নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

সাজিদ উল হক আবির

সাধু সাবধান ! ব্লগের মালিক বঙ্গালা সাহিত্যকে ধরিয়া বিশাল মাপের ঝাঁকি দিতে নিজেকে শারীরিক ও মানসিক ভাবে প্রস্তুত করিতেছেন। সেই মর্মে তিনি এখন কিটো ডায়েটিং, ডন-বৈঠক ও ভারোত্তলন প্রশিক্ষণে ব্যস্ত। প্রকাশিত গ্রন্থঃ১। শেষ বসন্তের গল্প । (২০১৪)২। মিসিং পারসন - প্যাত্রিক মোদিয়ানো, ২০১৪ সাহিত্যে নোবেল বিজয়ী (অনুবাদ, ২০১৫) ৩। আয়াজ আলীর ডানা (গল্পগ্রন্থ - ২০১৬ ৪। কোমা ও অন্যান্য গল্প(গল্প গ্রন্থ, ২০১৮) ৫। হেমন্তের মর্সিয়া (কবিতা, ২০১৮) ৬। কাঁচের দেয়াল (গল্পগ্রন্থ, ২০১৯) ৭।শহরনামা (উপন্যাস, মাওলা ব্রাদার্স, ২০২২), ৮। মুরাকামির শেহেরজাদ ও অন্যান্য গল্প (অনুবাদ, ২০২৩), ৯। নির্বাচিত দেবদূত(গল্পগ্রন্থ, ২০২৪), ১০। দেওয়ানেগির চল্লিশ কানুন/ফরটি রুলস অফ লাভ (অনুবাদ, ঐতিহ্য, ২০২৪)

