নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
ছত্রিশ, আটত্রিশ, অতঃপর চল্লিশ!
প্রায় তিন দশকের পুরোনো বন্ধু সজীব এলো দেশ থেকে। কানাডায় ইমিগ্রেশন নিয়ে এসেছে; সাথে ভাবি এবং দুই পুত্র। বড় ছেলের বয়স বিশ-একুশ হবে। ছোটটির বয়স ঠিক আঁচ করা গেলো না। জানতে চাইলে বন্ধু হাসিমুখে বললো, ‘কোন বয়স জানতে চাও, পাসপোর্ট, না আসল?’
– ‘আসলটাই আগে বলো।’
‘সাড়ে পাঁচ।’
– ‘পাসপোর্টের বয়স কত?’
‘তিন।’
তার মানে, পাসপোর্টের বয়স আসল বয়সের প্রায় অর্ধেক! অবাক হবার বিষয়ই বটে।
কানাডার ইমিগ্রেশন কর্মকর্তারা এয়ারপোর্ট, বা পোর্ট অব এন্ট্রিতে পাসপোর্ট দেখে কানাডায় প্রবেশকারীর পরিচয় নিশ্চিত করেন। সে চিন্তা হতেই বন্ধুর কাছে জানতে চাইলাম: ‘কানাডার এয়ারপোর্টে ছোট বাচ্চার বয়স নিয়ে তোমাকে কেউ কোন প্রশ্ন করেনি?’
আমার কথা শুনে সজীব হো হো করে হেসে উঠলো। ভাবিও হেসে খুন। আর, ছোট বাচ্চাটা ফ্যালফ্যাল দৃষ্টিতে আমাদের দিকে তাকাচ্ছে; মানে, হি ইজ টোটালি কনফিউজড। কিছুই বুঝে উঠতে পারছে না সে।
হাসি থামিয়ে বন্ধু বলল, ‘দোস্ত, তোমার সাথে কাহিনীটা শেয়ার করি, কাউকে আবার বলো না। ইমিগ্রেশন অফিসার বাচ্চার পাসপোর্ট এর বয়সের সাথে বাস্তবের পার্থক্য দেখে মৃদু হেসে আমাকে জিজ্ঞেস করেছিল: ‘আপনাদের বাংলাদেশে বাচ্চাদের গ্রোথ আজকাল বেশ ভালোই হচ্ছে, আগে কিন্তু এমনটি ছিল না। ইউর গভর্নমেন্ট মাস্ট বি ওয়ার্কিং হার্ড।’ এটুকু বলে ইঙ্গিতপূর্ণ হাসি হেসে ‘ওয়েলকাম টু কানাডা’ বলে আমাদের কানাডায় প্রবেশের অভ্যর্থনা জানালো। আমরাও যা বোঝার বুঝে নিলাম। এর বেশি কিছু না।’
বন্ধুর কথা শুনে আমাদের বাসায়ও হাসির রোল পড়ে গেল। পরে ওর কাছে জানতে চাইলাম, ‘পাসপোর্টে বাচ্চার বয়স এতটা কমিয়ে দিতে গেলে কেন?’
