নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
গজব আলীর একুশে পদক : এম এল গনি'র ব্যঙ্গরচনা
গজব আলী সাহেব দীর্ঘদিন ধরে সপরিবারে কানাডায়। টেকনিক্যাল লাইনের লোক হলেও আজকাল করেন নন-টেকনিক্যাল কাজ। পাশাপাশি লেখালেখিও করেন। ফেইসবুকে অসম্ভব রকমের সরব। বিদেশে থাকলেও বাংলাদেশের কিছুই তাঁর নজর এড়ায় না। ছোটগল্পের মোটাসোটা বইও একখানা লিখেছেন কয়েকবছর আগে। প্রথম বই হিসেবে ব্যবসা মন্দ হয়নি। বইটি ছোটখাট একটা পুরস্কারও জিতেছে। পরিবারের সমর্থন পেলে এদ্দিনে আরো দুয়েকটা হয়তো লিখে ফেলতেন।
এক সকালে তাঁর বাসার ফোন বেজে উঠলো। বাংলাদেশ হতে ফোন এসেছে। ফোনদাতা সম্ভবত দুই দেশের সময়ের ব্যবধান বিবেচনায় এনেই ফোনটা দিয়েছেন। কানাডায় সকাল সাতটা মানে বাংলাদেশের রাত আটটা।
- গজব আলী ভাই বলছেন? আমি বাংলাদেশ থেকে আপনার একজন ভক্ত, সৈকত। কেমন আছেন?
-জ্বি, ভালো। আপনি?
'ভক্ত' শব্দটা শুনে গজব সাহেবের মন খুশিতে আনচান করলেও তা প্রকাশ করলেন না।
- আপনার দোয়ায় ভালো আছি। তো, আপনার সাথে একটা বড় পুরস্কার নিয়ে কথা বলতে চাই। পাঁচ মিনিট সময় হবে?
-অসুবিধা নাই, বলেন। কি পুরস্কার?
- একুশে পদক।
-বলেন কী? ওই পদক পাবার মতো কী এমন লিখেছি আমি?
- কী যে বলেন, আপনি অনেক ভালো লেখেন। যাঁরা এ পুরস্কার এর আগে পেয়েছেন তাঁদের অনেকের লেখাই আপনার ধারেকাছেও না। এ নিয়ে টেনশন করবেন না।
-কিন্তু, আমি তো লিখেছি মাত্র একখানা বই। পুরস্কার দিয়ে কি লোক হাসাবেন?
- ওটা নিয়ে ভাববেন না গজব ভাই, ভালো লিখলে মাত্র পাঁচ-ছয়টা বই লিখে নোবেল পর্যন্ত পাওয়া যায়। এমন নজির আছে। জাপানি এক লেখকের কথা শোনেননি? তাছাড়া, আপনি যতটা ভাবছেন তার চেয়ে ঢের বেশি মানুষ আপনাকে চেনে। সমস্যা হবে না।
- তাই?
- তবে, আপনাকে আমি এখনই পুরস্কারের ব্যবস্থা করছি না। পুরস্কার দেয়া হবে আরো দু'বছর পর।
-বুঝলাম না, একটু খুলে বলবেন?
গজব সাহেব এবার খানিক টেনশনে পড়লেন।
- শুনুন গজব ভাই, বলছি। একুশে পদকটা দেয়া হয় কিছু সূক্ষ্ণ হিসেব নিকেশ বা ইনিজিনিয়ারিংয়ের মাধ্যমে। এক বা দুজন ভালো লেখককে সামনে দাঁড় করিয়ে বাকিদের পুরস্কারটা হয় মূলত টাকাপয়সার লেনদেনে। বিদেশ থাকেন বলে আপনি হয়তো এ বিষয়গুলো তেমন জানেন না। ওই ভালো লেখক দুয়েকজনকে আমরা লোকাল ভাষায় বলি, 'পুরস্কারের বলি'। মানে, তাঁরা বলি হন অন্যদের কাছে।
-তাই নাকি? তাঁদেরও কি টাকা দিতে হয়?