সাজিদ উল হক আবির › বিস্তারিত পোস্টঃ

শনিবারের চিঠি ১২ - খুন হওয়া ঘুম উপন্যাস পাঠের পরবর্তী ইতিবৃত্ত

১৭ ই এপ্রিল, ২০২২ সন্ধ্যা ৬:১৭



.
১।
কথাসাহিত্যিক সালাহ উদ্দিন শুভ্রের 'খুন হওয়া ঘুম' উপন্যাসটি বইমেলা ২০২২ এ আমার সংগ্রহকৃত উপন্যাসগুলির একটি। ঔপন্যাসিকের সঙ্গে সোশ্যাল মিডিয়ার সূত্রে কিছু প্রাক পরিচিতি ছিল, তাই তার লেখার সঙ্গে পরিচিত হবার আগ্রহ থেকে তার এ নতুন উপন্যাস সংগ্রহ, এবং পাঠ। পড়েছি, তাও প্রায় এক মাস আগে। নোট না রাখার কারনে উপন্যাসটির ভেতরের অনেক ডিটেইলও ভুলে গেছি। আজ বেশ অনেক দিন পর বইটির পাতা উল্টাতে উল্টাতে যা কিছু মনে পড়ছে, তা একটানে লিখে যাচ্ছি। একে প্রচলিত অর্থে পাঠ প্রতিক্রিয়া বলা উচিৎ হবে না। কারন, আমি বইটি সম্পর্কে যে সব মন্তব্য করবো, তা অধিকাংশই আমার স্মৃতি থেকে। পঙক্তি ধরে ধরে মন্তব্য করা সম্ভব হবে না।
.
'খুন হওয়া ঘুম' উপন্যাসের সারসংক্ষেপ বইয়ের বাম ফ্ল্যাপ থেকে তুলে দিই, যাতে করে এই রিভিউর মাধ্যমে প্রথম পরিচিতি যাদের হচ্ছে উপন্যাসটির সঙ্গে, তারা মোটের উপর একটা আইডিয়া পান উপন্যাসটির বিষয়বস্তু সম্পর্কে।
.
ফ্ল্যাপে লেখা আছে -
.
'থ্রিলার ধাঁচের উপন্যাস "খুন হওয়া ঘুম" ।
.
চাকরি না থাকলে ঢাকা শহরে টেকা সম্ভব না এমন নাগরিকদের একজন মনছুর। বেতন বাড়ে না, ছুটি পায় না, প্রোমোশন হয় না তার। শত চেষ্টায়ও জীবনটাকে একটু উন্নত করতে পারে না। ক্রমাগত বঞ্চিত আর অপমানিত মনছুর তাই ভাবল বিদ্রোহ করবে। নিজে এক গরিবি জীবন যাপন করলেও তার ম্যানেজার শমসের রাত হলে মেতে থাকে মদ আর নারী নিয়ে। এটা কিছুতে মানতে পারে না সে। পুরাতন প্রেমিকা রোজি ও তাকে প্রলুব্ধ করে নিজের স্বার্থে। কিন্তু কার সঙ্গে লড়বে মনছুর, কোথায় থাকে তারা - এর কিছু না জেনে অন্ধকারে হাতড়ে বেড়ায়। কেঁচো খুড়তে তার সানে বেরিয়ে আসে সাপ। যাকে তার বন্ধু মনে হয়, পেছনে সেও আসলে শত্রু। বুঝতে পারে এক্ত চক্রের হাতে জিম্মি সে আর তার প্রেমিকা লায়লা।
.
প্রেম, যৌনতা, পারিবারিক সম্পর্ক, সংঘাত, গুম, খুন, ব্যক্তির বিষণ্ণতা, অনুভূতি, অসহায়ত্ব আর একা একা লড়ে যাওয়ার মর্মস্পর্শী কাহিনী নিয়ে তৈরি নির্বান্ধব, নিষ্ঠুর এ সময়ের উপন্যাস 'খুন হওয়া ঘুম' শুরুর পর শেষ না করে ওঠা যায় না।
.
পড়া শেষে পাঠক পড়ে যায় অস্তিত্ব সংকটে।'
.
২।
.
খুন হওয়া ঘুম উপন্যাস দাঁড়িয়ে আছে মুখ্যত ঢাকা শহরের কর্পোরেট সেক্টরের পিপীলিকা সদৃশ মানুষজনের জীবনযাপনের রকমফেরের ওপর ভিত্তি করে। যেমন, উপন্যাসের একদম শুরুর প্যারাটা যদি বিবেচনা করি -
"মনছুরের ঘুম ভাঙলো সকাল দশটায়। গত চার বছরে একদিনের জন্যও এত সকাল পর্যন্ত সে ঘুমিয়ে থাকে নাই। এক নিষ্ঠাবান কেরানির মতো বরাবর সে সময়মত ঘুম থেকে উঠেছে। ঘুমের কছে কখনো পরাস্ত হয় নাই। যত ক্লান্তি থাকুক, ঘুমে ভেঙ্গে পড়তে চায় শরীর যদিও, তবু ঘড়ির কাঁটার মতো সিধা হয়ে অফিসে গেছে। এমনকি ছুটির দিনগুলোতেও অভ্যাসবশত তার সকাল সাতটাতেই ঘুম ভেঙ্গে যায়। অথচ অফিস খোলার দিনে দেরি করে ঘুম থেকে উঠলো সে।"
