেমন উন্নত হয়নি। রেলের ভাড়াও ছিল কম। তাই গরীবদের ভীড় ছিল বেশি। নোংরা পরিবেশ আর মানুষের চিল্লাফিল্লায় অতীষ্ঠ হয়ে পড়লাম কিছুক্ষণের মধ্যেই। এদিকে সন্ধ্যা হয়ে এলো। ইফতারির সময় হতে না হতেই চারিদিকে অদ্ভুত নীরবতা নামলো। গৌধূলী লগ্নে নির্জন প্লাটফর্মে দাঁড়িয়ে এক অন্যরকম আনন্দে ভরে গেলো মন। একটু আগে একটা ট্রেন এসে থেমেছে। নীরবে মানুষ চলাফেরা করছে। আমি দাঁড়িয়ে আছি। হঠাৎ একটা ছোট্ট ছেলে রেলগাড়ি থেকে দৌড়ে নামতে গিয়ে পড়ে গেলো। আর সজোরে চিৎকার করে কেঁদে উঠলো। সৌন্দর্যের অপার মূর্তিটা যেন নিমেষে ভেঙে খানখান হয়ে গেলো। আমি দৌড়ে ছেলেটার কাছে গেলাম। উঠিয়ে হাতপা ঝেড়ে দিচ্ছি এমন সময় দেখালাম একটা মেয়ে রেলগাড়ির দরজার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। বুঝলাম এই বাচ্চাটার কেউ হয়তো। ছেলেটা ফুফী বলে মেয়েটার দিকে যেতে নিয়ে থেমে দাঁড়ালো। বোঝা গেলো পায়ে ব্যথা পেয়েছে। কাঁদতে লাগলো দাঁড়িয়ে থেকে। আর মেয়েটি নামতে নিলো রেলগাড়ি থেকে। আমার বয়সী মেয়েটা। রেলগাড়িতে দরজাটা একটু উঁচুতে থাকে। যেখান থেকে নামাটা আমাদের বয়সী ছেলেমেয়ের জন্য একটু কঠিনই। ছেলেরা তবু যা একটু পারে কিন্তু মেয়েদের খুব কষ্ট হয়। মেয়েটি চেষ্টা করতে নিলো। আমি বললাম, “আপনি দাঁড়ান আমি ওকে নিয়ে আসছি।” এরপর খুব কষ্ট করে দুজনে ছেলেটাকে ওঠালাম। ছেলেটাকে ওঠাতে গিয়ে বারবার মেয়েটার হাত আমার হাতে লাগছিল। সত্যি অদ্ভূত লাগছিল ব্যাপারটা। জানি না মেয়ের হাত ধরাতে সেসময় এতো ভালো লেগেছিল কেন? এখনতো কত মেয়েরই হাত ধরি কিন্তু সে অনুভূতি নেই। যাহোক ছেলেটাকে ওঠানোর পর মেয়েটি বললো, “ধন্যবাদ। আসুন না ভেতরে।” খুব ভালো লাগলো। দৌড়ে উঠতে ইচ্ছে হলো কিন্তু আমি অত ছেলেমানুষ না তাই বললাম, “না যাই। একটু তাড়া আছে।” মেয়েটি বললো, “আপনি আসলে খুশি হবো। আর ১০মিনিট বসলে কি খুব দেরি হয়ে যাবে?” আমি আর না করতে পারলাম না। রেলগাড়িতে উঠে পড়লাম। ওদের কেবিনে গিয়ে দেখি আরো একজন মহিলা। একজন তরুণ যুবক। মেয়েটি আমার সাথে দেখা হওয়ার সব কথা তাদের বুঝিয়ে বললো। তারা ইফতারি করছিল। আমাকেও কিছুটা দিল। তারপর ট্রেন ছাড়ার আগ্ পর্যন্ত প্রায় আধ্ ঘন্টা তাদের সাথে গল্প হলো। সবাই খুব মিশুক। আমি আবার ছোটবেলা থেকেই মিশুক মানুষের সাথে দ্রুত মিশতে পারি। মিশুকরাও আমাকে খুব পছন্দ করে। তাদের সাথে পরিচিত হয়ে বেশ ভালো লাগলো। যখন তাদের বিদায় দিয়ে বাসার দিকে রওনা হলাম তখন রাত হয়ে গেছে। রেললাইনটা নিরাপদ না ভেবে সড়কপথে ঘুরে বাসায় ফিরলাম। সারাটা রাত ঘুম আসলো না চোখে। অদ্ভুত এক স্বপ্নাবেশে জড়িয়ে পড়লাম। বারবার শুধু নীলার কথা মনে পড়লো। মেয়েটার নাম নীলা। বড় ভাই, ভাবী আর ভাতিজার সাথে সিলেটে গ্রামের বাড়ি যাচ্ছিল। শহরে থাকে ভাইয়ার সাথে। পড়াশুনা করে ক্লাস এইটে। আমিও এইটে পড়ি। আরো অনেক কিছু জেনেছি। আমার অনেক কথাও জিজ্ঞাসা করে জেনেছিল ওর ভাবী। হায়, তখন যদি মোবাইল ফোন আজকের মতো সহজলভ্য হতো তাহলে হয়তো একটা নম্বর নিয়ে নীলার সাথে কথা বলতে পারতাম। কিন্তু তাতো হলো না। ওর কথা বহুদিন ভাবলাম। পৃথিবী নশ্বর। পৃথিবীর সবকিছুই নশ্বর। তাই স্মৃতিও এক সময়ে মুছে যায়। ওকে ভুলতে লাগলাম। একটি বছর ঘুরে আসলো। আবার ঈদ এলো। কেন যেন ঈদের আগের দিন হঠাৎ নীলার কথা মনে পড়লো। ও বলেছিলো ওরা প্রতিবছর ঈদের আগের দিন ট্রেনে করে সিলেট যায়। তার মানে আজও হয়তো যাবে। আমি আবার ছোটবেলা থেকেই গল্প উপন্যাস পড়তাম। বন্ধুরা মাসুদ রানার গোয়েন্দা কাহিনি পড়তো, কেউ কেউ লুকিয়ে লুকিয়ে চটিবই পড়তো। কিন্তু আমি পড়তাম রবীন্দ্রনাথ, শরৎ, বিভূতির গল্প। বিদেশি গল্পের অনুবাদও পড়তাম। এসব পড়ার ফলে আমার অপরিণত শিশু মস্তিষ্কে একধরণে রোমান্টিক প্রভাব পড়েছিল। এসব অবশ্য এখন ব্যাখ্যা করছি, তখন কিছুই বুঝতাম না। মনে হলো আজও যদি ওদের সাথে দেখা হয়। বিকেল হতে না হতেই রওনা হলাম স্টেশনে। যখন পৌঁছালাম তখন মাত্র ৫টা বাজে। ঐ ট্রেনটা হয়তো সাড়ে ৬টায় আসবে। আমি স্টেশনে দাঁড়িয়ে রইলাম। ট্রেন আসলো। পুরোটা ট্রেন খুঁজলাম ওদের। পেলাম না। গল্পের কাহিনি আর জীবনটা এক না। কাকতালীয়ভাবে জীবনের আকাঙ্ক্ষা খুব কমই পূরণ হয়। ট্রেন ছাড়ার পর বাসায় ফিরলাম। প্রাণপণে চেষ্টা করলাম ওকে ভুলে যেতে। তবু পরের বছরের ঈদের আগের দিনটিতে রেল স্টেশনে গেলাম আর ফিরে আসলাম নিজের বেকুব মনটাকে বকা দিতে দিতে। এভাবে বেশ কয়েকবার গিয়েছিলাম। কাল ঈদ। বাইরে বন্ধুরা অপেক্ষা করছে আমার জন্য। আকাশে ঈদের চাঁদটা দেখেই ফটকা ফাটালো ওরা। সবাই মিলে আজ ঘুরবো অনেক রাত পর্যন্ত। একটু আগে বাসায় ফিরলাম রেল স্টেশন থেকে। রেল ব্যবস্থার অনেক উন্নতি হয়েছে। সাড়ে ৬টায় এখন আর কোনো সিলেটগামী ট্রেন থামে না আমাদের স্টেশনে। সিলেটের ট্রেনটা এখন বিকেল সাড়ে ৫টায় অতিক্রম করে আমাদের স্টেশনকে। থামেও না এখানে। তবু আজ ৫টার দিকে রেল স্টেশনে গিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলাম। চোখের সামনে দিয়ে সিলেটের ট্রেনটা গেলো। দেখলাম আমার বয়সী একটা মেয়ে খুব করে স্টেশনের দিকে তাঁকিয়ে আছে জানালা দিয়ে। যেন কাউকে খুঁজছে। চোখের পলকে ট্রেনটা আমাকে অতিক্রম করলো। ন্যানো সেকেন্ডের জন্য হয়তো মেয়েটার চোখে চোখ পড়েছিল আমার। ও নিশ্চয়ই নীলা। সত্যি আমি একবিংশ শতাব্দির একজন পুরোনো ধাচের রোমান্টিক লেখক।

