নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

নেশা সাহিত্য, পেশা শিক্ষকতা।

সুব্রত দত্ত

পরিশ্রমকে সঙ্গী করে কত মানুষ উর্ধ্বে গেলো, আকাশের ঐ তারার দলে/ চিরদিনই অলস আমি, আছি পড়ে অনন্তকাল এই ধরনীর গাছের তলে।

সুব্রত দত্ত › বিস্তারিত পোস্টঃ

সদ্যপ্রয়াত সৈয়দ শামসুল হক ও তাঁর সাহিত্যকৃতির নবতর মূল্যায়নের প্রত্যাশা

০২ রা নভেম্বর, ২০১৬ রাত ৮:০৬

বেশ অনেকদিনই হয়ে গেল রোলাঁ বার্থ লেখকের মৃত্যু ঘোষণা করে পাঠকের জন্মগ্রহণের কথা বলে গেছেন। কিন্তু মানুষের আদিম প্রবৃত্তিকে অতিক্রম করা কতটুকু সহজ? ধ্রুপদী সাহিত্যে বরাবরই অবহেলিত হওয়া পাঠক, নিজেই জোরের সঙ্গে দাবি জানিয়েছে তার অস্তিত্ব লাভের কথা। লেখা ও লেখককে অবিচ্ছেদ্য ভাবার যুগেরও অবসান ঘটাতে সক্রিয় হয়েছে ভাষাবিজ্ঞান। ভাষাই কথা বলে এবং ভাষার সৃষ্ট প্রতিটি শব্দের আধেয়তে থাকে একটা শূন্য স্থান, যেখানে কেবল পরিভ্রমণ করতে পারে পাঠক, লেখক লেখার সঙ্গে সঙ্গেই মৃত হয়ে যান। যুক্তি আর দর্শনের মারপ্যাঁচে এই ধরনের তত্ত্বও কালের বিবর্তনে পুরনো হয়ে এসেছে। সাহিত্য চর্চা করেন না বা সাহিত্যতত্ত্বের সঙ্গে সম্পর্ক নেই এমন সাধারণ পাঠকদের কাছে কিন্তু এসব তত্ত্ব নয় বরং লেখকই প্রধান হয়ে থাকেন। তাই কোন লেখক ব্যক্তির মৃত্যুর পর পত্রিকার শিরোনাম হয় ‘সাহিত্যের আকাশ থেকে খসে গেল একটি তারা’ অথবা ‘তাঁর মৃত্যু সাহিত্যের অপূরণীয় ক্ষতি’ ইত্যাদি। অথচ যিনি শারীরিকভাবে মারা গেলেন তিনি একজন ব্যক্তি মাত্র। আর চার-পাঁচজন সাধারণ মানুষের মত করেই তাঁর ঘটেছে দেহাবসান। আর তাঁর সমস্ত সাহিত্যকৃতি? সেগুলো তো জন্মাতে জন্মাতেই মেরেছে তার ¯্রষ্টাকে।
সত্যি বলতে কি এখনও সাহিত্য¯্রষ্টা গুরুত্বপূর্ণ। ধ্রুপদী সাহিত্য সমালোচনায় যে লেখককে প্রাধান্য দেয়া হয়েছে, সে লেখকই আসলে তাঁর সমস্ত লেখার প্রতিনিধিত্ব করে। এমনকি লেখকের কেবল ‘মানবিক সত্তা’ই নয়, তাঁর ‘ধর্মীয়’, ‘রাজনৈতিক’, ‘সামাজিক’ সত্তাও অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ বিবেচিত হয় এখনো। তাই প্রায়ই শোনা যায় অমুক লেখক ‘হিন্দু লেখক’ তমুক লেখক ‘বামপন্থী লেখক’- এগুলো আসলে আমাদের সমগ্র জাতিসত্তা, সংস্কৃতি ও মানবিক মূল্যবোধের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। ‘অঁঃযড়ৎ রং ফবধফ’ বলে কেবল টেক্সটকে মূল্যায়ন করা সহজসাধ্য নয়। সাহিত্যতত্ত্বের এই ধারাটি তাই সার্বিক তত্ত্ব না হয়ে বরং একটি আলাদা ধারা হিসেবেই থেকে যাচ্ছে।
গত ২৭ সেপ্টেম্বর ২০১৬ খ্রি:-এ বর্তমান সময়ের প্রতিনিধিত্বশীল সাহিত্যিক সৈয়দ শামসুল হক ফুসফুসে ক্যান্সার আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর আশি বছরের জীবনকালে প্রায় বাষট্টি বছরের সাহিত্য জীবনে তিনি লিখছেন অসংখ্য গল্প, কবিতা, উপন্যাস, নাটকসহ বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধ। আছে কয়েকটি অনুবাদও। মাত্র ঊনত্রিশ বছর বয়সে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার