নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
সাধু সাবধান ! ব্লগের মালিক বঙ্গালা সাহিত্যকে ধরিয়া বিশাল মাপের ঝাঁকি দিতে নিজেকে শারীরিক ও মানসিক ভাবে প্রস্তুত করিতেছেন। সেই মর্মে তিনি এখন কিটো ডায়েটিং, ডন-বৈঠক ও ভারোত্তলন প্রশিক্ষণে ব্যস্ত। প্রকাশিত গ্রন্থঃ১। শেষ বসন্তের গল্প । (২০১৪)২। মিসিং পারসন - প্যাত্রিক মোদিয়ানো, ২০১৪ সাহিত্যে নোবেল বিজয়ী (অনুবাদ, ২০১৫) ৩। আয়াজ আলীর ডানা (গল্পগ্রন্থ - ২০১৬ ৪। কোমা ও অন্যান্য গল্প(গল্প গ্রন্থ, ২০১৮) ৫। হেমন্তের মর্সিয়া (কবিতা, ২০১৮) ৬। কাঁচের দেয়াল (গল্পগ্রন্থ, ২০১৯) ৭।শহরনামা (উপন্যাস, মাওলা ব্রাদার্স, ২০২২), ৮। মুরাকামির শেহেরজাদ ও অন্যান্য গল্প (অনুবাদ, ২০২৩), ৯। নির্বাচিত দেবদূত(গল্পগ্রন্থ, ২০২৪), ১০। দেওয়ানেগির চল্লিশ কানুন/ফরটি রুলস অফ লাভ (অনুবাদ, ঐতিহ্য, ২০২৪)
(হারুকি মুরাকামির 'আফটার দা কোয়েক' বইয়ের ভিন্টেজ পাবলিকেশন্সের ইংরেজিতে অনূদিত সংস্করন হতে গল্পটি বাংলায় অনুবাদ ~ সাজিদ উল হক আবির। অনুবাদটি মর্যাদাপূর্ণ বাংলা ট্রিবিউন পত্রিকার সাহিত্য পাতায় গত শুক্রবার প্রকাশিত - view this link
কাতাগিরি অ্যাপার্টমেন্টে ঢুকে দেখল, তাঁর জন্যে দানবাকৃতির এক ব্যাঙ অপেক্ষা করে বসে আছে। পেটা, শক্তপোক্ত শরীর। পেছনের দুটো পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়ালে সে উচ্চতায় ছ' ফিট ছাড়িয়ে যাবে। পাঁচফুট তিন ইঞ্চি উচ্চতার সরু কাতিগিরি হঠাৎ তাঁর সামনে এই শক্তিশালী ব্যাঙকে আবিষ্কার করে হচকচিয়ে গেলো।
"আমাকে 'ব্যাঙ' বলে ডাকতে পারেন, " ব্যাঙটি পরিষ্কার, শক্তিশালী কণ্ঠে বলে উঠলো।
কাতাগিরির পা এদিকে ঘরের প্রবেশদ্বারে দাঁড়িয়েই জমে গেছে, বলার মতো কিছু খুঁজে না পেয়ে।
"ভয় পাবেন না, আমি আপনার কোন ক্ষতি করতে আসি নি। প্লিজ, গেট আটকে ঘরের ভেতরে ঢুকে পড়ুন।"
ডানহাতে ব্রিফকেস, বাম হাতে বাজারের ব্যাগে সবুজ শাকসবজি, আর টিনের কৌটায় ভরা স্যালমন মাছ দুলছে। কাতাগিরি এক পাও সামনে বাড়াবার সাহস জোগাড় করে উঠতে পারলো না।
"প্লিজ, মিঃ কাতাগিরি, দ্রুত দরজা বন্ধ করে ঘরে ঢুকুন, আর আপনার জুতোটুতো খুলে ফেলুন।"
হঠাৎ ধ্বনিত হওয়া তাঁর নাম কাতাগিরিকে চড় দিয়ে জাগিয়ে তুললো স্থবিরাবস্থা থেকে। সে দরোজা বন্ধ করলো - যেমনটা তাঁকে বলা হয়েছিল, তাঁর বাজারের ব্যাগ উঁচু কাঠের মেঝেতে রাখলো, হাতের ব্রিফকেসটা বগলের নীচে চেপে ধরে জুতোর ফিতা খুললো। তারপর, ব্যাঙ তাঁকে ইশারায় কিচেন টেবিলে বসতে অনুরোধ জানালে সে গিয়ে বসলো সেখানে।
"আমি প্রথমেই ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি, মিঃ কাতাগিরি, আপনার অনুপস্থিতিতে, আপনার অনুমতি ছাড়াই আপনার ঘরের ভেতরে প্রবেশ করবার জন্যে," ব্যাঙ বলল। "আমি জানতাম, আমার উপস্থিতি আপনাকে চমকে দেবে। কিন্তু আমার আর কিছু করার ছিল না। চা খাবে এক কাপ? আমি ভেবেছিলাম আপনি শীঘ্রই ফিরবেন বাড়িতে, তাই আমি কিছু পানি আগেভাগেই ফুটিয়ে রেখেছি।"
কাতাগিরির বগলের নীচে তখনো তাঁর অফিসের ব্রিফকেস চেপে ধরে রাখা। কেউ আমার সঙ্গে মজা করছে, সে ভাবলো। ভাবলো, কেউ নিশ্চয়ই এই বিশাল ব্যাঙের কস্টিউমের ভেতরে ঢুকে বসে আছে আমাকে ভড়কে দেবার জন্য। কিন্তু ব্যাঙটা যখন গুণগুণ করতে করতে তাঁর সামনে দিয়ে হেঁটে চলে চা বানাচ্ছিল, কাতাগিরির বুঝতে সমস্যা হচ্ছিল না যে - তার সম্মুখের এ দৃশ্যাবলী প্রকৃতঅর্থেই কোন প্রাণীর পেশীর নড়াচড়ার ফসল। ব্যাঙ তাঁর সামনে এক কাপ গ্রিন টি রেখে আরেক কাপ চা ঢাললো নিজের জন্য।
চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে ব্যাঙ প্রশ্ন করলো, "কিছুটা স্থির হতে পেরেছেন?"
উত্তরে কাতাগিরি কিছু বলতে পারলো না।
" আমি জানি, মিঃ কাতাগিরি, আমার আসলে একটা অ্যাপয়েন্টমেন্ট করে আপনার সঙ্গে দেখা করতে আসা উচিৎ ছিল। সামাজিক কেতাকানুন যে আমার জানা নেই, এমনটা নয়। যে কেউই নিজের ফ্ল্যাটে ঢুকে এতো বড়সড় একটা ব্যাঙকে বসে থাকতে দেখলে চমকে উঠবে। কিন্তু খুব একটা আর্জেন্ট বিষয়ে আমার এভাবে হুট করে চলে আসতে হল। প্লিজ আমাকে ক্ষমা করবেন।"
"আর্জেন্ট বিষয়?" কাতাগিরি অবশেষে তাঁর প্রথম শব্দগুচ্ছ উচ্চারণ করতে সক্ষম হল।
"হ্যাঁ, অবশ্যই" ব্যাঙ বলল। "নইলে কেন আমি এভাবে আরেকজনের বাসায় অসময়ে, অনুমতি ছাড়া এসে হাজির হবো? এ ধরণের অসৌজন্যতামূলক আচরণ আমার ধাঁতে নেই একদম।"
"এই 'আর্জেন্ট বিষয়' এর সঙ্গে আমার কোন সম্পর্ক আছে?"
"হ্যাঁ এবং না," হালকা মাথা নাড়িয়ে জবাব দেয় ব্যাঙটি। "না এবং হ্যাঁ।"
আমার দ্রুত এ পরিস্থিতি সামাল দিতে হবে, মনে মনে ভাবে কাতাগিরি। "কিছু মনে করবেন, যদি আমি একটা বিড়ি ধরাই?"
"কোন সমস্যা নেই, কোন সমস্যা নেই," ব্যাঙটি গালে হাসি ঝুলিয়ে বলে। "এটা আপনার বাড়ি। আপনার আমার কাছ থেকে অনুমতি চাইবার কিছু নেই। যত খুশী বিড়ি খান, বা পানীয় গলায় ঢালুন। আমি যদিও ধূমপায়ী নই, তাই বলে অন্য কারো বাড়িতে এসে তাঁর টোব্যাকোর প্রতি আসক্তি নিয়ে বিরক্তি তো প্রকাশ করতে পারি না।"
কাতাগিরি তাঁর কোটের পকেট থেকে একটা সিগারেট বের করে দেশলাইয়ের কাঠি জ্বালাল একটা। সিগারেটে আগুণ ধরাবার সময় সে খেয়াল করলো, তাঁর হাত কাঁপছে। তাঁর বিপরীত পাশে বসে ব্যাঙটা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পর্যবেক্ষণ করছে তাঁর প্রতিটি কার্যকলাপ।
"আপনি কোনভাবে কোন গ্যাং -এর সাথে সংযুক্ত নন তো?" কাতাগিরি কথা বলবার সাহস সঞ্চয় করে সারলো কোনক্রমে।
"হা হা হা হা হা! অসাধারন আপনার রসবোধ, মিঃ কাতিগিরি!" সে বলল, তার ব্যাঙসুলভ হাত, ব্যাংসুলভ উরুতে চাপড় মেরে। "সন্দেহ নেই, সমস্ত ক্ষেত্রেই দক্ষ কর্মচারীর অভাব চলছে ইদানিং, কিন্তু কোন মাস্তানদের গ্রুপ কেন একটা ব্যাঙকে তাদের দলে নেবে? হাসবে না সবাই তাহলে ওদের উপর?"
"এখন, আপনি যদি এখানে কোন লোন রি-পেমেন্টের ব্যাপারে আলাপ করতে এসে থাকেন, আপনি আপনার সময় নষ্ট করছেন। এসমস্ত বিষয়ে কোন ডিসিশন দেয়ার মতো সক্ষমতা আমার নেই। আমার বসেরা এসমস্ত ব্যাপারে সিদ্ধান্ত দেন। আমি শুধু তাদের হুকুম তামিল করি। এ ব্যাপারে আমি কোন সাহায্যই করতে পারব না আপনাকে।"
"প্লিজ, মিঃ কাতাগিরি," ব্যাঙটি বলল, তার কিম্ভূতকিমাকার আঙ্গুল শূন্যে তুলে ধরে। "আমি এখানে এসব ছোটখাটো বিষয় নিয়ে আলোচনা করতে আসি নি। আমি খুব ভালো করে জানি যে আপনি টোকিও সিকিউরিটি ট্রাস্ট ব্যাংকের শিনজুকু ব্রাঞ্চের ঋণ বিভাগের সহকারি প্রধান। কিন্তু আমার আজকে এখানে আসবার সঙ্গে ব্যাংক ঋণ পরিশোধের কোন সম্পর্ক নেই। আমি এখানে এসেছি টোকিও শহরকে ধ্বংসের হাত থেকে বাঁচাতে।"
কাতিগিরি মনোযোগ দিয়ে সারা ঘর জুড়ে চোখ বোলালো, বুঝবার জন্যে যে - রুমে কোথাও কোন ক্যামেরায় তাকে লুকিয়ে ভিডিও করা হচ্ছে না। সে কোন সুপরিকল্পিত, এবং বড়সড় প্রাঙ্কের শিকার হতে যাচ্ছে কি না। কিন্তু কোথাও কোন ক্যামেরা ধরা পড়লো না কাতাগিরির চোখে। ছোট একটা অ্যাপার্টমেন্ট। এতে কারো লুকিয়ে থাকার অবকাশ নেই।
"না" ব্যাঙ্গটি বলে, "আর কেউ নেই, আমরাই কেবল আছি এখানে। আমি জানি আপনি ভাবছেন যে হয়তো আমি পাগল, অথবা আপনি স্বপ্ন দেখছেন। দুটোর কোনটাই সত্যি নয়। আপনি যা দেখছেন, তা নিশ্চিতভাবে, এবং ইতিবাচকভাবে একদম ঠিক।"
"সত্য বলতে, জনাব ব্যাঙ..."
