একটা এককোষী অ্যামিবাকে অণুবীক্ষণে দেখলে বেশ অবাক লাগে। এককোষী প্রাণী অথচ এমন ভাবে চলবে যেন সে খুব বোঝে। তাপমাত্রা একটু বাড়ালে ছুটতে থাকবে অন্যদিকে।চোখ নেই কিন্তু আলো বুঝবে। খাবার রেখে দিলে দু'পাশ দিয়ে ঘিরে ধরে খেয়ে ফেলবে। প্রাণীটার দু:খ হতে পারতো মাথা নেই বলে। কিন্তু মগজের অভাব বোঝার মতো মগজ তার নেই। ঝুট ঝামেলাও নেই। বিয়ে সাদী ছাড়া নিজেকে দু ভাগ করে বংশবৃদ্ধি করে। কিন্তু প্রশ্নটা গোড়াতে। এই যে প্রাণীর জীবনের একান্ত ইচ্ছে খাবে, সুবিধার জায়গায় যাবে আর বংশ বৃদ্ধি করবে এটা কেন হলো? এখন পর্যন্ত জীবজগতে ঐ নিজের স্বার্থটাই লেখা থাকে কোষের ভিতর।
অ্যামিবা অথবা নিচুশ্রেণীর প্রাণীগুলো ক্যালকুলেটরের মতো মনে হয়। বুদ্ধি আছে কিন্তু সব যুক্তি অনুযায়ী। খাওয়া পেয়েছ তো খাও। খাবার জমেছে তো বংশ বাড়াও। শীত বা গরম পেয়েছে তো পালাও। সব একলা চলো নীতি। অন্য অ্যামিব বলবে না - ভাই, টেবিলে ঠান্ডা জাউ জুড়ুচ্ছে, চলে দুজন মিলে খেয়ে আসি।
এসব বুদ্ধি দিয়ে জটিল পৃথিবীতে টিকে থাকা সহজ না। ধরা যাক চুলা ধরাচ্ছে গৃহিনী। এককোষী যদি জানতো চুলার নব ঘুরানোর সঙ্গে সঙ্গে আগুন জ্বলে। সেই আগুনে তার মা মারা গেছে। তাহলে সে দেখেই সাবধান হতো। কিন্তু এদের বুদ্ধির দৌড় সে পর্যন্তই। বুদ্ধি নেই বলেই তাদের বাচ্চা কাচ্চা হয় মিলিয়ন মিলিয়ন। মরে বেঁচে টিকে থাকে অল্প কয়টা। এর মধ্যে অবশ্য অধিকাংশ ভাইবোনই খাবারের প্রতিযোগিতায় গিয়ে অক্কা পায়। আনাড়ি ডিজাইনারের মতো প্রথম দিকের জীবনগুলোর মধ্যে অপচয় ছিল অনেক বেশী।
মগজের গড়নের বর্ণনা অনেক বইপুস্তকে আছে। তবে টিভির ব্যবহার জানতে ইলেক্ট্রনিক্স না জানলেও চলে। মগজ খাটিয়ে কী কী করা যায় সেটা মগজ যার আছে ভালই জানে।
ভবিষ্যতে হাসপাতাল থেকে বাড়ি ফেরার সময় শিশুর মাথায় লাইব্রেরীর সফটকপি লোড করে বাড়ি ফিরবে। কথা ফোটার আগেই সব শিক্ষিত হবে। এখন পর্যন্ত এসব কল্পকাহিনী। শিশুরা খালি একটা মাথা নিয়ে জন্মায়। খিদে পেলে ট্যাঁ ট্যাঁ কাঁদে আর ঘুম যায়। যেন সেই অ্যামিবার মতো। খাদ্যগ্রহণ এবং কষ্ট পেলে কি করবে এর বাইরে কিছু জানা নেই। শিশুরা কয়েক মাস বেশ বোকা থাকে (তাদের বাবা মায়েরা অবশ্য ক্ষেপে যাবে)। তারপর তারা কথা বলতে শিখে যায়। শিখে যায় কোলে উঠতে, হাঁটতে এমন কি চকলেটের জন্য বায়না ধরতে । কী করে এই শেখাটা ঘটে?
