নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

সাজিদ উল হক আবির

সাধু সাবধান ! ব্লগের মালিক বঙ্গালা সাহিত্যকে ধরিয়া বিশাল মাপের ঝাঁকি দিতে নিজেকে শারীরিক ও মানসিক ভাবে প্রস্তুত করিতেছেন। সেই মর্মে তিনি এখন কিটো ডায়েটিং, ডন-বৈঠক ও ভারোত্তলন প্রশিক্ষণে ব্যস্ত। প্রকাশিত গ্রন্থঃ১। শেষ বসন্তের গল্প । (২০১৪)২। মিসিং পারসন - প্যাত্রিক মোদিয়ানো, ২০১৪ সাহিত্যে নোবেল বিজয়ী (অনুবাদ, ২০১৫) ৩। আয়াজ আলীর ডানা (গল্পগ্রন্থ - ২০১৬ ৪। কোমা ও অন্যান্য গল্প(গল্প গ্রন্থ, ২০১৮) ৫। হেমন্তের মর্সিয়া (কবিতা, ২০১৮) ৬। কাঁচের দেয়াল (গল্পগ্রন্থ, ২০১৯) ৭।শহরনামা (উপন্যাস, মাওলা ব্রাদার্স, ২০২২), ৮। মুরাকামির শেহেরজাদ ও অন্যান্য গল্প (অনুবাদ, ২০২৩), ৯। নির্বাচিত দেবদূত(গল্পগ্রন্থ, ২০২৪), ১০। দেওয়ানেগির চল্লিশ কানুন/ফরটি রুলস অফ লাভ (অনুবাদ, ঐতিহ্য, ২০২৪)

সাজিদ উল হক আবির › বিস্তারিত পোস্টঃ

হারুকি মুরাকামির অনুবাদ গল্পঃ ছোট্ট সবুজ দানো (দা লিটল গ্রিন মনস্টার)

১৭ ই জুলাই, ২০২২ সন্ধ্যা ৬:০৫




অন্যান্য দিনের মতো আমার স্বামী কাজে চলে গেলো, আমি করার মতো কিছু খুঁজে পাচ্ছিলাম না। কাজেই জানালার পাশে চেয়ার পেতে বসে ছিলাম একাকী, দৃষ্টি ছিল জানালার পর্দাগুলোর ফাঁক গলে ওপাশের বাগানে নিবদ্ধ। বিশেষ কোনো উদ্দেশ্যে নিয়ে যে ওভাবে বসে ছিলাম, তাও নয়: এছাড়া তখন করার মতো কিছু ছিল না আমার। মনে হচ্ছিল, এখন হোক বা একটু পরেই হোক, এভাবে বসে থাকলে হয়তো করার মতো কিছু একটা খুঁজে পাবো। জানলার ওপাশে, বাগানে, যে জিনিসটার দিকে সবচেয়ে লম্বা সময় নিয়ে তাকিয়েছিলাম, সেটা ছিল একটা ওক গাছ। গাছটা আমার বিশেষ পছন্দের। যখন আমি ছিলাম ছোট্ট এক মেয়ে, তখন গাছটা রোপণ করেছিলাম। আমার চোখের সামনেই গাছটা বেড়ে উঠলো। ও আমার পুরনো এক বন্ধুর মতো। মনে মনে সারাক্ষণই এই গাছের সঙ্গে আলাপ করি আমি।