– ‘কানাডায় যাতে বাচ্চাটা বেশিদিন সরকারি চাকুরী করতে পারে সে উদ্দেশ্যেই এ ব্যবস্থা, যেমনটি আমরা সচরাচর বাংলাদেশে করে থাকি।’
ওর কথা শুনে আরেক দফা হাসলাম। তারপর সজীবকে বললাম: ‘শোন বন্ধু, কানাডায় কিন্তু মানুষ বেশিদিন কাজ করতে চায় না, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব কাজ হতে অবসর নিয়ে সবাই চায় ঝামেলামুক্ত অবসর জীবন শুরু করতে। কারণ, অবসরকালীন সিনিয়র সিটিজেন বা বয়োবৃদ্ধ নাগরিকরা সরকারের নানা সুযোগ-সুবিধা একপ্রকার বিনামূল্যে পেয়ে থাকেন। তাছাড়া, কানাডায় স্কুলের বাচ্চাদের পড়াশোনা ফ্রী, সবার জন্য চিকিৎসা ব্যবস্থা ফ্রী, মানে, ফ্রী’র তালিকা অনেক দীর্ঘ। এ কারণে অবসরে গেলেও মানুষের কোন আর্থিক সমস্যা হয় না। মূলত এসব অনিশ্চয়তা থাকে বলেই বাংলাদেশে মানুষ বয়স কমিয়ে হলেও বেশিদিন কাজ করতে চায়। তাই, কানাডার প্রেক্ষাপটে বয়স কমিয়ে তুমি আসলে ছেলেটার বয়স্ক ভাতাসহ বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা পাওয়ার বিষয়টা বরং কয়েক বছর পিছিয়ে দিয়েছো। সাধারণতঃ পঁয়ষট্টি বছর বয়স হলেই এসব সুবিধা পুরোপুরি পাওয়া যায়।’
আমার কথাগুলো মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনলো বন্ধু আর ভাবি। তারপর সজীব বলে উঠলো, ‘ইস, ভুল হয়ে গেছে তাহলে; তোমার সাথে এ ব্যাপারে আগেই কথা বলা উচিত ছিল। আমরা তো মনে করেছিলাম বয়স কমিয়ে বেশ একটা বুদ্ধিমানের কাজ করে ফেলছিলাম।’
বড়ো ছেলেটির নাম শৈবাল। তার নাম ধরে ভাবি বললেন, শৈবালের ক্ষতিটা আসলে বেশি হয়ে গেলো। সানুর (ছোটজন) বয়স আড়াই কমালেও শৈবালের কমিয়েছি চার বছর। আমরা কি আর এসব জানতাম? আমি সজীবকে কয়েকবার বলেছি আপনার সাথে কথা বলে যাচাই বাছাই করে নিতে। কে শোনে কার কথা? সে করছি করছি করেও শেষতক আর করেনি। আমি যে কেমন মানুষ নিয়ে সংসার করছি!’ – – –
এ তো শুনলেন ভবিষ্যত বিবেচনা করে আমাদের দেশে বাবা-মা’রা কিভাবে বাচ্চাদের বয়স কমিয়ে দিয়ে থাকেন সে কাহিনী। এবার শুনুন কানাডার মতো উন্নত দেশেও বাচ্চারা নিজেরাই নিজেদের বয়স নিয়ে কতটা উদ্বিগ্ন থাকে সে গল্প।
হেলাল সাহেব বাংলাদেশ থেকে কানাডার টরন্টো শহরে পড়ালেখা করতে এসেছিলেন বছর দশেক আগে। দেশের এক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করতেন তিনি। বৃত্তি নিয়ে এসেছিলেন কানাডায়। কানাডায় পড়ালেখা শেষ করে চাকরি খুঁজলেন বেশ কিছু কোম্পানিতে। ভাগ্য সুপ্রসন্ন হলো না। অবশেষে টরন্টো ছেড়ে কানাডার মন্ট্রিয়ল শহরে সপরিবারে চলে গেলেন।
