নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

সাজিদ উল হক আবির

সাধু সাবধান ! ব্লগের মালিক বঙ্গালা সাহিত্যকে ধরিয়া বিশাল মাপের ঝাঁকি দিতে নিজেকে শারীরিক ও মানসিক ভাবে প্রস্তুত করিতেছেন। সেই মর্মে তিনি এখন কিটো ডায়েটিং, ডন-বৈঠক ও ভারোত্তলন প্রশিক্ষণে ব্যস্ত। প্রকাশিত গ্রন্থঃ১। শেষ বসন্তের গল্প । (২০১৪)২। মিসিং পারসন - প্যাত্রিক মোদিয়ানো, ২০১৪ সাহিত্যে নোবেল বিজয়ী (অনুবাদ, ২০১৫) ৩। আয়াজ আলীর ডানা (গল্পগ্রন্থ - ২০১৬ ৪। কোমা ও অন্যান্য গল্প(গল্প গ্রন্থ, ২০১৮) ৫। হেমন্তের মর্সিয়া (কবিতা, ২০১৮) ৬। কাঁচের দেয়াল (গল্পগ্রন্থ, ২০১৯) ৭।শহরনামা (উপন্যাস, মাওলা ব্রাদার্স, ২০২২), ৮। মুরাকামির শেহেরজাদ ও অন্যান্য গল্প (অনুবাদ, ২০২৩), ৯। নির্বাচিত দেবদূত(গল্পগ্রন্থ, ২০২৪), ১০। দেওয়ানেগির চল্লিশ কানুন/ফরটি রুলস অফ লাভ (অনুবাদ, ঐতিহ্য, ২০২৪)

সাজিদ উল হক আবির › বিস্তারিত পোস্টঃ

পাঠ প্রতিক্রিয়াঃ দোজখনামা ~ রবিশঙ্কর বল

২৪ শে জুন, ২০২২ বিকাল ৪:২১


পাঠ প্রতিক্রিয়াঃ দোজখনামা ~ রবিশঙ্কর বল
.