যে দিনের গল্প আপনাদের শোনাচ্ছি, সেদিনও আমি মনে মনে ঐ গাছের সঙ্গেই গল্প করছিলাম, তবে কি নিয়ে- সেটা ঠিক মনে নেই। এটাও স্মরণে আসছে না যে, ঠিক কতক্ষণ ওখানে, ওভাবে বসেছিলাম আমি। বাগানের দিকে তাকিয়ে বসে থাকলে কেন যেন আমার সময়জ্ঞান লুপ্ত হয়ে যায়। বুঝে ওঠার আগেই ঝুপ করে সাঁঝবেলা নেমে এলো : বেশ অনেকক্ষণ ধরেই তবে বসেছিলাম ওখানে। তারপর না, হঠাৎ করেই কেমন যেন এক আওয়াজ শুনতে পেলাম। আওয়াজটা দূর থেকে ভেসে এলো, কেমন যেন হাস্যকর এক আওয়াজ, চাপাস্বরে কোনোকিছুর ওপর কোনোকিছু ঘষবার অনুরূপ শব্দ ছিল সেটা। প্রথম প্রথম আমার মনে হল, এ আওয়াজ আমার মনের গভীর থেকে উঠে আসছে; মনে হল এ যেন বাস্তবতা সংশ্লিষ্ট কিছু নয়, কেবল আমিই শুনতে পাচ্ছিলাম এ শব্দ। মনের ভেতর ক্রমাগত অন্ধকার সব চিন্তার জাল বুনে যাওয়ার ফসল হিসেবেই হয়তো শরীর এ সতর্কবাণী দিচ্ছিল আমাকে। আমি শ্বাস বন্ধ করে কান পেতে রইলাম। হ্যাঁ, কোনো সন্দেহের অবকাশ নেই। ধীরে, খুব ধীরে সে শব্দ আমার নিকটবর্তী হয়ে চলেছে। কিসের আওয়াজ এটা? আমার কোনো ধারণা ছিল না। কিন্তু সে আওয়াজের স্পন্দন আমার পুরো শরীর জুড়ে শিরশির করে সজাগ হয়ে উঠছিল ক্রমাগত।

হঠাৎ করে আমার প্রিয় ওক গাছের গোড়ার দিকটা থেকে বেশ কিছু মাটি উড়ে এলো, যেন ঘন- ভারী এক তরল পদার্থ এখনি উছলে উঠবে ওখান থেকে। আবারো আমি নিঃশ্বাস বন্ধ করে তাকিয়ে রইলাম সেদিকে নির্নিমেষে। তারপর সশব্দে মাটি দু'ভাগ করে, পাতাল থেকে তীক্ষ্ণ নখরযুক্ত একজোড়া থাবা দৃশ্যমান হয়ে উঠলো। আমার চোখজোড়া এই অত্যাশ্চর্য ঘটনা থেকে ফেরাতে পারছিলাম না, ওদিকে নিজের অজান্তেই আমার হাতজোড়া মুষ্টিবদ্ধ হয়ে গেলো। কিছু একটা ঘটতে চলেছে, নিজেকে নিজে ফিসফিসিয়ে বললাম- এবং, যা ঘটার তা এখনই ঘটবে। দেখলাম, থাবাজোড়া প্রাণপণে ওকে চাপা দিয়ে রাখা মাটি সরাতে লাগলো, আর শীঘ্রই এতে করে ছোটখাটো এক গর্তের মতোন তৈরি হয়ে গেলো ভূস্তরে। সেই গর্তের ভেতর থেকে হামাগুড়ি দিয়ে বেরিয়ে এলো এক ছোট্ট সবুজ দানো।


দানোটার পুরো শরীর চকচকে সবুজরঙা খোলসে আবৃত। মাটির ওপর উঠে দাঁড়িয়ে ওটা তার শরীর জোরে জোরে ঝাড়া দিতে থাকলো, যতক্ষণ পর্যন্ত না তার শরীরের ওপরস্থ প্রতিটি মাটির কনা ঝরে পড়ে যায় নিচে। ওর নাকটা ছিল হাস্যকর রকমের লম্বা, সে নাকের আগার দিকটা ছিল ওর বাকি শরীরের চেয়েও গাঢ়তর সবুজ রঙের। গোড়া থেকে আগার দিকে সে নাক ক্রমশ সরু হতে হতে চাবুকের ডগার মতো ছুঁচলো হয়ে এসেছিল, কিন্তু, অবাক করা ব্যাপার হল, জন্তুটার চোখজোড়া ঠিক মানুষের চোখের মতন। ঐ চোখে চোখ পড়তেই সমস্ত শরীর কেঁপে ওঠে, কারণ ওতে আপনার-আমার মতোই মানবিক অনুভূতি সাঁটা।