মন্ট্রিয়লের বিশেষ সুবিধা হলো, সেখানে নতুন অভিবাসীরা গেলে ফ্রেঞ্চ ভাষা শেখার জন্য কিছু আর্থিক সুবিধা পেয়ে থাকেন। সে সুবিধা দিয়ে সংসার খরচ হয়ে যায়। শুরুতে সে সুযোগ গ্রহণ করলেন তিনি। তার কিছুদিন পর ভর্তি হলেন সেখানকার এক বিশ্ববিদ্যালয়ে। সেখান থেকে পিএইচডি সম্পন্ন করে বছরখানেক রিসার্চ সহকারী হিসেবে স্বল্প বেতনে বিশ্ববিদ্যালয়ে কাজ করার সুযোগ পেলেন। এর আগে পিএইচডিকালীন আয় করা মাসিক ভাতার অর্থে বছর চারেক সংসার ভালোই চলেছে। নিজেদের খরচ চালানোর পাশাপাশি দেশেও বৃদ্ধা মায়ের জন্য সময় সুযোগে কিছু টাকাপয়সা পাঠিয়েছেন।
এতো পড়াশোনার পরও চাকুরীর ভাগ্য অনুকূল না হওয়ায় ডঃ হেলাল স্থানীয় এক পোস্ট অফিসে পোস্টাল ক্লার্কের চাকুরীর পাশাপাশি কমিউনিটির মুসলিম শিশু-কিশোরদের ধর্মীয় শিক্ষা দিতে শুরু করলেন এক মসজিদে। ছোটবেলায় মাদ্রাসা শিক্ষাবোর্ডের আওতায় পড়েছেন বলে ইসলাম ধর্ম বিষয়ে তাঁর যথেষ্ট জ্ঞান রয়েছে। তাছাড়া, তিনি বরাবরই ধার্মিক মানুষ। ইয়া লম্বা দাড়ি, চেহারা সুরৎও সহি মুসলমানের। এসব গুণাবলী কাজে লাগিয়ে তিনি মসজিদে বাচ্চাদের কুরআন পাঠ এবং ইসলামী শিক্ষাদানে নিয়োজিত হলেন। মসজিদ কর্তৃপক্ষ তাঁকে কিছু অর্থ সহায়তাও দিতো নিয়মিত। দুই বাচ্চার সরকারি ভাতাও পাচ্ছেন। সব মিলিয়ে চলছে ভালোই।
আরবি শিক্ষার পাশাপাশি আল্লাহ রাসুল, ঈমান আকিদাহ এবং ধর্মীয় মৌলিক বিষয়াদি নিয়ে বাচ্চাদের সাথে আলোচনা করতেন ডঃ হেলাল। প্রশ্নোত্তর পর্বও ছিল আলোচনায়। একদিন তিনি উপস্থিত শিশু কিশোরদের উদ্দেশ্যে বললেন, ‘বয়েস এন্ড গার্লস, তোমরা কি জানো আল্লাহ সর্বশক্তিমান, তাঁর ইচ্ছায় পৃথিবীর সবকিছু হয়, গাছের পাতাটিও তাঁর হুকুম ছাড়া নড়ে না; তাঁর অসাধ্য বলে কিছু নেই?’
কম বয়সী শিশুদের কেউ কোন প্রশ্ন না করলেও ক্লাসের পেছন হতে পনেরো ষোল বছরের এক বালক ডানহাত উঁচু করে মাথার উপর তুলে প্রশ্ন করার অনুমতি চাইলো। অনুমতি পেয়ে সে বললো: ‘মিস্টার হেলাল, আল্লাহ কি সত্যি সত্যিই যা খুশি তা করতে পারেন?’ – কানাডায় আবার শিক্ষকদের নাম ধরেই ডাকা হয়; স্যারের প্রচলন নেই।
ডঃ হেলাল: ‘অবশ্যই। মনে রেখো, তাঁর ক্ষমতা নিয়ে সন্দেহ থাকলে আমরা কখনো ভালো মুসলমান হতে পারবো না।’
বালক: ‘তাহলে আল্লাহ কি চাইলে আমার বয়স ষোলতে স্থির করে দিতে পারেন?’
অদ্ভুত এ প্রশ্ন শুনে হেলাল সাহেব প্রথমটায় কিছুটা বিব্রতবোধ করলেও দ্রুত নিজেকে সামলে নিয়ে বললেন, ‘আল্লাহ চাইলে পারবেন, সবই তাঁর ইচ্ছা। তবে, তোমাকে চাওয়ার মতো করে চাইতে হবে।’
বালক: ‘কিভাবে চাইতে হবে বলুন তো তাহলে! এটাই আমার সবচেয়ে বেশি দরকার। আমার বয়স যেন ষোলোতেই ফিক্স হয়ে থাকে; এর বেশিও না কমও না।’ – – –
এবার বুঝুন, শিশু কিশোররাও নিজেদের বয়স নিয়ে কতটা সিরিয়াস!
