নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
'তুম তো মেরে ভাই হো!' =
এডমন্টন শহরে আমাদের বাসার কাছে চৌত্রিশ এভিনিউতে কয়েকটি ভারতীয় দোকান আছে। হালাল মাংস, দেশি সব্জি, মরিচ মসলা, ইত্যাদি নানা পরিচিত দ্রব্য পাওয়া যায় সেখানে। আমার স্ত্রী হালিমা আফরিনকে সাথে করে সেই দোকানে ঢুকি। কোন সবজি, বা কোন মসলা কেনা যাবে না যাবে সেসব চিন্তা তাঁর মাথায় চড়িয়ে দিয়ে আমি কেবল ওর পেছনে পুশ কার্ট ঠেলি, আর এদিক ওদিক তাকাই।
দোকানটি বেশ প্রশস্থ। লাগোয়া একটা গুদাম ঘর, বা স্টোর রুমও আছে। সেখানে ছিপছিপে গড়নের এক মধ্য তিরিশের যুবক মালামাল নাড়াচাড়া করছেন। এ দোকানে বহুবার এসেছি, তবে, এর আগে তাঁকে দেখেছি বলে মনে পরে না।
ধারালো ছুরির মতো চিকন গোঁফ, মাথার তেলে ভেজা ঢেউ খেলানো কোঁকড়া চুল, মাঝারি উচ্চতার মানুষ তিনি। পায়ে চামড়ার সেন্ডেলজোড়া, ঢিলেঢালামতো ছাইরঙা পেন্ট, আর, গায়ে গোলাপি রঙের ফুল হাতা শার্ট। বাম হাতের কব্জিতে চকচকে ঘড়ি। সপ্রতিভ, চটপটে, পরিশ্রমী বলেই প্রথম দর্শনে মনে হলো। খানিক তফাৎ হতে আমার সাথে চোখাচোখি হলো কয়েকবার। যুবক হয়তো আঁচ করতে পেরেছেন তাঁকে মনোযোগ দিয়ে দেখার ছিল আমার।
মিনিট পাঁচেকের মধ্যে বেশকিছু তাজা ঢেঁড়স এনে আমাদের কাছের এক খালি ঝুড়িতে ঢেলে দিয়ে আমাকে উদ্দেশ্য করে হিন্দিতে বললেন, 'ফ্রেশ ওকরা, কেবলই গত রাতে এসেছে।' ঢেঁড়সকে এখানে ওকরা বলে। আঠালো বলে আমি ঢেঁড়স তেমন খাইনা। কিন্তু, আমার স্ত্রী এই সবজিটির বড়ো ভক্ত। এতে নাকি ভিটামিন 'এ', 'বি', 'সি' ও লোহা আছে বিস্তর। সে বেছে বেছে তরতাজা, নাদুসনুদুস দেখতে ঢেঁড়স সংগ্রহে লেগে গেলো। এমন টাটকা সবজি সবসময় মেলে না।
এই ফাঁকে আমি 'হাউ আর ইউ' বলে ওই লোকের সাথে আলাপ জমানোর চেষ্টায়। ভাঙা ভাঙা ইংরেজিতে তিনি আমাকে জানালেন ইংরেজি খুব ভালো বলতে পারেন না। তাঁকে আশ্বস্ত করে আমি বললাম, 'সমস্যা নেই, হিন্দি আমি মোটামুটি বুঝি।' বাস্তবতা হলো, কানাডায় ইমিগ্রেশন কনসালটেন্টের কাজ করতে গিয়ে বাংলা, ইংরেজির পাশাপাশি আমাকে হিন্দি, উর্দু, পাঞ্জাবি, স্প্যানিশ ইত্যাদি ভাষারও প্রাথমিক জ্ঞান অর্জন করতে হয়েছে।
- 'মাত্র সাতদিন আগে কাগজ পেলাম। আপনি কি কাগজ পেয়ে গেছেন?' - তিনি জানতে চাইলেন। সচরাচর যাঁরা কোনও উপায়ে কানাডায় ঢুকে পড়েন তাঁরা পরবর্তীতে আদালতের শরণাপন্ন হয়ে পিআর পাবার উদ্যোগ নেন।
'কাগজ' বলতে তিনি কানাডার পিআর স্ট্যাটাস বুঝাচ্ছেন। তাঁকে কি করে বলি, এ কাগজটি আজ হতে দুদশক আগেই আমি পেয়েছি। শুধু তাই নয়, বর্তমানে কানাডার এই কাগজ পেতে আমি মানুষকে প্রফেশনালি সহায়তাও দেই, বা, এটাই আমার পেশা।
তাঁর প্রশ্নে মাথা নেড়ে সম্মতিসূচক জবাব দিয়ে জানতে চাইলাম, 'কেমন আছেন আপনি; কানাডার জীবন কেমন লাগছে?'