রবিশংকর বলের সবচে বিখ্যাত উপন্যাস, সম্ভবত দোজখনামা। মানুষের অপরিসীম ভালোবাসা লাভ করেছে এই উপন্যাস, তার বিষয়বস্তু এবং বয়ানের ভঙ্গির কারনে। পরিনত হয়েছে পপ কালচারের অবিচ্ছেদ্য অংশে। ফেসবুকে দোজখনামা নামে পেইজও আছে কিছু। তারা শুধু এই বইটা নিয়ে নয়, বইয়ের মূলভাবকে ধারন করে নানা নান্দনিক বিষয়াদি নিয়ে লেখা, ছবি ও ভিডিও শেয়ার করে। কিছুদিন আগে পড়ে শেষ করা এই উপন্যাস নিয়ে দু'কলম লেখার প্রয়াস নিচ্ছি এখানে।
.
বিষয়বস্তু হিসেবে দোজখনামা নতুন কিছু না হলেও, যে ঢং ও ভঙ্গিতে এ উপন্যাসের বয়ন ও বয়ান, তা নিঃসন্দেহে নতুন, এবং উচ্চাভিলাষী। রবিশংকর বল এমন দু'জন মানুষকে বেছে নিয়েছেন এই উপন্যাসের মুখ্য কথক হিসেবে তারা দু'জনেই শিল্পী হিসেবে আমাদের উপমহাদেশে খুবই নামকরা, আমাদের হৃদয়ের কাছাকাছি। উপন্যাসটি পড়তে গিয়ে আমার প্রাথমিক যে সমস্যা হচ্ছিল, তা হচ্ছে - নামের সূত্রে ঐ দুই শিল্পীই মুসলিম, এবং ভারতের বর্তমান রুলিং গভর্নমেন্টের আমলে সংস্কৃতির অঙ্গনে যেভাবে সফট পাওয়ারের খেল খেলা হচ্ছে মুঘল সংস্কৃতি, গুরুত্বপূর্ণ ভারতীয় মুসলিমদের চরিত্রহননে, যে ভেতরে ভেতরে সন্দেহ কাজ করতেই থাকে, এই উপন্যাসের লেখকের ভেতরেও একই টেন্ডন্সি কাজ করেছে কি না। উপন্যাসে মাঝে মাঝে এধরনের কিছু ইঙ্গিত, আমার কলুষিত মন খুঁজে পেলেও, উপন্যাসের শেষ দিকে এসে যখন ব্রিটিশদের আক্রমনে দিল্লি উজাড় হওয়ার ঘটনা উপন্যাসিক বর্ণনা করেন, তার আফটারম্যাথ বর্ণনা করেন, মির্জা গালিব বা সাদাত হুসাইন মান্টোর কষ্টের কথা তুলে ধরেন - তখন রবিশংকর বলকে সাম্প্রদায়িক কলুষ মুক্ত লেখকই মনে হয়। এছাড়াও উর্দু বা ফার্সি ভাষার কাব্যিকতাকে যেভাবে তিনি বাংলা ভাষায় তুলে আনার চেষ্টা করেছেন, তাও প্রশংসনীয়।
.
এবারে কিছু ক্রিটিক্যাল অব্জারভেশন শেয়ার করা যাক।
.
উপন্যাসটিতে অদ্ভুত এক সমস্যা, যা লেখকের উর্দু ভাষার পুরো আন্ডারস্ট্যান্ডিংকেই প্রশ্নবিদ্ধ করে, তা হচ্ছে - আশেক আর মাশুক - এই দুই শব্দের ভুল ব্যবহারে। মির্জা গালিবের 'মাশুক', বাংলা করলে যার অর্থ হবে 'প্রেমাস্পদ' , যার প্রেমে গালিব দিশেহারা মাতোয়ালি, যাকে তিনি ফলকআরা নাম দিয়েছিলেন, সেই মহিলাকে বার বার তিনি গালিবের মুখ দিয়ে তার "আশেক" উল্লেখ করান। শব্দটা আশেক হবে না, মাশুক হবে। মাশুক মানে যাকে ভালোবাসা হয়, আর আশেক মানে যে ভালবাসে। যেমন, লায়লা - মজনুর সম্পর্কে মজনু হচ্ছে প্রেমিক, বা আশেক, আর লায়লা হচ্ছে প্রেমাস্পদ, বা মাশুক। কাজেই দোজখনামায় 'আশেক' ফলক আরা নন, 'আশেক' হচ্ছেন গালিব, 'ফলক আরা' তার মাশুক। যাকে তিনি কামনা করেন। এই একই ভুল ঔপন্যাসিক পরে আরও এক জায়গায় করেছেন। আশেক - মাশুক এই সাধারনতম দুটি উর্দু শব্দের তফাৎ না বুঝলে পুরো উপন্যাসে যত উর্দু শের আশারের অনুবাদ আছে - তার সবই প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়ে।
