নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
ঢাকাপোস্ট ডট কম'এ আমার গল্প: 'ডোন্ট টেক ইট পার্সোনালি'
https://www.dhakapost.com/literature/23553?fbclid=IwAR0mYx1snpH1zlCI2-OjVDp4cZN_G4wUVASmRQR5fe6jq7HaHoCNsMmOvts
খুব ছোটবেলা হতেই সৎ আর একরোখা স্বভাবের ছেলে অনন্ত। মেধাবী ছাত্রও সে। প্রথম শ্রেণি হতেই ক্লাসে প্রথম-দ্বিতীয় হয়ে আসছে। পঞ্চম শ্রেণির বৃত্তি পরীক্ষা দিল একসময়। বরাবরের মতোই পরীক্ষা বেশ ভালোই হয়েছে তার। তাই প্রচণ্ড আশাবাদী ছিল বৃত্তি পাওয়া নিয়ে। কিন্তু, এরই মাঝে স্থানীয় শিক্ষা অফিস থেকে তার বাবার পরিচিত এক লোক এসে তাকে জানালেন, কিছু পয়সা-পাতি খরচ করলে অনন্তকে ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি পাইয়ে দেওয়া যাবে। বিষয়টি নিয়ে অনন্তের বাবা যখন তার মায়ের সাথে কথা বলছিলেন তখন অনন্ত আড়াল থেকে তা শুনতে পায়। সাথে সাথে বাবার কাছে সে এর প্রতিবাদ জানায়। বলে, ‘বাবা, ওভাবে বৃত্তি পেতে আমি চাইনা; কারণ, টাকা দিয়ে বৃত্তি পেলেও আমার বৃত্তি পেয়েছি মনে হবে না। তোমরা এমনকিছু করো না!’
কেবল দশ কি এগারো বছরের ছোট্ট এক শিশুর মুখে এমন কথা শুনে বাবা-মা দুজনেই বেশ অবাক হলেন। তারপরও ভাবছিলেন, এমন লোভনীয় একটি প্রস্তাব হাতছাড়া করা ঠিক হবে কিনা। কেননা, ছেলেটা ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি পেলে নিজ গ্রামসহ সারা উপজেলার মানুষ তা জানবে। পরিবারটির সুনাম-সুখ্যাতি চারিদিকে ছড়িয়ে পড়বে। এতে শুধু তাদের পুরো পরিবারের সম্মানই বাড়বে না, বৃত্তির ভালো অংকের টাকাও পাবে অনন্ত মাসে মাসে। সপ্তাহখানেক পর বাবার পরিচিত শিক্ষা অফিসের সেই দালাল অনন্তদের বাড়িতে আবার এলে অনন্ত নিজেই ওই লোককে বলে দিল, ‘আঙ্কেল এ কাজটি করবেন না, এভাবে বৃত্তি আমি পেতে চাই না!’
এইটুকুন ছেলের অনড় অবস্থান দেখে বাবা-মা আর সে পথে আগালেন না। দালাল লোকও মন খারাপ করে চলে গেলেন। এতে তার টু-পাইস আয় হতো হয়তোবা। অথচ, কিছুদিন পরে বৃত্তির রেজাল্ট বের হলে দেখা গেল অনন্ত ঠিকই ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি পেয়েছে। শুধু তাই নয়, তার উপজেলায় প্রথম স্থানও অধিকার করেছে সে। লোকটি সম্ভবত আগেভাগে অনন্তের সাফল্য আঁচ করে ফাও কিছু টাকা কামাতে এসেছিলেন, এটা এখন অনন্তদের পরিবারের সবাই বুঝে গেছে। এ ঘটনার পর থেকে অনন্তের বাবা-মা হতে শুরু করে পরিবারের সবাই ওর সাথে খুব সাবধানে বুঝেশুনে কথা বলতেন। এমনকি তার স্কুলের শিক্ষকরাও তাকে বেশ সম্মান জানাতেন।
ধাপে ধাপে স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের গণ্ডি পেরিয়ে সেই অনন্ত প্রকৌশলী হিসেবে সরকারি চাকরিতে যোগ দিলেন একদিন। তার প্রকৌশলী হওয়ার মূল উদ্দেশ্য ছিল প্রকৌশল ও প্রযুক্তি জ্ঞান দিয়ে দেশ ও জনগণের সেবা করা। কিন্তু, বাংলাদেশের সরকারি অফিসে ঢুকেই তাকে হোঁচট খেতে হলো। সহকারী প্রকৌশলী হিসেবে এক সরকারি অফিসে তিনি যোগ দিয়েছেন মাস ছয় হলো। প্রশিক্ষণে কিছু সময় ব্যয়ের পর এক মাঝারি আকারের উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন ও তত্ত্বাবধানের কাজে এক নির্বাহী প্রকৌশলীর অধীনে তাকে নিয়োগ দেওয়া হলো।
নির্বাহী প্রকৌশলী ইকবাল সাহেব তার অধীনে যোগদানকারী সহকারী প্রকৌশলী অনন্তকে নতুন চাকরিতে যোগদানের জন্য অভিনন্দন জানিয়ে তাকে প্রকল্পের কাজকর্ম কিভাবে তদারকি করতে হয়, ঠিকাদারের সাথে কীভাবে কথাবার্তা বলতে হয়, বা অফিসের সিনিয়র-জুনিয়রদের সাথে কিভাবে আচরণ করতে হয়, ইত্যাদি বিষয়ে বাস্তব ধারণা দিলেন। এছাড়া, মাঠ পর্যায়ে প্রকল্পের কাজ বাস্তবায়নে ঠিকাদারের সাথে কীভাবে মিলেমিশে কাজ করতে হয় এবং স্থানীয় রাজনৈতিক নেতা ও চাঁদাবাজদের দাবি-দাওয়া থাকলে তা কীভাবে মোকাবেলা করতে হয় তা নিয়েও কিছু গুরুত্বপূর্ণ টিপস দিলেন। সরকারের অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে কীভাবে প্রকল্পের অর্থ বের করে আনতে হয় সে সম্পর্কেও নাতিদীর্ঘ আলোচনা করেন তিনি। ঠিকাদারের কাজের বিল কীভাবে তৈরি করতে হয় সে বিষয়েও আলোচনা হলো। চাকরিতে যেহেতু নতুন, অনন্ত এসবের কিছুটা বুঝলেন কিছুটা বুঝলেন না, এমনই অবস্থা। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে একজন ছাত্র যত ভালো রেজাল্টই করুক না কেন, সেখানে তো আর কাজের অভিজ্ঞতা শেখানো যায় না। কাজের অভিজ্ঞতা তো আসে চাকরি থেকে।