- না না, 'বলি'দের কাছ থেকে কোন অর্থ নেয়া হয় না। তাঁদেরকে শুধু কিছু অলেখক-কুলেখকের পাশাপাশি সেজেগুজে মঞ্চে বসে পুরস্কার গ্রহণ করতে বিনাশর্তে রাজি হতে হয়; এই যা!
- কিন্তু, আমার যে জমানো টাকাপয়সা নাই?
- ভাই, আপনাকে তো এখনই তেমন কিছু দিতে হবে না। দুবছর পরেই মূল টাকাটা দিতে হবে।
- মূল টাকা মানে কি তো বুঝলাম না।
- বলছি ভাই, সবই বলছি। কথা বলার সুযোগ যেহেতু দিয়েছেন পুরস্কারের সব নিয়মকানুন খুলেই বলি। এই দুবছরে আপনাকে আরো অন্তত দুই-তিনটা বই লিখে ফেলতে হবে। আপনিই তো বলেছেন, কেবল একটা বইয়ে এতবড়ো পুরস্কার দিলে তা নিয়ে সমালোচনা হবে। জানেন তো, বাঙালি স্বভাবগতভাবেই পরশ্রীকাতর!
- কথা ঠিক, একদম সঠিক।
গজব সাহেব নিজেও বাঙালির এ বিশেষ চরিত্রটি কনফার্ম করলেন।
- গজব ভাই, আপনি তো ছোটগল্পের মানুষ। ওই লাইনেই লিখুন, সমস্যা নেই। তবে গল্প লেখার সময় বইগুলো জাতীয় পুরস্কারের কাজে ব্যবহার হতে পারে, এটা একটু মাথায় রাখবেন। মানে বুঝলেন তো, পুরস্কার যাঁরা দেন তাঁরা ক্ষেপে গেলে তো মুশকিল! আপনি তো অনেকসময় প্রথার বাইরে গিয়ে লিখতে চান। তাই বিষয়টা মনে করিয়ে দিলাম।
- তারপর?
- আর হ্যাঁ, এই দুবছরে ১০ লাখ টাকা জমিয়ে ফেলবেন। এটা আপনার জন্য বড় ব্যাপার নয়; শুনেছি ভাবিও কানাডায় বড় অফিসার। তাছাড়া, কানাডা-আমেরিকার এক টাকায় এখানে সত্তর-আশি টাকা হয়ে যায়! সো নো প্রব্লেম। কী বলেন?
- ভাই, ১০ লাখ টাকা তো অনেক টাকা! এখানে তো সংসার খরচ আর বাড়ির মর্টগেজ দিয়ে হাতে তেমন কিছু থাকে না।
- না না পারবেন, চেষ্টা করলে পারবেন। আরেকটা কথা, আপনার টাকা কিন্তু মার যাবে না। পুরস্কার পাবার গ্যারান্টিও দেয়া হবে। পুরস্কার কমিটির এক প্রভাবশালী সদস্যের সাথেই আপনার চুক্তি হবে। এছাড়া, আপনি তো পুরস্কার পেলে লাখ চারেক টাকা ফেরতই পাচ্ছেন।
- কীভাবে?
- পুরস্কারে আপনি নগদ দুলাখ টাকা পাবেন। তারপর, পঁয়ত্রিশ গ্রাম স্বর্ণ দিয়ে তৈরী যে পদকটা পাবেন তার দামও তো লাখ দুয়েকের কম না। তারমানে, অর্ধেক টাকা তো পেয়েই যাচ্ছেন।
- হুম! কিন্তু, স্বর্ণটা কি রিয়েল?
- অবশ্যই। এটা একটা জাতীয় পুরস্কার না! এখানে ভেজাল দিলে তো সারাদেশে খবর হবে।
- তাই?
প্রায় অর্ধেক টাকা রিটার্নের নিশ্চয়তা পেয়ে গজব সাহেব আরো খানিকটা প্রশান্ত হলেন।
সৈকত বলে চললেন: আরেকটা কথা বলা হয়নি। আপনি খুব ভালো লিখেন, কিন্তু সে তুলনায় বাংলাদেশে পরিচিতি কম। পুরস্কারের জন্য আপনাকে আমরা রেডি করে নেবো। কাউকে সন্দেহ করার সুযোগই দেব না।
- কীভাবে?