.
দ্বিতীয়ত, আমার কাছে মির্জা গালিব আর সাদাত হুসাইন মান্টোর সম্পর্ককে যেভাবে এই উপন্যাসে উপস্থাপন করা হয়েছে, তা সমস্যাশঙ্কুল লেগেছে। লম্বা লম্বা সলিলকি, বা স্বগতোক্তির মাধ্যমে এক এক অধ্যায়ে এই দুই ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্বের জীবন কাহিনী বর্ণনা করাটা ক্রিয়েটিভ এনডেভর হিসেবে দুর্বলতার পরিচায়ক। ম্যাচিওর পাঠকের জন্যেও বিরক্তির উদ্রেককারী। এটা ছাড়াও, মির্জা গালিবকে যেমন সাদাত হুসাইন মান্টোর, প্রায় দোস্ত আহবাব হিসেবে এই উপন্যাসে উপস্থাপন করা হয়েছে, আমার তা হজম করতে কষ্ট হয়েছে। মান্টো নিশ্চয়ই বড় গল্প কথক, তার জীবনীতে অনেক সিনেমেটিক উপাদান মজুদ আছে, কিন্তু নিজেকে "খসরু এ সানি" মনে করা মির্জা গালিবের সমানে সমানে তাকে উপস্থাপন করা, বা গালিব যখন মান্টোকে উদ্ধৃত করে কথা বলছেন, তখন সে আলাপ প্রায় দুই দোস্তের মধ্যে আলাপের মতো করে উপস্থাপন করা, আমার বিবেচনায় এই দুই হাস্তির মর্যাদার তফাৎ বুঝতে ঔপন্যাসিকের ব্যার্থতা।
.
তৃতীয়ত, মির্জা গালিবের আলাপে দিল্লি বা লখনউ যেভাবে প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠার কথা, উপন্যাসে লেখক, গালিবকে কাশি - কোলকাতা ভ্রমণ করিয়ে এই দুই শহরকে লখনউএর চেয়েও বেশি প্রাসঙ্গিক ও গুরুত্বপূর্ণ করে তুলেছেন, গালিবের জীবনে। গালিব ব্রিটিশ সরকারের কাছ থেকে প্রাপ্য বৃত্তির টাকা তুলতে দিল্লি থেকে কোলকাতা সফর করে আসেন। পথিমধ্যে বানারস - কাশিও তিনি সফর করেন। এই বানারস - কাশি কিংবা কোলকাতার যে আবেগঘন বয়ান রবিশঙ্কর বল মির্জা গালিবের মুখ দিয়ে বের করেন তার উপন্যাসে, প্রশ্ন জাগে, এই আবেগের কতোটুকু গালিবের নিজের, আর কতটুকু ঔপন্যাসিকের। মুঘল সালতানাতের সঙ্গে সম্পর্কিত অন্যান্য শহর, যেমন লখনউ সফর করেন গালিব, এই উপন্যাসে। কিন্তু লখনউ শহরের বর্ণনা তার চে' অনেক ম্যাড়ম্যাড়ে। গালিবের চিত্ত উন্মাতাল হয়ে ওঠার কথা, লখনউ শহরের সৌন্দর্য, তার বাতাসে ভেসে বেড়ানো শের আশার - মুশায়রায়। কিন্তু শহরের সেই সিনিক বর্ণনা নেই এই উপন্যাসে। কারন হয়তো এটাই যে, ঔপন্যাসিক নিজে কাশি বারানসি নিজে চোখে দেখেছেন, তার সঙ্গে আধ্যাত্মিকভাবে যুক্ত ছিলেন, আর কোলকাতা তো তার নিজের শহর। কাজেই এই শহরগুলির বর্ণনা যতটা স্বতঃস্ফূর্তভাবে তার লেখায় আসবে, লখনউএর বর্ণনা সেভাবে আসবে না।
.
চতুর্থত, গালিবের মুশায়ারায় অংশ নেয়ার দৃশ্যগুলো আরও নাটকীয় হতে পারত। মুশায়ারা হচ্ছে কবিদের আসর, যেখানে কবিরা লেখা কবিতা, বা মুখে মুখে কবিতা বানিয়ে একে অপরের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হতেন। অসম্ভব রকমের উত্তেজনা, এবং নাটকীয়তায় ভর্তি এই মুশায়ারায় তিনি গালিবকে উপস্থিত করেন। কিন্তু তার বর্ণনায় সেই প্রাণোচ্ছলতা, নাটকীয়তার কিছুই উপস্থিত নেই।