তরুণ প্রকৌশলী অনন্তের সরাসরি তত্ত্বাবধায়নে একটি সড়ক সংস্কার প্রকল্পের কাজ এগিয়ে চলছিল। কিছু কাজ শেষ করার পর তার অধীনস্থ উপ-সহকারী প্রকৌশলী হোসেন সাহেব ও ঠিকাদার সালাম সাহেবের এর কর্মচারী মিলে কাজের পরিমাপ নিয়ে অনন্তের স্বাক্ষরের জন্য বিল তার টেবিলে পেশ করলেন। কাজের বিল টেবিলে আসার আগেই অনন্ত একটা খসড়া হিসেব নিজেই করে রেখেছিলেন যাতে কাজের পরিমাপ বা বিলে বড়ো ধরনের হেরফের হলে তিনি তা আঁচ করতে পারেন। তার হিসাবে আনুমানিক বিলের পরিমাণ যা হওয়ার কথা তার চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ টাকার বিল এসেছে দেখে তিনি বেশ অবাক হলেন। পাঁচ-দশ শতাংশ এদিক সেদিক হলে অনন্ত হয়তোবা দেরি না করেই বিলে স্বাক্ষর করে দিতেন; কিন্তু, এতটা অমিল তিনি মেনে নিতে পারলেন না। তাই, তার স্বাক্ষরের জন্য দাখিল করা বিলটি ভালোভাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার সিদ্ধান্ত নিলেন। এ বিষয়টা নিয়ে নির্বাহী প্রকৌশলী সাহেবের সাথে অনন্ত কথা বললে তিনি স্পষ্ট জানিয়ে দিলেন, ঠিকাদারের বিল কতটা সঠিক বা বাস্তবসম্মত তা সার্টিফাই করার মূল দায়িত্ব প্রকল্পের সহকারী প্রকৌশলী, অর্থাৎ, অনন্তের। তাই, তাকে অবশ্যই সবকিছু দেখেশুনে সঠিক আছে বলে সার্টিফাই করতে হবে বলে জানিয়ে দিলেন নির্বাহী প্রকৌশলী। নির্দেশনা শুনে আরেক দফা সতর্ক হলেন অনন্ত।
উপ-সহকারী প্রকৌশলী হোসেন সাহেব ও ঠিকাদারের কর্মচারী মিলে যে বিলটি প্রস্তুত করেছেন তা পরীক্ষার শুরুতেই অনন্ত দেখতে পেলেন ঠিকাদার মোটেও কাজ করেননি এমন দুটি আইটেম বিলে অন্তর্ভুক্ত আছে। এর একটি হলো, ঘাসের উপর নতুন মাটি ফেলার আগে (পুরনো মাটির সাথে ভালো বন্ধনের জন্য) ঘাস এবং ঝোপঝাড় তুলে বাইরে ফেলে দেওয়া। অপরটি হলো, রাস্তার দুপাশে নতুন মাটি ফেলার আগে কাদা পরিষ্কার করা। বাস্তবে এই দুই আইটেমের কিছুই করা হয়নি। মাঝে মাঝে নির্মাণ প্রকল্পের সাইট পরিদর্শন করে অনন্ত নিজের নজরে রেখেছিলেন কমবেশি সব আইটেম। বাস্তবে কাদা বলতে কিছুই ছিল না মাঠে; মানে, ওটা একটা ভৌতিক আইটেম। মাটি যেখানে যে অবস্থায় ছিল তার উপরই নতুন মাটি এনে ফেলা হয়েছে। ঘাস তুলে ফেলার কোনো ব্যবস্থাও তার চোখে পড়েনি। অথচ এ দুটো আইটেমের বিল হয়েছে প্রায় কোটি টাকা। এত বড় চুরি অনন্তের ধারনার বাইরে ছিল। ঠিকাদারি কাজে চুরি যে হয় তা আগে থেকেই অনন্ত শুনেছেন, তবে, একেবারে কাজ না করেই যে শতভাগ ভুয়া বিল তৈরি করা হয় তা নিজে দায়িত্ব পালন করতে এসে সরজমিনে প্রত্যক্ষ করলেন। বিষয়টার বিস্তারিত জানতে টেলিফোন করে হোসেন সাহেবকে নিজের অফিসে ডাকলেন অনন্ত।
ইকবাল স্যার সত্যিই খুব ব্রড মাইন্ডেড মানুষ, হার্টটা ফুটবল মাঠের চেয়েও বড়ো, মানুষকে দিতেও জানেন নিতেও জানেন। ফ্যামিলি ব্যাকগ্রাউন্ডও খুবই উঁচু। স্যারের আপন চাচা পাপলু সাহেব গত সরকারের এমপি ছিলেন। স্যারের এক মামা ও দুই টার্ম মেয়র ছিলেন। নামীদামী পরিবারের আওলাদ। এরকম প্রভাবশালী ইঞ্জিনিয়ার পুরো ডিপার্টমেন্টে পাঁচজনও খুঁজে পাওয়া যাবে কিনা সন্দেহ। তিনি যেভাবে সিদ্ধান্ত দেন আমরা তা মেনে চললেই হবে। আর কোন ঝামেলা নাই।
ডাক পেয়ে সেদিন বিকেলেই হোসেন সাহেব তার বস অনন্তের অফিসে এলেন। সাথে নিয়ে এসেছেন কাজের ঠিকাদার সালাম সাহেবকেও। ঠিকাদারকে সাথে নিয়ে আসায় অনন্ত বিব্রত হলেন। এটা তিনি আশা করেননি। তারপরও, তাদের দুজনকে বসতে বলে পিয়নকে ডেকে চা সমুচার ব্যবস্থা করলেন। চা পানের পর অনন্ত ঠিকাদারকে বিনয়ের সাথে অনুরোধ জানালেন তার অফিস ছেড়ে চলে যেতে, কারণ, তিনি বিল নিয়ে তার উপ-সহকারী প্রকৌশলী হোসেন সাহেবের সাথে একান্তে কথা বলতে চান। মুখ গম্ভীর করে তাৎক্ষণিক অনন্তের অফিস ত্যাগ করলেন সালাম সাহেব। তবে, তিনি একেবারে অফিস কম্পাউণ্ড ছেড়ে চলে যাননি। অনন্তের অফিস ছেড়ে অদূরেই নির্বাহী প্রকৌশলী ইকবাল সাহেবের অফিসে গিয়ে বসেছেন। ইকবাল সাহেবের তত্ত্বাবধানে দীর্ঘদিন নানা প্রকল্পে ঠিকাদারির কাজ করায় ধীরে ধীরে তাদের দুজনের সম্পর্ক প্রশান্ত মহাসাগরের গভীরতা লাভ করেছে, যা বলাই বাহুল্য।
স্পষ্টতই, ঠিকাদার সালাম সাহেবকে অফিস থেকে বের করে দেওয়ার বিষয়টি হোসেন সাহেব মেনে নিতে পারেননি। তাই, সালাম সাহেবের প্রস্থানের পরপরই হোসেন সাহেব অনন্তকে প্রশ্ন করলেন: ‘স্যার, আপনি সালাম সাহেবকে এভাবে বের করে না দিলেও পারতেন। উনি আমাদের অনেক পুরনো ঠিকাদার, আপদে বিপদে পাশে থাকেন। এমপি সাহেবেরও খুব কাছের মানুষ।’
এ মন্তব্য শুনে অনন্ত বলেন, 'হোসেন সাহেব, আমরা তার বিলের কিছু অসংগতি নিয়ে আলাপ করব যা তিনি হয়তো পছন্দ করবেন না। তাই, তাকে সাময়িক বাইরে যেতে বলেছি, বের করে দিয়েছি তা নয়। এছাড়া, আমি কিন্তু আপনাকে একাই আসতে বলেছিলাম, ঠিকাদারকে সাথে নিয়ে আসবেন ভাবিনি।'
হোসেন সাহেব এতে আরও বেশি বিরক্ত হয়ে অনন্তকে বললেন, 'ঠিক আছে স্যার, ঠিক আছে; সরি, আমার ভুল হয়ে গেছে। এবার বলেন, বিলে আমরা কি ভুল করেছি?'