"প্লিজ," আবারও একটি আঙ্গুল তুলে ধরে ব্যাঙটি কথার মধ্যে ঢুকে গেলো "আমাকে কেবল ব্যাঙ বলুন।
"সত্য বলতে, ব্যাঙ," কাতিগিরি বললেন, "আমি না আসলে ঠিক বুঝে উঠতে পারছি না যে এখানে কি হচ্ছে। বিষয় এটা নয় যে আমি আপনাকে বিশ্বাস করতে পারছি না। সত্য বলতে, এখানে আমার চোখের সামনে যা ঘটছে, আমি তা পুরো হজম করে উঠতে পারছি না। আপনি কি আমার দু' একটি প্রশ্নের জবাব দেবেন দয়া করে?"
"অবশ্যই, অবশ্যই," ব্যাঙটি বলল, "পারস্পারিক বোঝাপড়ার গুরুত্ব অনেক। লোকে বলে না যে - 'সমস্ত মিসআণ্ডারস্ট্যান্ডিং এর সমষ্টিই হচ্ছে আন্ডারস্ট্যান্ডিং' ? আমি এই আইডিয়াটা পছন্দ করি, কিন্তু সমস্যা হচ্ছে নিজেদের মাঝে অনেকগুলো ভুল বোঝাবুঝির জন্ম দিয়ে দিয়ে অবশেষে একটা বোঝাপড়ায় পৌঁছানোর মতো সময় নেই আমাদের হাতে। আমাদের পারস্পারিক বোঝাপড়ায় পৌঁছানোর জন্যে সবচে সংক্ষিপ্ততম পথকে বেছে নিতে হবে। আর সে জন্যেই, আপনার মনে যত প্রশ্ন আছে, আপনি একে একে আমাকে করতে থাকুন।"
"এখন, আপনি আসলেই একজন ব্যাঙ, তাই তো?
"হ্যাঁ, অবশ্যই, আপনার চোখের সামনেই তো দেখতে পাচ্ছেন আমাকে। একটি পরিপূর্ণ ব্যাঙ আমি, এটাই আমার পরিচয়। আমি কোন সাহিত্যিক মেটাফোর নই, বা অ্যালিউশন নই, নই কোন ডিকন্সট্রাকশন, স্যাম্পলিং বা অন্য কোন তাত্ত্বিক জটিলতার বহিঃপ্রকাশও। আমি কেবলই একটি ব্যাঙ। আমি কি আপনাকে ব্যাঙের মতো ডেকে দেখাব?"
ব্যাঙটি তার মাথা কিছুটা পেছনে সরিয়ে প্রথমে তার লম্বা গলার পেশীগুলো ফুলিয়ে নিল। তারপর শুরু হল - "ঘ্রো! ঘ্রোওঁওঁওঁ! ঘ্রো ঘ্রো ঘ্রো! ঘ্রো! ঘ্রো! ঘ্রওঁওঁওঁ!" তার দানবীয় ব্যাঙডাকানি ঘরের দেয়ালে টাঙ্গিয়ে রাখা ছবিগুলোকে কাঁপিয়ে দিলো একদম।
"আচ্ছা, আমি বুঝেছি, আমি বুঝেছি!" সস্তার অ্যাপার্টমেন্টের পলকা দেয়াল ভেঙ্গে যাওয়ার ভয়ে কাতাগিরি লাফিয়ে উঠলো প্রায়। "অসাধারন। সন্দেহাতীতভাবে আপনি একজন ব্যাঙ।"
"আবার কেউ কেউ বলতে পারে, আমি পৃথিবীর সমস্ত ব্যাঙের সমষ্টি। যা হোক, এটা অবশ্য আমার ব্যাঙত্বকে খারিজ করে দেয় না। তবে যে দাবী করবে যে আমি একটি ব্যাঙ নই - সে এক নোংরা মিথ্যাবাদী! আমি প্রথম সুযোগে তাকে একদম ভর্তা বানিয়ে ফেলবো।"
কাতাগিরি মাথা নাড়ালো। নিজেকে শান্ত করবার আশায় সে চায়ের কাপ হাতে তুলে নিয়ে তাতে বড়সড় এক চুমুক দিলো। "আপনি বললেন, আপনি টোকিও শহরকে ধংসের হাত থেকে বাঁচাতে এখানে এসেছেন..."
"তাই তো বলেছি।"
"কি ধরনের ধংস?"
"ভূমিকম্প" কণ্ঠস্বর যতটুকু সম্ভব ভারি করে ব্যাঙ উত্তর দিলো।
মুখ হা করে কাতাগিরি ব্যাঙের দিকে তাকিয়ে রইল। ব্যাঙ, উত্তরে কিছুই না বলে তাকিয়ে রইল কাতাগিরির দিকে। এভাবে, কোন বাক্যব্যয় না করে একে অপরের দিকে তারা তাকিয়ে রইল কিছুক্ষন। এরপর ব্যাঙের মুখ খোলার পালা।
"খুবই ভয়াবহ এক ভূমিকম্প। ফেব্রুয়ারি মাসের ১৮ তারিখ, সকাল সাড়ে আটটায় এই ভূমিকম্পের টোকিও শহরকে আঘাত করবার কথা। অর্থাৎ, আজ থেকে তিনদিন পর। গতমাসে কোবে-কে যে ভূমিকম্প কাঁপিয়ে দিলো, তার চে অনেক বড়, আর শক্তিশালী। এধরনের ভূমিকম্পে মৃতের সংখ্যা প্রায় দেড় লাখ ছাড়িয়ে যাবে। হতাহতের সংখ্যা বৃদ্ধি পাবে মূলত যোগাযোগ ব্যবস্থায় দুর্ঘটনার কারনেঃ ট্রেন লাইনচ্যুত হওয়া, গাড়িঘোড়া ঝাঁকুনি খেয়ে উল্টে পড়া, প্রধান সড়ক, রেলপথ, সাবওয়ে - এ সবকিছুর ভেঙ্গেচুরে যাওয়া, ট্যাংকার ট্রাকে বিস্ফোরণ। দালানগুলো ইট - পাথরের বড় বড় স্তুপে পরিণত হবে। ভেতরের বাসিন্দারা কংক্রিটের নীচে চাপা পড়ে মারা যাবে। জায়গায় জায়গায় আগুন লাগতে দেখা যাবে, যাতায়াত ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়বে পুরোপুরি। অ্যাম্বুলেন্স আর অগ্নি নির্বাপণের গাড়িগুলো দাঁড়িয়ে থাকবে - ঠায় , অকেজো হয়ে। রাস্তা জুড়ে পড়ে থাকবে মানুষের মৃতদেহ - এখানে সেখানে। দেড় লাখ মানুষের মৃতদেহ! পুরো জাহান্নাম! মানুষ উপলব্ধি করবে - তাদের বহুদিনের যত্নে গড়া শহর নামের এই কনসেপ্ট কতোটা ভঙ্গুর।" ভদ্রভাবে একবার মাথা ঝাঁকিয়ে ব্যাঙ তার বাক্য শেষ করলো - "ভূমিকম্পের এপিসেন্টার হবে শিনজুকু ওয়ার্ড অফিসের কাছাকাছি।"
"শিনজুকু ওয়ার্ড অফিসের কাছাকাছি?"
"সংক্ষেপে বললে তাই ই। এটা সরাসরি টোকিও সিকিউরিটি ট্রাস্ট ব্যাঙ্কের শিনজুকু ব্রাঞ্চের নীচে আঘাত করবে।"
এরপর কিছুসময় ধরে রুমজুড়ে প্রলম্বিত নীরবতা বজায় রইল।
"এবং আপনি," কাতাগিরি বলল, "এই ভূমিকম্প ঠেকানোর পরিকল্পনা করছেন?"