লাভ করে তিনি বিস্ময়ের সৃষ্টি করেছিলেন। এছাড়া পেয়েছেন একুশে পদক, স্বাধীনতা পুরস্কারসহ আরো বেশ কয়েকটি পুরস্কার। এইসব তথ্যগুলো গুরুত্বের সঙ্গেই নিচ্ছি সবাই। তারপর তাঁর ব্যক্তিমানস, রাজনৈতিক আদর্শ এবং ধর্মীয় মূল্যবোধগুলোকে বিশ্লেষণে আগ্রহী হয়েছি আমরা। একদল সমালোচক সেই মহান ব্রতকে সামনে রেখে লিখে চলেছেন প্রবন্ধ-নিবন্ধ। আমি মনে করে এতে করে ব্যক্তি সৈয়দ শামসুল হক এক ধরনের পাবলিসিটি ছাড়া আর বেশি কিছুই পাচ্ছেন না এমনকি সেই ‘সৈয়দ শামসুল হক’ নামটিও একটি ফাঁকা শব্দ ব্যতীত অন্য কিছু হিসেবে বর্তমানে সক্রিয় নয়।
আমার ভাবনার জায়গাটা তাই অন্যত্র। আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি সৈয়দ শামসুল হকের সমস্ত সাহিত্যকৃতিকে একটা অভিধান হিসেবে বিবেচিত করে তার মর্মার্থ বোঝার প্রয়াসটাই হওয়া উচিত সর্বপ্রথম। ভাষা নিয়ত প্রবহমান। ভাষাই নিজ দায়িত্বে বলে চলে তার অতীতকে, বর্তমানকে। আমরা কেবল ভাষা থেকে পেতে পারি আমাদের হাজার বছরের প্রবাহিত জীবনের গল্পটা। প্রকৃতপক্ষে তো সমস্ত সাহিত্য, শিল্প, জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রধান প্রয়াসটা হলো ‘নিজেকে চেনা’র প্রয়াস। ভাষা সেই চেনার পথটা বাতলে দেয়।
“আমার ঘরের জানালার পাশে গাছ রহিয়াছে
তাহার উপরে দুটি লাল পাখি বসিয়া আছে।”
সৈয়দ শামসুল হকের জবানিতে জানা যায় ছোটবেলায় টাইফয়েড আক্রান্ত শয্যাশায়ী কবি তাঁর বাড়ির রান্নাঘরের পাশে সজনে গাছের উপর একটি লাল পাখিকে বসে থাকতে দেখে এই দু’চরণ লিখেছিলেন, যা তাঁর প্রথম রচনা। এরপর ম্যাট্রিক পরীক্ষা দিয়ে তিনি তাঁর ব্যক্তিগত খাতায় লিখে ফেলেন দুই শতাধিক কবিতা কিন্তু সাহিত্যিক হিসেবে আত্মপ্রকাশ ঘটে একটি ছোট্ট গল্প প্রকাশের মাধ্যমে। ১৯৫১ সালে ‘অগত্যা’ নামক একটি পত্রিকায় প্রকাশিত হয় ‘উদয়াস্ত’ নামক একটি ছোটগল্প। সেখান থেকেই তাঁর সাহিত্যিক পরিচয়ের প্রসার। লিখেছেন অসংখ্য ছোটগল্প। গল্পগুলোতে বারবার ফুটে উঠেছে মধ্যবিত্ত জীবন, তৎকালীন জীবন-ব্যবস্থা, রাজনীতি, ধর্মীয় ও যৌনচেতনা, নাগরিক জীবনের যান্ত্রিকতার মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো। বাংলাদেশের সাহিত্যে এই ধরনের বিষয়বস্তুকে নতুন বলে চিহ্নিত করার কোন সুযোগ আমরা পাই না কিন্তু বিচার্য হচ্ছে সৈয়দ শামসুল হক কোন সময়কার গল্পকার হিসেবে বিবেচিত হবেন। তাঁর অধিকাংশ গল্পই দেশ বিভাগোত্তর ও স্বাধীনতাপূর্ব পূর্ব-পাকিস্তান আমলে। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় পূর্ব বাংলা তথা পূর্ব পাকিস্তানের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক বিকাশ ঠিক ভারতবর্ষের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক বিকাশের সমসাময়িক নয় বরং দেশ বিভাগোত্তর সময়ে রাষ্ট্র ধারনার নূন্যতম যুক্তিকে গ্রাহ্য না করে গঠিত পূর্ব-পাকিস্তান শাসনামলে। পশ্চিম-পাকিস্তানীদের দূরদর্শিতার অভাব এবং শোষণের মনোভাব মাত্র ২৩ বছরেই পাকিস্তান ভাঙনের ভেতর দিয়ে বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের জন্ম দেয়। সৈয়দ শামসুল হকের ছোটগল্পের অধিকাংশই রচিত হয়েছে এই বছরগুলোতে।
