নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

সাজিদ উল হক আবির

সাধু সাবধান ! ব্লগের মালিক বঙ্গালা সাহিত্যকে ধরিয়া বিশাল মাপের ঝাঁকি দিতে নিজেকে শারীরিক ও মানসিক ভাবে প্রস্তুত করিতেছেন। সেই মর্মে তিনি এখন কিটো ডায়েটিং, ডন-বৈঠক ও ভারোত্তলন প্রশিক্ষণে ব্যস্ত। প্রকাশিত গ্রন্থঃ১। শেষ বসন্তের গল্প । (২০১৪)২। মিসিং পারসন - প্যাত্রিক মোদিয়ানো, ২০১৪ সাহিত্যে নোবেল বিজয়ী (অনুবাদ, ২০১৫) ৩। আয়াজ আলীর ডানা (গল্পগ্রন্থ - ২০১৬ ৪। কোমা ও অন্যান্য গল্প(গল্প গ্রন্থ, ২০১৮) ৫। হেমন্তের মর্সিয়া (কবিতা, ২০১৮) ৬। কাঁচের দেয়াল (গল্পগ্রন্থ, ২০১৯) ৭।শহরনামা (উপন্যাস, মাওলা ব্রাদার্স, ২০২২), ৮। মুরাকামির শেহেরজাদ ও অন্যান্য গল্প (অনুবাদ, ২০২৩), ৯। নির্বাচিত দেবদূত(গল্পগ্রন্থ, ২০২৪), ১০। দেওয়ানেগির চল্লিশ কানুন/ফরটি রুলস অফ লাভ (অনুবাদ, ঐতিহ্য, ২০২৪)

সাজিদ উল হক আবির › বিস্তারিত পোস্টঃ

শনিবারের চিঠি - ২ঃ ঢাকা শহরের রাস্তায় এক অভিমানী মানুষ

০৬ ই নভেম্বর, ২০২১ সকাল ৮:১৭

নভেম্বর মাস একেকজনের কাছে একেক অর্থ বহন করে। স্কুলগামী ছেলেপেলেদের জন্য নভেম্বর মানে বার্ষিক পরীক্ষা, আর শীতের ছুটির আগমনী মাস। তাদের চে' এক ধাপ উঁচুতে যারা আছে, তাদের কাছে নভেম্বর হল ব্যাডমিন্টন কোর্ট কাটার দিন। সকাল বিকেল কোদাল, ফিতে, রঙ নিয়ে তারা মহল্লার বাছাইকৃত জায়গায় বসে পড়ে কোর্ট মাপজোক করবার কাজে। রাতের বেলা বাতি জ্বালিয়ে ব্যাডমিন্টন খেলার শুরুও এই মাসেই। আর এক গোষ্ঠী আছে, যারা নভেম্বরকে 'নো শেইভ নভেম্বর' ঘোষণা দিয়ে নভেম্বর মাস গোঁফ দাঁড়ি কামানো বন্ধ করে দেয়। ঘটনা কিছুই না, তারা নভেম্বর মাসে স্রেফ শেভ করা বন্ধ করে দেয়। কেন? - জানা নেই। মাগরেবের এক লেখকগোষ্ঠীর খবর পেয়েছিলাম কিছুদিন আগে, ইউটিউবে, যারা নভেম্বর মাসকে নভেল লেখার মাস হিসেবে বিবেচনা করে। অর্থাৎ, এ মাসের ত্রিশদিনে, গড়ে ১৭০০ - ১৭৫০ শব্দ করে লিখে তারা একমাসে ৫০,০০০ শব্দের একটি উপন্যাস শেষ করে। এটা তাদের একটা আন্তর্জাতিক আয়োজন। পৃথিবীর যে কোন প্রান্তের লেখক তাদের ওয়েবসাইটে রেজিস্ট্রি করে অংশ নিতে পারে এই বিশাল যজ্ঞে। খাদ্যরসিক মানুষজনের কাছে নভেম্বর পিঠা - পুলির মাস। ঢাকা শহরের রাস্তাঘাটেই বছরের এই সময়টা থেকে হরেকরকমের পিঠার পসরা সাজিয়ে বসেন মৌসুমি পিঠা বিক্রেতারা। ভাসমান গরীব দুঃখী মানুষের জন্য নভেম্বর মাস, শীতের বাড়তি কষ্টের নাম।