২৮৬ কম্পিউটারের যুগ থেকে হৈচৈ চলছে মস্তিস্কের বিকল্প পাওয়া গিয়েছে। কম্পিউটারের বিজ্ঞানীদের কথা আর কি বলবো। বড় বড় সংখ্যা গুণভাগ করে ফলাফল চুম্বকের ডিস্কে সঞ্চয় করার দিন থেকে গায়ে ফুঁ দিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। মনে পড়ে যেদিন আইবিএমএর ডিপব্লু নামের দুনিয়ার সমান কম্পিউটার ক্যাসপারভ কে দাবায় হারালো - কী সে উষ্মা, যন্ত্রের বিজয়! অথচ এখন পর্যন্ত যা পারে সেটা হলো সরলতম কাজ।
এটা অবশ্য ঠিক মস্তিষ্কের ডানপাশের অংশটা কম্পিউটারের সঙ্গে খুব মিল। জায়গাটা যেন যোগবিয়োগ, গুণভাগ আর যুক্তির মারপ্যাচের দোকান। মাউস, কীবোর্ড যেভাবে ইউএসবি পোর্টে যুক্ত মস্তিষ্ক যুক্ত আছে ত্বক, চোখ, নাকের মতো সেন্সরগুলোর সঙ্গে। কম্পিউটার কি নেটওয়ার্কের অন্য কম্পিউটারের কষ্ট বোঝে? অন্যগুলোর হাত মুখ নড়ানো দেখে হাসে কাঁদে, দলবেধে বিদ্রোহ করে? প্রতিবেশী কম্পিউটার হ্যাং হলে সে তো তার ডিস্কে তো ইউটিউবের ছবি লোড করতেই থাকে। মানুষের পার্থক্যটা সেখানেই (অমানুষগুলো ছাড়া)
অন্য ভাবে বললে, মানুষের অন্তরে সহমর্মিতা আছে যেটা কম্পিউটারে নেই (ভাগ্যিস কম্পিউটার হুজুগে চলে না, আর পরীক্ষার ফলাফল গুনতে ভেউ ভেউ কেঁদে দেয় না)। একটা জিনিস কি দেখেছেন? ফুটবল খেলা দেখতে বসলে যখনই গোলে কিক হয়, নিজের অজান্তে পা উঠে যায়। নাটকে কেউ চা খেতে থাকলে তৃষ্ণা জাগে। যখন মাধুরী কাঁদতো, মনে পড়ে বড় আপাও ঝর ঝর করে কাঁদতো। আর ৩ বছরের ভাতিজিটা শাহরুখ খানের নাচকে এমনভাবে অনুকরণ করে যে অবাক লাগে। শৈশব থেকে অন্যদের দেখে শিখেই বড় হই এবং সামাজিক হই। আর এটা অফিসে আদালতে, বাসায়, আড্ডায় চলতেই থাকে। বাংলায় হুজুগ বলে একটা কথা আছে। দুজন মিছিলে আগুন জ্বালো বলতেই, শরীরের ভেতর রক্ত খেলে যায়। এই হুজুগটা কোথা থেকে আসে?