"ঠিক তাই," ব্যাঙ মাথা নাড়ালো, "ঠিক এটাই আমার পরিকল্পনা। আপনি আর আমি মিলে টোকিও সিকিউরিটি ট্রাস্ট ব্যাঙ্কের শিনজুকু শাখার নীচে, আন্ডারগ্রাউন্ডে গিয়ে পোকাটার সঙ্গে জীবনপণ লড়াই করবো।"
ট্রাস্ট ব্যাঙ্কের ঋণদাতা বিভাগের একজন কর্মকর্তা হিসেবে কাতাগিরিকে আজকের পর্যায়ে আসতে হয়েছে অনেকরকম যুদ্ধ করেই। গ্রাজুয়েশন শেষ করে এই ব্যাঙ্কে স্টাফ হিসেবে যুক্ত হবার পর টানা ষোল বছর তিনি প্রতিদিন জীবনপণ লড়াই ই তো করলেন। তার দায়িত্ব ছিল কালকেশন অফিসারের, ঋণ ফেরত নেয়ার। এই পজিশনে কাজ করার ফলে তিনি খুব কম মানুষেরই প্রিয়ভাজন হতে পেরেছেন। তার ডিভিশনে কাজ করা সবারই লোন দিতে বড় আগ্রহ ছিল- বিশেষ করে ইন দা টাইম অফ বাবলস। তখন ব্যাঙ্কে এতো এতো টাকা ছিল যে বিনিময়যোগ্য যে কোন বস্তু, হোক সে একখণ্ড জমি, অথবা শেয়ার - দেখানো মাত্রই লোন অফিসারেরা লোন দিয়ে দিতো। যত বড় অংকের লোন, কোম্পানিতে তত বড় রেপুটেশন। কিছু ঋণ এমন ছিল, যা আর ব্যাঙ্ক আদায় করে সারতে পারে নি, ইংরেজিতে যাকে বলে - "স্টাক টু দা বটম অফ দা প্যান"। কাতাগিরির কাজ ছিল ঐ সমস্ত ঋণ উদ্ধার করা। যখন সে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সে বাবল ফুটে গেলো, কাতাগিরির কাঁধে কাজের পাহাড় জমে গেলো সঙ্গে সঙ্গে। প্রথমে দরপতন ঘটলো শেয়ার বাজারে, তারপর মূল্য হ্রাস হল জমির, বিনিময়পোযোগি সমস্ত দ্রব্য গুরুত্ব হারিয়ে ফেলল। "বেরিয়ে পড়ো," তার বস বলেছিল, "এমতাবস্থায় যাকে নিংড়ে যা বের করে আনতে পারো ওটাই লাভ।"
শিনজুকুর কাবুকিচু এলাকা হচ্ছে সহিংসতার আখড়াঃ পুরনো দিনের গ্যাংস্টার, কোরিয়ান গুন্ডা, চায়নিজ মাফিয়া, বন্দুক এবং ড্রাগ, এক নোংরা জায়গার তল থেকে আরেক নোংরা জায়গায় টাকার স্রোতের প্রবাহ, বাতাসে কর্পূরের উবে যাওয়ার মতো করে হুটহাট মানুষের গুম হয়ে যাওয়া। কাবুকিচু এলাকায় ঋণ উদ্ধারের কাজে নেমে কাতাগিরিকে একাধিকবার এ ধরনের গুন্ডাদের মুখোমুখি হওয়া লেগেছে। অনেকবারই তারা তাকে হত্যার হুমকি দিয়েছে, কিন্তু কাতাগিরি কখনো ভয় পায় নি। সে ভেবেছে, ব্যাংকের জন্যে কাজ করা একটা লোককে মেরে তাদের কি লাভ? তারা চাইলেই তাকে ছুরি মারতে পারে। তাকে মেরে ভর্তা বানিয়ে দিতে পারে। সে এই ব্যাংকের দেনা আদায়ের জন্যে সবচে যোগ্য মানুষ। স্ত্রী নেই, সন্তান নেই, বাবা - মা দুজনেই মৃত, কলেজ পর্যন্ত কাতাগিরির কাঁধে ভর দিয়ে উৎরে যাওয়ার পর ভাই বোনেরাও বিয়েশাদি করে যে যার সংসারে ব্যস্ত। কি আসে যায় যদি তারা এখন তাকে মেরে ফেলে? কারো কিছু যাবে আসবে না তাতে, অন্তত কাতাগিরির কোন পরোয়া নেই তাতে।
কাজেই কাতাগিরির বদলে তাকে ভয় দেখাতে আসা গুন্ডাগুলো বরং ভয় পেয়ে যেতো, তাদের সামনে কাতাগিরিকে এতোটা সুস্থির অবস্থায় দেখে। শীঘ্রই সে গুন্ডামহলে 'টাফ গায়', বা কঠিন মানব - এর পরিচিতি পেয়ে যায়। যদিও এ মুহূর্তে কঠিন মানব কাতাগিরিও বেকুব বনে আছে। এই ব্যাঙটা কিসের কথা বলছে আসলে? কোন ধরনের পোকা এটা?
"কে, মানে, কি জিনিস - এই পোকা?" সে কিছুটা দ্বিধাজড়িত কণ্ঠে প্রশ্ন করে।
"সে এক বিশাল শুঁয়োপোকা। বাস করে মাটির নিচে। সে রেগে গেলেই ভূমিকম্পের জন্ম হয়," ব্যাঙ বলে, "আর এই মুহূর্তে সে রেগে আছে। ভয়ানক রেগে আছে।"
"কি নিয়ে ক্ষেপে আছে সে?" কাতাগিরি প্রশ্ন করে।
"জানা নেই," ব্যাঙ উত্তর দেয়। "কারো পক্ষে জানা সম্ভব না যে এই মুহূর্তে তার ভোঁতা মাথার ভেতরে কি চলছে। তাকে খুব বেশি কেউ দেখে নি। সাধারণত সে ঘুমিয়ে থাকে। এটাই তার প্রিয় কাজঃ লম্বা সময় ধরে ঘুমিয়ে থাকা। সে বছরের পর বছর, দশকের পর দশক ধরে ঘুমিয়ে থাকে মাটির নীচের আঁধার ও উষ্ণতায়। চোখ - দীর্ঘদিন বন্ধ থাকার ফলে প্রায় অকেজো হয়ে পড়ে। মস্তিষ্ক জেলির মতো থলথলে হয়ে যায়। আমার আসলে মনে হয় না যে তাকে প্রকৃতপক্ষে কেউ খেপিয়ে তোলে। সে শুধু মরার মতো পড়ে থাকে, আর মাটির নীচে তার শরীরের তরফ ধেয়ে আসা সব কম্পন, আর তরঙ্গগুলো শরীরের ভেতর জমা করতে থাকে। এই জমা হওয়া শক্তিগুলো কোনো এক রাসায়নিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে পরিনত হয় অন্ধ ক্রোধে। কেন এমনটা হয় - আমার কোন আইডিয়া নেই। আমি এটা ব্যাখ্যা করতে পারব না।"
ব্যাঙ চুপ করে কাতাগিরিকে তার কথাগুলো হজম করবার সময় দেয়। তারপর আবারো শুরু করেঃ
"আমাকে ভুল বুঝবেন না দয়া করে। আমার ঐ শুঁয়োপোকার প্রতি কোন ব্যক্তিগত বিদ্বেষ নেই। আমি যে তাকে শয়তানির চরম পরাকাষ্ঠা হিসেবে দেখি - এমনটাও না। সুযোগ পেলে আমি ওর বন্ধু হতে চাইতাম - এমনটাও না। ব্যাপার হোল, পৃথিবীর নিয়মকানুন আমি যতটুকু বুঝি, আমার মনে হয় যে ওর মতো একটা প্রাণী থাকতেই পারে। পৃথিবীটা একটা বিশাল সাইজের ওভারকোটের মতো, এর নানা আকার আকৃতির পকেট থাকতেই হবে। তবে সমস্যা হচ্ছে, এই মুহূর্তে ঐ পোকা খুব বিপদজনক একটা অবস্থানে পৌঁছে গেছে। এতোটাই যে, ওকে আর অবহেলা করা, বা ওকে ওর মতো ছেড়ে দেয়া সম্ভব হচ্ছে না। দীর্ঘ - দীর্ঘ দিন যাবত, এতো বিভিন্ন রকমের ক্রোধ আর ক্ষোভ ওর মধ্যে জমা হয়েছে, এবং সে ক্ষোভও পরিমানে এতো বিশাল যে - সেটা অতীতের সব ইতিহাসকে ছাড়িয়ে গেছে। মরার ওপর খাঁড়ার ঘায়ের মতো - গতমাসের কোবে শহরের ভূমিকম্প ওর ঘুম ভাঙ্গিয়ে দিয়েছে। তার ভেতরে জমা হওয়া ক্রোধের আগ্নেয়গিরি তাকে ইশারা করেছে, ওর জন্যেও সময় এসেছে বিশাল আকারের এক ভূমিকম্পে সবকিছু ছারখার করে দেবার। আর সে অঘটনের কেন্দ্রস্থল হবে টোকিও। আমি নিশ্চিত হয়েই কথা বলছি মিঃ কাতাগিরি। ভূমিকম্পের আসন্ন সময় এবং মাত্রার ব্যাপারে আমার কিছু কীটপতঙ্গ বান্ধবদের কাছ থেকে যথোপযুক্ত তথ্যপ্রমাণ পেয়েছি আমি।"
ব্যাঙটি ঝপ করে তার মুখ বন্ধ করে, এবং গোল গোল চোখ বুজে দীর্ঘক্ষন ধরে কথা বলবার ফলে সৃষ্ট ক্লান্তির জানান দেয়।
"তাহলে আপনি বলতে চাইছেন," কাতাগিরি এবার মুখ খোলে, "যে, আপনি আমি মিলে শ' শ' ফুট মাটির নীচে যাবো একটা শুঁয়োপোকার সঙ্গে মারপিট করতে, যাতে করে সে ভূমিকম্প তৈরি না করতে পারে?"
"ঠিক তাই।"
কাতাগিরি হাত বাড়িয়ে তার চায়ের কাপটা তুলে নিয়ে আবার জায়গা মতো রেখে দেয়।
"আমি এখনও পুরো ব্যাপারটা বুঝে উঠতে পারছি না," সে বলে। "আমাকে বেছে নেয়ার কারন কি?"
ব্যাঙ কাতাগিরির চোখে চোখ রেখে বলে, "আপনাকে আমি দীর্ঘদিন ধরে অত্যন্ত সম্মানের চোখে দেখে এসেছি, মিঃ কাতাগিরি। গত ১৬ বছর ধরে আপনি বিনা বাক্যব্যায়ে খুব বিপদজনক, এবং জাঁকজমকহীন একটি কাজ করে এসেছেন আপনার ব্যাংকের জন্য। অন্য যে কেউ এই কাজ ছেড়ে দিয়ে চলে যেতো, কিন্তু আপনি এই কাজ খুবই সুচারুরূপে করে এসেছেন। আমি জানি এভাবে কাজ করে যাওয়া কতটা বিপদজনক ছিল আপনার জন্য, কতটা ত্যাগস্বীকার করেছেন আপনি এ চাকরি করতে গিয়ে; আমি এও জানি আপনার বসেরা, বা আপনার সহকর্মীরা আপনাকে আপনার উপযুক্ত সম্মান দেয় নি কখনো। তারা অন্ধ, তাদের প্রত্যেকে অন্ধ। কিন্তু আপনি, সম্মান - প্রোমোশন কিছুই না পেলেও এ নিয়ে কখনো অভিযোগ করেন নি।
শুধু কাজের ক্ষেত্রটাই নয়। আপনার বাবা মা মারা যাওয়ার পর আপনি আপনার ছোট ভাইবোনদের বলতে গেলে একা হাতে মানুষ করেছেন। তাদের পড়াশোনা করিয়েছেন, তাদের বিয়েথা দিয়ে সংসার সাজিয়ে দিয়েছেন। এ সবকিছু আপনি করেছেন আপনার সময়, খুব কষ্টে আয় করা অর্থ, এমনকি আপনার নিজের সংসারের ইচ্ছে বিসর্জন দিয়ে। বদলে আপনার ভাইবোনেরা একটিবারের জন্যও আপনাকে ঠিকমতো ধন্যবাদ দেয় নি, আপনার প্রতি কৃতজ্ঞতাজ্ঞাপন করে নি। আমার মতে, তারা চরম বিবেকহীনের মতো আচরন করেছে। আমার তো মাঝেমধ্যে মন চাইতো, আপনার হয়ে আমিই ওদের রামধোলাই দিয়ে আসি। অথচ দেখুন, আপনার ভেতরে ক্রোধের চিহ্ন মাত্রও অনুপস্থিত।
সত্য বলতে, মিঃ কাতাগিরি, আপনি দেখতে শুনতে অমন জবরদস্ত কেউ নন, তাই আপনার আসেপাশের সবাই আপনাকে হেয় করে। আপনাকে আপনার প্রাপ্য সম্মানটুকু দেয় না। কিন্তু আপনি আমার চোখ এড়াতে সক্ষম হন নি। আমি ঠিকই জানি - আপনি কতটা দায়িত্ববান এবং সাহসী মানুষ। টোকিও শহরের মিলিয়ন মিলিয়ন মানুষের ভিড়ে আপনি ছাড়া আমি আর কাউকে খুঁজে পেলাম না, যাকে সঙ্গে নিয়ে আমি এই লড়াই শুরু করতে পারি।"
"মিঃ ব্যাঙ, আর একটা কথা ..." কাতাগিরি বলল।
"প্লিজ," ব্যাঙ আবারো তার একটি আঙ্গুল তুলে পয়েন্ট অফ অর্ডার ঘোষণা করলো "কোন মিঃ নয়, কেবল ব্যাঙ।"
"আচ্ছা, আর একটা কথা, ব্যাঙ," কাতাগিরি বলল, "আমার ব্যাপারে এতোকিছু আপনি কিভাবে জানলেন?"