আগস্ট ৬, ২০১৩

মন্তব্য ৪ টি রেটিং +৩/-০

মন্তব্য (৪) মন্তব্য লিখুন

১| ০৮ ই নভেম্বর, ২০১৮ বিকাল ৩:৩৬

রাজীব নুর বলেছেন: ভালো লিখেছেন।
একটা আচানক বিষয় হলো- সব রেল স্টেশনে পাগল থাকেই।

০৮ ই নভেম্বর, ২০১৮ রাত ৯:০২

সুব্রত দত্ত বলেছেন: সত্যি বলতে, অনেক আগের লেখা গল্পটা। এমন আরো কিছু গল্প আছে। তখন এগুলো গল্প মনে হত কিন্তু এখন কেমন পানসে পানসে, মরা মরা লাগে। তাই আর গোপন করে পরম যত্নে রাখছি না ছাপানোর আশায়। বই বের করে লেখক হওয়ার স্বপ্নটা আপাতত স্থগিত। তবে ভালো বললেন, তাই ভালো লাগলো অনেক। অনেক অনেক ধন্যবাদ। আর রেললাইনে তো পাগল থাকেই, গল্পকথক কত বড় পাগল বলেন!

২| ০৮ ই নভেম্বর, ২০১৮ বিকাল ৪:০৫

মা.হাসান বলেছেন: যদি এক মুহূর্তের জন্যও আমায় চাও সেটাই সত্যি...

০৮ ই নভেম্বর, ২০১৮ রাত ৯:০২

সুব্রত দত্ত বলেছেন: ঠিক বুঝলাম না আপনার মন্তব্যটা।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.