এ লেখা আর দীর্ঘ না করে নিজের একটা সাম্প্রতিক প্রফেশনাল অভিজ্ঞতা দিয়েই শেষ করি।
কানাডিয়ান ইমিগ্রেশন কনসালটেন্ট, বা আরসিআইসি হিসেবে কাজ করি বলে কানাডা ইমিগ্রেশন নিয়ে কথা বলতে আমার সাথে দেশ-বিদেশের অনেকেই যোগাযোগ করেন। বাংলাদেশ থেকে এক ভদ্রমহিলা দুদিন আগে আমাকে ফোন দিলেন। মাস্টার্স পাশ; কাজ করেন বাংলাদেশের একটা প্রাইভেট ব্যাংকে। কানাডায় ইমিগ্রেশনের সম্ভাবনা নিয়ে কথা বলতে চান তিনি।
বয়স কানাডা ইমিগ্রেশনের একটি গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর বলে কথার শুরুতেই জানতে চাইলাম তাঁর বয়স। ভদ্রমহিলার সাথে কথোপকথন হয়েছে অনেকটা নিচের মতো।
শুরুতেই তিনি আমাকে সালাম জানালেন।
আমি: ‘ওয়ালাইকুম আসসালাম, কেমন আছেন? আপা না স্যার সম্বোধন করবো বলবেন প্লীজ?’ – শুনেছি, বাংলাদেশে নাকি আজকাল ভদ্রমহিলাদেরও স্যার সম্বোধন করতে হয়।
– ‘ না না, নাম ধরে ডাকুন; আপনি অনেক সিনিয়র পার্সন। আমার নাম মিলি।’
‘ঠিক আছে মিলি, আপনার বয়স কত?’
– (আমতা আমতা করে) ‘ছত্রিশের মতো। আমাকে তুমি বললেও চলবে; আমি অনেক ছোট।’
‘ইমিগ্রেশনের এসেসমেন্ট করতে আমার কিন্তু সঠিক বয়স জানতে হবে, না হয় এসেসমেন্ট ঠিক হবে না। তাই বয়স জানতে চাইছি। কিছু মনে করবেন না।’
– ‘বুঝেছি ভাইয়া, বুঝেছি। ভুল হয়েছে, আটত্রিশ।’
‘পড়াশোনা?’ – – –
এভাবে আরো কিছু প্রাসঙ্গিক আলোচনা সেরে তাঁকে সবশেষে লেখাপড়ার সনদসহ কিছু ডকুমেন্ট আমাকে ইমেইল করতে অনুরোধ জানালাম। দু’তিন দিনের মধ্যে তাঁর ইমেইলের উত্তর দেয়া হবে বলেও জানিয়ে দিলাম।
পরদিনই ইমেইলে অনেকগুলো ডকুমেন্ট মিলি আমাকে পাঠালেন। পাসপোর্টের কপিও ছিল সেখানে। দেখলাম, মাত্র সপ্তাহ দুয়েক পরেই তিনি চল্লিশে পা রাখছেন। তার মানে, ছত্রিশ হতে এক লাফে চল্লিশ! বাহ্!
দেখুন, ভদ্রমহিলাকে ইমিগ্রেশনে সঠিক তথ্য প্রদানের গুরুত্ব কতখানি তা বুঝিয়ে দেওয়ার পরও তিনি আমাকে তাঁর প্রকৃত বয়স জানাতে স্বাচ্ছন্দবোধ করলেন না। ভাগ্যিস ডকুমেন্ট চেয়ে নিয়েছিলাম, নইলে তাঁর ইমিগ্রেশন এসেসমেন্টের যে কি হতো!
ছত্রিশ, আটত্রিশ, অতঃপর চল্লিশ!
(পুনশ্চঃ এটি একটি রম্য গল্প। তাই, চরিত্র, ঘটনা, সবই কাল্পনিক।) [email protected]প্রায় তিন দশকের পুরোনো বন্ধু সজীব এলো দেশ থেকে। কানাডায় ইমিগ্রেশন নিয়ে এসেছে; সাথে ভাবি এবং দুই পুত্র। বড় ছেলের বয়স বিশ-একুশ হবে। ছোটটির বয়স ঠিক আঁচ করা গেলো না। জানতে চাইলে বন্ধু হাসিমুখে বললো, ‘কোন বয়স জানতে চাও, পাসপোর্ট, না আসল?’
– ‘আসলটাই আগে বলো।’
‘সাড়ে পাঁচ।’
– ‘পাসপোর্টের বয়স কত?’