আমাদের সাধারণদের একটা বড় ধারণা যে নিভৃতচারি শিল্পীরা হয়ে থাকেন মেধাবী ও যথার্থ শিল্পী। উদাহরণ হিসেবে একেবারে হাতের কাছেই পেয়ে যাই জীবনানন্দ দাশকে। অন্যদিকে সাহিত্যাঙ্গনে প্রবল প্রতিপত্তি নিয়ে বিরাজমান শিল্পীর দিকে আমার আড়চোখে তাঁকিয়ে প্রশ্নবিদ্ধ করতে থাকি তাঁর সৃষ্টিকর্মকে। এখানেও লেখা নয়, লেখকের প্রাধান্য লক্ষ করা যায়। সৈয়দ শামসুল হক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার আগে থেকেই বাংলা সাহিত্যের অঙ্গনে সবসময় সক্রিয়ভাবে উপস্থিত ছিলেন। বাংলাদেশ হওয়ার পর লেখকগোষ্ঠী, তাদের কার্যক্রম ও বাংলাদেশের সাহিত্য গড়ে তোলায় তিনি কেবল শিল্পী হিসেবে নন একজন শ্রমিক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। তাই বরাবর নানাভাবে নিন্দিতও হতে হয়েছে তাঁকে। বিশেষত তাঁর রাজনৈতিক আদর্শ নিয়ে কথা বলতে শোনা যায় অনেকের মুখেই। এসবকে তিনি তোয়াক্কা না করে বরং ‘সব্যসাচী’র মতো এক হাতে বাংলাদেশের সাহিত্য নির্মাণে ব্যস্ত থেকেছেন, অন্য হাতে লিখে চলেছেন গল্প, কবিতা, উপন্যাস, নাটক- যার সবগুলোই প্রকৃতপক্ষে তাঁর সময়ের দলিল হিসেবে একটা ‘পা-ুলিপি’ বা ‘অভিধান’ তৈরি করেছে। তাঁর ‘প্রাচীন বংশের নিঃস্ব সন্তান’ গল্পের দেওয়ান ইদ্রিস খাঁ আবহমান বাংলার ঐতিহ্যটুকু হারিয়ে যাওয়ার যন্ত্রণার প্রতীকী চরিত্র, ‘জমিরউদ্দিনের মৃত্যুবিবরণ’ গল্পের জমিরউদ্দিন মানুষের আত্মিক ঐতিহ্যের পরিচায়ক আবার ‘গাধা জ্যোৎ¯œার পূর্বাপর’ গল্পের জ্যোৎ¯œা মানুষের হৃদয়বৃত্তির গভীরতম জায়গাটিকে স্পর্শ করে যাওয়া একটি মেয়ে। এমনিভাবে তাঁর অসংখ্য গল্পে অসংখ্য চরিত্র একে একে ফুটে উঠছে মানুষের জীবন, স্বপ্ন, আকাঙক্ষা, চিন্তা, আদর্শের এক একটি দিক। আবার বিষয়শৈলি ও গঠনকৌশলেও সৈয়দ শামসুল হক প্রতিনিয়ত নিজেকে উন্নত করেছেন ব্যতিক্রম পথে পা বাড়িয়ে। তাঁর ক্রমশ পরিবর্তনের এই পথ বাংলাদেশের সাহিত্যে এনে দিয়েছে একটি বিশালতর ক্ষেত্র। আশি বা নব্বইয়ের দশক থেকে লক্ষ করা যায় বাংলাদেশের সাহিত্যের প্রবণতা আঙ্গিকগত জায়গাকে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে, যা বর্তমান সময়েও লক্ষণীয় অথচ এতে করে উপেক্ষিত হয়েছে বিষয়শৈলিগত দিকটির মহত্ত্ব। সৈয়দ শামসুল হক সে পথে যাননি তিনি বরাবরই গুরুত্ব দিয়েছেন বিষয়কে। তাঁর বিষয়গত দিকটির প্রাধান্য রেখেই তিনি আঙ্গিক নিয়ে কাজ করেছেন।
সর্বাপরি বাংলাদেশের সাহিত্যাঙ্গনে বর্তমানে সবচেয়ে আলোচিত সদ্যপ্রয়াত সৈয়দ শামসুল হকের সমস্ত সাহিত্যকৃতির নবতর মূল্যায়নের প্রত্যাশা নিয়ে আমি আমার কথা শেষ করছি এবং এই আশাকেও সঙ্গে রাখছি যে, ব্যক্তি সৈয়দ শামসুল হক অপেক্ষা তাঁর সাহিত্যকৃতি যেন বেশি গুরুত্ব পায়।


অক্টোবর ০৭, ২০১৬ খ্রি:

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.