"দেখুন মিঃ কাতাগিরি, এতোগুলো দিন ধরে কোন কারন ছাড়া তো আমি ব্যাঙগিরি করে বেড়াই নি। জীবনের গুরুত্বপূর্ণ দিকগুলোর ব্যাপারে বরাবর আমার তীক্ষ্ণ দৃষ্টি ছিল।"
"তবুও, ব্যাঙ," কাতাগিরি বলে, "আমি তেমন শক্তিশালী নই, তাছাড়া মাটির নীচে কি চলছে - তা নিয়ে আমার কোন ধারণাও নেই। মাটির নীচের অন্ধকারে ঐ দানবাকৃতির শুঁয়োপোকার সঙ্গে লড়াই করবার মতো শক্তিশালী পেশীও আমার শরীরে নেই। আমি নিশ্চিত, আমার চে শক্তিশালী কাউকে আপনি পেয়ে যাবেন - ক্যারাটে জানে এমন কেউ, অথবা, 'সেলফ ডিফেন্স ফোর্স' কম্যান্ডোদের কাউকে।"
ব্যাঙ সব শুনেটুনে হতাশার সঙ্গে 'আই রোল' করলো। "সত্যি বলতে, মিঃ কাতাগিরি," বলল সে, "মারামারির পুরো দায়িত্ব কেবল আমার কাঁধে। কিন্তু আমি এ কাজ একা করতে পারব না। এটা আপনার বোঝা খুব গুরুত্বপূর্ণ যে, আপনার সাহস, ন্যায়প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে আপনার যে প্রবল আগ্রহ, আমার ওটা দরকার। আপনার কাজ হবে আমার পিছে দাঁড়িয়ে ক্রমাগত বলে চলা যে - 'এগিয়ে চলো ব্যাঙ! অসাধারন হচ্ছে! অবশ্যই জিতবে তুমি! তুমি ন্যায়ের পক্ষ হয়ে লড়াই করছ!' "
ব্যাঙ তার দু হাত (বা সামনের দুই পা) ডানেবামে ছড়িয়ে আবারো সজোরে চাপড় মারলো হাঁটুতে।
"সত্যি বলতে, মিঃ কাতাগিরি, মাটির নীচে, অন্ধকারে গিয়ে ঐ দানবাকৃতির শুঁয়োপোকার সঙ্গে লড়াই করার কথা ভাবলে আমার নিজেরও ভয় লাগে। বছরের পর বছর ধরে আমি শান্ত স্থবির অবস্থায় আছি। শিল্পকলার চর্চা, প্রকৃতির সংস্পর্শে থাকা - এসব নিয়ে ভালোই ছিলাম। লড়াই করা আমার কাজ না। আমার এটা করতে হচ্ছে, কারন এ ছাড়া আমার আর কোন উপায় নেই। আর এইবারের লড়াইটা ভয়াবহ হতে যাচ্ছে, তাতেও কোন সন্দেহ নেই। হয়তো আমি এখান থেকে বেঁচে ফিরবো না। ফিরলেও, সম্ভাবনা আছে অঙ্গহানির। কিন্তু আমি পারবো না, বা আমার পক্ষে সম্ভব না - এই যুদ্ধ থেকে পালিয়ে যাওয়া। নিটশে যেমনটা বলেছিলেন - প্রজ্ঞার সর্বোচ্চ স্তর হচ্ছে ভয়হীনতা। আপনার কাছে আমার চাওয়া এতোটুকুই যে - আপনি আপনার বুকের যে দুর্মর সাহস, সেটা আমার সঙ্গে ভাগ করে নেবেন। একজন প্রকৃত বন্ধুর মতো আপনার হৃদয়ের পুরোটা দিয়ে আপনি আমাকে সমর্থন করবেন। আপনি কি বুঝতে পারছেন, আমি কি বলতে চাইছি?"
কোন কিছুই আসলে তেমন একটা অর্থবহ লাগছিল না কাতাগিরির কাছে। তবুও, অবিশ্বাস্য হলেও সত্য যে, সে একটু একটু করে গ্রহন করা শুরু করছিল ব্যাঙের বক্তব্যকে। এই ব্যাঙের মধ্যে কিছু একটা বিষয় আছে। তার বক্তব্যের মধ্যে এমন একটা সরল সততা আছে - যা সরাসরি অন্তরকে প্রভাবিত করে। দীর্ঘদিন যাবত সিকিউরিটি ট্রাস্ট ব্যাঙ্কের কঠিনতম শাখায় কাজ করবার ফলে এ সূক্ষ্ম ব্যাপারগুলো ধরতে পারার যোগ্যতা তার মধ্যে ছিল। এটা কাতাগিরির চরিত্রেরই একটা অংশ।
"আমি জানি সবকিছু মিলিয়ে ব্যাপারটা কঠিন হয়ে যাচ্ছে আপনার জন্য, মিঃ কাতাগিরি। কোথা না কোথা থেকে যেন এক বিশাল সাইজের ব্যাঙ প্রথমে আপনার ঘরের লক ভেঙ্গে ঢুকে বসে আছে, তারপর সে আপনাকে এসমস্ত আজগুবি খবর বিশ্বাস করতে বলছে। আপনার প্রতিক্রিয়া কিন্তু সে বিবেচনায় একদম স্বাভাবিক। কাজেই, আমার মনে হয় এই মুহূর্ত আমার আপনাকে একটা প্রমাণ দেয়া উচিৎ যে আমি আসলে কল্পনা নই, বাস্তব। বলুন, মিঃ কাতাগিরি, 'বিগ বিয়ার ট্রেডিং' কোম্পানির নেয়া একটা ব্যাংক ঋণের টাকা তুলে আনতে আপনি দীর্ঘদিন যাবত গলদঘর্ম হচ্ছেন - সত্যি কি না?
"এটা সত্যি," কাতাগিরি উত্তর দিল।
"তাদের মধ্যে কিছু খারাপ লোকও আছে, যারা বিভিন্ন গুন্ডা গ্যাঙের সাথে জড়িত। তারা কোম্পানিকে দেউলিয়া বানিয়ে তার সব ক্যাশটাকা হাতিয়ে নিতে চাইছে। আপনার ব্যাংকের ঋণদাতা কর্মকর্তা ঐ কোম্পানির অতীত ইতিহাস ভালোভাবে নিরীক্ষা না করেই তাদের বিশাল অঙ্কের ঋণ দিয়ে দিয়েছে, আর তার পরবর্তী কর্মকর্তা হিসেবে আপনার ঘাড়ে দায়িত্ব এসে পড়েছে সে ঋণ তুলে আনবার। কিন্তু এ কাজটা করতে গিয়ে আপনি হিমশিম খাচ্ছেন, উপরন্তু কেসের কোন অগ্রগতি হচ্ছে না। সম্ভবত খুব শক্তিশালী কোন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব তাদের আশ্রয় দিচ্ছে। তাদের ৭০০ মিলিয়ন ইয়েনের ঋণ আপনার ব্যাঙ্কের কাছে। সব মিলিয়ে এইতো অবস্থা?"
"ঠিক বলেছেন।"
ব্যাঙ আবারো তার দু'হাত প্রসারিত করলো, আড়মোড়া ভাঙ্গার আঙ্গিকে - এবং তাতে তার হাতের আঙ্গুলের ফাঁকে সংযুক্তিকারক চামড়াগুলো ফ্যাকাশে ডানার মতো প্রসারিত হয়ে রইলো। "চিন্তা করবেন না, মিঃ কাতাগিরি। সবকিছু আমার ওপর ছেড়ে দিন। কাল সকালের মধ্যে এই বুড়ো ব্যাঙ আপনার সমস্যা সমাধান করে দেবে। বিশ্রাম নিন, রাতে সুন্দরমতোন একটা ঘুম দিন।"
আকর্ণবিস্তৃত হাসি মুখে ঝুলিয়ে ব্যাঙ উঠে দাঁড়ালো। তারপর, স্কুইডের শুটকির মতো কীভাবে যেন নিজেকে চিমশে ফেলে ঘরের বদ্ধ দরোজা, আর কপাটের মাঝে যে অতি ক্ষীণ ফাঁক - তার মধ্য দিয়ে সে বেরিয়ে গেলো, পেছনে কাতাগিরিকে একা রেখে। টেবিলের ওপর দু'কাপ চা - ই কাতাগিরির অ্যাপার্টমেন্ট থেকে সদ্য চলে যাওয়া ব্যাঙের একমাত্র চিহ্নস্বরূপ রয়ে গেলো।
পরদিন সকাল নয়টা বাজে নিজের অফিসের ডেস্কে বসা মাত্র সামনের টেলিফোন বেজে উঠলো
"মিঃ কাতাগিরি," ফোনের অপর পাশ থেকে একটি পুরুষকণ্ঠ ভেসে আসে। শুষ্ক, ব্যবসায়িক কণ্ঠস্বর। "আমার নাম শিরাওকা। আমি বিগ বিয়ার কেইসের একজন অ্যাটর্নি। আজ সকালে আমি আমার ক্লায়েন্টের কাছ থেকে একটি ফোনকল পেয়েছি, আপনাদের পাওনা ঋণের ব্যাপারে। তিনি আপনাকে জানাতে বলেছেন যে, যেকোনোভাবেই হোক, নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে তিনি আপনাদের পুরো ঋণ পরিশোধ করে দেবেন। এই মর্মে তিনি লিখিত প্রত্যয়নপত্রও যথাশীঘ্র আপনার অফিসে পাঠিয়ে দেবেন। তার একমাত্র অনুরোধ হল, আপনি আর কোন ব্যাঙকে তার বাসায় পাঠাবেন না। আমি আবারো বলছি, তার একমাত্র অনুরোধ, আপনি আর কোন ব্যাঙকে তার বাসায় পাঠাবেন না। আমি আসলে নিজেও ঠিক নিশ্চিত নই যে এটা দ্বারা তিনি ঠিক কি বোঝাতে চেয়েছেন, কিন্তু আমার ধারনা - আপনি হয়তো বুঝেছেন যে তিনি কি বোঝাতে চাইছেন। আমার ধারনা কি সঠিক?"