আমার মতো ছাপোষা মানুষের কাছে নভেম্বর সম্পূর্ণ ভিন্ন এক দ্যোতনা বহন করে। নভেম্বর, আমার - আমাদের কাছে ট্যাক্সদানের মাস। সারাবছরের আয়ব্যায়ের হিসেব মিলিয়ে সরকারের হাতে নিজের কষ্টার্জিত অর্থের কতোটুকু অংশ তুলে দেব - এই নিয়ে গলদঘর্ম হওয়ার সময়। এই বছরে পরিশোধযোগ্য করের পরিমান হিসেবটিসেব করে এখন স্রেফ ডাক ছেড়ে কাঁদা বাকি। তা যেহেতু করতে পারছি না, যখনই ঢাকা শহরের রাস্তায় বেরুচ্ছি - নিজেকে এটা সেটা দেখিয়ে প্রবোধ দিয়ে শান্ত করে রাখার চেষ্টা করছিঃ এই যে সড়ক, পীচ ঢালাই করা, আমার ট্যাক্সের টাকা ছাড়া এটা কিভাবে সম্ভব হত? এই যে মাথার ওপর ফ্লাইওভার, ইউলুপ, আগতপ্রায় মেট্রোরেল, টিভিতে দেখা পদ্মাসেতু - আমার ট্যাক্সের টাকাতেই তো নির্মাণ হচ্ছে এ সব! এগুলো নিজেকে বলি, সান্ত্বনা দেই, আর ভেতর থেকে উঠে আসা কান্নার দমক চেপে রাখি কোনক্রমে।

গতকাল বিকেলেও তাই করছিলাম, যখন বাসাবো আড়ং থেকে রিকশায় করে খিলগাঁও যাচ্ছিলাম, আমার শ্বশুরবাড়ি। সপ্তাহে একবার বেড়াতে যাওয়ার চেষ্টা করি আমার শ্বশুর - শাশুড়িকে দেখে আসতে, তাদের সঙ্গে খাওয়া দাওয়া করে আড্ডা দিতে। কালকে রওনা দিতে দিতেই প্রায় মাগরিবের আজানের সময় হয়ে গেছে। তারোপর বাসাবো কদমতলির মোড়ে কিম্ভূতকিমাকার জ্যাম। সাধারন সময়ের চে' অনেক বেশী সময় পর একটা রিকশা পেয়ে লাফিয়ে তাতে চড়ে বসেছি, আর আসেপাশের সরকারি ইনফ্রাস্ট্রাকচারগুলো দেখে দেখে নিজেকে সান্ত্বনা দিচ্ছি, আগেই যেমন বললাম।

এরমধ্যে খেয়াল করলাম, আমার স্ত্রী বেশ জোর গলায় রিকশাওয়ালাকে কি যেন বলে চলেছে। মনোযোগ দিয়ে শোনার পর বুঝলাম, রিকশাওয়ালার শম্ভুকগতিতে চালানো নিয়ে তার আপত্তি। এমনিই সন্ধ্যা হয়ে গেছে, দেরি যত হবে, বাবা - মায়ের সঙ্গে সময় তত কম কাটানো যাবে।

আমাদের রিকশাওয়ালা, বয়সে তরুন, আমার বয়সিই হবে হয়তো, কিন্তু শরীরের গড়নে খুবই দুবলা পাতলা, সে ঘুরে আমাদের দিকে ফিরে হাত নাড়িয়ে নাড়িয়ে কি নিয়ে যেন বক্তৃতা দেয়া শুরু করলো। তার ভাষা, ও বচনের প্রায় কিছুই বুঝতে পারছিলাম না।

এমতাবস্থায় হয় চুপ করে থাকা উচিৎ, অথবা, ওকে কথা থামিয়ে নিজের কাজে মন দিতে বলা উচিৎ। কিন্তু আমি তা না করে, জানিনা কেন, মনোযোগ দিয়ে ওর কথা শোনার চেষ্টা করলাম। বহু কষ্টে, ওর জড়ানো কণ্ঠস্বর এবং আঞ্চলিকতা মিশ্রিত ভাষার বুহ্য ভেদ করে বুঝতে পারলাম, সে জোরে রিকশা চালাতে পারছে না, কারন সে দুপুরে খায় নি।

কেন খায় নি, জিজ্ঞেস করতে বেরোলো আরেক খবর। রিকশার গ্যারেজের মালিক তাকে সকালে রিকশা নেয়ার সময় ঝাড়ি দিয়েছে। আমার রিকশাওয়ালার কথা হল - সে স্বাধীন পেশাজীবী, তাকে ঝাড়ি কেন দিবে? যদি ঝাড়ি খেয়ে থাকতে হতো, তবে সে বাঁধা মাইনের চাকরিই করতে পারত। সে জানালো যে - কোন এক রড নির্মাণ ফ্যাক্টরিতে সে মাসে সাড়ে বাইশ হাজার টাকা বেতনে চাকরিও করত এক সময়ে। মানুষের ঝাড়ি খেতে তার ভালো লাগে না বলে সে চাকরি ছেড়ে দিয়ে ঢাকায় এসে রিকশা চালানো শুরু করেছে। সেখানেও, আজ সকালে তার গ্যারেজের মালিক তাকে কি বিষয় নিয়ে যেন ঝাড়ি দিয়েছে, ফলে তার মন খারাপ। গ্যারেজের মালিকের ওপর রাগ করে সে আজ সারাদিন ভাত খায় নি। শুধু তাই না, ছয় ঘণ্টা ধরে রিকশা চালাচ্ছে সে কোন প্যাসেঞ্জার ছাড়া। কোন প্যাসেঞ্জার না উঠিয়ে ক্ষোভের ঠ্যালায় খালি রিকশা নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে ঢাকা শহরের অলিগলি।