'কিছু ভুল হয়েছে বলেই তো মনে হচ্ছে। আমি এখনো পুরো বিল চেক করিনি; তবে, শুরুতেই যে দুটো আইটেম দেখছি ওসবের কাজ তো আসলে হয়নি। ওই দুই আইটেম হতেই তো প্রায় কোটি টাকার বিল চলে আসছে। এটা কিভাবে হল একটু বলবেন?' - অনন্ত রাখঢাক না করে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলেন হোসেন সাহেবের উদ্দেশ্যে।
'স্যার, কিছু মনে করবেন না, চাকরিতে আপনি নতুন। আমার প্রায় বিশ বছর চাকরি হয়েছে। চাকরির প্রয়োজনে অনেক কিছু আমাদের করতে হয় যা আপনি ধীরে ধীরে বুঝবেন। ওই দুটো আইটেম কেন দেওয়া হলো তা নিয়ে সময়ক্ষেপণ না করে আপনি অন্য আইটেমগুলো দয়া করে দেখুন। কারণ, ঠিকাদারকে বিল না দিলে তিনি কাজ চালিয়ে যেতে পারবেন না; তার টাকা দরকার। আপনি তো জানেন, ঠিকাদার পুরো প্রকল্পের খরচের টাকা একসাথে নিয়ে কাজ শুরু করেন না। কিছু টাকার কাজ করেন, সেখান থেকে বিল পান; সেই বিলের টাকা দিয়ে নতুন কাজ করেন। মানে, রানিং বিলে কাজ করেন তারা। সালাম সাহেবের টাকা খুবই দরকার, না হয় কাজের অগ্রগতি ধীর হয়ে যাবে। কাজ না হলে আমাদের সবার বদনাম হবে, উপর হতে চাপ আসবে। বিষয়টা বুঝার চেষ্টা করুন প্লিজ।' - রীতিমতো একটা ভাষণ দিয়ে দিলেন হোসেন সাহেব।
অনন্ত বললেন, 'দেখুন, আপনি বয়সে আমার অনেক বড়; আপনার চাকরির অভিজ্ঞতাও অনেক বেশি। ঠিকাদারকে রানিং বিল না দিলে যে কাজের অগ্রগতি থমকে যাবে তাও আমি জানি। কিন্তু, তাই বলে কি এভাবে কাজ না করেই ঠিকাদারকে টাকা দিয়ে দিতে হবে? এ প্রকল্পের কাজ নিয়ে কোনো তদন্ত হলে আমরা কি জবাব দেবো ভেবেছেন? এটাতো ছোটোখাটো কোনো অনিয়ম নয়; দুই কোটি টাকার বিলে এক কোটি টাকাই ভিত্তিহীন! কেউ প্রশ্ন তুললে আমরা কী জবাব দেব?'
হোসেন সাহেব কণ্ঠ নামিয়ে বললেন, 'স্যার, বয়সে আপনি আমার ছোট হতে পারেন, কিন্তু সম্মানে বড়ো, আপনি আমার বস। আপনাকে শেখানোর ঔদ্ধত্য আমি দেখাবো না। তার চেয়ে বরং নির্বাহী প্রকৌশলী মহোদয় এর সাথে বসে এ বিষয়টা আমরা আলোচনা করি। তার মতামত নিয়ে যা করার আমরা করব। আরেকটা কথা, যে সব আইটেমের কাজ একেবারেই হয়নি ওসব আইটেমের টাকা কিন্তু আধাআধি ভাগ হবে। আমরা অর্ধেক, ঠিকাদার অর্ধেক। এই টাকা আমাদের ফাইভ পার্সেন্ট হিসাবের বাইরে। আশা করি, বুঝতে পেরেছেন। চলুন, নির্বাহী প্রকৌশলী স্যারের সাথে আলোচনা করি সার্বিক বিষয়ে। উনি একমত না হলে আমি বাড়তি বিল কেটে দেব। সমস্যা নেই।'
অধীনস্থের মুখে এসব বেআইনি কথা শুনে অনন্ত অপ্রস্তুত বোধ করলেন। মনে মনে ভাবলেন, এ তো পরামর্শ নয়, রীতিমতো চুরির ট্রেনিং। পতিতালয়ে নতুন কোনো মেয়ে এলে পতিতা-সর্দারনী যেভাবে নীল ছবি দেখিয়ে ওই মেয়েকে খদ্দেরের জন্য প্রস্তুত করে তোলে তাকেও তেমনিভাবেই দুর্নীতিতে নিমজ্জিত হবার ট্রেনিং দেওয়া হচ্ছে, অনেকটা তেমনই পরিস্থিতি আঁচ করলেন অনন্ত। এছাড়া, বসের সামনে ভুয়া আইটেমের বিল নিয়ে আলোচনার বিষয়টি তিনি ভাবতেও পারছেন না। তাই, হোসেন সাহেবের উদ্দেশ্যে তিনি বললেন, 'দেখুন, হোসেন সাহেব, নির্বাহী প্রকৌশলী স্যার আমাদের সবার মুরুব্বী। উনি একজন সিনিয়র অফিসার। তার সাথে এমন বিষয়ে কথা বলা কি শোভা পায়? আমি এ ধরনের আলোচনায় বসতে বিব্রতবোধ করছি।'
অনন্তের কথা শুনে হোসেন সাহেব মুচকি হেসে বললেন, 'স্যার, আপনি শুধু উপস্থিত থাকলেই হবে; আপনাকে কিছুই বলতে হবে না, যা বলার আমি বলবো। স্যারকে পুরো বিষয়টা বুঝিয়ে বলব। ঠিকাদারদের সাহায্য করার ব্যাপারে উনি খুব উদার। অতীতে এমনও ঘটেছে, প্রকল্পের কোনো কাজ না করেও স্যার ঠিকাদারকে কোটি কোটি টাকা বিল তোলার সুযোগ করে দিয়েছিলেন। আমাদের বর্তমান কাজের এই দুই আইটেম তো সে তুলনায় কিছুই না। ইকবাল স্যার সত্যিই খুব ব্রড মাইন্ডেড মানুষ, হার্টটা ফুটবল মাঠের চেয়েও বড়ো, মানুষকে দিতেও জানেন নিতেও জানেন। ফ্যামিলি ব্যাকগ্রাউন্ডও খুবই উঁচু। স্যারের আপন চাচা পাপলু সাহেব গত সরকারের এমপি ছিলেন। স্যারের এক মামা ও দুই টার্ম মেয়র ছিলেন। নামীদামী পরিবারের আওলাদ। এরকম প্রভাবশালী ইঞ্জিনিয়ার পুরো ডিপার্টমেন্টে পাঁচজনও খুঁজে পাওয়া যাবে কিনা সন্দেহ। তিনি যেভাবে সিদ্ধান্ত দেন আমরা তা মেনে চললেই হবে। আর কোন ঝামেলা নাই।'