- আপনি কয়েকটি গল্প লিখে আমাকে ইমেইল করবেন। দেশের একটা পেপারে নিয়মিত ছাপার ব্যবস্থা করা হবে।
- ওরা ছাপাতে না চাইলে?
ওই দায়িত্ব আমার। সবকাজ নগদ নারায়ণে হবে। আপনি শুধু লিখে যাবেন। এই ধরুন, মাসে একটা। আপনার গল্পের গঠনমূলক সমালোচনা লেখার ব্যবস্থাও আমি নেবো। সমালোচক কলম নিয়ে এক পায়ে খাড়া আছেন। বুঝলেন তো, দেশে এখন সবক্ষেত্রেই ব্যবসায়িক ধান্ধা। যে কারণে কিছু হাতে গুঁজিয়ে দিলে আপনাকে নিয়ে লেখার মানুষের অভাব হবে না। এসব ম্যানেজ করার জন্য লাখ দুয়েক টাকা আপনাকে সহসাই পাঠাতে হবে। বাকি টাকা পরে দিলে চলবে।
- এখন দুই লাখে হবে?
- হ্যাঁ, ওতেই আপাতত চলবে। আরেকটা কথা, বছরখানেক পর আপনাকে একবার দেশে আসতে হবে। আপনার সম্বর্ধনার আয়োজন করা হবে পত্রিকার তরফ হতে। নামিদামি কিছু কবি সাহিত্যিককেও খরচপাতি দিয়ে উপস্থিত রাখা হবে। অনুষ্ঠানের টিভি কাভারেজও দেয়া হবে। তখন লাখখানেক টাকা সাথে আনলেই হবে। বুঝলেন না, মানুষকে তো আগে চিনতে হবে ঠিক এক বছর পরই একুশে পদক পাবেন এমন একজন লেখককে। আমি বলছি না আপনার লেখা ওই মানের নয়; কিন্তু পুরস্কারদাতাদের তো খুশি করতে হবে। দেশে এটা একটা বড় সিন্ডিকেট; বুঝলেন না?
- বুঝেছি, বুঝেছি।
গজব সাহেব সৈকতের কথায় সায় দিয়ে বললেন, আচ্ছা, সবমিলে আট লাখে কাজটা করা যায় না?
- আট লাখে করলে আমার হাতে যে কিছু থাকে না! আট লাখ তো ওদেরই বিলিয়ে দিতে হবে। এই টাকার ভাগ অনেকে পায়। যাক, আপনার মতো ভালো লেখকের জন্য এই কন্ট্রাক্টটা না হয় টাকা পয়সা না নিয়েই করলাম। গুণীর কদর করেই তো জীবন কাটালাম। ঠিক আছে, আট লাখই যোগাড় করুন।
ফোনালাপের বিষয়টা গজব আলী সাহেব দিনকয় নিজের ভেতরেই লুকিয়ে রেখেছিলেন; ভয়ে স্ত্রীকে বলেননি। কেননা, স্ত্রী তো তাঁর লেখালেখিতে সময় নষ্টের কারণে এমনিতেই বিরক্ত। তাই সুযোগ খুঁজছিলেন কীভাবে বিষয়টা তাঁর সাথে আলোচনা করা যায়। অনেক টাকার ব্যাপার তো! যদিও অর্ধেক টাকা তো উসূলই হয়ে যাচ্ছে। সাথে নামডাক!
পরের উইকেন্ডে রেস্টুরেন্টে খাবার ফাঁকে মুড বুঝে গজব আলী সাহেব স্ত্রীকে বললেন: আমি লেখালেখিতে খুব বড়ো কোনো পুরস্কার জিতলে তোমার কেমন লাগবে লক্ষ্মী?
- তোমার কি মাথা খারাপ হয়েছে? এতদিন পর শান্তিতে একটু রেস্টুরেন্টে খেতে এসেছি, আর এখানেও লেখালেখির কথা! তোমাকে পুরস্কার দেবেটা কে শুনি?
- কি যে বলো? ইঙ্গিত না পেলে কি এমনি এমনি তোমাকে বলি?
