নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
সাধু সাবধান ! ব্লগের মালিক বঙ্গালা সাহিত্যকে ধরিয়া বিশাল মাপের ঝাঁকি দিতে নিজেকে শারীরিক ও মানসিক ভাবে প্রস্তুত করিতেছেন। সেই মর্মে তিনি এখন কিটো ডায়েটিং, ডন-বৈঠক ও ভারোত্তলন প্রশিক্ষণে ব্যস্ত। প্রকাশিত গ্রন্থঃ১। শেষ বসন্তের গল্প । (২০১৪)২। মিসিং পারসন - প্যাত্রিক মোদিয়ানো, ২০১৪ সাহিত্যে নোবেল বিজয়ী (অনুবাদ, ২০১৫) ৩। আয়াজ আলীর ডানা (গল্পগ্রন্থ - ২০১৬ ৪। কোমা ও অন্যান্য গল্প(গল্প গ্রন্থ, ২০১৮) ৫। হেমন্তের মর্সিয়া (কবিতা, ২০১৮) ৬। কাঁচের দেয়াল (গল্পগ্রন্থ, ২০১৯) ৭।শহরনামা (উপন্যাস, মাওলা ব্রাদার্স, ২০২২), ৮। মুরাকামির শেহেরজাদ ও অন্যান্য গল্প (অনুবাদ, ২০২৩), ৯। নির্বাচিত দেবদূত(গল্পগ্রন্থ, ২০২৪), ১০। দেওয়ানেগির চল্লিশ কানুন/ফরটি রুলস অফ লাভ (অনুবাদ, ঐতিহ্য, ২০২৪)
১।
আজ ১৪২৮ বঙ্গাব্দের চৌঠা শ্রাবন। হুমায়ূন আহমেদের লোকান্তরে যাওয়ার ৯ বছর পূর্তি। ঢাকার যে প্রান্তে আমার বাস, সেখানে মেঘে ঢাকা আকাশ থেকে থেকে গুড়গুড় করছে। থম ধরা পরিবেশ। আজকের দিনে হুমায়ূন আহমেদের পরিবারের সবাই আমাদের জীবনে প্রাসঙ্গিক। তাঁরা বেঁচে আছেন, সক্রিয় আছেন, সহি সালামত আছেন। আনন্দের সংবাদ আমাদের জন্যে। এই পরিবারটির নিকট বাংলাদেশের শিল্প - সংস্কৃতিমনা মানুষরা নানাভাবে ঋণী।
.
হুমায়ূন আহমেদ আজ মাটির নীচে শায়িত প্রায় একদশক। নতুন করে তাকে নিয়ে কিছু আবেগ জর্জর কাব্যিক কথাবার্তা কিই বা বলবো। গবেষণা বলে মৃতদেহ কবরে রাখার পর তার কঙ্কাল মাটির নীচে সাধারণত ১০ - ১৫ বছর টিকে থাকে, ধুলো হয়ে যাওয়ার আগে। কাজেই নুহাস পল্লীতে আজ যদি বৃষ্টিও হয়, সে বৃষ্টি হুমায়ূন আহমেদের কবরের মাটি চুয়ে তার সাদা হয়ে যাওয়া হাড়গুলোকে স্পর্শ করছে - সর্বোচ্চ এতটুকুই হয়তো আমরা আন্দাজ করতে পারি। শ্রাবণ মেঘের দিনকে যে লেখক এতোটা রোম্যান্টিক করে উপস্থাপন করেছেন তার লেখায়, এতোটা প্রাসঙ্গিক করে গেছেন আমাদের জীবনে, তাকে এভাবে স্মরণ করাটা খুব একটা সুখকর নয় আমাদের জন্য।
.
২।
আমি বরং হুমায়ূন আহমেদের ব্যক্তিজীবনের সবচে সেনসিটিভ একটি অংশ নিয়ে লিখতে আগ্রহী আজ। পারিবারিক জীবনে বড় কঠিন অভিযোগ এবং দায় মাথায় নিয়ে মারা গেছেন স্বাধীন বাংলার অন্যতম সেরা এ লেখক। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল প্রায় ৩০ বছরের একটি সংসারের মর্যাদাকে ভূলুণ্ঠিত করা। নিজের স্ত্রী - পুত্র - কন্যার প্রতি অবিচার করা। নিজের কন্যার সমবয়েসি একটি মেয়ের সঙ্গে প্রণয়ের সম্পর্ক গড়ে তোলা, এবং তাকে পরবর্তীতে বিয়ে করা।
.