পরদিন সকালবেলা অনন্ত, হোসেন সাহেবকে সাথে নিয়ে নির্বাহী প্রকৌশলী ইকবাল সাহেবের দপ্তরে গেলেন। ঠিকাদারের প্রসঙ্গ নিয়ে গোপনীয় আলাপ শুরু হতেই ইকবাল সাহেব চেয়ার থেকে উঠে গিয়ে অফিস রুমের দরজা লক করে লাল বাতি জ্বালিয়ে দিলেন যাতে বাইরের ভিজিটর ডিস্টার্ব না করেন। তিনি হোসেন সাহেবের কথা শুনছেন গভীর মনোযোগ দিয়ে; ওদিকে, অনন্ত একদৃষ্টে তাকিয়ে আছেন তার দিকে। হোসেন সাহেব নির্বাহী প্রকৌশলী সাহেবকে দুটো আইটেমের কাজ না করেও বিল দেওয়া থেকে শুরু করে সবকিছুই খুলে বলেছেন। অনন্তের ধারণা ছিল ওসব দুই নম্বরি বিষয়ে একজন সিনিয়র বসের সাথে কথা বলতে হোসেন সাহেব দ্বিধা করবেন। কিন্তু, এদের কথাবার্তা শুনে হোসেন সাহেব বা ইকবাল সাহেব এ দুজনের কারো চেহারায় বিব্রত বা লজ্জাবোধের কোনো আলামত দেখা গেলো না। এতে অনন্তের বুঝতে বাকি রইলো না যে এরা আসলে পুরনো পাপী। এসব এদের জন্য ডালভাত।
নির্বাহী প্রকৌশলী সাহেবের সরকারি চাকরিতে প্রায় বিশ বছর পার হতে চলেছে। এ বিষয়টি তিনি স্বয়ং অনন্তকে মনে করিয়ে দিয়ে বললেন, 'দেখুন অনন্ত, বছর বিশেক আগে আমি যখন আপনার মতো চাকরিতে যোগদান করি তখন আমিও এদেশের চাকরির পরিবেশ সম্পর্কে তেমন কিছু জানতাম না। এখানে একটি প্রকল্পের কাজ পাওয়া থেকে শুরু করে ধাপে ধাপে বিভিন্ন জায়গায় টাকা খরচ করতে হয়। টাকা ছাড়া গাছের পাতাও নড়ে না। একটা প্রকল্পের কনসেপ্ট পেপার, প্রাক্কলন, ইত্যাদি হতে শুরু করে সরকারের বিভিন্ন দফতর হতে প্রকল্প বাস্তবায়নের অনুমোদন নিয়ে আসা পর্যন্ত বিস্তর টাকা খরচ হয়ে যায়। এসবের কোনো রেকর্ড থাকে না। মাঠপর্যায়ে উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নের সময় প্রকল্পের অর্থ মন্ত্রণালয় হতে ধাপে ধাপে ছাড়িয়ে আনতেও লাগে টাকা। রাজনৈতিক মাস্তান বা ছাত্রনেতাদের চাঁদাবাজি, কাজের মনিটরিং এ যারা সরকারের বিভিন্ন সংস্থা হতে আসেন তাদের আমোদ ফূর্তির ব্যবস্থা, প্রয়োজনে দুর্নীতি দমন কমিশনের মুখ বন্ধ রাখার ব্যবস্থা, ইত্যাদি নানা অলিখিত আইটেমে ঠিকাদারকে মোটা অংকের টাকা খরচ করতে হয়। গোদের উপর বিষফোঁড়া হিসেবে আছেন আবার এক শ্রেণির হলুদ সাংবাদিক। এরাও কিন্তু গোপনে প্রকল্পের কাজে চোখ রেখে সুযোগ মতো ব্ল্যাকমেইল করে। এসব বিবেচনায় ঠিকাদারকে আসল কাজের বাইরেও কিছু আর্থিক সুবিধা আমাদের দিতেই হয়। তাই, হোসেন সাহেবের সাথে মিলেমিশে যেভাবে উপযুক্ত মনে করেন সেভাবে বিল তৈরি করে সম্ভব হলে কালকেই আমার টেবিলে পাঠান। আমি চোখ বুজে সাইন করে দেব, আপনাদের সাথে দ্বিমত করবো না। তা না হলে টাকার অভাবে ঠিকাদার কাজ বন্ধ করে দিতে পারে। তখন আমাদের বিরুদ্ধে কাজ তুলতে অদক্ষতার প্রশ্ন উঠতে পারে। ফলে, ভবিষ্যতে ভালো প্রজেক্টে আমরা পোস্টিং নাও পেতে পারি। এ বিষয়টিও মাথায় রাখবেন।'
নির্বাহী প্রকৌশলীর মুখে দুর্নীতির সবক শুনে মন খারাপ করে অনন্ত তার অফিস কক্ষে ফিরে গেলেন। তার পেছন পেছন হোসেন সাহেবও ঢুকলেন অনন্তের অফিসে। অনন্ত ঠিক বুঝে উঠতে পারছিলেন না এ অবস্থায় তার কি করা উচিত। সবদিক ভেবেচিন্তে স্থির করলেন, কোন অবস্থাতেই এ বিল অনুমোদন করে পেমেন্টের জন্য ফরোয়ার্ড তিনি করবেন না। ঠিকাদারের বিলে পঞ্চাশ শতাংশেরও বেশি গোলমাল তিনি কোনভাবেই মেনে নিতে পারলেন না। তাই, তিনি ওই দুটি আইটেম কেটে দিয়ে প্রয়োজনীয় সংশোধন করে পুনরায় বিল পেশ করার জন্য হোসেন সাহেবকে নির্দেশ দিলেন। পরিস্থিতি বুঝে হোসেন সাহেব আর কথা না বাড়িয়ে অনন্তের নির্দেশমতো বিল সংশোধন করে স্বাক্ষরের জন্য তার টেবিলে পেশ করলেন। অনন্ত দ্রুত স্বাক্ষর করে দিলেন সে বিল। নির্বাহী প্রকৌশলী সাহেবের স্বাক্ষর হতেও বেশি সময় লাগল না। তারপর আরও কয়েকটি স্বাক্ষরের পর বিলটি পেমেন্টের জন্য চূড়ান্ত প্রস্তুত হলো। টাকা পেলেন ঠিকাদার। উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ ও এগিয়ে চলেছে।
ঠিকাদারি কাজের প্রথম বিল অনুমোদনের অভিজ্ঞতা অনন্তের কাছে একেবারেই নতুন। ঠিকাদার বিলের অর্থ পাবার দু'তিনদিন পর হোসেন সাহেবকে বগলদাবা করে অনন্তের অফিসে এলেন। অনন্তের সাথে কাজ নিয়ে কিছু কথা বলার পর ঠিকাদার তার হাতে থাকা ব্রিফকেইসটি রেখেই অনন্তের অফিস কক্ষ ত্যাগ করতে উদ্যত হলে অনন্ত বলে উঠেন, 'সালাম সাহেব, আপনি ব্রিফকেসটা কিন্তু এখানে ফেলে যাচ্ছেন।'
'এটা আপনার জন্য এনেছি স্যার; রাখেন প্লিজ।' - সালাম সাহেবের তাৎক্ষণিক উত্তর।
ঠিকাদারের এমন উত্তর অনন্ত আশা করেননি। তাই, আবারও প্রশ্ন করলেন, 'কেন এটি রেখে যাচ্ছেন? ভেতরে কি আছে?'