"অবশ্যই," কাতাগিরি জবাব দেয়।
"এতক্ষন যে ব্যাঙকে নিয়ে আলোচনা হল, আশা করি আপনার বদান্যতায় সেই ব্যাঙের কাছেও এই বার্তা পৌঁছে যাবে।"
"নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন। আপনার ক্লায়েন্ট সে ব্যাঙকে জীবনে আর কখনো দেখবে না।"
"অনেক ধন্যবাদ। আগামিকালের মধ্যে আপনি প্রত্যয়নপত্র পেয়ে যাবেন।"
"শুনে খুশি হলাম," কাতাগিরি বলে।
ফোন কেটে গেলো।
ব্যাঙ কাতাগিরির সঙ্গে দুপুরের খাবারের সময় দেখা করবার জন্য ট্রাস্ট ব্যাংকের অফিসে এলো।
"দা বিগ বিয়ার কেইসের ঝামেলাটা মিটেছে আশা করি।"
জবাব দেয়ার বদলে কাতাগিরি অস্বস্তি নিয়ে চারপাশে নজর বুলালো একবার।
"ভয় পাবেন না," ব্যাঙ বলল। "আপনি ছাড়া আর কেউ আপনাকে এ মুহূর্তে দেখতে পাচ্ছে না। যাই হোক, আশা করি আমার অস্তিত্বের ব্যাপারে বিশ্বাস জন্মেছে আপনার এতক্ষনে। আমি যে কোন কাজ শুরু এবং শেষ করতে পারি। আমি বাস্তব, জীবন্ত এক সত্ত্বা।
"মিঃ ব্যাঙ, আমাকে দয়া করে খুলে বলুন যে..."
"প্লিজ," ব্যাঙ পুনরায় পয়েন্ট অফ অর্ডারের মতো করে এক আঙ্গুল তুলে বলল - "ব্যাঙ। শুধু ব্যাঙ। মিস্টার ফিস্টার লাগাবেন না আমার নামের আগে।"
"আমাকে দয়া করে খুলে বলুন ব্যাঙ," কাতাগিরি প্রশ্ন করে, "আপনি তাদের কি করেছেন?"
"ওহ, তেমন কিছু না," ব্যাঙ বলে, " 'ব্রাসলস স্প্রাউট' সেদ্ধ করার চেয়েও সোজা ছিল কাজটা। আমি তাদের শুধু একটু ভয় দেখিয়েছি। খানিকটা সাইকোলজিক্যাল ভীতি। ঐ যে, জোসেফ কনরাড লিখেছিলেন না, সত্যিকারের ভয় হচ্ছে সেটা, যেটা মানুষের কল্পনার জগতে গিয়ে আঘাত হানে, এবং থিতু হয়। যাই হোক, বাদ দিন এ আলোচনা। আপনি বরং আপনার অবস্থা বলুন। বিগ বিয়ার কেইস সমাধা হয়েছে, আশা করি?"
কাতাগিরি ইতিবাচক ভঙ্গীতে মাথা নেড়ে একটা সিগারেট ধরায়, "আপাতত তাই মনে হচ্ছে।"
"তাহলে তো মনে হয় গতকাল রাতে যে বিষয়ের আলোকপাত করেছিলাম আপনার কাছে, সে ব্যাপারেও কিছু বিশ্বাস জন্মেছে আপনার। যাচ্ছেন তাহলে আমার সঙ্গে, মাটির নীচে - ঐ শুঁয়োপোকার সঙ্গে লড়াই করতে?"
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে কাতাগিরি তার চশমা খুলে হাতে নিয়ে কাঁচ পরিষ্কার করা শুরু করলো। "সত্যি বলতে, কাজটা নিয়ে আমার যথেষ্ট আগ্রহ নেই। কিন্তু মনে হচ্ছে না যে আগ্রহ নেই বলেই কাজটা থেকে আমি মুক্তি পাবো।"
"পাবেন না," ব্যাঙ বলল। "এটা আসলে দায়িত্ববোধ এবং সম্মানের ব্যাপার। আপনার হয়তো কাজটা নিয়ে 'যথেষ্ট আগ্রহ' নেই, কিন্তু আমাদের আর কোন উপায়ও নেইঃ আমাকে আপনাকে মাটির নীচে যেতেই হবে ঐ শুঁয়োপোকার সঙ্গে লড়াই করতে। এতে করে যদি আমাদের প্রাণও চলে যায়, আমাদের জন্য কেউ সমবেদনা প্রকাশ করবে না। অপরদিকে আমরা যদি পোকাটাকে হারাতে সক্ষমও হই, কারো কাছ থেকে কোন প্রশংসাও পাবো না আমরা। কেউ এটা জানবেও না যে এমন একটা লড়াই মাটির নীচে হয়েছিল কোনদিন। শুধু আপনি আর আমিই জানবো এ লড়াইয়ের ব্যাপারে। কাজেই, এটা খুব একাকী এক যুদ্ধ।"
কাতাগিরি নিজের হাতের দিকে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ, তারপর তার দৃষ্টিশক্তি অনুসরন করলো সিগারেটের ধোঁয়ার উদগিরনকে। শেষমেশ সে বলল - "দেখুন মিঃ ব্যাঙ, আমি খুব সাধারন একজন মানুষ।"
"খালি 'ব্যাঙ' , মিস্টার ছাড়া," ব্যাঙ বলল, তবে কাতাগিরি তার কথায় কর্ণপাত করলো না।
"আমি সাধারনের চেয়েও সাধারন ছাপোষা একজন মানুষ। আমার মাথায় টাক পড়ে যাচ্ছে, পিপের মতো একটা ভুঁড়ি আছে আমার। আমার বয়স চল্লিশ, 'ফ্ল্যাট ফিট' - সমস্যা আছে পায়ে। এই তো সেদিন ডাক্তার বললেন আমার মধ্যে ডায়াবেটিক লক্ষণাদিও আছে। সবশেষ যে মেয়েটাকে নিয়ে বিছানায় গেছি, তারও তিনমাস হয়ে গেছে, আর আফসোসের ব্যাপার, এ জন্যে তাকে আমার টাকা দেয়া লেগেছে। আমার এই বিভাগে ঋণ উদ্ধারের জন্য আমার কিছু পরিচিতি আছে বটে, কিন্তু অফিসের কেউই সে অর্থে আমাকে সম্মান করে না। এমন একজন ব্যক্তিও দুনিয়ায় নেই, নেই আমার অফিসে বা ব্যক্তিগত জীবনে - যে আমাকে পছন্দ করে। মানুষের সঙ্গে গুছিয়ে কথা বলতে পারি না, অপরিচিতদের সঙ্গে তো আরও লেজেগোবরে অবস্থা হয়, তাই আমার কখনো নতুন বন্ধু হয় না। আমার কোন অ্যাথলেটিক নৈপুণ্য নেই, মিউজিক্যাল বিভিন্ন নোটেশনের পার্থক্য বুঝি না, উচ্চতায় খাটো, ফিমোটিক, সমস্যার কারনে চোখে অল্প দেখি। আমার এ এক ভয়াবহ জীবন। কেবল খেয়ে, ঘুমিয়ে, আর হাগু করে জীবনটা পার করে দিচ্ছি। আমি যে আদৌ বেঁচে আছি কেন, আমার তাও জানা নেই। আমার মতো একজন মানুষের কেন টোকিও শহরকে বাঁচানোর গুরুদায়িত্ব কাঁধে নিতে হবে?"
"কারন, মিঃ কাতাগিরি, শুধুমাত্র আপনার মতো একজন লোকই টোকিও শহরকে বাঁচাতে পারবে। আর আপনাদের মতো মানুষদের জন্যেই আমি টোকিওকে বাঁচানোর পন নিয়ে নেমেছি।"
কাতাগিরি আগেরবারের চেয়েও গভীর দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করল। "ঠিক আছে, আমাকে কি করতে হবে?"
ব্যাঙ কাতাগিরির সঙ্গে তার পরিকল্পনা শেয়ার করলো। তারা দুজনে মিলে ১৭ ফেব্রুয়ারি রাতে (ভূমিকম্প সংঘটিত হবার একদিন আগে) মাটির নীচে প্রবেশ করবে। মাটির নীচে প্রবেশের রাস্তা হবে টোকিও সিকিউরিটি ব্যাংকের শিনজুকু ব্রাঞ্চের বেইজমেন্টের বয়লার রুম। তারা সেদিন রাত গভীরে সে জায়গায় মিলিত হবে (কাতাগিরি ওভারটাইম করার নাম করে সে রাতে থেকে যাবে ব্যাংকে)। সেখান থেকে মাটির নীচে নামবার পথ, এবং খাড়া একটা মই পাওয়া যাবে। মই ধরে নীচে নামতে নামতে একপর্যায়ে মই শেষ হয়ে গেলে প্রায় ১৫০ ফুট লম্বা রশির মই বেয়ে আরও নীচে নামতে হবে। এরপর গিয়ে সেই পোকার দেখা পাওয়া যাবে।
"আপনার কোন ফাইট স্ট্রাটেজি, বা রণপরিকল্পনা আছে?" কাতাগিরি প্রশ্ন করে।
"অবশ্যই আছে। এই শুঁয়োপোকার মতো প্রবল এক প্রতিপক্ষকে কোন রণনীতি ছাড়া হারানো কিভাবে সম্ভব? ওটা খুবই চিকন একটা প্রাণী। পুরো শরীরের কোনটা যে মুখ আর কোনটা যে পাছা - বোঝা দুষ্কর। এছাড়াও, দৈর্ঘ্যে সে একটা কমুটার ট্রেনের সমান লম্বা।"
"তাহলে আপনার রণনীতিটা কি?"
কিছুক্ষন চিন্তায় ডুবে থেকে ব্যাঙ বলল - "হুমমম, কি যেন একটা কথা আছে না - সাইলেন্স ইজ গোল্ডেন, বা নিরবতাই সম্পদ, এ ধরনের?"
"বলতে চাইছেন, আমার জানার প্রয়োজন নেই?"
"অনেকটা সেরকমই।"
"আমি যদি একদম শেষমুহূর্তে ভয় পেয়ে পালিয়ে যাই? সে ক্ষেত্রে আপনি কি করবেন মিঃ ব্যাঙ?"
"ব্যাঙ। শুধু ব্যাঙ।"
"হ্যাঁ, ব্যাঙ। কি করবেন তখন আপনি?"
ব্যাঙ কিছুক্ষন চিন্তা করে উত্তর দিলো, "আমার একারই তাহলে লড়তে হবে। সে ক্ষেত্রে আমার জয়ের সম্ভাবনা, আনা কারেনিনার ছুটন্ত ইঞ্জিনকে পরাজিত করবার সম্ভাবনার চে' অল্পএকটু বেশী হবে। আপনি আনা কারেনিনা পড়েছেন, মিঃ কাতাগিরি?"