.
এই শুরুর প্যারায়, মনছুরের দেরিতে ঘুম থেকে ওঠার মধ্য দিয়ে যে ঘটনার ঘনঘটা শুরু হয় এ উপন্যাসে, ডমিনো এফেক্টের মতো এর সূত্র ধরেই একের পর এক ঘটন দুর্ঘটনের মধ্য দিয়ে উপন্যাস সমাপ্তির দিকে এগোয়। উপন্যাসের প্লট ছড়িয়ে পড়ে মনছুরের বাসা থেকে বাড়ির পাশের ডিসপেন্সারিতে - যেখানে সে ডাক্তারের কাছ থেকে অসুস্থতার নকল সার্টিফিকেট তোলে, মনছুরের অফিসে - যে জায়গাটা আসলে পুরো উপন্যাসের কেন্দ্রবিন্দু, এবং এছাড়াও অনান্য নানা রেস্টুরেন্টে - যেখানে বসে উপন্যাসের প্রেক্ষাপটে গুরুত্বপূর্ণ একের পর এক মিটিং হতে থাকে। উপন্যাসের একদম শেষে মনছুরের ভাগ্য নির্ধারিত হয় ঢাকা থেকে অনেক অনেক দূরে, জনমানবহীন এক চরে, চর আড়ালিয়ায়। অফিসে লাঞ্ছনার, বঞ্চনার শিকার পিপীলিকাসম মানুষদের প্রতিনিধি মনছুর, যে কিনা বিদ্রোহ করে বসে একদিন, না জেনে, না বুঝে, যে - তার প্রতিপক্ষ আসলে কতো বিরাট, কতো শক্তিশালী, সে মনছুর কি বেঁচে যায়, সেই চরে গিয়ে? নাকি চূড়ান্ত পরিণতি বরন করে নিতে হয় তাকেও? পাঠককে তা আবিষ্কার করে নিতে হবে।
.
৩।
.
উপন্যাসের ঘটনাপ্রবাহে দারুণ গতিশীলতা এ উপন্যাসের এক উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য। মনছুর অসুস্থতার কারন দেখিয়ে অফিস থেকে দু'দিন ছুটি নেয়, এবং তার কর্পোরেট হাউজ বা তার বস শমসের তাকে ছুটি মনজুর করার বদলে প্রথমে ওএসডি, এবং পরবর্তীতে চাকুরি থেকে ছাঁটাই করবার পদক্ষেপ নেয়। এটা আঁচ করতে পেরে মনছুর তার বস শমসেরের অফিসের গোপন কুঠুরিতে নারী এবং মদ নিয়ে নৈশ উৎযাপনের ঘটনা ফাঁস করে দিয়ে তার বসের ওপর শোধ তুলবার চেষ্টা করে। পরিকল্পনায় সে ব্যারথ হয়, এবং শমসের মনছুরকে জানে মারার পাল্টা পদক্ষেপ গ্রহণ করে। এইসব গুটি এবং পাল্টা গুটি চালার ফাঁকে ফোঁকরে মনছুরের সঙ্গে পরিচয় হয় সমব্যথী, হামদরদ, 'মরিচা জবার মতো টকটকে' লায়লার। মনছুরের প্রাক্তন প্রেমিকা রোজিও পুনরায় এসে যুক্ত হয় উপন্যাসে, নিজস্ব কিছু এজেন্ডা নিয়ে। যে জামশেদ একদা মনছুরকে চাকুরি দিয়ে ঢাকা শহরে কিছু একটা আঁকড়ে ধরে বাঁচবার অবলম্বন দিয়েছিল, সেই জামশেদই মনছুরকে তরফদার গ্রুপের তরফ থেকে মারার প্ল্যান করা হলে হাত গুটিয়ে বসে থাকে। মধ্যখান থেকে আমরা জানতে পারি ধনকুবের তরফদার গ্রুপের ছেলে সিমরানের সংস্পর্শে থাকা তরুণী শিমুর নিখোঁজ হয়ে যাওয়ার ঘটনা। এই সবকিছু অলমোস্ট সাঁই সাঁই করে ঘটতে থাকে, কেবল সে অংশগুলো বাদে, যেখানে, চৈতন্যপ্রবাহ রীতিতে উপন্যাসের চরিত্রগুলি নিজেদের অতীতের মানসভ্রমণে ব্যস্ত থাকে। আমরা পরিচিত হই তাদের জীবনের অন্ধকার গলিঘুঁজির সঙ্গে।
.
৪।
উপন্যাসটির অন্যতম শক্তিশালী দিক হচ্ছে চরিত্রের নির্মিতি।