এবার হোসেন সাহেব অনন্তের খুব কাছে গিয়ে কানে কানে বললেন, 'স্যার, ওখানে আপনার টু পার্সেন্টের প্রায় তিন লাখ টাকা আছে। এটি আপনার প্রাপ্য।'
চরম অপ্রত্যাশিত কথাগুলো শুনে অনন্ত চেঁচিয়ে বলে উঠলেন, 'বলেন কি হোসেন সাহেব? আমার ওসব লাগবে না, প্লিজ! প্লিজ!, আমাকে এভাবে বিব্রত করবেন না।'
ঠিকাদার নিজেও অনন্তকে বোঝানোর চেষ্টা করলেন। তাতেও কাজ হলো না। অবশেষে ঠিকাদারকে ব্রিফকেস নিয়েই অনন্তের কক্ষ ত্যাগ করতে হলো। এর পরের বিলগুলোতে অনন্তকে আর কোন টাকা পয়সা অফার করা হলো না। এভাবেই প্রকল্পের কাজ কয়েক মাসের মধ্যে অনেকখানি শেষ হয়ে গেল বলা চলে। অনন্ত বুঝতে পারেন, হোসেন সাহেব বা তাদের বস ইকবাল সাহেবের মতো ধূর্ত লোকেরা যেখানে জড়িত আছেন সেখানে তার অগোচরে হলেও চুরি কিছুটা হয়েছে ঠিকাদারের বিলে। তবে, এ সড়ক প্রকল্পে সম্প্রতি ঘটে যাওয়া 'বালিশ কেলেঙ্কারির' মতো বড়ো ধরনের দুর্নীতি ঠেকাতে পেরেছেন দেখে অনন্ত কিছুটা হলেও তৃপ্তি বোধ করলেন। তার বেশ মনে আছে, গণপূর্তের এক প্রকল্পে একেকটা সাধারণ মানের বালিশের পেছনেই খরচ ধরা হয়েছিল প্রায় সাত হাজার টাকা।
এর কিছুদিনের মধ্যে সরকারের অডিট বিভাগ হতে তিন সদস্যের এক টিম ইকবাল সাহেবের অফিসে এলেন। নির্বাহী প্রকৌশলী সাহেব, অনন্ত এবং হোসেন সাহেবকে ডেকে এই টিমের সদস্যদের সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন। টিম লিডারের নাম হাজী শাহ সৈয়দ। বয়স বড়োজোর পঁয়তাল্লিশ হবে। অপর দুজন আরও বয়স্ক। তারা টিম লিডারের সহযোগী। ইকবাল সাহেবের ইশারায় তার দুই পিয়নের একজন চা-সমুচা-মিষ্টির আয়োজন করলেন দ্রুত। প্রাথমিক পরিচয় পর্ব হতে আড্ডা জমে উঠতে সময় তেমন লাগেনি।
এক পর্যায়ে ইকবাল সাহেব টিম লিডারকে প্রশ্ন করলেন, 'হাজী সাহেব, আপনি তো বয়সে বেশ তরুণ। এতো তাড়াতাড়ি হজ সেরে ফেললেন কি মনে করে? আমার তো পঞ্চাশ পেরিয়ে গেলো, এখনো সুযোগ হয়নি।'
হাজী শাহ হো হো করে হেসে বললেন, 'ইঞ্জিনিয়ার সাহেব, আমি আসলে হজ করিনি, আমার এ নামের পেছনে একটা ছোট্ট কাহিনী আছে, শুনবেন?'
- অবশ্যই, অবশ্যই, বলুন।
শুনুন তাহলে। পরপর তিন কন্যা সন্তানের জন্মের পর আমার বাবা একটা ছেলে সন্তানের জন্য অস্থির হয়ে পড়েছিলেন। তার মনটা ছিল ভীষণ কাতর। এমনি সময়ে একদিন চুলে জট পাকানো এক সাধুবাবা এলেন আমাদের বাড়িতে। আমার বাবা তাকে শ্রদ্ধা-সম্মান জানিয়ে বাড়িতে বসতে দিলেন। এক পর্যায়ে সাধু বাবার হাতজোড়ে অনুমতি চাইলেন একটা আর্জি পেশ করতে। সাধু বাবা বললেন, 'আমি জানি তুমি কি বলতে চাইছো।' বাবাকে অবাক করে দিয়ে সাধু বাবা বললেন, 'ভগবানের কাছে তুমি একটা পুত্র সন্তান চাইছো, এইতো?'
সাধুজীর মুখে মনের গহীনের কথাটা শুনে আবেগাপ্লুত হয়ে আমার বাবা তার পায়ে লুটিয়ে পড়লেন; অঝোরে কাঁদলেনও। সাধুবাবা চোখ বন্ধ রেখে বিড়বিড় করে মন্ত্র আউড়িয়ে আমার বাবার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। তারপর বাবার উদ্দেশ্যে বললেন, 'তুমি কি যতদ্রুত পারো হজ্ব করে আসতে পারবে?' বাবা বললেন, 'সাধুজী, আপনি আশীর্বাদ করলে অবশ্যই পারবো।'
এটুকু বলেই জটচুলের সেই সাধুজী চুপ মেরে গেলেন। নতুন কিছু না বলেই রংচঙা লাঠিতে বড় করে বসা থেকে দাঁড়িয়ে গিয়ে দ্রুত আমাদের বাড়ি ত্যাগ করলেন। একবারও পেছন ফিরে তাকালেন না।
যা বুঝার বুঝে গেলেন বাবা। জমি বন্ধকী রেখে পরের বছরই বাবা পবিত্র হজ্ব সেরে আসলেন। এর মাস না পেরোতেই মায়ের পেটে আমার আগমন। সে সূত্রেই বাবা আমার নাম রেখেছেন হাজী শাহ।'
ইকবাল সাহেবের অফিসকক্ষে উপস্থিত সবাই মন্ত্রমুগ্ধের মত অডিটের লিডার হাজী সাহেবের কথাগুলো শুনছিলেন। এরই মাঝে কাছের মসজিদ হতে আসরের আযানের শব্দ ভেসে এলে হাজী সাহেবের নেতৃত্বে অনন্ত ছাড়া অন্য সবাই নামাজ আদায়ের জন্য লাইনে দাঁড়ালেন। 'আল্লাহ আকবর, আল্লাহু আকবর ..'
বাহ, কি সুন্দর দৃশ্য! মন্ত্রণালয়ের এতো বড়ো কর্মকর্তা হয়েও হাজী শাহ সৃষ্টিকর্তার প্রতি কতটা ভক্তি-ভালোবাসা রাখেন তা দেখে মুগ্ধ হলেন অনন্ত। মনে মনে নিজেকে প্রশ্ন করলেন, তামাম দুনিয়াটা কেন এই হাজী সাহেবদের মত ধর্মভীরু, নীতিবান মানুষে ভরে যায় না?