‘তিন।’
তার মানে, পাসপোর্টের বয়স আসল বয়সের প্রায় অর্ধেক! অবাক হবার বিষয়ই বটে।
কানাডার ইমিগ্রেশন কর্মকর্তারা এয়ারপোর্ট, বা পোর্ট অব এন্ট্রিতে পাসপোর্ট দেখে কানাডায় প্রবেশকারীর পরিচয় নিশ্চিত করেন। সে চিন্তা হতেই বন্ধুর কাছে জানতে চাইলাম: ‘কানাডার এয়ারপোর্টে ছোট বাচ্চার বয়স নিয়ে তোমাকে কেউ কোন প্রশ্ন করেনি?’
আমার কথা শুনে সজীব হো হো করে হেসে উঠলো। ভাবিও হেসে খুন। আর, ছোট বাচ্চাটা ফ্যালফ্যাল দৃষ্টিতে আমাদের দিকে তাকাচ্ছে; মানে, হি ইজ টোটালি কনফিউজড। কিছুই বুঝে উঠতে পারছে না সে।
হাসি থামিয়ে বন্ধু বলল, ‘দোস্ত, তোমার সাথে কাহিনীটা শেয়ার করি, কাউকে আবার বলো না। ইমিগ্রেশন অফিসার বাচ্চার পাসপোর্ট এর বয়সের সাথে বাস্তবের পার্থক্য দেখে মৃদু হেসে আমাকে জিজ্ঞেস করেছিল: ‘আপনাদের বাংলাদেশে বাচ্চাদের গ্রোথ আজকাল বেশ ভালোই হচ্ছে, আগে কিন্তু এমনটি ছিল না। ইউর গভর্নমেন্ট মাস্ট বি ওয়ার্কিং হার্ড।’ এটুকু বলে ইঙ্গিতপূর্ণ হাসি হেসে ‘ওয়েলকাম টু কানাডা’ বলে আমাদের কানাডায় প্রবেশের অভ্যর্থনা জানালো। আমরাও যা বোঝার বুঝে নিলাম। এর বেশি কিছু না।’
বন্ধুর কথা শুনে আমাদের বাসায়ও হাসির রোল পড়ে গেল। পরে ওর কাছে জানতে চাইলাম, ‘পাসপোর্টে বাচ্চার বয়স এতটা কমিয়ে দিতে গেলে কেন?’
– ‘কানাডায় যাতে বাচ্চাটা বেশিদিন সরকারি চাকুরী করতে পারে সে উদ্দেশ্যেই এ ব্যবস্থা, যেমনটি আমরা সচরাচর বাংলাদেশে করে থাকি।’
ওর কথা শুনে আরেক দফা হাসলাম। তারপর সজীবকে বললাম: ‘শোন বন্ধু, কানাডায় কিন্তু মানুষ বেশিদিন কাজ করতে চায় না, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব কাজ হতে অবসর নিয়ে সবাই চায় ঝামেলামুক্ত অবসর জীবন শুরু করতে। কারণ, অবসরকালীন সিনিয়র সিটিজেন বা বয়োবৃদ্ধ নাগরিকরা সরকারের নানা সুযোগ-সুবিধা একপ্রকার বিনামূল্যে পেয়ে থাকেন। তাছাড়া, কানাডায় স্কুলের বাচ্চাদের পড়াশোনা ফ্রী, সবার জন্য চিকিৎসা ব্যবস্থা ফ্রী, মানে, ফ্রী’র তালিকা অনেক দীর্ঘ। এ কারণে অবসরে গেলেও মানুষের কোন আর্থিক সমস্যা হয় না। মূলত এসব অনিশ্চয়তা থাকে বলেই বাংলাদেশে মানুষ বয়স কমিয়ে হলেও বেশিদিন কাজ করতে চায়। তাই, কানাডার প্রেক্ষাপটে বয়স কমিয়ে তুমি আসলে ছেলেটার বয়স্ক ভাতাসহ বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা পাওয়ার বিষয়টা বরং কয়েক বছর পিছিয়ে দিয়েছো। সাধারণতঃ পঁয়ষট্টি বছর বয়স হলেই এসব সুবিধা পুরোপুরি পাওয়া যায়।’
আমার কথাগুলো মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনলো বন্ধু আর ভাবি। তারপর সজীব বলে উঠলো, ‘ইস, ভুল হয়ে গেছে তাহলে; তোমার সাথে এ ব্যাপারে আগেই কথা বলা উচিত ছিল। আমরা তো মনে করেছিলাম বয়স কমিয়ে বেশ একটা বুদ্ধিমানের কাজ করে ফেলছিলাম।’