প্রধান চরিত্র কে বা কারা? মনছুর, মনছুরের প্রেমিকা লায়লা, মনছুরের সরাসরি বস শমসের - এই তো, মোটামুটি। দ্বিতীয় ক্যাটাগরির গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রের গ্রুপে পড়বে হয়তো - মনছুরের প্রাক্তন প্রেমিকা এবং বর্তমানে মনছুরের অফিসের ব্যবসায়িক রাইভাল গ্রুপের সদস্য রোজি, জামশেদ - যার উসিলায় মনছুরের চাকরির বন্দোবস্ত হয়, রোমানা - মনছুরের বস শমসেরের রাতের উৎযাপনের অংশী সিনেমার প্রাক্তন সাইড নায়িকা। আরও আছে কিছু অপেক্ষাকৃত কম গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র, যেমন - মনছুরের মহল্লার ডঃ ফয়সালের কম্পাউন্ডার হালিম, অথবা জহির ভাই - যার বাসায় একরাতের জন্যে স্বামী স্ত্রীর পরিচয়ে আশ্রয় নেয় মনছুর এবং লায়লা।
.
অনেকগুলো নাম একসঙ্গে বলে গেলাম। একসঙ্গে এতো নাম মনে রাখাও মুশকিল। উপন্যাস পড়া না থাকলে হয়তো এভাবে ধেয়ে আসা নামের বাহার বিরক্তিও উৎপাদন করতে পারে। কিন্তু, বিষয় হচ্ছে, মুখ্য চরিত্রগুলি থেকে শুরু করে অপেক্ষাকৃত গৌণ, এমনকি একদম গৌণ চরিত্রগুলিও যে যত্নের সঙ্গে লেখক তুলে আনেন নানাবিধ খুঁটিনাটি ডিটেইলসের সঙ্গে - এই ব্যাপারটা উপন্যাসটাকে বিশেষায়িত করে। কোন চরিত্রই জাস্ট রাখবার জন্যে রাখা নয়, বরং খুব ছোট একটু অংশে কারো উপস্থিতি দেখা গেলেও, উপন্যাসের আঁটসাঁট কাঠামো ধরে রাখার জন্যে সে চরিত্রটিও হয়তো দুটো ইট আর একটু সুরকির জোগান দেয়ার মতো কাজ করে।
একই সঙ্গে আমরা জানতে পারি প্রত্যেকের হয়ে ওঠার গল্প। ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থী থেকে মনছুর কীভাবে এসে আটকা পড়ে এক কর্পোরেট অফিসের আইটি সেক্টরে, অপরদিকে তার প্রাক্তন প্রেমিকা রোজি কীভাবে তার মেধা এবং যৌবনকে পুঁজি করে কর্পোরেট জগতের মই হুরমুরিয়ে ডিঙ্গিয়ে চলে, মনছুরের বস শমসের কীভাবে তরফদার গ্রুপের ডানহাত হয়ে ওঠে, লায়লার পরম সুন্দরী বান্ধবী শিমু কীভাবে তরফদার গ্রুপের মালিকের ছেলে সিমরানের সঙ্গী হয়, সঙ্গী থেকে সজ্জাসঙ্গী হয়, এবং সঙ্গোপনে গুম হয়ে যায়, একদা নায়িকা খ্যাতির প্রত্যাশী রোমানা কীভাবে হাই সোসাইটি কলগার্ল হয়ে নিজের যৌবনের শেষ দিনগুলি গুজরান করে - এসবই অনেক অনেক ডিটেইলিং এর মধ্য দিয়ে ফুটিয়ে তুলেছেন লেখক। শুধু তাই নয়, সমাজের প্রচলিত মূল্যবোধ - নীতিনৈতিকতার পরাকাষ্ঠা কীভাবে তাদের একবার ডুবায়, একবার ভাসায় - আর এই হাবুডুবু খেতে খেতেই কীভাবে তারা এক নষ্ট পচা হাজামজা সমাজ নামক পচা ডোবার ঝানু সাতারু হয়ে ওঠে, তা আমরা পাঠক হিসেবে উপলব্ধি করতে পারি সহজে। চরিত্রের মানসের কাটাছেঁড়া, নিজেদের সঙ্গে নিজেদের বোঝাপড়া, সমাজের গড়পড়তা যে মূল্যবোধের স্রোতে ভেসে পড়বে, না কি উজান ঠেলে বিপরীত মুখে সাঁতার কাটবে, এ নিয়ে চরিত্রসমূহের মাঝে অঙ্কিত এ দোটানা আমাদের দস্তয়েফস্কির উপন্যাসের চরিত্রগুলির আত্মিক সংকটের কথাও স্মরণ করায়।
.
তো, সামারি করলে, এ উপন্যাসে চরিত্রের নির্মিতি এতটাই রিয়েলিস্টিক , যে, ক্ষেত্র বিশেষে মনে হয় লেখক কেইস স্টাডি করে লিখছেন একেকজনের জীবনের ওপর।
.
৫।