অনন্তদের অফিসের রেস্টহাউসে হাজী সাহেবদের থাকার ব্যবস্থা করা হলো। তারা অডিটের কাজে পনের দিন থাকবেন। ইকবাল সাহেব অনন্ত এবং হোসেন সাহেবকে পরামর্শ দিলেন অডিট টিমের থাকা-খাওয়া, আরাম-আয়েস, ইত্যাদির দেখভাল করতে। তিনি অনন্তকে এও বললেন, 'ভবিষ্যতে মন্ত্রণালয় হতে অডিট টিম আসলে তাদের দেখভালের দায়িত্ব আপনাকেই পালন করতে হবে। আপনি চাকরিতে নতুন বলে আমি এ ব্যাপারে সহযোগিতা করছি, কিন্তু, এটা আসলে সহকারী প্রকৌশলীরই দায়িত্ব। অডিট টিম যেন কোনকিছুতেই মন খারাপ না করেন, বা মাইন্ড না করেন তা অবশ্যই নিশ্চিত করতে হবে। নইলে, জটিলসব অডিট আপত্তি দিয়ে যেতে পারেন তারা। একবার অডিটের ঝামেলায় পড়ে গেলে উদ্ধার পাওয়া সহজ না।' কাছেই দাঁড়িয়ে থাকা হোসেন সাহেবও সম্মতিসূচক মাথা নাড়লেন।
অনন্তের অনুরোধে হোসেন সাহেব অডিট টিমের হাজী সাহেবদের সাথে কথা বলে অনন্তের অফিসকক্ষে এলেন। হাজী সাহেবরা কোন রেস্তোরাঁর খাবার খেতে চান, শহরের কোন কোন স্পটে বেড়াতে চান, বা কোন কোন শপিং মল হতে পরিবারের সদস্যদের জন্য কী ধরনের গিফট কিনতে চান, ইত্যাদির একটি তালিকা অনন্তের কাছে পেশ করলেন হোসেন সাহেব। এসব কাজে হোসেন সাহেবের অনেক দিনের অভিজ্ঞতা। এছাড়া হোসেন সাহেব লোকটা কথাবার্তায় বেশ পটু। কথার পিঠে কিভাবে ঘুরিয়ে কথা বলতে হয় তা তার বেশ জানা। একারণে অনন্ত এসবে নতুন হলেও হোসেন সাহেবের সহযোগিতায় চালিয়ে নিতে বেগ পেতে হচ্ছে না।
নতুন কর্মকর্তা বলে অনন্ত এসবের মাথামুণ্ডু কিছুই ধরতে পারছিলেন না। তিনি বরং ভাবছিলেন, সরকারি কর্মকর্তা এসেছেন সরকারি কাজে। এজন্য সরকার হতেই তারা প্রয়োজনীয় ভাতা বা আর্থিক সহায়তা পাওয়ার কথা। অনন্তদের কেন এসব নিয়ে মাথা ঘামাতে হবে তার কোন যৌক্তিক কারণ খুঁজে পাচ্ছিলেন না তিনি।
তার মানসিক অবস্থা আঁচ করে হোসেন সাহেব বললেন, 'স্যার, এটাই নিয়ম, শুধু আমাদের অফিস বলে কথা নয়, দেশের অন্যসব প্রতিষ্ঠানেও এভাবেই সরকারি কাজকর্ম চলে। মাঠ পর্যায়ে প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজে এমন অনেক কিছুই করতে হয়। তাছাড়া, ভালো জায়গায় অডিটের দায়িত্ব পাওয়ার জন্য হাজী সাহেবরাও অনেক টাকা পয়সা খরচ করে ফেলেন।'
পরপর তিন বোনের বিবাহ আর ছোট ভাইটাকে ব্যবসা ধরিয়ে দিয়ে বিয়ের পিঁড়িতে বসতে বেশ খানিকটা সময় লেগে গেছে। বিবাহ করেছেন মাত্র বছর তিনেক আগে। তাই, ভালোবাসা এখনো টাটকা। যাই হোক, অডিট তো নয়, যেন কিছু মানুষের ঈদের আমেজ চলছে অনন্তদের অফিসে!
অনন্ত, হোসেন সাহেবের কথার পুরোটা বুঝতে না পেরে প্রশ্ন করলেন, 'ভালো জায়গা মানে? আমাদের ডিপার্টমেন্ট কি ভালো জায়গা?'
'অবশ্যই স্যার, অবশ্যই, আমাদের অফিস ভালো জায়গাগুলোর একটি' - মৃদু হেসে হোসেন সাহেব জবাব দিলেন। যেমন ধরুন, তদবির না করলে তারা হয়তো কোন সরকারি স্কুলেও অডিটের দায়িত্ব পেতে পারতেন। স্কুলে কি আর থাকে আপনি তো বুঝেন।
এবার কিছুটা বিরক্তির স্বরে হোসেন সাহেবকে অনন্ত প্রশ্ন করলেন, 'আচ্ছা, আমরা যদি অডিট টিমকে এভাবে তোয়াজ না করি তাহলে সমস্যাটা কোথায়?'
'স্যার, অসুবিধা হলো, হাজী সাহেবরা ক্ষেপে গেলে এমনসব অডিট আপত্তি ফাইল করে যাবেন যা সমাধান করতে আমাদের হিমশিম খেতে হবে। তাছাড়া তাঁদের খুশি করতে না পারলে তারা পান থেকে চুন খসলেও অডিট আপত্তি লিখে যাবেন। আপনি খেয়াল করেননি হয়তো, নির্বাহী প্রকৌশলী স্যারও কিন্তু কথাটা বলেছেন।'
- আমরা ওসব প্রশ্নের যৌক্তিক উত্তর দিলেও কাজ হবে না?
'স্যার, উত্তর গ্রহণযোগ্য কিনা তা নির্ভর করছে হাজী সাহেবরা আমাদের আদর আপ্যায়নে কতটা খুশি হলেন তার উপর, যুক্তি কতটা মজবুত তার উপর নয়। সম্পর্কটা কতকটা বৌ-শাশুড়ি সম্পর্কের মতো আরকি!'
- বলেন কি? অবস্থা এতটাই খারাপ? - একটা দীর্ঘশ্বাস নিয়ে অনন্ত হোসেন সাহেবের কাছ থেকে এই অবস্থায় করণীয় কি জানতে চাইলেন।
হোসেন সাহেব আশ্বস্ত করতে বললেন, 'স্যার আপনাকে কিছু করতে হবে না, আমি সবকিছু ম্যানেজ করে নেব। আমার কেবল লাখ দুয়েক টাকা দরকার।'
- এতো টাকা আমরা কোথায় পাব?
'স্যার, আপনার-আমার এতো টাকা জমা নাই; থাকবেই বা কোত্থেকে? আমরা অনেস্টলি সরকারি চাকরি করি, জনগণের সেবা দেই, আমরা টাকা কোথায় পাবো? ঠিকাদার থেকেই এই টাকা নিতে হবে। সালাম সাহেবকে বলে আমি টাকাটা আজকালকের মধ্যে নিয়ে নেব স্যার। জাস্ট আপনার নলেজে দিলাম।'
- তো, ঠিকাদার সালামকে এই টাকা আমরা কোথা থেকে বুঝিয়ে দেবো?
'অসুবিধা নাই স্যার, লাখ দুয়েক টাকা কোন ব্যাপার না, পরের বিলেই আমরা টাকাটা তাকে পুষিয়ে দেব।' - পথ বাতলে দিলেন হোসেন সাহেব।
যাক, টাকার ব্যবস্থা আছে দেখে অনন্ত কিছুটা স্বস্তি পেলেন, যদিও তিনি বিষয়গুলো মোটেও মন থেকে মেনে নিতে পারছিলেন না। কিন্তু, চাকরিতে যেহেতু একবার ঢুকে গেছেন এসবের সাথে তাল না মিলিয়েও তো উপায় নেই। তারপরও হোসেন সাহেব সাথে আছেন বলে টাকা পয়সা লেনদেনের এসব অনৈতিক কাজগুলো তাকে সরাসরি করতে হচ্ছে না। এটাই মন্দের ভালো ভেবে আপাতত: মন ভালো করার চেষ্টা চালালেন অনন্ত।
অডিট কাজ চলছে ভালই। শহরের নামীদামী রেস্টুরেন্টে প্রতি বেলা খানাপিনা চলছে, ফাঁকে ফাঁকে হোসেন সাহেবকে সাথে নিয়ে অডিট টিম শহরের নানা আকর্ষণীয় জায়গায় ঘুরে বেড়াচ্ছেন, শপিং মল থেকে গিফট কিনছেন প্রিয়জনদের জন্য, হাজী সাহেব প্রিয়তমা তরুণী স্ত্রীর জন্য একটা দামি লেহেঙ্গাও কিনেছেন। তার আবার লেট ম্যারেজ। পরপর তিন বোনের বিবাহ আর ছোট ভাইটাকে ব্যবসা ধরিয়ে দিয়ে বিয়ের পিঁড়িতে বসতে বেশ খানিকটা সময় লেগে গেছে। বিবাহ করেছেন মাত্র বছর তিনেক আগে। তাই, ভালোবাসা এখনো টাটকা। যাই হোক, অডিট তো নয়, যেন কিছু মানুষের ঈদের আমেজ চলছে অনন্তদের অফিসে!