বড়ো ছেলেটির নাম শৈবাল। তার নাম ধরে ভাবি বললেন, শৈবালের ক্ষতিটা আসলে বেশি হয়ে গেলো। সানুর (ছোটজন) বয়স আড়াই কমালেও শৈবালের কমিয়েছি চার বছর। আমরা কি আর এসব জানতাম? আমি সজীবকে কয়েকবার বলেছি আপনার সাথে কথা বলে যাচাই বাছাই করে নিতে। কে শোনে কার কথা? সে করছি করছি করেও শেষতক আর করেনি। আমি যে কেমন মানুষ নিয়ে সংসার করছি!’ – – –
এ তো শুনলেন ভবিষ্যত বিবেচনা করে আমাদের দেশে বাবা-মা’রা কিভাবে বাচ্চাদের বয়স কমিয়ে দিয়ে থাকেন সে কাহিনী। এবার শুনুন কানাডার মতো উন্নত দেশেও বাচ্চারা নিজেরাই নিজেদের বয়স নিয়ে কতটা উদ্বিগ্ন থাকে সে গল্প।
হেলাল সাহেব বাংলাদেশ থেকে কানাডার টরন্টো শহরে পড়ালেখা করতে এসেছিলেন বছর দশেক আগে। দেশের এক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করতেন তিনি। বৃত্তি নিয়ে এসেছিলেন কানাডায়। কানাডায় পড়ালেখা শেষ করে চাকরি খুঁজলেন বেশ কিছু কোম্পানিতে। ভাগ্য সুপ্রসন্ন হলো না। অবশেষে টরন্টো ছেড়ে কানাডার মন্ট্রিয়ল শহরে সপরিবারে চলে গেলেন।
মন্ট্রিয়লের বিশেষ সুবিধা হলো, সেখানে নতুন অভিবাসীরা গেলে ফ্রেঞ্চ ভাষা শেখার জন্য কিছু আর্থিক সুবিধা পেয়ে থাকেন। সে সুবিধা দিয়ে সংসার খরচ হয়ে যায়। শুরুতে সে সুযোগ গ্রহণ করলেন তিনি। তার কিছুদিন পর ভর্তি হলেন সেখানকার এক বিশ্ববিদ্যালয়ে। সেখান থেকে পিএইচডি সম্পন্ন করে বছরখানেক রিসার্চ সহকারী হিসেবে স্বল্প বেতনে বিশ্ববিদ্যালয়ে কাজ করার সুযোগ পেলেন। এর আগে পিএইচডিকালীন আয় করা মাসিক ভাতার অর্থে বছর চারেক সংসার ভালোই চলেছে। নিজেদের খরচ চালানোর পাশাপাশি দেশেও বৃদ্ধা মায়ের জন্য সময় সুযোগে কিছু টাকাপয়সা পাঠিয়েছেন।
এতো পড়াশোনার পরও চাকুরীর ভাগ্য অনুকূল না হওয়ায় ডঃ হেলাল স্থানীয় এক পোস্ট অফিসে পোস্টাল ক্লার্কের চাকুরীর পাশাপাশি কমিউনিটির মুসলিম শিশু-কিশোরদের ধর্মীয় শিক্ষা দিতে শুরু করলেন এক মসজিদে। ছোটবেলায় মাদ্রাসা শিক্ষাবোর্ডের আওতায় পড়েছেন বলে ইসলাম ধর্ম বিষয়ে তাঁর যথেষ্ট জ্ঞান রয়েছে। তাছাড়া, তিনি বরাবরই ধার্মিক মানুষ। ইয়া লম্বা দাড়ি, চেহারা সুরৎও সহি মুসলমানের। এসব গুণাবলী কাজে লাগিয়ে তিনি মসজিদে বাচ্চাদের কুরআন পাঠ এবং ইসলামী শিক্ষাদানে নিয়োজিত হলেন। মসজিদ কর্তৃপক্ষ তাঁকে কিছু অর্থ সহায়তাও দিতো নিয়মিত। দুই বাচ্চার সরকারি ভাতাও পাচ্ছেন। সব মিলিয়ে চলছে ভালোই।
আরবি শিক্ষার পাশাপাশি আল্লাহ রাসুল, ঈমান আকিদাহ এবং ধর্মীয় মৌলিক বিষয়াদি নিয়ে বাচ্চাদের সাথে আলোচনা করতেন ডঃ হেলাল। প্রশ্নোত্তর পর্বও ছিল আলোচনায়। একদিন তিনি উপস্থিত শিশু কিশোরদের উদ্দেশ্যে বললেন, ‘বয়েস এন্ড গার্লস, তোমরা কি জানো আল্লাহ সর্বশক্তিমান, তাঁর ইচ্ছায় পৃথিবীর সবকিছু হয়, গাছের পাতাটিও তাঁর হুকুম ছাড়া নড়ে না; তাঁর অসাধ্য বলে কিছু নেই?’