যখন ব্যাঙ শুনলো যে কাতাগিরি আনা কারেনিনা পড়েনি, সে এমন এক দৃষ্টিতে কাতাগিরির দিকে তাকালো, যার শাব্দিক তর্জমা হবে - 'ছিঃ, আপনার লজ্জা হওয়া উচিৎ।' দেখা গেলো, ব্যাঙ আনা কারেনিনা অনেক পছন্দ করে।
"যা হোক, তবুও আমার বিশ্বাস, মিঃ কাতাগিরি, আপনি এই লড়াইয়ে আমাকে একা রেখে চলে যাবেন না। এটা আসলে পুরুষত্বের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যাপার। বিচি আছে নাকি নাই - তার প্রমাণ দেবার প্রশ্ন। আপনার বিচি থাকলে লড়াই ছেড়ে পালিয়ে যাবেন না। অদ্ভুত ব্যাপার দেখেন, লড়াইয়ের প্রস্তাব নিয়ে আমি এসেছি আপনার কাছে, বিচির দোহাই দিয়ে অনুরোধ করছি লড়াইয়ে অংশ নিতে, এদিকে আমার নিজেরই বিচি নাই। ব্যাঙের তো বিচি থাকবার কথাও না। হা হা হা!" ব্যাঙ মুখ খুলে হাসা শুরু করলে বোঝা যায় - তার জীবনে কেবল বিচির অভাবই স্পষ্ট নয়। এই ব্যাঙের কোন দাঁতও নেই।
যা হোক, জীবনে অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটে যায়।
১৭ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যেবেলা কাতাগিরিকে গুলি করা হয়। সারাদিনের মতো ঋণগ্রহীতাদের অফিস-বাড়ি ঘুরে ফিরে দেখা করে সে সময় সে শিনজুকুর সড়ক ধরে ফিরছিল ট্রাস্ট ব্যাংকে তার অফিসরুমে। এমন সময় লেদার জ্যাকেট পরা এক তরুন তার সামনে লাফ দিয়ে এসে দাঁড়ায়। অনুভূতিশূন্য চেহারার লোকটির হাতে একটি ছোট কালো পিস্তল ধরা ছিল। সে পিস্তল এতটাই ছোট, আর এতোটাই কালো যে - দেখে মনেই হচ্ছিল না যে ওটা খেলনা ছাড়া আর কিছু। কাতাগিরি যখন অবাক হয়ে বস্তুটার দিকে তাকিয়ে ছিল, সে খেয়াল করে ওঠে নি যে বন্দুকটা তার দিকে তাক করে ধরা, আর লোকটি ট্রিগারে চাপ দিতে যাচ্ছে। সবকিছু এতো দ্রুততার সঙ্গে ঘটছিলো যে পুরো ব্যাপারটাকেই কল্পনা বলে মনে হচ্ছিল।
পিস্তলের ব্যারেলের ঝাঁকি কাতাগিরির চোখে ধরা পড়েছিল, একই সঙ্গে সে অনুভব করেছিল, কেউ একজন হাতুড়ি দিয়ে তার কাঁধে আঘাত করেছে। কোন ব্যাথা অনুভব করতে না পারলেও সে গুলির তোড়ে ছিটকে গিয়ে পড়েছিল রাস্তার ওপর। তার হাতের ব্রিফকেস উড়ে গিয়ে পড়ে রাস্তার অন্যপাশে। ছেলেটি আবারো তার দিকে বন্দুক তাক করে। আরও একটি গুলির আওয়াজ শোনা যায়। রাস্তার ওপর রাখা এক রেস্তোরার সাইনবোর্ড কাতাগিরির চোখের সামনে উড়ে যায়। কাতাগিরি তার আসেপাশে মানুষের চিৎকার চ্যাঁচামেচি শুনতে পায়। ততক্ষণে তার চশমা উড়ে গেছে। চারপাশ ঘোলা। সে অস্পষ্টভাবে টের পাচ্ছিল যে, ঐ ছেলেটা তার দিকে বন্দুক তাক করে এগিয়ে আসছে। আমি মারা যাচ্ছি, কাতাগিরি ভাবলো। ব্যাঙ তাকে বলেছিল, সত্যিকারের ভয় সেটা যার বিস্তার মানুষের কল্পনার জগতে ঘটে। কাতাগিরি তার কল্পনার সুইচ অফ করে ভরহীন নৈঃশব্দের পৃথিবীতে ডুব দেয়।
যখন সে চোখ খোলে, সে নিজেকে আবিষ্কার করে এক বিছানায়। এক চোখ খুলে আগে সে চারপাশের অবস্থা দেখে নেয়, তারপর সে তার অপর চোখ খোলে। সবার আগে যা তার নজর কাড়ে, তা হচ্ছে মাথার কাছে এক লৌহ দণ্ড থেকে ঝুলন্ত তরল ঔষধ ভরা এক প্ল্যাস্টিকের ব্যাগ, যা থেকে ফোঁটায় ফোঁটায়, টুপ টুপ করে ঔষধ প্রবেশ করছে তার শরীরে। তার পাশে, সাদা পোশাকে একজন নার্স। সে অনুভব করে যে সে একটা শক্ত বিছানায় চিত হয়ে শুয়ে আছে, এবং তার শরীর জুড়ে এক অদ্ভুত পোশাক - যার নীচে নিজেকে তার প্রায় নগ্ন অনুভব হচ্ছে।
ওহ হ্যাঁ, সে ভাবলো, আমি রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলাম, যখন কেউ একজন আমাকে গুলি করে। কাঁধে, খুব সম্ভবত। ডান পাশে, বোধয়। সে মনে মনে পুরোটা ঘটনা আর একবার কল্পনা করলো। লোকটার হাতে ছোট কালো বন্দুকটার কথা স্মরণে আসা মাত্রি তার হৃদপিণ্ডে এক বড়সর ধাক্কা লাগলো। মাদারচোদগুলো আমাকে মেরে ফেলতে চেয়েছিল, সে ভাবল। কিন্তু মনে হচ্ছে আমি এ যাত্রা বেঁচে গেছি। আমার স্মৃতিশক্তি ঠিক আছে। শরীরে কোন ব্যাথা নেই। শুধু ব্যাথা নেই, তা নয় - আমি শরীরে কিছুই অনুভবই করতে পারছি না। পারছি না আমার হাত নড়াচড়া করতে...
এই হাসপাতালের কক্ষে কোন জানালা নেই, কাজেই কাতাগিরি দিন রাতের হদিস পাচ্ছিল না। সে বিকেল পাঁচটার একটু আগে গুলিবিদ্ধ হয়। তখন থেকে নিয়ে কতোটুকু সময় গেলো, এরমধ্যে ? ব্যাঙের সাথে মাটির নীচে গিয়ে তার যে লড়াই - তার সময় কি পার হয়ে গেছে? কাতাগিরি রুমের মাঝে ঘড়িটাকে খুঁজে বের করার চেষ্টা করলো, কিন্তু তার চশমা ছাড়া সে কিছুই দেখতে পেল না।
"এক্সকিউজ মি," সে নার্সকে ডাকে।
"বাহ! অবশেষে আপনার জ্ঞান ফিরেছে।" নার্স প্রফুল্লকণ্ঠে বলে।
"ক'টা বাজে এখন?
সে তার হাতঘড়ির দিকে তাকায়।
"সোয়া নয়টা।"
"রাত?"
"এ কেমন বোকার মতো প্রশ্ন? এখন দিনের বেলা!"
"সকাল সোয়া নয়টা?" কাতাগিরি কাতরে উঠে বালিশ থেকে স্রেফ তার মাথাটা নাড়তে পারে অল্প একটু। তার কম্পিত কণ্ঠস্বর কাতাগিরির নিজের বলে মনে হচ্ছিল না। "সকাল সোয়া নয়টা, ১৮ ফেব্রুয়ারি?"
"ঠিক," হাতের ঘড়িতে আর একবার নজর বুলিয়ে নার্স বলে "আজ ১৯৯৫ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি।"
"আজ সকালে টোকিও শহরে কোন বড়সড় ভূমিকম্প হয় নি?"
"টোকিওতে?"
"টোকিওতে।"
নার্স ডানেবামে মাথা নাড়ল। "আমার জানা মতে, না।"
কাতাগিরি স্বস্তির নিঃশ্বাস ত্যাগ করলো। যাই হোক মধ্যখানে, অন্তত ভূমিকম্প এড়ানো গেছে।
"আমার আঘাতের কি অবস্থা?"
"আপনার আঘাত?" নার্স জিজ্ঞেস করলো। "কোন আঘাত?"
"যে জায়গায় আমার গুলি লেগেছিল।"
"গুলি?"
"হ্যাঁ, ট্রাস্ট ব্যাংকের প্রবেশদ্বারের কাছাকাছি। এক তরুণ আমাকে গুলি করেছিল। খুব সম্ভবত আমার ডান কাঁধে।"
নার্সের মুখ জুড়ে এক অস্বস্তির হাসি ছড়িয়ে পড়লো। "আমি দুঃখিত, মিঃ কাতাগিরি, কিন্তু আমার জানামতে আপনার শরীরে কোন গুলির ক্ষত নেই।"
"নেই? আপনি নিশ্চিত?"
"ততোটাই, যতটা নিশ্চিত আজ সকালে টোকিওতে কোন ভূমিকম্প না হওয়ার ব্যাপারে।"
কাতাগিরি বোকা বনে গেল। "তাহলে আমি এই হাসপাতালে কি করছি?"
"কেউ একজন আপনাকে রাস্তার অজ্ঞান হয়ে পড়ে থাকা অবস্থায় খুঁজে পায়। শিনজুকুর কাবুকিচু এলাকায়। শরীরের বাইরে আপনার কোন ক্ষত ছিল না। আপনি কেবল বরফের মতো ঠাণ্ডা হয়ে শুয়ে ছিলেন। আমাদের এখনো এ নিয়ে কোন ধারনা নেই যে - কেন, কিভাবে এটা হয়েছিল। ডক্টর শীঘ্রই আসবেন। তার সঙ্গে কথা বলে দেখতে পারেন।
সড়কে অজ্ঞান হয়ে পড়েছিল সে? কাতাগিরির এখনো নিশ্চিত মনে হচ্ছে, সে তার দিকে বন্দুক তাক হতে দেখেছে। কাতাগিরি এক লম্বা শ্বাস নিয়ে পরিষ্কার মাথায় চিন্তা করা শুরু করলো। সমস্ত ঘটনাপ্রবাহকে তার একটা ধারাবাহিকতার মধ্যে আনতে হবে।
"আপনি বলছেন যে, আমি গতকাল সন্ধ্যা থেকে এই হাসপাতালের বিছানায় অজ্ঞান হয়ে শুয়ে আছি, তাই তো?"
"ঠিক তাই," নার্স উত্তর দিলো। "কিন্তু রাতটা আপনার খুব খারাপ কেটেছে মিঃ কাতাগিরি। আপনি ক্রমাগত দুঃস্বপ্ন দেখে গেছেন। আমি আপনাকে চিৎকার করতে শুনেছি - 'ব্যাঙ! এই ব্যাঙ!' আপনি এই চিৎকার চ্যাঁচামেচি প্রায় সারারাত ধরেই করে গেছেন। ব্যাঙ নামে আপনার কোন বন্ধু আছে?"