এরই মাঝে হাজী সাহেব হোসেন সাহেবের কাছে গোপনে একটা আবদার জানিয়ে বসলেন। তা হলো, এ শহরের বিতর্কিত আবাসিক হোটেল 'হ্যাভেন্স ড্রিম'এ দুটি রাত রিলাক্সলি কাটাতে চান তিনি। অডিটের কারণে বেশ কয়েকদিন খাটা-খাটুনি গেছে, এবার একটু রেস্ট দরকার।
'হ্যাভেন্স ড্রিম' হোটেলে আবার ঘণ্টাপ্রতি বিল দিতে হয়, দিন প্রতি নয়। শহরের বিতর্কিত ব্যবসায়ী বা, ছাত্র সংগঠনের চাঁদাবাজ নেতা হতে শুরু করে মাদক ব্যবসায়ীদের অভয়ারণ্য এ হোটেল। জনশ্রুতি আছে, মক্ষীরানী রাজনৈতিক নেত্রী লামিয়া, আর কুখ্যাত ইয়াবা চোরাকারবারি বদু সাহেবেরও শেয়ার আছে ওই হোটেলে। নারীলোভী কোটিপতিদের আনাগোনা আছে এমন বিতর্কিত একটি হোটেলে কেন অডিটের টিম লিড হাজী সাহেব দু'রাত কাটাতে চাইছেন তা বুঝতে কষ্ট হয় না হোসেন সাহেবের। তবে, এ অনৈতিক কাজে তো অনেক টাকা দরকার! প্রতি রাতে কম করে হলেও বিশ-ত্রিশ হাজার টাকা দরকার হবে।
হোসেন সাহেব অনন্তকে হাজী সাহেবের এ বিশেষ আগ্রহের কথাটা সসংকোচে জানালেন। কথাটা শুনেই অনন্ত সাফ জানিয়ে দিলেন এই অপকর্মে টাকা খরচ তিনি কোনোভাবেই মেনে নেবেন না। ঠিকাদার হতেও এ কাজের জন্য টাকা না নিতে হোসেন সাহেবকে তিনি কঠোর নির্দেশ দিলেন। সাথে এও বললেন, নির্বাহী প্রকৌশলী সাহেবের সাথে যেন এ বিষয়টা আলোচনাই করা না হয়। কঠিন অবস্থান অনন্তের।
সুযোগটি না দেবার ফল যা হওয়ার তাই হলো। অনন্তদের অফিস ছেড়ে যাবার আগে কয়েকটি কঠিন অডিট আপত্তি দাখিল করে অডিট টিম ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা হলেন। ইতিমধ্যে কয়েক ঠিকাদার আলাদা করে অডিট টিমের সদস্যদের নগদ অর্থও উপহার দিলেন। এই টিমের একজন আবার অন্যরকমের 'সৎ'। তিনি নগদ টাকা বা এমাউন্ট নেন না, তবে গিফটে আপত্তি করেন না। তাই, তাকে দেওয়া হলো প্রতিটি আশি হাজার টাকা মূল্যমানের দুটি হাত ঘড়ি। একটি তার ও অপরটি তার স্ত্রীর জন্য। সরকারি কর্মকর্তাদের মধ্যে বিশেষ ধরণের কিছু 'সৎ' লোকও যে আছে তা দেখে নোটের কিছুটা হলেও ভালো লেগেছে।
অডিট টিম অনন্তদের অফিস ত্যাগ করার কয়েকদিনের মাঝে গোটা দশেক অডিট আপত্তির একটি ফাইল ইকবাল সাহেবের দপ্তরে এলে তিনি তার জবাব তৈরি করার জন্য তা অনন্তের অফিসে পাঠিয়ে দিলেন। তাছাড়া, অনন্তকে তার অফিসে ডেকে এত বেশি অডিট আপত্তি পাবার কারণও জানতে চাইলেন ইকবাল সাহেব। অনন্ত এর কোন সন্তোষজনক জবাব দিতে না পেরে কেবল মুখ গম্ভীর করলেন।
অডিট আপত্তির ফাইল এখন অনন্তের টেবিলে। আপত্তির জটিল ভাষার কারুকার্য, আইনের বিভিন্ন ধারা উপধারার বর্ণনা এবং সে সাথে, এসব আপত্তির সন্তোষজনক জবাব দিতে ব্যর্থ হলে কি ধরণের দণ্ড হতে পারে, ইত্যাদি ভেবে অনন্ত চোখে সর্ষে ফুল দেখছিলেন। এ অবস্থা হতে মুক্তি কিভাবে মেলে তার উপায় খুঁজতে তিনি তার অফিসের খোলা জানালা দিয়ে একদৃষ্টে অদূরে দাঁড়িয়ে থাকা বহুবছরের পুরনো আমগাছটির দিকে মনের অজান্তে তাকিয়ে রইলেন।
ছোটবেলা হতেই পড়ুয়া মানুষ অনন্ত। বাংলা সাহিত্যের পুরনো দিনের নামীদামী লেখকদের দুর্বোধ্য বাংলায় লেখা অনেক বই অনন্ত পড়েছেন। তাই তার বাংলা জ্ঞান যথেষ্ট উন্নত। তারপরও, উদ্দেশ্যমূলকভাবে সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা অডিট আপত্তির প্যাঁচানো ভাষা তার কাছে দুর্বোধ্য ঠেকছিল। আপত্তিগুলো পড়ে অনন্ত মনে মনে ভাবলেন, হাজী সাহেবরা সরকারি চাকরিতে না ঢুকে বরং লেখালেখির লাইনে চলে গেলে হয়তো আগের দিনের বঙ্কিমচন্দ্র, বা আজকের যুগের এম এলো গনি'কেও হার মানাতে পারতেন। মেধার এমন অপপ্রয়োগ বা অপচয় তিনি মেনে নিতে পারছেন না মোটেও।
যাক এ অবস্থায় নিজেদের করণীয় স্থির করতে হোসেন সাহেবের সাথে পরামর্শে বসলেন অনন্ত। হোসেন সাহেব তাকে আশ্বস্ত করে বলেন, 'স্যার আপনি চাকরিতে নতুন, তাই ভয় পাচ্ছেন। এতে আসলে ভয়ের কিছু নেই। হাজী সাহেবরা এখনো মন্ত্রণালয়ে আপত্তির ফাইনাল কপি জমা দেননি। উনারা সাধারনত ঢাকায় গিয়ে আমরা আপস করবো কি করবো না তা বুঝতে কয়েকদিন সময় নেন। তাই, আমরা চাইলে আপত্তিগুলো কিছুটা হালকা করে লিখিয়ে নিয়ে আসতে পারি, বা আমরা কিভাবে উত্তর দিলে তারা তা মেনে নেবেন তা নিয়ে তাদের সাথে আলাপ করতে পারি। এখনো সে সুযোগ আছে। তবে, বেশি দেরি করা যাবে না স্যার।
হোসেন সাহেবের মুখে আশার বাণী শুনে অনন্ত কিছুটা স্বাভাবিক হয়ে বললেন, 'সে উদ্যোগই নিন তবে।'
হোসেন সাহেব বললেন, 'স্যার, সবকিছুর মূলে টাকা। এ সমস্যার সমাধান করতে গেলে আমাকে ঢাকায় যেতে হবে। হাজী সাহেবদের সাথে বসতে হবে, কত দিলে তারা আপত্তিগুলোর ফায়সালা করে দেবেন তা জেনে নিতে হবে? আপনি ঢাকায় যেতে চাইলে যেতে পারেন, বা আমাকে যেতে বললেও আপত্তি নেই । এদের সাথে আমি আগেও কাজ করেছি।'
- টাকা কোথায় পাবো আমরা?