উপন্যাসটিতে ভাষার ব্যবহারে শান্তি নিকেতনি বাংলাকে কেবলা মানা হয় নি। মেট্রোপলিটন সিটি ঢাকা শহরের বাসিন্দাদের মুখের ভাষা যেমন বাংলা - ইংরেজি মেশানো পাঁচমেশালি খিচুড়ি, ঔপন্যাসিক তার উপন্যাসেও চরিত্রসমূহের মুখের সংলাপে, তাদের চিন্তায়, এবং অমনিসেন্ট ন্যারেটরের ভূমিকায়ও ভাষা বাংলা ইংরেজি মিশ্রিতই রেখেছেন।
.
তবে, উল্লেখ্য যে, সংলাপে নয়, বরং বর্ণনায়, এবং অনেকটাই চরিত্র সমূহের চিন্তার মধ্য দিয়ে, অনেকটা যেন চৈতন্যপ্রবাহ রীতির অনুবর্তে উপন্যাসের প্লট সামনে আগায়।
.
৬।
যৌনতা থ্রিলারের গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ, যার যথোপযুক্ত ব্যবহার হয়েছে এই উপন্যাসে। উপন্যাসের নারীচরিত্রসমূহের শারিরি বর্ণনায়, চরিত্রসমূহের মধ্যে কটাক্ষপূর্ণ সংলাপ বিনিময়ে, এবং যৌনাচারের বর্ণনায়ও উপন্যাসটি খুবই বোল্ড। আপনি কল্পনাপ্রবন পাঠক হলে উপন্যাসের পাঠের জায়গায় জায়গায় আপনার ইরেকশন হওয়া বিচিত্র নয়। এটাকে যদি লেখকের বর্ণনার গুণ হিসেবে আমরা ধরি, তবে সেক্ষেত্রেও লেখক সফল।
.
উপন্যাসের নারী চরিত্রগুলির উপস্থাপন প্রায়ই উত্তেজক। শুধু তাই নয়, তারা নিজ নিজ যৌনতাকে পুঁজি করেই ব্যক্তিগত এবং পেশাগত জীবনকে সামনে এগিয়ে নিয়ে চলে। যৌনতা নিয়ে ছুৎমার্গহীন এরকম একগুচ্ছ নারী চরিত্রের চিত্রন, একটি উপন্যাসে, আমার পঠনের বাংলাদেশী উপন্যাসে এ মোটামুটি এক নতুন ঘটনা।
.
৭।
তবে সমালোচনার রইলো কি?
.
মূল কথা হচ্ছে, আমি থ্রিলার উপন্যাসের পাঠক নই। বহু বহু বছর পড়া এই আমার একটি থ্রিলার উপন্যাস। লেখক নিজে যদিও উপন্যাসটিকে পুরোদস্তুর থ্রিলার বলতে রাজি নন। ফ্ল্যাপে লেখা আছে, এটি 'থ্রিলার ধাঁচের' উপন্যাস। সে যাই হোক, এই জনরার লেখা আমার বেশী পড়া না থাকায় আমি তুল্যমূল্য বিচার করতে অক্ষম। আমার উপন্যাসে সবচে পছন্দের জনরা হচ্ছে হিস্টোরিক্যাল ফিকশনস, অথবা ফ্যান্টাসি / ম্যাজিক রিয়েলিস্ট জনরা। ড্রামাও আমার পছন্দ। কিন্তু থ্রিলার - ডিটেকটিভ ঘরানা আমার ঠিক পছন্দের না।
.
যাই হোক, মনে হয়েছে যে উপন্যাসের সমাপ্তিতে লেখক আর একটু মুনসিয়ানা দেখাতে পারতেন। উপন্যাসটি যে গতিতে এগোয়, যে ধুন্ধুমার একটা সমাপ্তির কল্পনা আমরা মনে মনে করি, সে হিসেবে মনছুরের চরিত্রের চূড়ান্ত পরিণতিটাকে আমার একটা স্যাটিসফায়িং এন্ড লাগে নি।পাঠক হিসেবে উপন্যাসের সমাপ্তিতে হয়তো আরও বেশী কিছু আমার আকাঙ্ক্ষা ছিল। শুরু থেকে উপন্যাসের সুতো যেভাবে ছাড়তে থাকেন ঔপন্যাসিক, একদম শেষে এসে জোরসে টান দেয়ার বদলে আস্তে আস্তে সুতো গুটিয়ে নেয়ার মতো একটা সমাপ্তিই আমার কাছে মনে হয়েছে উপন্যাসের শেষটা। পড়ার ফাঁকে ফাঁকে হয়তো একটু অ্যাকশন প্যাকড, আরও একটু রক্তাক্ত একটা এন্ডিং কল্পনা করেছিলাম আমি। যদিও লেখক যেভাবে উপন্যাস শেষ করেছেন, এটাই উপন্যাসটির প্রেক্ষাপটে সবচে বাস্তবানুগ সমাপ্তি। চরিত্র হিসেবে এর চে' বেশী, মনছুরের কাছে আমরা কিই বা আশা করতে পারতাম?
.