আমার আগ্রহ - এই জায়গাটায় আজ একটু খনন করা। ভিন্ন আঙ্গিক থেকে কিছু প্রশ্ন তোলা এই পুরো বিষয়টি ঘিরে, যে দৃষ্টিকোন থেকে আলাপ কখনোই খুব প্রমিনেন্ট ছিল না। অন্তত আমি দেখি নি কোনদিন বাংলাদেশের সাহিত্যে ও সামাজিক ডিসকোর্সে।
.
৩।
'হুমায়ূন আহমেদ তার প্রথম সংসারের সঙ্গে যা করেছেন' - তার জন্যে তাকে তার প্রাক্তন স্ত্রী, এবং সন্তানরা ক্ষমা না করতে পারেন। কেননা, পুরো কষ্টকর ব্যাপারটির সঙ্গে তাঁরা দীর্ঘদিন যাবত সরাসরি জড়িত ছিলেন। কিন্তু এই কাজটির জন্যে আমরা, পাঠকরা বাহির হতে হুমায়ূন আহমেদকে বিচারের কাঠগড়ায় তুলতে পারি? মন্তব্য তো করাই যায়, প্রতিনিয়তই করে চলছি আমরা, কিন্তু তা কতটুকু সঠিক হবে?
.
৪।
একটা দাম্পত্য জীবনে কখন কীভাবে অপূর্ণতা বোধ সৃষ্টি হয়, কখন কীভাবে সমস্যা দানা বাঁধে - এ নিয়ে ঢালাওভাবে মন্তব্য করাটা সম্ভব নয়। যদি স্বামী - স্ত্রীর সম্পর্কের মধ্যে কোন তৃতীয় ব্যক্তি হিসেবে কোন নারী উপস্থিতি হয় - তবে আমাদের সমাজে বহুলাংশে সে সমস্যার দায় স্বামীর ওপর দেয়া হয়।
.
অনেকটা সে সূত্রেই, আমরা হুমায়ূন আহমেদের পাঠক ভক্তরা বাহির হতে মোটা দাগে যা শুনেছি তা হোল - শাওনের প্রতি হুমায়ূন আহমেদের অনুরাগের মতো অগ্রহণযোগ্য, অবমাননাকর একটা ঘটনা তার পরিবারের কারো পক্ষে মেনে নেয়া সম্ভব হয় নি। যার ফলশ্রুতিতে গুলতেকিন খান এবং হুমায়ূন আহমেদের ডিভোর্স।
.
৫।
বিষয়টা কি এরকম যে - হুমায়ূন হুট করে মেহের আফরোজ শাওনের প্রেমে পড়েন, এবং তারপর তার স্ত্রীর সংসারে ভাঙ্গন ধরে?
.
নাকি হয়তো এমনটা হওয়াও সম্ভব যে - হয়তো ভিন্ন কিছু বা বেশকিছু ইস্যুতে তার স্ত্রীর সঙ্গে হুমায়ূনের সমস্যা হচ্ছিল, বনিবনা হচ্ছিল না? হয়তো হুমায়ূনের কিছু কষ্ট ছিল - যা তাকে ঘরের বাইরে ভালোবাসা খুঁজতে বাধ্য করে?
.
আমরা, বহিরাগতরা কি নিশ্চিতভাবে এ ব্যাপারে কোন মন্তব্য করতে পারি?
.
যার সৃষ্ট সাহিত্যে চরিত্রগুলি এতোটা আবেগি, এতোটা সেনসিটিভ, এতোটা কাইন্ড এবং এমপ্যাথি বিশিষ্ট, যিনি মানুষের চরিত্রের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম দাগের ওপর দিয়ে হেঁটে চলেন তার সাহিত্যকর্মে - তিনি এতো বড় দানব?
.
হুট করে কন্যার সমবয়স্ক একটি মেয়ের প্রেমে পড়ে সংসার তছনছ করবার দায় নিয়ে বেঁচে থাকার মতো একজন মানুষ কী তিনি?
.
আমরা যখন হ্যাঁ বলি, বা না বলি - এই প্রশ্নগুলোর উত্তরে, আমরা কতোটা নিশ্চিত হয়ে বলি? আমাদের কি প্রমাণ আছে? আমরা কি দুইপক্ষের বক্তব্য শুনেছি?
.