কম বয়সী শিশুদের কেউ কোন প্রশ্ন না করলেও ক্লাসের পেছন হতে পনেরো ষোল বছরের এক বালক ডানহাত উঁচু করে মাথার উপর তুলে প্রশ্ন করার অনুমতি চাইলো। অনুমতি পেয়ে সে বললো: ‘মিস্টার হেলাল, আল্লাহ কি সত্যি সত্যিই যা খুশি তা করতে পারেন?’ – কানাডায় আবার শিক্ষকদের নাম ধরেই ডাকা হয়; স্যারের প্রচলন নেই।
ডঃ হেলাল: ‘অবশ্যই। মনে রেখো, তাঁর ক্ষমতা নিয়ে সন্দেহ থাকলে আমরা কখনো ভালো মুসলমান হতে পারবো না।’
বালক: ‘তাহলে আল্লাহ কি চাইলে আমার বয়স ষোলতে স্থির করে দিতে পারেন?’
অদ্ভুত এ প্রশ্ন শুনে হেলাল সাহেব প্রথমটায় কিছুটা বিব্রতবোধ করলেও দ্রুত নিজেকে সামলে নিয়ে বললেন, ‘আল্লাহ চাইলে পারবেন, সবই তাঁর ইচ্ছা। তবে, তোমাকে চাওয়ার মতো করে চাইতে হবে।’
বালক: ‘কিভাবে চাইতে হবে বলুন তো তাহলে! এটাই আমার সবচেয়ে বেশি দরকার। আমার বয়স যেন ষোলোতেই ফিক্স হয়ে থাকে; এর বেশিও না কমও না।’ – – –
এবার বুঝুন, শিশু কিশোররাও নিজেদের বয়স নিয়ে কতটা সিরিয়াস!
এ লেখা আর দীর্ঘ না করে নিজের একটা সাম্প্রতিক প্রফেশনাল অভিজ্ঞতা দিয়েই শেষ করি।
কানাডিয়ান ইমিগ্রেশন কনসালটেন্ট, বা আরসিআইসি হিসেবে কাজ করি বলে কানাডা ইমিগ্রেশন নিয়ে কথা বলতে আমার সাথে দেশ-বিদেশের অনেকেই যোগাযোগ করেন। বাংলাদেশ থেকে এক ভদ্রমহিলা দুদিন আগে আমাকে ফোন দিলেন। মাস্টার্স পাশ; কাজ করেন বাংলাদেশের একটা প্রাইভেট ব্যাংকে। কানাডায় ইমিগ্রেশনের সম্ভাবনা নিয়ে কথা বলতে চান তিনি।
বয়স কানাডা ইমিগ্রেশনের একটি গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর বলে কথার শুরুতেই জানতে চাইলাম তাঁর বয়স। ভদ্রমহিলার সাথে কথোপকথন হয়েছে অনেকটা নিচের মতো।
শুরুতেই তিনি আমাকে সালাম জানালেন।
আমি: ‘ওয়ালাইকুম আসসালাম, কেমন আছেন? আপা না স্যার সম্বোধন করবো বলবেন প্লীজ?’ – শুনেছি, বাংলাদেশে নাকি আজকাল ভদ্রমহিলাদেরও স্যার সম্বোধন করতে হয়।
– ‘ না না, নাম ধরে ডাকুন; আপনি অনেক সিনিয়র পার্সন। আমার নাম মিলি।’
‘ঠিক আছে মিলি, আপনার বয়স কত?’