- 'ভালো না, এখানে তো লেবারের কাজ করছি, দেশে থাকতে সরকারি চাকুরীতে ছিলাম। অনেক ক্ষমতা ছিল আমার।'
- 'তাই নাকি? কোন অফিসে, কি করতেন?'
- 'পিডব্লিডডি অফিসের পিয়ন ছিলাম; সরকারি পিয়ন, অনেক সম্মানের পদ! আমার পেছনে অনেক মানুষ বিভিন্ন তদবিরে ঘুরঘুর করতো।'
তাঁর অভিব্যক্তি দেখে বুঝা গেলো, দেশে, অর্থাৎ, ভারতে থাকতে তিনি আসলেই খুব ভালো অবস্থায় ছিলেন। বাংলাদেশের মতো সরকারি চাকুরীর মজা ভারতেও কিন্তু আছে। জায়গামতো চাকরি হলে পিয়নেরও একাধিক গাড়িবাড়ি হয়ে যায়। কেন যেন সরকারি চাকুরেদের কৃপাবর্ষণে ভগবান কিছুমাত্রও কার্পণ্য করেন না।
কানাডার চাকুরীতে তাঁর অতৃপ্তি দেখে বছর বিশেক আগের এক ঘটনা মনে পড়লো। তখন আমি সপরিবারে কানাডায় কেবল এসেছি। প্রথম তিন চারমাস তেমন কিছু করিনি বলা চলে। সুযোগ পেলেই টরোন্টোর রাস্তায় ঘুরে বেড়াতাম। তেমনই অবস্থায় একদিন এক সুপারশপে ঢুকতেই বাঙালিমতো এক সিকিউরিটি গার্ডের সাথে দেখা হলো। কাছে যেতেই তিনি আমাকে প্রশ্ন করলেন, 'বাংলাদেশ থেকে এসেছেন?'
- 'জি ভাই, আপনি?'
- 'আমিও বাংলাদেশের। আমি বাংলাদেশ সরকারের একজন উপসচিব।'
- 'তাই নাকি? তো এখানে কিভাবে?'
- 'পিআর স্ট্যাটাস নিয়ে আছি। দেশ থেকে ছুটি নিয়েছি। এই আর কি।'
- 'ওহ, তাই?'
- 'কানাডায় কবে এলেন?' - তিনি জানতে চাইলেন।
- 'গেল মাসে। ভাবছি, বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে মাস্টার্স করবো। আইডিয়াটা কেমন?'
- 'আরে না! মাস্টার্স করেন আর পিএইচডি করেন তাতে কাজ হবে না। সাদা চামড়ার না হলে এখানে ওই লেবেলের কাজ পাবেন না।'
- 'এখানে কাজ পাওয়া কি খুব কষ্টের?'
- 'সাধারণ লেবার জব সহজে পেয়ে যাবেন, কিন্তু, আমার মতো প্রফেশনাল জব পেতে হলে আপনাকে কোর্স করতে হবে? এখানে কোর্স করা ছাড়া নাপিতগিরিও করা যায় না।'
বিশেষ ধরণের ইউনিফর্ম পরে হাতে একটা লাঠি নিয়ে হাটাহাটি, মানে, সিকিউরিটি গার্ডের কাজ পেতেও কোর্স করতে হয় জেনে কিঞ্চিৎ অবাকই হলাম। কি আজব দেশ রে বাবা!