কোনোরকমের দোটানা ছাড়া- সুস্থির, এবং অবিচল পদক্ষেপে দানোটি হেঁটে হেঁটে এসে দাঁড়ালো আমার বাড়ির সদর দরোজায়। তারপর, সে তার সূচলো নাকের ডগা দিয়ে দরজার ওপর টোকা দিতে আরম্ভ করলো। তার শুষ্ক, খশখশে শব্দ ছড়িয়ে পড়লো পুরো ঘর জুড়ে। আমি পায়ে পায়ে পেছনের কামরায় চলে এলাম, এই আশায় যে, জন্তুটা হয়তো টের পাবে না আমি এখানে লুকিয়ে আছি। চিৎকার দিয়ে কোনো লাভ হত না। আমাদের বাড়িটা এক দীর্ঘ এলাকা জুড়ে একমাত্র মানববসতি। অপরদিকে রাত গভীর হওয়ার আগে আমার স্বামীরও বাড়ি ফেরার কোনো সম্ভাবনা নেই। পেছনের দরজা দিয়ে বেরিয়ে যে পালিয়ে যাবো, সে উপায়ও ছিল না। এ বাড়ির একটাই দরজা, যার সামনে দাঁড়িয়ে ঐ কুৎসিত সবুজ দানোটা এখন কড়া নাড়ছে। আমি শ্বাস-প্রশ্বাসের গতিপ্রকৃতি প্রায় নৈঃশব্দের কাছাকাছি নামিয়ে আনলাম, এই আশায় যে- দানোটা হয়তো মনে করবে বাড়িতে কেউ নেই, এবং একপর্যায়ে হতাশ হয়ে চলে যাবে। কিন্তু শীঘ্রই বোঝা গেলো যে সে হাল ছাড়ার পাত্র নয়। একপর্যায়ে সে তার লম্বা নাক দিয়ে দরজা নক করা থামিয়ে, দরজার হাতলটা পেঁচিয়ে ধরল। লক ভাংতে তার তেমন কোনো শ্রমই ব্যয় হল না, তারপর দরজাটা নিজেই শব্দ করে খুলে গেলো। খুব ধীরে, দরজাটার কিনার ঘেঁষে প্রথম বেরিয়ে এলো দানোর সরু সে নাক, এবং একটুখানি প্রবেশ করেই থেমে গেলো সেটা। তারপর এক লম্বা সময়কাল ধরে নাকখানা ওখানেই, ওভাবেই স্থির হয়ে রইলো, যেমন করে কিনা সাপ ফণা উঁচিয়ে দীর্ঘ সময় ধরে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে। এমনটা যে ঘটবে, তা আন্দাজ করতে পারলে আমি দরজার কাছ ঘেঁষেই থাকতাম। তারপর এক কোপে ঐ নাক নামিয়ে দিতে পারতাম, বললাম নিজেকে। আমাদের রান্নাঘর ধারালো সব ছুরি দিয়ে ভর্তি। যখনি এই চিন্তা আমার মাথায় দানা বাঁধছে, ঠিক তখনি দানোটা হাসিমুখে দরজা অতিক্রম করে এসে দাঁড়ালো ভেতরে, যেন সে পড়তে পেরেছে আমার মনের কথা। তারপর সে কথা বলা শুরু করলো। কিম্ভূত তার কথা বলার ধরন। তোতলানো বলা যাবে না একে, কিন্তু কিছু কিছু শব্দ বারবার পুনরাবৃত্তি করে করে কথা বলা, যেন সেই শব্দগুলো সে কথা বলার ছলে নতুন করে শিখছে। এতে করে কোনো উপকার হবে না, উপকার হবে না, ছোট্ট সবুজ দানোটা বলল। আমার নাক টিকটিকির লেজের মতো। কাটলে পরে আবারো গজাবে, আরও শক্ত এবং লম্বা হয়ে, আরও শক্ত এবং লম্বা হয়ে। কেবল তার উল্টোটাই পাবেন, যা আপনি চান চান। তারপর, দানোটা এক লম্বা সময় ধরে খুবই অদ্ভুত উপায়ে, কোটরের মধ্যে নিজের চোখদুটো ক্রমাগত ঘুরিয়ে চলল।