কাতাগিরি চোখ বন্ধ করে তার ধীর, ছন্দবদ্ধ হৃদস্পন্দন মনোযোগ দিয়ে শোনা আরম্ভ করলো, যা তার জীবন থেকে ক্ষয়ে যাওয়া সেকেন্ডগুলোকে যূথবদ্ধ করছে। যা কিছু যতটুকু ঘটলো - এর মাঝে কতোটুকু বাস্তব, আর কতোটুকু তার হ্যালুসিনেশন? এই ব্যাঙ বলতে আসলেই কি কিছু ছিল? সে কি সত্যিসত্যিই মাটির নীচে দানবাকৃতির শুঁয়োপোকাকে লড়াই করে হারিয়ে ভূমিকম্প থামিয়েছে? নাকি এ সবই তার এক লম্বা স্বপ্নের অংশ? সত্য-মিথ্যার ব্যাপারে কাতাগিরি ততক্ষণে তার স্বাভাবিক বিবেচনাবোধ হারিয়ে ফেলেছে।
সে রাতে আবারো ব্যাঙ এলো তার হাসপাতাল কক্ষে। কাতাগিরির ঘুম ভেঙ্গে গেলে সে রুমের আবছা আলোয় দেখল, ব্যাঙ বসে আছে তার রুমে, রুমে রাখা ষ্টীলের চেয়ারে, দেয়ালে পীঠ ঠেকিয়ে। ব্যাঙের বড়, কোটর থেকে ঠেলে বেরিয়ে আসা চোখ তার বদ্ধ পাপড়ির নীচ থেকে সামান্য একটু দেখা যাচ্ছে।
"ব্যাঙ!" কাতাগিরি ডেকে উঠলো।
ব্যাঙ খুব ধীরে তার চোখের পাপড়ি মেললো, তার বিশাল সাদা রঙের ভুঁড়ি নিঃশ্বাস - প্রশ্বাসের সঙ্গে ওঠানামা করছিল।
"সেদিন রাতে আমার বয়লার রুমে আপনার সঙ্গে দেখা করবার জন্যে পুরো প্রস্তুতি ছিল, যেমনটা আমি কথা দিয়েছিলাম," কাতাগিরি বলে, "কিন্তু সন্ধ্যায় আমার একটা অনাকাঙ্ক্ষিত দুর্ঘটনা ঘটে, তারপর তারা আমাকে এখানে এনে রেখে দেয়।"
ব্যাঙ খুব হালকা করে তার মাথা নাড়ে। "আমি জানি। সমস্যা নেই। দুশ্চিন্তা করবেন না। গতরাতের লড়াইয়ে আপনি আমাকে দারুনভাবে সাহায্য করেছেন মিঃ কাতাগিরি।"
"আমি সাহায্য করেছি?"
"হ্যাঁ। আপনি স্বপ্নের মাঝে আমাকে সাহায্য করেছেন। আর এ কারনেই আমি শেষমেশ ঐ দৈত্যটাকে হত্যা করতে পেরেছি। আমার কাছে আপনার একটা বড়সড় ধন্যবাদ পাওনা আছে।"
"বুঝতে পারছি না," কাতাগিরি বলে। "পুরোটা সময় আমি অচেতন ছিলাম। আমাকে ওষুধ দিয়ে রাখা হয়েছিল। স্বপ্নে কিছু করবার কোন স্মৃতিই আমার মধ্যে নেই।"
"ভালো তো, মিঃ কাতাগিরি। ভালো হয়েছে যে আপনার কিছু মনে নেই। এই ভয়াবহ লড়াইয়ের পুরোটাই সংঘটিত হয়েছে কল্পনার জগতে। এটাই এই যুদ্ধের ময়দানের ঠিকানা, সংক্ষেপে। এখানেই আমরা আমাদের জয় - পরাজয় উপলব্ধি করি। আমাদের সবার হাতেই সময় খুব কম, আমাদের সবাইকে একপর্যায়ে এসে হার মেনে নিতে হয়। কিন্তু, আর্নেস্ট হেমিঙ্গওয়ে যেমনটা খুব স্পষ্ট করে বলেছেন - মানবজীবনের মুল্য সে কিভাবে জয়লাভ করে, তার ওপর নির্ভর করে না। নির্ভর করে সে কিভাবে পরাজিত হয়, তার উপর। আপনি আমি মিলে, মিঃ কাতাগিরি, টোকিও শহরের ধ্বংস রোধ করতে পেরেছি।। প্রায় ১ লাখ ৫০ হাজার মানুষের জীবন বাঁচিয়েছি আমরা।"
"কিভাবে আপনি ঐ পোকাকে হারালেন? আমিই বা কি করছিলাম তখন?"
"আমরা আমাদের সবকিছু দিয়ে, সবটুকু দিয়ে একদম শেষপর্যন্ত লড়াই করেছি। আমরা -" ব্যাঙ কথা থামিয়ে বিশাল করে একবার শ্বাস নেয়। "হাতের কাছে যা যা অস্ত্র পেয়েছি, তার সবই আমরা ব্যাবহার করেছি। ভেতরের সাহসের সবটুকু নিংড়ে ঢেলে দিয়েছি যুদ্ধের ময়দানে। আমাদের শত্রুর প্রধানতম সঙ্গী ছিল অন্ধকার। আপনি লড়াইয়ে একটা ফুট - পাওয়ারড জেনারেটর নিয়ে হাজির হন এবং জায়গাটাকে আলোকিত রাখতে নিজের সর্বশক্তি ব্যয় করেন। সে বিশাল - কদাকার পোকা আপনাকে ভয় দেখিয়ে তাড়িয়ে দিতে চেয়েছিল বারবার, অন্ধকারের প্রেতদের পাঠিয়ে। কিন্তু আপনি মাটি কামড়ে পড়েছিলেন। অন্ধকারের সঙ্গে আলোর এক ভয়াবহ লড়াই হয়েছিল, এবং সেই আলোতে আমি দানবাকৃতির পোকাটার সঙ্গে কুস্তি করেছি। সে বারবার আমাকে তার সরীসৃপের মতো শরীর দিয়ে পাকিয়ে ধরছিল, আমার সারা শরীর তার দেহ থেকে নিঃসৃত নোংরা তরলে ভরে গিয়েছিল। আমি তাকে ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে ফেলি, তবুও সে মরছিল না। পরবর্তীতে সে নিজেকে অসংখ্য ছোট ছোট পোকায় পরিনত করে ফেলে। আর তারপর..."
ব্যাঙ চুপ হয়ে গেলো, কিন্তু শীঘ্রই, নিজের শরীরের শেষ শক্তিটুকুও নিঃশেষ করে দিচ্ছে, এমনভাবে সে আবারো কথা বলা শুরু করলো। "ফিওদর দস্তয়েভস্কি, অতুলনীয় মায়ামমতা দিয়ে তাদের গল্প তুলে এনেছে নিজের লেখায়, যারা পৃথিবীতে ঈশ্বরের কৃপালাভে ব্যার্থ হয়েছে। তিনি মানুষের অস্তিত্ব এই কিম্ভূতকিমাকার প্যারাডক্সের মধ্যে খুঁজে পান যে - যে মানুষ ঈশ্বরের ধারনা আবিষ্কার করলো, সে মানুষকেই একদিন তার ঈশ্বর ভুলে যায়, ত্যাগ করে। পোকার সঙ্গে লড়াই করতে করতে আমার বারবার দস্তয়ভস্কির 'হোয়াইট নাইটস' - এর কথা মনে পরছিল। আমি ..." ব্যাঙ আর কথা বলতে পারছিল না। "মিঃ কাতাগিরি, আপনি কি রাগ করবেন যদি আমি একটু চোখ বুজি? আমি খুবই ক্লান্ত।"
"অবশ্যই," কাতাগিরি বলে, "খুব ভালো এবং গভীর একটি ঘুম আপনার পাওনা।"
"শেষমেশ আমি কিন্তু পোকাটাকে হারাতে পারি নি।" চোখ বোজা অবস্থাতেই ব্যাঙ বলে। "ভূমিকম্প থামাতে পারলেও পোকার সঙ্গে আমার লড়াই ড্র এ গিয়ে থেমেছে। আমরা কেউ কাউকে হারাতে পারি নি। আমি ওকে আহত করেছি, ও আমাকে আহত করেছে। কিন্তু আপনাকে একটা সত্য বলতে চাই , মিঃ কাতাগিরি..."
"কি সেটা, ব্যাঙ?"
"আমি সন্দেহাতীতভাবে একটি ব্যাঙ। কিন্তু একই সঙ্গে আমি 'না' - ব্যাঙ, বা 'অ' - ব্যাঙের পৃথিবীকেও রিপ্রেজেন্ট করি।"
"হুমমম, আমি কিছুই বুঝছি না।"
"আমিও না," ব্যাঙ বলল, তার চোখ তখনো বন্ধ। "এটা স্রেফ একটা অনুভূতিই, যা আমার ভেতরে কাজ করছে। যা আপনি আপনার চোখে দেখছেন, তা যে সবসময় সত্যি হবে - এমনটা নয়। আমার শত্রু, আরও অনেক কিছুর সাথে, আমার ভেতরে যে আমি আছি - সেই আমিটা। এই আমি'র ভেতরই আবার আছে এক 'অ' - আমি... আমার মস্তিষ্ক থকথকে হয়ে যাচ্ছে... ট্রেনের ইঞ্জিন ছুটে আসছে আমার দিকে... কিন্তু আমি সত্যি সত্যি চাই যে আপনি উপলব্ধি করেন আমি কি বলতে চাইছি, মিঃ কাতাগিরি।"
"আপনি ক্লান্ত, ব্যাঙ। ঘুমানোর চেষ্টা করুন। ভালো লাগবে।"
"আমি খুব ধীরে আবারো কাদায় পরিনত হচ্ছি, মিঃ কাতাগিরি। কিন্তু তবুও ... আমি ..."