রিকশার চাকা ঘোরে, আর আমি ভাবি - এই অভিমানী তরুণ রিকশাচালকের ঢাকা শহরের মতো নির্মম এক মেট্রোপলিটন সিটিতে কী গতি হবে? কে করবে ওর নাজুক অনুভূতির মূল্যায়ন? গ্যারেজের মালিকের ঝাড়িতে সকাল থেকে না খেয়ে খালি রিকশা নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে ঢাকা শহরের অলিগলিতে। এখন প্রায় সন্ধ্যা। ক্ষুধার কারনে শরীর কাঁপছে, রিকশা টানতে পারছে না ঠিকমতো। ক'দিন লাগবে ওর পাগল হয়ে রাস্তায় নামতে? এই যে যারা চটের বস্তা গায়ে গলিয়ে উষ্কখুষ্ক চুলে অসংলগ্ন বুলি মুখে, উদ্ভ্রান্ত দৃষ্টিতে ঢাকা শহরের সড়কে হেঁটে বেড়ায় - এই প্রবল অভিমানি তরুণ, নিজের আবেগের মূল্যায়ন না পেয়ে কি সামিল হবে তাদের দলে?

গন্তব্যে পৌঁছে রিকশা থেকে নেমে সামান্য কিছু ভাড়া বাড়িয়ে দিয়ে হেঁটে চলি। মনের একটা অংশ চায়, পেছনে ফিরে গিয়ে ওকে শক্ত করে একবার বুকে জড়িয়ে ধরতে। রাস্তার পাশে ওকে নিয়ে বসে বুঝিয়ে বলতে - এই শহর কতো নির্মম। কেউ শুনবে না ওর কষ্টের কথা। কেউ দেবে না ওর আবেগের দাম। অন্য কারো সঙ্গে ঝগড়ার কারনে নিজের খাবার বন্ধ রাখবার কোন যুক্তি নেই। ঢাকা শহরে তো না ই, পৃথিবীর কোথাও না। আত্মবিধ্বংসী যেকোনো আবেগই ভুল আবেগ।

পারিনি অবশ্যই, ফিরে গিয়ে এই কাজগুলো করতে। ওকে জড়িয়ে ধরতে, কিংবা ওকে নিয়ে কোথাও বসে কথা বলতে। এগুলো আমাদের মধ্যবিত্ত মানসের রোমান্টিক কামনা, বাস্তবে যা প্রায় কখনোই পুরন করা হয়ে ওঠে না। তবে ওকে এক প্যাকেট খাবার কিনে দেয়া উচিৎ ছিল। ঘটনার ঘনঘটায় তৎক্ষণাৎ মাথায় আসে নি ব্যাপারটা। মনটা ভার হয়ে আছে তখন থেকে। এরপর থেকে, ক্ষুধার তাড়নায় ভুগছে - এমন যেকোনো মানুষকে অন্তত সে বেলার খাবারের সংস্থান করবো - মনে মনে এমন একটা সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর পর কিছুটা ভালো লাগছে।

খোদা তার এই অবোধ অভিমানী সৃষ্টিকে যেন পৃথিবীর নরম কোমল চেহারাই দেখান সবসময়।

মন্তব্য ৪ টি রেটিং +৪/-০

মন্তব্য (৪) মন্তব্য লিখুন

১| ০৬ ই নভেম্বর, ২০২১ সকাল ১০:৩৭

খায়রুল আহসান বলেছেন: যুবকটির আত্মসম্মানবোধ প্রখর, তাই সে রড কারখানার মাসিক সাড়ে বাইশ হাজার টাকা বেতনের চাকুরি ছেড়ে দিয়ে স্বাধীন পেশা হিসেবে রিক্সা চালনাকে বেছে নিয়েছে। হয়তো এই আত্মসম্মানবোধ থেকেই তার অভিমানটাও জন্ম নিয়েছে।

"খোদা তার এই অবোধ অভিমানী সৃষ্টিকে যেন পৃথিবীর নরম কোমল চেহারাই দেখান সবসময়" - আল্লাহতা'লা যেন আপনার এই সুন্দর মনোবাসনাটা পূরণ করে দেন! আমীন!

০৭ ই নভেম্বর, ২০২১ দুপুর ১:০২

সাজিদ উল হক আবির বলেছেন: ধন্যবাদ স্যার। আমার আশঙ্কা, তার এই অতিসেনসিটিভ আচরন তাকে এই হৃদয়হীন শহরে মানসিক অসুস্থতার দিকে নিয়ে যেতে পারে। এটা যাতে না হয়, তাই এ দোয়া।

২| ০৬ ই নভেম্বর, ২০২১ রাত ৮:৩৪

স্বামী বিশুদ্ধানন্দ বলেছেন: একটি মনকাড়া মানবিক পোস্ট !

০৭ ই নভেম্বর, ২০২১ দুপুর ১:০৩

সাজিদ উল হক আবির বলেছেন: ধন্যবাদ স্বামীজী। অনেকদিন পর। ভালো আছেন আশা করি। : )

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.