ওহ, না, আমি চিন্তা করলাম। এটা কি মানুষের চিন্তা পড়তে পারে? আমার মাথায় কি চলছে, তা কেউ পড়তে পারুক, এমনটা আমি একেবারেই চাইবো না। বিশেষ করে সেই 'কেউ' টা যদি এই ভয়াবহ, এবং অভিব্যক্তিবহীন জন্তু হয়। আমার সমগ্র শরীর থেকে ঠাণ্ডা ঘামের স্রোত প্রবাহিত হওয়া শুরু হল। এই জন্তুটা কী করবে আমার সঙ্গে? খেয়ে ফেলবে আমাকে? ওর সঙ্গে করে টেনে নিয়ে যাবে মাটির নিচে? একটা ভালো দিক হল, ওকে এখন আর দেখতে অতটা কুৎসিত লাগছে না যে, ওর পাশে দাঁড়ানোমাত্র আমার নাড়ি উল্টে আসবে। ওর হাতগুলো গোলাপি রঙের, সরু সরু। পা দুটো হঠাৎ করেই যেন বেরিয়ে এসেছে চকচকে সবুজ রঙের আঁশ আর খোলসে মোড়া দেহাবয়ব থেকে। হাত আর পা- দুইয়ের শেষ প্রান্তেই তীক্ষ্ণ নখরযুক্ত থাবা। সবটা মিলিয়ে দেখতে ওকে খুব কিউট লাগছে, সত্যি বলতে। এবং, ক্রমাগত আমি এটাও বুঝছিলাম যে, জন্তুটা আমার কোনো ক্ষতি করার মতলব রাখে না।

অবশ্যই না, ঘাড় সোজা করে জন্তুটা আমায় বলল। ও খানিকটা নড়লেই ওর শরীরের আঁশগুলো নিজেদের মধ্যে নড়েচড়ে এক শব্দ তৈরি করে, যেমনটা কিনা টেবিলের ওপর পাশাপাশি সাজিয়ে রাখা কফি ভর্তি মগ সামান্য নাড়া পেলেই নিজেদের মধ্যে টুংটাং করে বেজে ওঠে। কি ভয়াবহ চিন্তা আপনার, ম্যাডাম, অবশ্যই আপনাকে খেয়ে ফেলার কোনো পরিকল্পনা নেই আমার। না না না। কোনো ক্ষতি করবো না, ক্ষতি করবো না, ক্ষতি করবো না আপনার।

কাজেই, আমি ঠিক ভাবছিলাম: এটা নিশ্চিতভাবে আমার চিন্তা পড়তে পারে।

ম্যাডাম, ম্যাডাম, ম্যাডাম, আপনি এখনও বুঝতে পারেননি? বুঝতে পারেননি? আমি এখানে এসেছি আপনাকে প্রেম নিবেদন করার জন্য। অনেক গভীর গভীর গভীর মাটির গভীর গভীর তলদেশ থেকে। আমার হামাগুড়ি দিয়ে উঠে আসতে হয়েছে এখানে, এখানে। ভয়াবহ ছিল, অভিজ্ঞতাটা খুব ভয়াবহ ছিল। আমার ক্রমাগত খুঁড়ে যেতে হয়েছে, খুঁড়ে যেতে হয়েছে, খুঁড়ে যেতে হয়েছে। তাকিয়ে দেখুন, এতে করে আমার সুন্দর নখরযুক্ত থাবার কী দুর্দশা হয়েছে! আমি কোনোমতেই এতো কিছু করে সারতে পারতাম না, যদি আমার আপনার ক্ষতি করার ইচ্ছে থাকতো, ক্ষতি করার ইচ্ছে থাকতো, ক্ষতি করার ইচ্ছে থাকতো। আমি ভালোবাসি আপনাকে। আমি এতোটাই ভালোবাসি আপনাকে যে, আমার পক্ষে আর মাটির নিচে থাকা সম্ভব হয়নি, মাটির নিচে। আমার হামাগুড়ি দিয়ে আপনার সামনে এসে দাঁড়ানো লেগেছে, লেগেছে। ওরা সবাই আমাকে থামাতে চেয়েছিল, কিন্তু আমি সহ্য করতে পারিনি। চিন্তা করে দেখুন, কী পরিমাণ সাহস আমাকে সঞ্চয় করতে হয়েছে, প্লিজ, সঞ্চয় করতে হয়েছে। যদি আপনি আমার মতো এক জন্তুর আপনাকে ভালোবাসা নিবেদনের প্রক্রিয়াটাকে নির্মম এবং দুঃসাহসী ভাবেন, নির্মম এবং দুঃসাহসী ভাবেন?