এই প্রেক্ষিতে হুমায়ূন আহমেদকে এতটুকু বেনিফিট অফ ডাউট কী দেয়া যায় না যে - হয়তো তার আগের সংসারেও সমাধান অযোগ্য কিছু সমস্যার মধ্যে তিনি ছিলেন?
.
অর্থাৎ কেবলই পুরুষ হিসেবে হুমায়ূন আহমেদের চারিত্রিক দোষের কারণে নয়, বরং সংসার জীবনে কিছু অপ্রাপ্তির কষ্টও তাকে বাধ্য করে এমন একটা সিদ্ধান্ত নিতে?
.
৬।
শাওনকেই কেন? যিনি তার মেয়ের বয়েসি, এবং মেয়ের বান্ধবী, কারো কারো মতে?
.
মানুষ কেন, কীভাবে, কার প্রতি আকর্ষিত হয় - এটা ব্যাখ্যা করা মুশকিল। তবে এটা সঠিক যে হুমায়ূন - শাওনের সম্পর্ক যে অবস্থায় শুরু হয়ে যেদিকে টার্ন নেয়, আমাদের সমাজের এ ধরণের সম্পর্ক সাক্ষাৎ ট্যাবু।
.
এখানেও হুমায়ূন আহমেদকে এতটুকু সততার ক্রেডিট আমি দিতে চাই যে, সংসার জীবনের কোন অপূর্ণতার কষ্ট তিনি র্যা ন্ডম মডেল - নায়িকা বা ভক্ত তরুণীদের সঙ্গে অর্থহীন শারীরিক - মানসিক সম্পর্কের মাধ্যমে মেটানোর চেষ্টা করেন নি। তিনি পূর্ণতা খুঁজেছেন সমাজের প্রথাগত পদ্ধতি বিয়ের মাধ্যমেই। প্রাক্তন স্ত্রীর সংসার থেকে বেরিয়ে এসেছেন। বিয়ে করেছেন শাওনকে। ঘটনাক্রমে যিনি তার কন্যার সমবয়স্ক।
.
কিন্তু শাওনই কেন?
.
আমি এই জায়গায় নিজের অনুমানের সাহায্য নেবো।
.
অনুভূতিশীল মানুষ যারা - তাঁরা একদম অপরিচিত র্যাঘন্ডম মানুষজনের সঙ্গে গোড়া থেকে সম্পর্ক গড়ে তুলতে ভয় পায়। বরং একটি অসম্পূর্ণ সম্পর্ক থেকে বেরিয়ে আরেকটি সম্পর্কের মধ্যে সমাধান খুঁজতে গেলে তাঁরা পরিচিত মানুষকে প্রেফার করে। কারণ, আমাদের শরীর প্রায় সবার এক উপায়ে কাজ করে - সেটা জান্তব। কিন্তু মানুষের মনের গতিপ্রকৃতি একেকজনেরটা একেকরকম। যে কারণে ওয়ান নাইট স্ট্যান্ডে অপরিচিত কারো সামনে নিজের পোশাক খুলে ফেলতেও অনেকের ততটা লজ্জা হয় না, যতটা মানুষ অসহায় বোধ করে কারো সামনে নিজের মনকে, মনের কষ্টকে, দুর্বলতাকে, ভালনারেবিলিটিকে নগ্নভাবে উপস্থাপন করবার সময়।
.
মেহের আফরোজ শাওনের সঙ্গে হুমায়ূন আহমেদের অতি দীর্ঘদিনের পরিচয়। কাজেই, এটা সম্ভব যে হুমায়ূন আহমেদের মধ্যে যদি কোন কষ্ট থেকে থাকে, হতে পারে তিনি শাওনের সঙ্গে তা কখনো কখনো শেয়ার করেছেন। হয়তো সেখান থেকেই তাদের মধ্যে একটা আন্ডারস্ট্যান্ডিং, এবং আন্ডারস্ট্যান্ডিং থেকে বন্ডিং গড়ে উঠেছে। হুমায়ূন আহমেদের বয়সে, সোশ্যাল স্ট্যাটাসে - একটা অসম্পূর্ণ সম্পর্ক থেকে বেরিয়ে আসার জন্যে ২০ - ২৫ বছর বয়সের তরুণদের মতো প্রেমিকা বা জীবনসঙ্গী খোঁজার অ্যাপ্রোচ গ্রহণ করা সম্ভব ছিল না। শাওন, হয়তো দীর্ঘদিন ধরে হুমায়ূন আহমেদকে জানা এবং বোঝার কারণেই পেরেছিলেন হুমায়ূনের অন্তরের গভীরের সেই কষ্টের জায়গাটায় হাত রাখতে। শাওনের সঙ্গে সম্পর্ক নিয়ে হুমায়ূন আহমেদের কোন ক্ষেদ বা কষ্ট ছিল না ভবিষ্যৎ জীবনে। শাওনের দুজন পুত্রসন্তানের পিতাও তিনি। এই ব্যাপারটা অন্তত এটা নিশ্চিত করে যে - স্রেফ মজা করার জন্যে শাওনের সঙ্গে তার সম্পর্ক ছিল না। হুমায়ূন শাওনের সম্পর্ক ছিল গভীর ও তাৎপর্যপূর্ণ সম্পর্ক, তাদের দুজনের জীবনে।
.