৮।
উপন্যাসের একদম শেষ দিকে এসে ঔপন্যাসিক মনছুরের তার অফিসের বসের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে প্লটিং এ লিপ্ত হবার যে মূল কারনটা বর্ণনা করেন, এটা পড়ে আমার আপনার মতো যারা কর্পোরেট লাইফে কাজ করছি, আমাদের অনেকের চমকে ওঠার কথা। আমাদের অনেকের জীবনের সঙ্গেই সাযুজ্য আছে বিষয়টির।
.
ঢাকায় মনছুর তার পরিবার নিয়ে বাস করতো গাবতলীতে। গাবতলী থেকে আর একটু ভালো পরিবেশের আশায় মনছুর তার মা আর বোনসহ এসে ওঠে কালশীতে। পরে মনছুর এই কালশী থেকেও বাসা পাল্টে আর একটু ভালো জায়গায় বাসা নিয়ে থাকতে চায়। কিন্তু অফিসের রেভিনিউ ভালো হওয়া সত্যেও গত চারবছর ধরে মনছুরদের কোন ইনক্রিমেন্ট দেয়া হয় না। তবুও মনছুর তার অন্যান্য সহকর্মীদের সঙ্গে মুখ বুজে কাজ করতে থাকে 'সুশৃঙ্খল ফুলকপির ক্ষেতের' মতো কিউবিকলে বসে। তারা কাজ করতে করতে কেউ হাসে না। নীচে যায় না চা পান করতে। ছুটি নিলে চাকরি ছাঁটাই হয়ে যাবে, এই ভয়ে কেউ ছুটিও নেয় না।
.
তারপর, বইয়ের পৃষ্ঠা থেকে -
.
"সবারই তাদের দমবন্ধ হয়ে আসতো ঘাড় গুঁজে কাজ করতে করতে। এতো শৃঙ্খল, বিধিনিষেধ, তো দমিয়ে রাখা নিজেদের - সহ্য হতো না। তারপরেও মনছুর সব ভুলে যেত তার চোখের সামনের জানালাটার দিকে তাকালে। সেখানে একহারা নীল আকাশ, মাঝে মাঝে ঘন মেঘ, বৃষ্টি। এই জানালা দিয়ে তাকালে তার মন ছুটে যায় বাগেরহাট। তার শৈশব, কৈশোর - কিসব দিন পার করে আজ এ কোথায় যেন আটকা পড়েছে! ... গ্রামের পর গ্রাম , মাইলের পর মাইল। জলজ সব ঘের, পারে পারে গাছ, সবুজ, ঘের শুকায়ে গেলে ধানি জমি - কি এক ফল্গুধারা জীবন পার হয়ে এল! বর্ষায় পানিতে ডুবে যেতো গ্রাম। মাছ ধরত, সাপের ভয় পেত। ভলা নদী, সন্ন্যাসীর খাল, চৌখালী নদী - কতো বিশাল এলাকা নিয়ে না বড় হয়েছিল মনছুর। নদীতে দাপিয়েছিল ... ভাবতো শুধু এসব জানালার দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে। সেটাও অফিসের পছন্দ হল না। তাকে সরিয়ে দেয়া হল জানালার সামনে থেকে। ... একদিন তাকে অ্যানমনে তাকিয়ে থাকতে দেখেছিল ম্যানেজার। পরদিনই তার ডেস্ক চেঞ্জ হয়ে গেল।"
.
কর্পোরেট লাইফের জালে আটকা পড়া আমাদের সবার জন্যেই ঐ জানালাটা বড় প্রিয় এক বস্তু। সব অফিসেই ঐ একচিলতে একটা ঘুলঘুলির মতন থাকে, যার দিকে তাকিয়ে আমরা আমাদের বল্গাহীন জীবনের সোনাঝরা সকাল - বিকেল - সন্ধ্যাগুলির কথা ভাবি। সেই স্পেসটুকু কেড়ে নেয়ার ফলে চূড়ান্তভাবে বিদ্রোহী হয়ে ওঠা মনছুর যেন আমাদের সবার মনের ক্ষোভটুকুকে পুঞ্জিভূত করেই উঠে দাঁড়ায় এক একাকী বিশেষ চরিত্র হয়ে।
.
এবং উপন্যাসের একদম শেষ প্যারার সঙ্গে আমরা সহসাই একাত্ম বোধ করি -
.
"জানালার অবকাশ আর চোখের সামনে না থাকাতে, ঘাড় ঘুরিয়ে তানিয়ার মসৃণ গ্রীবা দেখতে না পেয়ে, চুলের আবডালে ওর লুকিয়ে থাকা আধো মুখের হাতছানি বঞ্চিত অফিসটাকে তার মনে হতে লাগলো ছেলেবেলায় শোনা সেই জেল স্কুল। মা যে জেল স্কুলের ভয় তাকে দেখাতেন, যেখানে কোন বাহির নাই, কোন বিশৃঙ্খলা নাই, শুধু নিয়মের বেড়াজাল, শুধু চারদেয়াল। সেখানে সবাই অনাত্মীয় আর নিষ্ঠুর। সে তো শুধু মায়ের ভয় লাগানোর গল্পেই ছিল। কিন্তু বাস্তবের ে জেল স্কুলে কীভাবে আটকা পড়লো সে। এই নিষ্ঠুরালয় চালায় কারা?
.
উপন্যাস পাঠের পর এই শেষ প্রশ্নটি একটা লম্বা সময় ধরে প্রতিধ্বনিত হতে থাকবে আপনার মননে। এখানেই ঔপন্যাসিকের সাফল্য।
.
আমাদের সময়ের ঔপন্যাসিক সালাহ উদ্দিন শুভ্রকে অভিনন্দন, একটি সফল উপন্যাসের জন্ম দেয়ায়।
.
বইটির প্রকাশক বৈভব প্রকাশনী, প্রচ্ছদ ও অলঙ্করণের দায়িত্বে থাকা তৌহিন হাসানকেও সাধুবাদ জানাই। বইটির প্রোডাকশন অসাধারণ ছিল। বইয়ের প্রচ্ছদও বইটির বিষয়বস্তুর প্রতি প্রায় শতভাগের কাছাকাছি সুবিচার করেছে।