এই বিষয়টি যখন বিজ্ঞানীদের খুব ভাবাচ্ছে তখনই একটা ঘটনা নজরে আসে। বলাবাহুল্য মস্তিস্ক নিয়ে গবেষণা খুব ধীরগতির এবং সহজ নয়। চাইলেই কারো মগজ কেটে ল্যাবে ইলেক্ট্রিক মিটার ধরে পরীক্ষার ফলাফল ঘোষণা সম্ভব না । মাথায় নানান যন্ত্রপাতি বসিয়ে ভিতরের রক্তচলাচল বৃদ্ধি মাপা অথবা মস্তিস্কের তরঙ্গ মেপে এসব জানতে হয়। এফ-এমআরআই এমন একটা পদ্ধতি। চাঁদের পাহাড়ের নামকরণের মতো, মানুষের মাথার ভিতরের প্যাচগুলোর দাঁত ভাঙা নাম দেয়া হয়ে গেছে। মস্তিষ্কের ছোট ছোট একক অংশকে বলা হয় নিউরন। ১০০ বিলিয়ন নিউরন নিয়ে মাথা গঠিত। নিউরনগুলোর কাজ জানতে এখানে ওখানে গবেষণা হচ্ছে। জানা গেছে কিছু নিউরন আছে নাটের গুরু। নাম মোটর নিউরন। এরা কী করে? যখনই হাত ছোড়া দরকার বা হাতে কিছু ধরতে হবে, তখন তারা দ্রুত সক্রিয় হয়ে ইনস্ট্রাকশন দেয়।
ইটালিতে ঘটনাটা ঘটেছিল। । সেখানে ম্যাকাক বানরের মাথায় এমআরআই প্রোব লাগানো হয়েছিল। দেখা গেছে বানরের দিকে কিছু বাড়িয়ে দিলে ঠিক ঠাক মোটর নিউরন উত্তেজিত হয়।
একদিন কাকতালীয় ভাবে দেখা গেল পাশের বানর হাত দিয়ে কিছু করতে থাকলে দর্শক বানরের মোটর নিউরনে উত্তেজনার সৃষ্টি হয়। ল্যাবে কোন এক বিজ্ঞানী আইসক্রিম নিয়ে ঢুকেছিল। মনিটরে দেখা গেল বিজ্ঞানীর আইসক্রিম খাওয়া দেখে বানরটার মোটর নিউরন এমন উত্তেজিত হলো যেন সে নিজে খাচ্ছে। বিষয়টি এমন অদ্ভুত যে আপনার সামনে অন্যরা যা করে, চুপচাপ বসে থাকলেও মগজে লুকানো ছোট ছোট আয়নায় তার অভিনয় হতে থাকে। কাজের সঙ্গে মিল রেখে নিউরনগুলো নাম দেয়া হয়েছে মিরর নিউরন বা দর্পণ নিউরন।
যখন ম্যারাডোনা খেলছে। আপনি উত্তেজিত হচ্ছেন । কারণ আর আপনার মনের দর্পনে খেলাটা অনুকরণ হচ্ছে। নাটকে কেউ কাঁদছে, আপনার দর্পণ সেই কান্নাটার প্রতিবিম্ব ভিতরে তুলে নিচ্ছে। যে কারণে শিশুর সামনে যখন মাথা নেড়ে গান করা হয় সে দ্রুত শিখে নেয়। পরীক্ষায় নকল ধরতে হেলিকপ্টার ভাড়া করে ছুটে বেড়ালেও - শেখার গোড়ায় নিউরনের কপিপেস্টের খেলা।
অনেক কিছুর উত্তর আসছে এ থেকে। যখন কবি স্মৃতিচারণ করে পাঠকের স্মৃতিতেও এই স্মৃতির বিমূর্ত একটা কপি চলে আসে। যখন সে বিদ্রোহী কবিতা পড়ে নজরুলের বিদ্রোহ তার মধ্যে সঞ্চারিত হয়। উল্লেখ্য অনেক পশুপাখীর মগজ থাকলেও বানর বা এপ ছাড়া অন্য প্রাণীদের দর্পন নিউরন তেমন নেই।
বলা হয়েছে মস্তিস্কে দর্পণ নিউরনের বিবর্তন যেদিন থেকে শুরু সেদিন থেকেই একক ভাবে গড়ে ওঠা প্রাণী সামাজিক হতে শিখেছে।
===========================================
উপরের ছবিটি টেক্সাসে জেনেটিক্যালি ক্লোন করা অ্যামিবার দলের