গজব সাহেবের মুখে মৃদু হাসি।
তারপর ধীরে ধীরে সেদিনের ফোনালাপের বিষয়টা স্ত্রীকে খুলে বললেন তিনি। সব শুনে উত্তেজিত না হয়ে তাঁর স্ত্রী তাঁকে পাল্টা প্রশ্ন করলেন: দেখো, দুইনম্বরি কাজ করতে হচ্ছে বলে আমরা দুজনই কত সুন্দর, আরামদায়ক, ফকফকা ভবিষ্যতের সরকারি চাকুরি ছেড়ে বিদেশে এসে স্ট্রাগল করছি। মোটামুটি দাঁড়িয়েও গেছি একরকম। আজ এতো বছর পর তুমি আবার দুইনম্বরি চিন্তা করছ কেন? খবরদার, এ নিয়ে আমার সাথে দ্বিতীয়বার আলাপ করবে না। লিখতে চাইলে লিখো, তবে তা যেন ওই উদ্দেশ্যে না হয়। পুরস্কার ছাড়াই দেশে বিদেশে আমাদের অনেকে চেনে। আজকাল পুরস্কারের যা অবস্থা, ওই পুরস্কার গ্রহণ করলেই বরং লোকে তোমাকে সন্দেহের চোখে দেখবে; সাথে আমাকেও। মানুষকে ওতো বোকা মনে করো না। ওই চিন্তা বাদ দাও।
গজব আলী সাহেবের স্ত্রী দূরদৃষ্টিসম্পন্ন, বুদ্ধিমতী ও পরিশ্রমী মহিলা। দুই দশকের সংসার জীবনে গজব সাহেব তা নানাভাবেই প্রত্যক্ষ করেছেন। তাছাড়া, মাঝে তাঁর যখন ছয়-সাতমাস চাকুরি ছিল না তখন তাঁর স্ত্রী কি কঠোর পরিশ্রম ও নৈপুণ্যে সংসারের হাল ধরেছিলেন তাও তাঁর মনে পড়লো আরেকবার। তাই স্ত্রীর পরামর্শ তিনি নীরবেই গ্রহণ করলেন। স্ত্রীর সাথে সুর মিলিয়ে মৃদুস্বরে বললেন: খুব খারাপ লাগে ভেবে, দেশে এতোবড়ো একটা সাহিত্য পুরস্কারও এভাবে পণ্যের মতো কেনা যায়! আমরা এতটা নিচে নামলাম কী করে?
গজব আলীর একুশে পদক : এম এল গনি'র ব্যঙ্গরচনা
লেখক- এম এল গনি : কানাডা প্রবাসী লেখক, ইমিগ্রেশন কনসালটেন্ট ও প্রকৌশলী।
মানবকণ্ঠ/এইচকে
২| ২৭ শে ডিসেম্বর, ২০২০ দুপুর ১২:৫১
পদ্মপুকুর বলেছেন: খুবই সুষম লেখা। ভাল্লাগলো।
৩| ২৭ শে ডিসেম্বর, ২০২০ দুপুর ১২:৫২
মেহেদি_হাসান. বলেছেন: সবকিছুই ব্যবসাকেন্দ্রিক
৪| ২৭ শে ডিসেম্বর, ২০২০ বিকাল ৩:৩১
নীল আকাশ বলেছেন: ভালো লিখেছেন। এই দেশে কোন কিছুই অসম্ভব না।
৫| ২৭ শে ডিসেম্বর, ২০২০ বিকাল ৫:৩৩
রাজীব নুর বলেছেন: ব্যঙ্গ এবং রম্য হয়েছে। ভালো লেগেছে।
©somewhere in net ltd.
১| ২৭ শে ডিসেম্বর, ২০২০ ভোর ৫:১৫
এস এম মামুন অর রশীদ বলেছেন: সবই গাভী বিত্তান্ত, ছফা বলে গেছেন। তবে দশ লাখ কম হয়ে গেছে। দশ লাখে এ পুরষ্কার কেনার জন্য কমপক্ষে দশ লাখ দুর্নীতিবাজ এদেশে আছে।