মন্তব্য ৪ টি রেটিং +৩/-০

মন্তব্য (৪) মন্তব্য লিখুন

১| ১৭ ই এপ্রিল, ২০২২ রাত ৮:৪৬

পদাতিক চৌধুরি বলেছেন: বড় লেখা ভাইয়া সময় নিয়ে আবার আসছি...

১৯ শে এপ্রিল, ২০২২ রাত ১০:৫৯

সাজিদ উল হক আবির বলেছেন: দুঃখিত ভাই, দেরিতে প্রত্যুত্তর করায়। লেখা না পড়লেও সমস্যা নেই, বইটা পড়ে দেখতে পারেন! : )

২| ১৮ ই এপ্রিল, ২০২২ রাত ২:৪৯

সোহানী বলেছেন: বইটা পড়তে আগ্রহ জাগিয়েছে আপনার এ বৃহৎ লিখা সেটা সত্য কিন্তু আপনার এ কঠিন লিখা বুঝতে আমার দু'বার করে পড়তে হয়েছে প্রতিটা লাইন। ;)

দেখি অনলাইনে পাওয়া যায় কিনা.............

১৯ শে এপ্রিল, ২০২২ রাত ১১:০১

সাজিদ উল হক আবির বলেছেন: সরি আপা, রিপ্লে করতে দেরি হল!

লেখাটা দ্রুত লিখেছি বলে এডিট করে ভাষা আরও মেলো করে আনার সুযোগ পাই নাই। আমার ভাষা কঠিন - এটা আমার জন্যেও বড় মানসিক প্যাঁড়া। চেষ্টায় আছি ভাষা আরও সহজবোধ্য করে আনার।

অনেক শুভকামনা আপনার জন্যে :)

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.