কিন্তু তুমি তো আসলেই নির্মম, এবং দুঃসাহসী, আমি মনে মনে বললাম। কতোবড় সাহস তোমার, জন্তু, মাটির তল থেকে উঠে এসে আমার ভালোবাসা চাইছ তুমি!

আমি এটা ভাববার সঙ্গে সঙ্গেই জন্তুটার চেহারা দুখী দুখী হয়ে গেলো, এবং ওর উজ্জ্বল সবুজ ত্বক, ওর মনের অবস্থার সঙ্গে সামঞ্জস্য রাখতে, কেমন যেন একটা বেগুনী বর্ণ ধারণ করলো। ওর পুরো শরীরটাও যেন কুঁকড়ে খানিকটা ছোট হয়ে এলো। আমি হাতের ওপর হাত ভাঁজ করে দাঁড়িয়ে ওর শরীরের এসব পরিবর্তন দেখতে লাগলাম। মনে হয় ওর মনের ভাবের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গেই ওর শরীর এভাবে, ক্রমাগত বদলাতে থাকবে। এবং, সম্ভবত, ওর এই কুৎসিত দর্শন চেহারা কেবলই ওর ভেতরের নরমসরম মার্শমেলোর মতো অন্তরকে বেষ্টন করে রাখা এক মুখোশমাত্র। যদি ঘটনা তাই হয়ে থাকে, আমি নিশ্চিত, আমি এই খেলায় জিতবো। চেষ্টা করেই দেখা যাক। তুমি দুনিয়ার কুৎসিততম ছোট্ট দানো, আশা করি তুমি জানো তা- আমি মনের সমস্ত জোর একত্র করে মস্তিষ্কের অভ্যন্তরেই চেঁচিয়ে উঠলাম। এতো জোরে যে, আমার পুরো অন্তরাত্মা থরথর করে কেঁপে উঠলো। তুমি এক কুৎসিত বেঁটে দানো! দেখলাম, ওর শরীরের রঙ বেগুনী থেকে আরও গাঢ় বেগুনী হয়ে উঠছে, আর ওর চোখদুটো যেন আমার সমস্ত ঘৃণা শুষে নিয়ে ফুলে ফেঁপে উঠে ঠেলে কোটর থেকে বেরিয়ে আসতে চাইছে। মেঝে ভিজে যাচ্ছে লাল রঙের জুসের মতো ওর চোখের জলে।