.
পঞ্চমত, যদিও ঔপন্যাসিক এটা উল্লেখ করতে ভোলেননি যে, মির্জা গালিবের বাবা ছিলেন তুর্কি বংশোদ্ভূত, এবং সৈনিক, কিন্তু আবেগের বসে তিনি মির্জা সাহেবের 'ঘর ওয়াপসি' করায়ে ফেলেন তার উপন্যাসে। কাশিতে থাকা অবস্থায় মির্জা গালিবের ইচ্ছে হয় তার মুসলমানি মুখোশ খুলে ছুঁড়ে ফেলে দিতে। উপন্যাসের পাতা থেকেই তুলে দিচ্ছি -
.
"ইলাহাবাদকে আমি একদম সহ্য করতে পারি নি, মান্টোভাই। একেবারে লাওয়ারিশ শহর, কোনও তমদ্দুন নেই। কাশীতে পৌঁছে বুক ভরে শ্বাস নিতে পারলুম। এ এক আশ্চর্য আলোর শহর। মনে হল, এই রকম এক শহরেই আমি এতদিন পৌছাতে চেয়েছি। ... জীবনে যে একবার কাশী দেখে নি, আমি মনে করি, তার এখনও জন্মই হয় নি। ... কাশীই এই দুনিয়াটা।
.
মধ্যরাত অবধি আমি মণিকর্ণিকার ঘাটে বসে থাকতুম, একের পর এক জলন্ত চিটার লেলিহান শিখা দেখতুম, আর মনে হত, আবার যদি এক জন্ম পাই, তবে যেন আমার শরীর এমন চিতাতেই পোড়ানো হয়, আমি যেন অন্তরীক্ষে মিশে যেতে পারি। ... মনিকর্ণিকার চিতার আগুন আমার সব কামনা - বাসনাকে পুড়িয়ে দিচ্ছিল; আর সেই ছাইয়ের ওপর অদ্রুশ্য থেকে কারা যেন ছিটিয়ে দিচ্ছিল পবিত্র গঙ্গার জল। ভাবতুম ইসলামের খোলসটাও ছুঁড়ে ফেলে দেবো, কপালে তিলক কেটে হাতে জপমালা নিয়ে গন্তার তীরে বসেই বাকি জীবনটা কাটিয়ে দেবো, আমার অস্তিত্ব যেন একেবারে মুছে যায়, একবিন্দু জলের মতো যেন হারিয়ে যেতে পারি দেবী গঙ্গার স্রোতধারায়।" (পৃষ্ঠা ১৭৩, ১৭৪, ১৮৬)
.
একজন সনাতন ধর্মের ভক্ত অনুরক্ত অনুসারী মানুষের স্বাভাবিক স্বতঃস্ফূর্ত আবেগ, কাশী বা বেনারসের ব্যাপারে - এমনটা হওয়া স্বাভাবিক। কিন্তু মুঘল দরবারের সর্বশেষ সভাকবি, যার শরীরে তুর্কি রক্তের স্রোত প্রবাহিত - তার মুখ দিয়ে উপন্যাসে এই কথা বলানো, যে তিনি ইসলামের খোলস ছুঁড়ে ফেলে দিতে চান, কপালে তিলক লাগিয়ে হাতে জপমালা নিয়ে দেবী গঙ্গার তীরে বসে বাকি জীবন কাটিয়ে দিয়ে মৃত্যুর পর চিতায় ভস্ম হতে চান - এটা একজন লেখকের তরফে অপরাধ। মির্জা গালিবের এহেন বক্তব্যের ঐতিহাসিক কি ভিত্তি ঔপন্যাসিক রবিশঙ্কর বলের আছে, আমার জানা নেই। কিন্তু মির্জা গালিব, যিনি নিজেকে আধ মুসলিম দাবী করতেন, দিল্লির আসেপাশে খাজা মইনুদ্দিন চিশতী, নিজামুদ্দিন আউলিয়া সহ আরও অসংখ্য পীর বুজুর্গের মাজার যার ভেতরে বিশেষ কোন দ্যোতনা তৈরি করতে পারে নি (নাকি পেরেছিল, কিন্তু রবিশঙ্কর তা এড়িয়ে গেছেন ?), তিনি হঠাৎ গঙ্গার তীর, আর কাশীর মণিকর্ণিকার ঘাট দেখে হঠাৎ ধার্মিক হয়ে যাবেন, তাও এমন এক ধর্মের প্রতি, যার সঙ্গে তার তুর্কি অরিজিনের দূর দুরান্তে কোন সম্পর্ক নেই?
.