ব্যাঙ তার কথার ওপর দখল হারিয়ে কোমায় চলে গেলো। দুপাশে তার ঝুলন্ত হাতদ্বয় প্রায় মেঝে ছুঁয়ে ছুঁয়ে রইল, এবং তার বিশাল মুখ হাঁ হয়ে রইল। খুঁটিয়ে দেখতে কষ্ট হলেও, কাতাগিরি লক্ষ্য করলো, ব্যাঙের শরীর জুড়ে গভীর ক্ষতের আভাস। শরীরে লম্বা লম্বা কাটা দাগ, মাথায় আর একটা আঘাত - যেখানে তার মাংস ছিঁড়ে গেছে।
কাতাগিরি দীর্ঘসময় ধরে তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে রইল ব্যাঙের দিকে, যে এখন চেয়ারটাতে গভীর ঘুমের চাদরে নিজেকে আপাদমস্তক মুড়ে বসে আছে। হাসপাতাল থেকে ছাড়া পাওয়া মাত্র আমি আন্না কারেনিনা আর "হোয়াইট নাইটস" - এ দুটো বই কিনে মনোযোগ দিয়ে পড়বো। এরপর ব্যাঙের সাথে লম্বা সময় নিয়ে সাহিত্য বিষয়ক আড্ডা দেয়া যাবে।
কিছুক্ষণের মধ্যেই ব্যাঙের পুরো শরীর মোচড়াতে আরম্ভ করলো। কাতাগিরি প্রথমে মনে করলো, এ হয়তো ঘুমের মধ্যেই শরীরের স্বাভাবিক আঁকাবাঁকা হওয়া, কিন্তু সে শীঘ্রই নিজের ভুল অনুধাবন করতে পারল। ব্যাঙের শরীরের ঝাঁকুনির মধ্যে একটা অস্বাভাবিক - অপ্রকৃতস্থতা আছে। যেন বড়সর এক পুতুলকে কেউ ঝাঁকি দিচ্ছে পেছন থেকে ধরে। কাতাগিরি তার নিঃশ্বাস চেপে রেখে তাকিয়ে রইল। সে পারলে তখনি দৌড়ে যেতো ব্যাঙের কাছে, কিন্তু তার শরীর প্যারালাইজড হয়ে সে শুয়ে ছিল নিজের বিছানায়।
কিছুক্ষন পর ব্যাঙের ডান চোখটা গোল হয়ে ফুলে ওঠা শুরু করলো। একই ধরনের বীভৎস কুৎসিত একটা আকৃতি গজিয়ে উঠলো ব্যাঙের কাঁধে, পাশে, এবং শরীরের অন্যত্রও। কাতাগিরির চিন্তা করে কোন থই পাচ্ছিলো না - কি হচ্ছে এই ব্যাঙের? সে নিঃশ্বাস বন্ধ করে তাকিয়ে রইল।
তারপর, হঠাৎ করে ব্যাঙের শরীরের ফুলে ওঠা টিউমারের একটি শব্দ করে ফেটে গেলো। চামড়া উড়ে গেলো এবং সারা ঘরভর্তি বাজে গন্ধ ছড়িয়ে একপ্রকার আঠালো তরল বেরিয়ে এলো সেখান থেকে। বাকি ফুলে ওঠা অংশগুলোও একে একে ফাটতে আরম্ভ করলো, সঙ্খ্যায় প্রায় ২০ - ৩০টার মতো। ফলশ্রুতিতে ব্যাঙের শরীরের চামড়া, এবং তরল উড়ে উড়ে ঘরের পুরো দেয়াল রাঙ্গাতে শুরু করলো। জঘন্য, অসহ্যকর গন্ধে পুরো হাসপাতাল কক্ষ ভরে গেলো। এর মাঝে আবার ব্যাঙের শরীরের ছিদ্রগুলো দিয়ে নানা আকার আকৃতি ও আঙ্গিকের ছোটছোট শুঁয়োপোকা বেরিয়ে আসতে শুরু করলো। ফোলা ফোলা সাদারঙের কিলবিলে পোকা। তাদের পিছু পিছু বেরিয়ে এলো ছ্যাঙ্গা ধরনের কিছু শত শত পা বিশিষ্ট কিলবিলে পোকা। তাদের শত শত পা'র নড়াচড়া রুমজুড়ে এক প্রবল অস্বস্তিকর, গা সিরসিরে শব্দ সৃষ্টি করলো। যেন অনন্তকাল ধরে এ সমস্ত পোকামাকড় বের হতে থাকল ব্যাঙের শরীর থেকে। ব্যাঙের শরীর, বা একদা যা ব্যাঙের শরীর ছিল - সে বস্তু ততক্ষণে পুরোপুরি ঢাকা পরে গেছে অন্ধকারের জীবদের আড়ালে। তার বড় বড় চোখ দুটো লাফিয়ে বেরিয়ে এলো চোখের কোটর থেকে, এবং মেঝেতে পড়া মাত্রই শক্তিশালী চোয়াল বিশিষ্ট কিছু কালো রঙের পোকা তাদের খেয়ে ফেললো। সরু কিলবিলে পোকাগুলি দ্রুত দেয়াল বেয়ে সিলিঙ্গে উঠে পড়ে ফ্লুরোসেন্ট আলোকে ঢেকে ফেলল। তাদের একটা দল স্মোক অ্যালার্মের মেশিনটাকে ফুটো করে ঢুকে পড়লো ভেতরে।
পুরো মেঝে জুড়ে তখন সেই কিলবিলে পোকাদের রাজত্ব। তারা কাতাগিরির বিছানার পাশে রাখা ল্যাম্পে চড়ে বসে তা ঢেকে ফেলল, এবং তাদের এক বিরাট অংশ দলে দলে উঠে আসতে শুরু করলো কাতাগিরির বিছানায়। শত শত পোকা কাতাগিরিকে ঢেকে রাখা চাদরকে ছিদ্র করে, ছিন্ন বিচ্ছিন্ন করে উঠে আসলো কাতাগিরির শরীরে। বেডগাউনের নীচে কাতাগিরির পা বেয়ে তারা উঠতে লাগলো তার উরু বরাবর। তাদের মধ্যে সবচে ছোট পোকাগুলো কাতাগিরির পায়ুপথ, নাক, এবং কান দিয়ে শরীরের ভেতর ঢুকে পড়লো। আর সাইজে বড় ছ্যাঙ্গাগুলো কাতাগিরির মুখের ভেতর প্রবেশ করা আরম্ভ করলো ঝাকে ঝাকে। প্রচন্ড হতাশা ও ভয়ে কাতর কাতাগিরি চিৎকার করে উঠলো।
কেউ একজন শব্দ করে সুইচ অন করা মাত্র রুমটি আলোতে ভরে গেলো।
"মিঃ কাতাগিরি!" নার্স ডেকে উঠলো। কাতাগিরি তার চোখ খুলে আলোর দিকে নিবদ্ধ করলো। তার পুরো শরীর ঘামে ভেজা। পোকামাকড়গুলো চলে গেছে। কাতাগিরির শরীর জুড়ে কেবল এখনো সেই গা শিরশিরে অনুভূতি।
"আবারো দুঃস্বপ্ন, তাই না? আহারে বেচারা।" দ্রুত গতিতে একটি ইনজেকশন প্রস্তুত করে কাতাগিরির হাতে তার সূচ ফোটাতে ফোটাতে বলে, নার্স।
কাতাগিরি লম্বা, গভীর এক শ্বাস নিয়ে আস্তে আস্তে তা ত্যাগ করে। তার হৃদস্পন্দন ভয়াবহভাবে ওঠা নামা করছে।
"কি নিয়ে স্বপ্ন দেখছিলেন আপনি?
কাতাগিরির জন্য স্বপ্ন আর বাস্তবকে আলাদা করা সম্ভব মনে হচ্ছিল না।
"যা আপনি চোখ দিয়ে দেখছেন, তার সবকিছু কিন্তু সত্য না।" নিজেকে নিজে প্রবোধ দেয়ার মতই সজোরে বলে ওঠে সে।
"খুব সত্যি," নার্স মিষ্টি হেসে বলে "বিশেষত স্বপ্নের ক্ষেত্রে।"
"ব্যাঙ..." কাতাগিরি ফিসফিসিয়ে ওঠে।
"ব্যাঙের কি কিছু হয়েছে?" নার্স জিজ্ঞেস করে।
"সে টোকিও শহরকে ভূমিকম্পে ধংস হওয়া থেকে বাঁচিয়েছে, সম্পূর্ণ একা। একক প্রচেষ্টায়।"
"ভালো তো।" শরীরে সূচ দিয়ে প্রবেশ করাতে থাকা তরল ওষুধের খালি ব্যাগকে নতুন আর একটি ওষুধ ভর্তি ব্যাগ দ্বারা প্রতিস্থাপন করতে করতে নার্স বলে, "টোকিওতে আর নতুন কোন সমস্যা আমার দেখতে চাইনা। এমনিতেও এখানে সমস্যার কোন অভাব নেই।"
হাসিমুখে কাতাগিরির কপালের ঘাম মুছে দিতে দিতে সে নার্স প্রশ্ন করে, "আপনি ঐ ব্যাঙকে খুব পছন্দ করতেন, তাই না, মিঃ কাতাগিরি?"
"ট্রেনের ইঞ্জিন," কাতাগিরি আপনমনে বিড়বিড় করে, "অন্য সবার চে।" তারপর সে তার চোখ বোজে, এবং এ যাত্রা গভীর, শান্ত, এবং স্বপ্নবিহীন ঘুমে ডুব দেয়।
১২ ই এপ্রিল, ২০২২ রাত ১০:৫৮
সাজিদ উল হক আবির বলেছেন: গল্পে কাতাগিরির ক্রাইসিস কিন্তু আমাদের মতো মধ্যবিত্তদের সবাইকেই স্পর্শ করে, খেয়াল করে দেইখেন।
২| ১১ ই এপ্রিল, ২০২২ রাত ১২:৩৯
সন্ধ্যা রাতের ঝিঁঝিঁ বলেছেন: আপনার অনুবাদ চমৎকার। এক টানে পড়ে গেছি, একবার ও মনে হয়নি অনুবাদ পড়ছি। সাফল্য কামনা করছি।
১২ ই এপ্রিল, ২০২২ রাত ১১:০০
সাজিদ উল হক আবির বলেছেন: অনুপ্রেরণাদায়ী মন্তব্যে বিনীত ধন্যবাদ। অনেক শুভকামনা আপনার জন্যে!
৩| ১১ ই এপ্রিল, ২০২২ দুপুর ১২:০৫
বিটপি বলেছেন: রিপোস্ট করলেন কেন? আমি তো ভেবেছি আগের গল্পটার সিকুয়েল বুঝি। তাই আগ্রহ নিয়ে পড়তে গেছিলাম।
১২ ই এপ্রিল, ২০২২ রাত ১১:০৩
সাজিদ উল হক আবির বলেছেন: মুরাকামির গল্প নিয়ে আমি একটা অনুবাদ প্রোজেক্টের মধ্যে আছি। প্রতিমাসে একটা করে গল্প অনুবাদ করি। অনুবাদ শেষে ওটার রাফ একটা ভার্শন প্রথমে শেয়ার করি, নামহীনভাবে। ১ দিন পর ওটা ড্রাফটে নিই। সেই অনুবাদ কোথাও ছাপা হবার পর পার্মানেন্টলি ওটা ব্লগে জমা করে রাখি। এটা সেই পার্মানেন্ট ভার্শন। এই প্রক্রিয়া মোটামুটি পুরো বছর জুড়ে চলবে ইনশাআল্লাহ।
৪| ১২ ই এপ্রিল, ২০২২ রাত ১১:৩০
মনিরা সুলতানা বলেছেন: চমৎকার !
১৩ ই এপ্রিল, ২০২২ রাত ৮:০৫
সাজিদ উল হক আবির বলেছেন: শুকরিয়া আপা!
©somewhere in net ltd.
১| ১০ ই এপ্রিল, ২০২২ বিকাল ৪:৫৫
ফয়সাল রকি বলেছেন: বেচারা কাতাগিরি!