নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
পরিশ্রমকে সঙ্গী করে কত মানুষ উর্ধ্বে গেলো, আকাশের ঐ তারার দলে/ চিরদিনই অলস আমি, আছি পড়ে অনন্তকাল এই ধরনীর গাছের তলে।
হে মোর বন্যা, তুমি অনন্যা,
আপন স্বরূপে আপনি ধন্যা।
অমিতলালের লাবণ্য সম্পর্কে এই উক্তি থেকেই ‘শেষের কবিতা’র নায়িকা লাবণ্যের পরিচয়ের প্রথম সূত্রটি পাওয়া যায়। আর পাঁচটি মেয়ের মধ্যে যে সে একজনা, তা সুষ্পষ্ট। মাতৃহীন, অধ্যাপক পিতার আদুরে মেয়ে লাবণ্য ছোটবেলা থেকেই পড়াশুনার সঙ্গে বড় হতে হতে তার জীবনে যেন পড়াশুনাই একমাত্র সঙ্গী হয়ে ওঠে। অনেক বই পড়ে সে, তার নিজস্ব একটা জগৎ আছে। তাতেই লাবণ্য অনন্য।
দেখতেও কোথাও যেন একটা অন্যরকম ছাঁদ আছে তার। অমিতলালের সঙ্গে তার প্রথম সাক্ষাৎতেই তা সুস্পষ্ট। লেখকের ভাষায়Ñ
‘সদ্য-মৃত্যু-আশঙ্কার কালো পটখানা তার পিছনে, তারই উপরে সে যেন ফুটে উঠল একটি বিদ্যুৎরেখায় আঁকা সুস্পষ্ট ছবিÑ চারি দিকের সমস্ত হতে স্বতন্ত্র। মন্দরপর্বতের নাড়া খাওয়া ফেনিয়ে-ওঠা সমুদ্র থেকে এইমাত্র উঠে এলেন লক্ষ্মী, সমস্ত আন্দোলনের উপরেÑ মহাসাগরের বুক তখনো ফুলে ফুলে কেঁপে উঠছে।’
লাবণ্যের পরনে ছিল সাদা আলোয়ানের শাড়ি, তার উপরে একটি জ্যাকেট। তার দেহটি দীর্ঘ, বর্ণ হালকা শ্যামলা, টানাটানা চোখের ভেতর স্নিগ্ধতা, প্রশস্ত ললাটের পিছনে ঝুলে পড়া চুল, চিবুক ঘিরে সুকুমার মুখের ডৌলটি একটি অনতিপক্ব ফলের মতো রমণীয়। সবমিলিয়ে একেবারে নায়িকাদের মতো (আক্ষরিক অর্থে) অপূর্ব সুন্দর তা নয়, কিন্তু একটা অভূতপূর্ব জ্যোতিতে ভাস্বর লাবণ্য। অমিত যেন আচমকাতেই প্রেমে পড়ে যায় তার।
উপন্যাসে ধীরে ধীরে লাবণ্যের স্বভাব, চরিত্র এবং বৈশিষ্ট্যের প্রকাশ ঘটতে থাকে। শান্তশিষ্ট এই মেয়েটি জীবন নিয়ে বড় কোন আশা করতে পারে না। কোথায় যেন তার একটা শঙ্কা কাজ করে। অথচ আর পাঁচটা মেয়ের থেকে সে যে কোন কোন ক্ষেত্রে আলাদা, তা সেও বুঝতে পারে। অমিত যতই তার নিকটবর্তী হতে থাকে ততটাই তার শঙ্কা বাড়ে। অমিতের চকিতে এসে ভালোবাসার আহ্বানটা লাবণ্যের কাছে স্বপ্নের মতো মনে হয়। তাই অমিত যখন ফিরে আসতে পারবে না বলে জানায়, তখন লাবণ্য বিচলিত হয় না। বরং এমনটা অত্যন্ত স্বাভাবিক বলেই তার মনে হয়ে। প্রকৃতপক্ষে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এই উপন্যাসে লাবণ্য নামক চরিত্রটিকে এমনভাবে নির্মাণ করেছেন যাতে লাবণ্য একেবারেই অন্যরকম একটি মেয়ে। বাস্তবিক এমন মেয়ে আছে কিনা সন্দেহ। অন্যদিকে অমিতলালের মতো নায়কের অভাব নেই দুনিয়াতে। সে জন্য লাবণ্য চরিত্রটি ভিন্ন একটি মাত্রাতে পৌঁছেছে।
লাবণ্য এমন একটি মেয়ে, যে তার হৃদয়ের গভীরের অনুভূতিকে একেবারে গোপনে লুকিয়ে রাখতে জানে। সে এতে এতটাই পারদর্শী যে উপন্যাসেও শেষ পর্যন্ত ব্যক্ত হয়নি লাবণ্যের অমিতের প্রতি ভালোবাসার সুনির্দিষ্ট রূপটি। তাই তার শেষ চিঠিতে লাবণ্য লিখেছেÑ
ওগো তুমি নিরূপম,
হে ঐশ্বর্যবান,
তোমারে যা দিয়েছিনু সে তোমারি দানÑ
গ্রহণ করেছ যত ঋণী তত করেছ আমায়।
হে বন্ধু, বিদায়।
অমিতকেই শেষ পর্যন্ত একটি নায়কের চরিত্র দান করে লাবণ্য নিজেকে সামান্যা হিসেবে জানিয়েছে। উপন্যাসের কাহিনিভাগে কিন্তু অমিতের চেয়ে লাবণ্যই যথেষ্ট উজ্জ্বল। বরং অমিতলাল যখন লাবণ্যকে শেষ চিঠি লেখে সেখানে তার সহজ স্বীকারোক্তি করে যে, লাবণ্য তার কাছে দিঘির মতো বিস্তৃত। যেখানে স্বাচ্ছন্দ্যে সাঁতার কাটা যায়। অন্য পাঁচটি মেয়ে যেখানে ঘটির জলের মতো নিত্যনৈমিত্তিক কাজেই যাদের দরকার। অমিতের কাছে এ ভাবনা সুস্পষ্ট (অবশ্য রবীন্দ্রনাথের এই থিয়োরি কেবল সাহিত্যজগতেই শোভা পায়, জীবনের রূঢ় বাস্তবতায় প্রমাণ হবে অমিত প্রকৃতপক্ষে লাবণ্য প্রসঙ্গের যবনিকা টেনেছে উক্ত উক্তির ভেতর দিয়ে)।
সুব্রত দত্ত
১৯ মার্চ ২০১৬।
©somewhere in net ltd.