যা হোক , আমার গালিবের এ বক্তব্য বিশ্বাসযোগ্য মনে হয় নি, কারন শাইখুল হিন্দ মাওলানা মাহমুদ হাসান দেওবন্দি গালিবের কবিতার বড় ভক্ত ছিলেন। যদি গালিবের মধ্যে এরকম দোআঁশলা টেন্ডেন্সি থাকতো, শাইখুল হিন্দ গালিবের কবিতাকে আপন করে নিতেন না। হুসাইন আহমদ মাদানি রহঃ এর আত্মজৈবনিক - নকশে হায়াতে এটা জানা যায়। এটা রবিশংকর বলের তরফ থেকে গালিবের মুখে বসিয়ে দেয়া বক্তব্য।
.
ষষ্ঠত, এই উপন্যাসে অসম্ভব কাব্যিক কিছু পংক্তি এবং অন্তর্ভেদী ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ আছে। পড়ে রবিশংকর বলের লেখনীর শক্তির ব্যাপারে আপনার অপরিসীম শ্রদ্ধা জেগে উঠবে। যেমন, একটা মেটাফর উল্লেখ করি। মির্জা গালিব, অথবা মান্টোর মুখ দিয়ে তিনি মানব মানবীর প্রেম আর ঈশ্বর প্রেমের মধ্যে একটা অদ্ভুত সম্পর্ক রচনা করেন। তিনি বলেন, 'এশকে মাজাজ' , বা পার্থিব প্রেম হচ্ছে 'এশকে হাকিকি' বা স্রষ্টার সঙ্গে প্রেমের একটা ছায়া। যদি আর একটু ব্যাখ্যা করে বলি, প্লেটোর ওয়ার্ল্ড অফ আইডিয়ায় যেমন সমস্ত বস্তুর একটা আদর্শিক ফর্ম লুক্কায়িত থাকে, এশকে হাকিকি, বা খোদায়ি ভালোবাসা হচ্ছে সেই আইডিয়াল ফর্ম। তারই ইম্পারফেক্ট ফর্ম, বা ছায়া হচ্ছে দুনিয়ার প্রেম, বা এশকে মাজাজ। এশকে মাজাজের রাস্তা ধরেই মানুষ ভালবাসতে শেখে, এবং এশকে মাজাজই মানুষকে একসময় অনুভব করায় পার্থিব ভালোবাসার অসম্পূর্ণতা। তারপর তা মানুষকে ধাবিত করে এশকে হাকিকি, বা খোদার প্রেমের দিকে।
.
কি অসাধারন এক ব্যাখ্যা!
.
কিন্তু, কপাল কুঁচকে আসে যখন এই অনুচ্ছেদটা পড়ি।
.
"কয়েকটা শব্দ, কিছু মুহূর্তকে কাটাছেঁড়া করে; এরা কারা জানেন, মির্জা সাব? পাণ্ডুলিপি, ভাষ্য, টীকা, কালি আর কলমের পর বসে থাকে সিংহাসনে - কবি নয় - অজর, অক্ষর অধ্যাপক - দাঁত নেই - চোখে তার অক্ষম পিঁচুটি; বেতন হাজার টাকা মাসে - আর হাজার দেড়েক পাওয়া যায় মৃত সব কবিদের মাংশ কৃমি খুঁটি" (৩১৮)
.
এই অনুচ্ছেদের প্রায় পুরোটা, জীবনানন্দ দাসের সমারূঢ় কবিতা থেকে ধার করা -
.
"বরং নিজেই তুমি লেখোনাকো একটি কবিতা—’
বলিলাম ম্লান হেসে; ছায়াপিণ্ড দিলো না উত্তর;
বুঝিলাম সে তো কবি নয়— সে যে আরূঢ় ভণিতা:
পাণ্ডুলিপি, ভাষ্য, টীকা, কালি আর কলমের ’পর
ব’সে আছে সিংহাসনে— কবি নয়— অজর, অক্ষর
অধ্যাপক; দাঁত নেই— চোখে তার অক্ষম পিঁচুটি;
বেতন হাজার টাকা মাসে— আর হাজার দেড়েক
পাওয়া যায় মৃত সব কবিদের মাংস কৃমি খুঁটি;"
.
অর্থাৎ , ঔপন্যাসিক দেদারসে মীর তকি মীর, জামি, রুমি, গালিবের লেখা থেকে জীবন, রাজনীতি, কাব্য ও কবিতা, মানবীয় প্রেম, ঐশ্বরিক প্রেম ইত্যাদি সম্বন্ধে ভাব ধার করেছেন। এক্ষেত্রে তিনি স্রেফ অনুবাদক, সৃজনশীল সত্ত্বা নন। জীবনানন্দ দাসের নাম কোনভাবে উল্লেখ না করে, সমালোচকদের সমালোচনা করতে গিয়ে তিনি যে পুরো সমারূঢ় কবিতাটি প্রায় অক্ষরে অক্ষরে মেরে দিয়েছেন, এটা কুম্ভিলকবৃত্তি।