– (আমতা আমতা করে) ‘ছত্রিশের মতো। আমাকে তুমি বললেও চলবে; আমি অনেক ছোট।’
‘ইমিগ্রেশনের এসেসমেন্ট করতে আমার কিন্তু সঠিক বয়স জানতে হবে, না হয় এসেসমেন্ট ঠিক হবে না। তাই বয়স জানতে চাইছি। কিছু মনে করবেন না।’
– ‘বুঝেছি ভাইয়া, বুঝেছি। ভুল হয়েছে, আটত্রিশ।’
‘পড়াশোনা?’ – – –
এভাবে আরো কিছু প্রাসঙ্গিক আলোচনা সেরে তাঁকে সবশেষে লেখাপড়ার সনদসহ কিছু ডকুমেন্ট আমাকে ইমেইল করতে অনুরোধ জানালাম। দু’তিন দিনের মধ্যে তাঁর ইমেইলের উত্তর দেয়া হবে বলেও জানিয়ে দিলাম।
পরদিনই ইমেইলে অনেকগুলো ডকুমেন্ট মিলি আমাকে পাঠালেন। পাসপোর্টের কপিও ছিল সেখানে। দেখলাম, মাত্র সপ্তাহ দুয়েক পরেই তিনি চল্লিশে পা রাখছেন। তার মানে, ছত্রিশ হতে এক লাফে চল্লিশ! বাহ্!
দেখুন, ভদ্রমহিলাকে ইমিগ্রেশনে সঠিক তথ্য প্রদানের গুরুত্ব কতখানি তা বুঝিয়ে দেওয়ার পরও তিনি আমাকে তাঁর প্রকৃত বয়স জানাতে স্বাচ্ছন্দবোধ করলেন না। ভাগ্যিস ডকুমেন্ট চেয়ে নিয়েছিলাম, নইলে তাঁর ইমিগ্রেশন এসেসমেন্টের যে কি হতো!
(পুনশ্চঃ এটি একটি রম্য গল্প। তাই, চরিত্র, ঘটনা, সবই কাল্পনিক।) [email protected]
১৮ ই অক্টোবর, ২০২০ দুপুর ১:২১
এমএলজি বলেছেন: ভাই, আমার বেশিরভাগ লেখাই এমন।
পড়ার জন্য ধন্যবাদ।
২| ১৭ ই অক্টোবর, ২০২০ রাত ২:৫৩
রাজীব নুর বলেছেন: আমার আজকাল কোনো কিছুতেই হাসি পায় না। হে চন্দ্র এ আমার কেমন অসুখ হলো?
১৮ ই অক্টোবর, ২০২০ দুপুর ১:২২
এমএলজি বলেছেন: ভাই, আপনি হাসতে বাধ্য নন।
পড়ার জন্য ধন্যবাদ।
৩| ১৭ ই অক্টোবর, ২০২০ সকাল ৮:১৫
কূপমণ্ডূক বলেছেন: আমার এক পরিচিত বড় ভাই, গানি ভাই, খুব ঋণাত্মক একজন মানুষ। তেমন বন্ধু বান্ধব নাই, তবে গানি ভাই একজন 'হনু'মানব, মানে মুই কি হনুরে টাইপ। গানি ভাই ক্যানাডা যাইতে চায়।
১৭ ই অক্টোবর, ২০২০ সকাল ১০:৪২
এমএলজি বলেছেন: পরিচয় গোপন করে এ ধরণের মন্তব্য দেয়া কাম্য নয়।
৪| ১৭ ই অক্টোবর, ২০২০ সকাল ৯:০৩
ching বলেছেন: এ্যাসাইলাম নিতে চাই।
১৮ ই অক্টোবর, ২০২০ দুপুর ১:২৫
এমএলজি বলেছেন: বিস্তারিত ইমেইল করতে পারেন। সহায়তা দেবার চেষ্টা করবো।
©somewhere in net ltd.
১| ১৭ ই অক্টোবর, ২০২০ রাত ১২:০২
নুরুলইসলা০৬০৪ বলেছেন: কাল্পনিক হলেও বাস্তব মনে হয়।