টের পেলাম, আমি আর এই জন্তুটাকে একবিন্দু ভয় পাচ্ছি না। আমি মনে মনে ওকে নিয়ে করবার মতো অসংখ্য নিষ্ঠুর চিত্র অঙ্কন করলাম। ওকে একটা ভারী চেয়ারে বসিয়ে, শক্ত করে তার দিয়ে পেঁচিয়ে বেঁধে, সূচালো চিমটার মাথায় টেনে টেনে একটা একটা করে ওর শরীরের সমস্ত আঁশ, একদম গোড়া থেকে টেনে তুলে ফেলতে লাগলাম। একটা ধারালো ছুরির তীক্ষ্ণ ফলাকে আগুনের আঁচে গনগনে লাল বানিয়ে, তা ওর পায়ের পেছনের দিকের গোলাপি বর্ণের কাফ মাসলের ভেতর ঢুকিয়ে দিলাম হুট করে। তৈরি করলাম গভীর ক্ষত। তপ্ত লোহার শিক দিয়ে একের পর এক আঘাতে ক্ষতবিক্ষত করে দিতে থাকলাম ওর কোটর থেকে ঠেলে বেরিয়ে আসা চোখদুটোকে। মনে মনে অত্যাচারের প্রতিটি নতুন ধরনের আবিষ্কারের সঙ্গে সঙ্গে, আমি দেখতে পেলাম যে জন্তুটা যেন ব্যাথায় কুঁকড়ে দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছে। যা কিছুই আমি কল্পনা করছি, সবই যেন সত্যি সত্যি হচ্ছে ওর সঙ্গে। জন্তুটার চোখ থেকে ক্রমাগত রঙিন অশ্রুর ঢল প্রবাহিত হতে থাকলো, শরীর থেকে বেরিয়ে আসা ঘন থকথকে তরলের স্রোত আবৃত করে ফেলতে লাগলো মেঝেকে, ওর কান থেকে ছাইবর্ণের ধোঁয়া বের হতে থাকলো ক্রমাগত, সেই ধোঁয়ায় আবার গোলাপ ফুলের ঘ্রাণ! ওর চোখের অতল গভীর থেকে আকুতি স্পষ্ট হয়ে উঠলো আমার প্রতি। প্লিজ, ম্যাডাম, আহ, প্লিজ, আমি ক্ষমা চাইছি, দয়া করে এসব ভয়াবহ চিন্তা বন্ধ করুন! ও কান্না করতে লাগলো। আমার কোনো খারাপ চিন্তা নেই আপনাকে নিয়ে। আমি কখনো আপনার কোনো ক্ষতি করবো না। আপনাকে দেবার জন্যে আমার কেবল ভালোবাসা আছে, কেবল ভালোবাসা আছে। কিন্তু আমি শুনতে চাইলাম না আর, ওর এসব গালগল্প। আমি মনে মনে বললাম, নিজেকে হাসির পাত্র বানিয়ো না! তুমি আমার বাগানের মাটি ফুঁড়ে উঠে এসেছ তুমি। আমার অনুমতি ছাড়া প্রবেশ করেছো আমার ঘরে। আমি তোমাকে দাওয়াত দিয়ে আনিনি। তাই আমার পুরো অধিকার আছে, তোমাকে নিয়ে যা ইচ্ছা তাই ভাববার। এবং আমি ঠিক তাই করলাম, জন্তুটাকে আমার কল্পনায় চিরে টুকরো টুকরো করতে থাকলাম। যতরকম ভয়াবহ ধারালো অস্ত্র এবং যন্ত্র আমার জানামতে আছে, তাদের প্রতিটা ব্যবহার করে ওর শরীর, ওর মাংসকে ছোট ছোট সাইজ করে কাটতে থাকলাম। একটা জীবন্ত বস্তুকে কষ্ট দেয়া যায়, এমনকোন উপায়, এমন কোনো অবলম্বন দিয়ে ওকে কষ্ট দিতে বাকি রাখলাম না আমি। ছোট্ট দানো, অবশেষে বুঝলে, নারী কাকে বলে- এ বিষয়ে তোমার কোনো ধারণাই নেই। তোমাকে কষ্ট দেয়ার হেন কোনো উপায় নেই, যা আমি জানি না। শীঘ্রই জন্তুটার শরীরের অবয়ব বদলে যেতে লাগলো, এমনকি এর লম্বা সবুজ নাকখানা ছোট হতে হতে একটা শুঁয়োপোকার সাইজের হয়ে গেলো। মেঝেতে শুয়ে জন্তুটা ওর ঠোঁট নাড়িয়ে কী যেন একটা বলতে চাইলো আমাকে, হয়তো কোনো এক সমাপনি বার্তা, জ্ঞানগর্ভ প্রাচীন কোনো এক বাণী, কোনো এক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য যা আমাকে আগে দিতে ভুলে গেছে ও। কিন্তু এর কোনোকিছু ঘটার আগেই, ওর ঠোঁটদুটো নিয়ে যে মুখের আদল, তাও চূড়ান্তভাবে থেমে গিয়ে, একসময় মিশে গেলো বাকি শরীরের সঙ্গে। আলাদা করা গেলো না আর ঐ অংশটুকুকে। জন্তুটাকে এখন সবমিলিয়ে স্রেফ সাঁঝের ধুসর আবছায়ার মতো লাগছে। বাকি ছিল কেবল বাতাসে ভেসে থাকা ওর ফাঁপা, দুখী চোখদুটো। ওতে আর কী লাভ হবে, আমি ভাবলাম। তাকিয়ে থাকতে পারবে আজীবন, কিন্তু কিছু বলতে তো পারবে না আর। পারবে না কিছু করতেও। তোমার অস্তিত্ব শেষ, সমাপ্ত, খতম। ধীরে ধীরে ঐ চোখদুটিও মিলিয়ে গেলো বাতাসে, এবং আমার কামরা জুড়ে রইলো কেবল রাতের শীতল ছায়া।