.
উপন্যাসে লেখকের সঙ্গে 'তবসুম' নাম্নী এক রমণীর উর্দু শেখার ছলে পরিচয় হয়, ওনার সঙ্গে লেখকের সম্পর্কটা উপন্যাসের শেষে কোন ইঙ্গিত, বা কোন পূর্ণতা ছাড়া দুম করে শেষ হয়ে যায়। লেখক উপন্যাসের শুরুতে নিজেই ঘোষণা দেন - "এরপর আপনারা যা পড়বেন, তা মির্জা গালিবকে নিয়ে মান্টোর উপন্যাসের অনুবাদ। মাঝে মাঝে আমি ও তবসুম ফিরে আসতেও পারি।" (১৮) সত্য কথা হচ্ছে, এই আসতে পারা না পারার দোদুল্যমানতার মধ্যেই সম্পর্কটি শেষ হয়েছে। তবসুমের আলটিমেটলি কি হয়, আমরা জানতেও পারি না।
.
উল্টোপাল্টা বাংলা বানানে উর্দু আর ফার্সি শের আশার লেখার কারনে কবিতাগুলোর মূল সৌন্দর্য ব্যাপকভাবে নষ্ট হয়েছে এই উপন্যাসে। তবুও কবিতার আধিক্য, প্রতিটি অধ্যায় একটি শের দিয়ে শুরু করা উপন্যাসটিকে বিশেষত্ব দেয়।
.
শেষমেশ উপন্যাসটিকে সাম্প্রদায়িকতা দোষে দুষ্ট বলা যায় না এই কারনে যে, সিপাহী বিদ্রোহ পরবর্তী দিল্লী, বা দেশভাগ পরবর্তী ভারত - পাকিস্তানের হাল বর্ণনায় রবিশঙ্কর বল কঠোরভাবে নিরপেক্ষ থেকেছেন। এ জন্যে তাকে সাধুবাদ। অনেক পড়াশোনা এবং বিষয়ভিত্তিক গবেষণার মাধ্যমে তাকে এ উপন্যাসটি লিখতে হয়েছে। তার ফলে যে প্রশংসা তিনি পাচ্ছেন, তা তার প্রাপ্য।

মন্তব্য ১ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (১) মন্তব্য লিখুন

১| ২৪ শে জুন, ২০২২ সন্ধ্যা ৬:৩৯

নূর মোহাম্মদ নূরু বলেছেন:
সুন্দর রিভ্যু!
ভালো লেগেছে।
ধন্যবাদ আপনাকে।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.