৭।
অনেকগুলো 'হয়তো' র সমন্বয়ে লেখাটি প্রস্তুত করলাম। এবং আমার লেখাটিও অ্যাজাম্পশন বেসিসে তৈরি। তবে তার অর্থ এই নয় আমি কোন স্বামীর নিজের স্ত্রীকে ডিচ করা সমর্থন করি, বা নিজের কন্যার বয়সী কাউকে ডেট করা প্রমোট করি।
.
যদি সামারি করি, আমি বলতে চাইছি - হুমায়ূন আহমেদ একজন মহান সাহিত্যিক ও সৃজনশীল মানুষ হওয়ার পাশাপাশি একজন সাধারণ মানুষও বটে, যার বিদ্যমান সংসারে ঝুটঝামেলা হতে পারে, এবং সেটা তাকে সংসারের বাইরে কোথাও সুখ খুঁজতে বাধ্য করতে পারে।
.
এই যে আমার আন্দাজ, এটা খুব একটা প্রমিনেন্ট আলাপ নয় আমাদের দেশে। হুমায়ূনকে এই লেন্সে কেউ দেখার চেষ্টা করে নি। অন্তত আমার চোখে সে প্রয়াস ধরা পড়ে নি। "গুলতেকিন - হুমায়ূন - শাওন" বিষয়ক পাবলিক ডিসকোর্সে মোটাদাগে তাকে সুখের সংসার পায়ে মাড়িয়ে গুঁড়িয়ে দেয়া এক নারীলোলুপ দানব হিসেবেই রিপ্রেজেন্ট করা হয়েছে বেশীরভাগ সময়।
.
হুমায়ূন হয়তো আরও একটু সহানুভূতির দাবীদার পাবলিক সেন্টিমেন্টের কোর্টে এই গোটা বিচারিক প্রক্রিয়ায়।
.
হয়তো ...
.
৮।
প্রথমে উত্থাপন করা প্রশ্নটি দিয়ে শেষ করি। কাকে হুমায়ূন ডেকেছিলেন বর্ষামুখর দিনে, তার কাছে, যদি মন কাঁদে? মেহের আফরোজ শাওন অপূর্ব কণ্ঠে গেয়েছেন গানটি। শুধুই কী শাওন এইগানের উদ্দেশ্য? নাকি গানটি ইনজেনারেল একটি বানিজ্যিক গান? নাকি এই গানে তিনি তার কন্যা শিলাকেও ডেকেছেন, নোভাকেও ডেকেছেন, ডেকেছেন তার পুত্র নুহাসকেও, তার কাছে?
.
হুমায়ূন তো তার ছেলে মেয়েদের ভুলতে পারেন নি কখনো। তার প্রাক্তন স্ত্রী'র প্রতি তার অনুভূতি ছাড়াছাড়ির পর, এবং মৃত্যুসজ্জায় কি ছিল - আমাদের জানা নেই। দ্বিতীয় স্ত্রী শাওনকে তিনি অনেক ভালোবেসেছেন। তার শেষ জীবনের লেখায় তা স্পষ্ট।
.
একই সঙ্গে এও তো আমরা জানি, পুত্র নুহাস হুমায়ূনের সঙ্গে দেখা করবার জন্যে তিনি প্রায়ই তার প্রাক্তন স্ত্রীর বাড়ির সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতেন। ছেলেকে ফোন দিয়ে বলতেন, বাবা তোর পছন্দের বড় চিংড়ি নিয়ে এসেছি। তুই খাবি না?