`দা ইলিফেন্ট ভ্যানিশেস' গল্পগ্রন্থের ভিন্টেজ সংস্করণ হতে, জে রুবিনের ইংরেজি থেকে আমার অনুবাদ।

আজকের বাংলা ট্রিবিউনের সাহিত্য পাতায় প্রকাশিত

মন্তব্য ৯ টি রেটিং +৫/-০

মন্তব্য (৯) মন্তব্য লিখুন

১| ১৭ ই জুলাই, ২০২২ সন্ধ্যা ৭:৫২

পদাতিক চৌধুরি বলেছেন: দুর্দান্ত গল্প। অনুবাদ বলে একেবারেই মনে হয়নি।দানোটি মহিলার সঙ্গে শেষ পর্যন্ত কি করে তা জানতে এক নিঃশ্বাসে পড়ে ফেললাম। আপনি সুন্দর করে লিখেছেন।++

১৭ ই জুলাই, ২০২২ রাত ১১:১৪

সাজিদ উল হক আবির বলেছেন: অনেক ধন্যবাদ, প্রিয় পদাতিক ভাই। মুরাকামির গল্পগুলিতে মানুষের একেকটি অনুভূতি একেকটা চরিত্র হিসেবে উঠে আসে। এই দানো, আমার পঠনে মনে হয়েছে যে - সুন্দরী রমণীদের অ্যাপ্রোচ করা অযোগ্য পাণিপ্রার্থীদের এক রূপক প্রতিচ্ছবি। মুরাকামির আর যে গল্পগুলি সাম্প্রতিক সময়ে পড়ছি, বা অনুবাদ করছি, প্রত্যেক ক্ষেত্রেই আমার গল্পের বোঝাপড়া এই একরকম। শুভেচ্ছা জানবেন। : )

২| ১৭ ই জুলাই, ২০২২ রাত ৮:১৪

ইসিয়াক বলেছেন: একেবারে ঝরঝরে অনুবাদ। পড়ে ভালো লাগলো।

১৭ ই জুলাই, ২০২২ রাত ১১:১৫

সাজিদ উল হক আবির বলেছেন: ফেসবুকে একবার কৃতজ্ঞতা জানিয়েছি, এখানেও পুনরায় কৃতজ্ঞতা, প্রিয় ইসিয়াক ভাই। অনেক শুভকামনা।

৩| ১৯ শে জুলাই, ২০২২ সকাল ১১:০৭

ফয়সাল রকি বলেছেন: বেচারা দানোটা! নারীর মন বুঝতে পারাটা যে কত কঠিন একটা ব্যাপার বেচারা যদি আগে জানতো!

৪| ০২ রা মার্চ, ২০২৩ রাত ১০:৫৫

সন্ধ্যা রাতের ঝিঁঝিঁ বলেছেন: এবার আপনার কোনো বই বের হয়নি??

৩০ শে সেপ্টেম্বর, ২০২৩ রাত ১:২০

সাজিদ উল হক আবির বলেছেন: বেরিয়েছিল। মুরকামির শেহেরযাদ ও অন্যান্য গল্প।

৫| ১০ ই সেপ্টেম্বর, ২০২৩ বিকাল ৫:০২

ডার্ক ম্যান বলেছেন: অনেকদিন ধরে আপনি অনুপস্থিত

৩০ শে সেপ্টেম্বর, ২০২৩ রাত ১:২১

সাজিদ উল হক আবির বলেছেন: আমার অনুপস্থিতি লক্ষ্য করার জন্য শুকরিয়া। কুশলে আছেন, আশা করি।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.