উপসচিব সাহেবের সাথে কথা বলে বুঝতে কষ্ট হলো না সিকিউরিটি গার্ডের এই 'প্রফেশনাল জব' পেয়ে উনি যারপরনাই খুশি। আর, ওদিকে, একজন অফিস পিয়ন সবজির দোকানে শ্রমিকের কাজ পেয়েও অতৃপ্ত। অথচ, দুজনের বেতনের তেমন পার্থক্য আছে মনে হয় না। গুণীজনদের বলে যাওয়া 'সুখ সন্তুষ্টির উপর নির্ভর করে' কথাটার গূঢ়ার্থ আরেকবার অনুধাবনের সুযোগ পেলাম।
যাক, আগের কথায় ফিরে যাই। কোঁকড়া চুলের ভারতীয় সেই যুবকের সাথে ঐকমত্য পোষণ করে বললাম, 'ঠিক বলেছেন, দেশের সরকারি চাকুরীর মজাটাই আলাদা। সরকারি চাকুরী হলো তো আপনি রাতারাতি জমিদার বনে গেলেন।' তাঁর বক্তব্যে একমত হয়েছি দেখে উনি খুব খুশি হলেন বুঝা গেলো।
- 'আপনিও কি আপনার দেশে সরকারি চাকুরী করতেন?' - যুবক আমার কাছে জানতে চাইলেন।
আমি সম্মতিসূচক জবাব দিতেই তিনি পরের প্রশ্ন করলেন, 'গভর্নমেন্ট পিয়ন ছিলেন কি?'
এ প্রশ্নের উত্তর দিতে কিছুটা থতমত খেয়ে গেলাম। আলোচনা যে পর্যায়ে চলছে তেমন অবস্থায় আমি কি করে বলি, দেশে আমি প্রথম শ্রেণীর সরকারি কর্মকর্তা ছিলাম।
সত্য বললে উনি এক্ষুনি হয়তো আমাকে এড়িয়ে যেতে চাইবেন। আবার মিথ্যে বলাও যে আমার স্বভাববিরুদ্ধ! বড়ো ধরণের ধন্ধে পড়ে গেলাম। তারপরও বিশেষক্ষেত্রে সীমিত পর্যায়ের মিথ্যে বলা জায়েজ বিবেচনা করে যুবকের প্রশ্নে সম্মতিসূচক জবাব দিতেই তিনি আমাকে দ্রুত বুকে জড়িয়ে ধরে বললেন, 'ওহ মাই গড, তুম তো মেরে ভাই হো!' [বাংলা: ভগবান, তুমি যে আমারই ভ্রাতা!]
অদূরে সবজি পছন্দে ব্যস্ত থাকা আমার স্ত্রী আমাদের কথোপকথন শুনে মহাবিরক্ত বলেই তাঁর চেহারা দেখে মনে হলো। উনি আবার রাশভারী প্রকৃতির কম কথা বলা মানুষ।
২| ০২ রা মার্চ, ২০২২ সকাল ১১:৩৬
দেশ প্রেমিক বাঙালী বলেছেন: কানাডার বেগম পাড়াার বাসিন্দা ছাড়া বাংলাদেশ থেকে যারা কানাডায় যায় তাদের সবারই কি একই অবস্থা?
৩| ০২ রা মার্চ, ২০২২ দুপুর ১:২৯
রাজীব নুর বলেছেন: প্রবাসীরা ঢেড়স খেতে পছন্দ করে।
©somewhere in net ltd.
১| ০২ রা মার্চ, ২০২২ রাত ৩:২০
ঋণাত্মক শূণ্য বলেছেন: বিভিন্ন দিকে কথা বলেছেন, কোনটা নিয়ে কমেন্ট করবো সেটাই খেই হারায় ফেলতেছি।
১. যে যেমন, অন্যকেও তাই মনে করে। আমার সাথেও এমন ঘটনা বহু বার ঘটেছে।
২. ঢেরস ভাজি খাইতে খুব পছন্দ করি। রান্না করলে খাই না। তবে সৌদীতে ঢেরস রান্না খুব চলে। এখানেও ওকরা বলে।