হোসেন সাহেব মুচকি হেসে বললেন, 'স্যার, বলেছি তো, টাকার মালিক ঠিকাদার! হি ইজ দ্যা এন্ডলেস সোর্স! এজন্যই তো ঠিকাদারদের এতো সুবিধা দিতে হয়।'
হোসেন সাহেব অডিট আপত্তি নিষ্পত্তির জন্য মন্ত্রণালয় আর হোম অফিসে দৌড়ঝাঁপ শুরু করলেন। কিন্তু, তাতেও আশ্বস্ত হতে পারছিলেন না অনন্ত। কারণ, তিনি জানেন, অডিট আপত্তি সঠিকভাবে নিষ্পত্তি না হলে এইসব অনিয়মের বিষয় দুর্নীতি দমন কমিশনে যাবে। পত্রপত্রিকায় দুর্নীতিবাজ হিসেবে তাঁদের নাম আসবে। তখন তিনি একা সৎ থাকতে চেয়েছিলেন বললেই নিষ্কৃতি পাওয়া যাবে না। নির্বাহী প্রকৌশলী এবং উপ-সহকারী প্রকৌশলী সাহেবের পাশাপাশি অনিয়মের দায় তাকে নিতে হবে; দায়টা বরং তারই বেশি। কারণ, তিনিই প্রকল্পের বাস্তবায়নে সবচেয়ে বেশি দায়িত্বপ্রাপ্ত অফিসার। তার তুলনায় নির্বাহী প্রকৌশলী ইকবাল বা হোসেন সাহেবের দায় অনেক কম।
অডিট আপত্তি নিরসন করতে না পারলে দুর্নীতি দমন কমিশনের মুখোমুখি হওয়া এড়াতে পারবেন না তাঁদের কেউই। তখন আবার দুর্নীতি দমনের লোকদের সামলাতে বিস্তর টাকা পয়সা খরচ করতে হবে। অনন্তের নিজের আর্থিক সক্ষমতাও এমন নয় যে টাকা পয়সা ঢেলে ম্যানেজ করবেন। তার বুঝতে বাকি নেই, টাকার জোরে ইকবাল বা হোসেন সাহেবরা পার পেয়ে যাবেন ঠিকই, ঝুলে যাবেন তিনি একাই। এমনসব নানা এলোমেলো ভাবনায় আজকাল অনন্তের ঘুমও হয় না ঠিকমত। তার কাছে এখন সরকারি চাকরি পাওয়াটা বড়ো অর্জন মনে না হয়ে বরং বোঝা-ই মনে হতে লাগলো বেশি।
কয়েকমাস আগে অস্ট্রেলিয়ার এক বিশ্ববিদ্যালয়ে মাস্টার্স ডিগ্রি করার জন্য প্রবাসী এক বন্ধুর সহায়তা নিয়ে অনন্ত আবেদন করেছিলেন। সেখান থেকে ভর্তির আবেদন অনুমোদিত হয়ে এসেছে তার। সেটি তিনি লুফে নিলেন। গোপনে আবেদন করে ভিসাও পেয়ে গেলেন। তাকে আর পায় কে? এ দুঃসময়ে এমনকিছুই তার দরকার ছিল।
এক রাতে অফিসের কাউকে না জানিয়েই পাড়ি জমালেন অস্ট্রেলিয়ায়। ছাত্র হিসেবে অনন্ত বরাবরই ভালো। ফার্স্ট ক্লাস পাওয়া মানুষ। তাই, অস্ট্রেলিয়ায় পড়াশোনা শেষ করতে তাকে মোটেও বেগ পেতে হয়নি। দুই বছরের মাস্টার্স প্রোগ্রাম শেষ করে ফেললেন দেড় বছরেই। তারপর, অস্ট্রেলিয়ায় স্থায়ী অভিবাসনের ব্যবস্থাও করে ফেললেন স্বল্পতম সময়ে। টেনশনমুক্ত এক নতুন জীবনের সন্ধান পেলেন তিনি। হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন।
প্রাক্তন সহকর্মী হোসেন সাহেবের এক আত্মীয়ের সাথে কয়েকদিন আগে মেলবোর্নের এক বাঙালি মেলায় অনন্তের দেখা। সে সুবাদে বাংলাদেশে হোসেন সাহেবের সাথে চাকরিকালীন স্মৃতিগুলো তার আরেকবার মনে পড়ে গেল। একদিন হোসেন সাহেবকে ফোন করে তার সাথে দীর্ঘক্ষণ কথা বললেন। কথায় কথায় কয়েকবছর আগের সেই সব অডিট আপত্তির প্রসঙ্গও চলে এলো।
অনন্ত জানতে চাইছিলেন ওই কঠিন আপত্তিগুলো তারা কিভাবে সামাল দিয়েছিলেন? উত্তরে হোসেন সাহেব উচ্চস্বরে হেসে বললেন, 'স্যার, ওসব এখনো আপনার মনে আছে? ও কিছু না, স্রেফ ভেলকিবাজি। সব ঠিক হয়ে গেছে। টিম লিডার হাজী সাহেবকে এক লাখ টাকা দিয়ে মূল আপত্তি বদলিয়ে সহজ-সরল কয়েকটা আপত্তি লিখিয়ে এনেছিলাম। শুধু তাই নয়, প্রথম বিলে আপনি কাজ হয়নি বলে যে দুটি আইটেমের বিল কেটে দিয়েছিলেন তার বিলও অডিটের সাথে কথা বলে ঠিকাদারকে দিয়ে দিয়েছি। ঠিকাদারও খুব খুশি। আপনি মনে হয় খুব ভয় পেয়েছিলেন স্যার, তাই না? আমার দীর্ঘ চাকরি জীবনে এমন কত অডিট আপত্তি দেখলাম! ও কিছু না স্যার, ও কিছু না। আমরা তো সরকারি চাকরি করি, মানে, জনগণের চাকর। তাই, এগুলো পার্সোন্যালি নিতে নেই। '
সব শুনে বিস্ময়ের সাথে অনন্ত বলে উঠলেন, 'বাহ্, চমৎকার ম্যানেজ করেছেন তো!'
এম এল গনি
কানাডিয়ান ইমিগ্রেশন কনসালটেন্ট; গল্পকার ও কলামিস্ট
[email protected]
২| ১৩ ই এপ্রিল, ২০২১ রাত ১:৪৭
রেজওয়ান ইসলাম বলেছেন: গল্প পড়তে পড়তে ক্লান্ত হয়ে গিয়েছি।
৩| ১৩ ই এপ্রিল, ২০২১ রাত ১:৫৫
নূর মোহাম্মদ নূরু বলেছেন:
গুড নিউজ !!
ভালো খবর।
©somewhere in net ltd.
১| ১৩ ই এপ্রিল, ২০২১ রাত ১২:৪৫
রাজীব নুর বলেছেন: খুবই বিরক্তকত গল্প লিখেছেন।