somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ঢাকার ট্রাফিক জ্যাম: ‘এ্যজ গুড এ্যজ ইট গেটস’

২৬ শে সেপ্টেম্বর, ২০২৪ সকাল ৮:৪৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



যারা নতুন ঢাকা শহরে এসেছেন, তাদের কাছে ট্রাফিক জ্যাম হয়তো একটা অসহ্য যন্ত্রণা মনে হতে পারে যেন সময় এখানে থমকে গেছে আর গাড়ি চলার কোনো অবস্থা নেই। কিন্তু যারা এই মহানগরে বেশ কিছুদিন ধরে বেঁচে আছেন, আমরা ভালো করেই জানি যে ট্রাফিক জ্যাম কেবল সামান্য একটি বাধা নয় এটা ঢাকার সবচেয়ে স্থায়ী বিনোদন।

একটু ভেবে দেখুন। আমাদের আর কী বিনোদনের সুযোগ আছে? যদি তাই থাকে তবে অফিস থেকে বাড়ি ফেরার তাড়া থাকে না কেন? বেলা যত বাড়ে, কাজের চাপও নাকি জ্যামেতিক হারে বাড়তে থাকে। অথচ ততক্ষনে ছুটির ঘন্টা বেজে যাবার কথা। কিন্তু ছুটির ঘন্টা বাজনা ওয়ালাও একটু ওয়েট করে কেননা ওয়েটিং এ ওভার টাইম বাড়ে! আর গিয়েও বা কি করার? বাচ্চা পড়ানো, কাপড় কাচা বা রান্নার মতন কাজতো সব করে রাখে শাকিব খানের ‘প্রিয়তমা’। টিভি? ওহ হো, সেটা আবার কি? সারা দিন ফোর জি তে রিলস আর শর্টস দেখে টিভিতে নতুন কিইবা পাওয়ার আছে। টিভি, বিগ নো নো।

হ্যাঁ, শপিং মল আছে, যেখানে আপনি প্রায় আধ্যাত্মিক অভিজ্ঞতা পাবেন যখন কারেন চলে যাবে। এলাকা উঠতি, ফুটন্ত আনাড়িকচিকদমরা গিজগিজ করবে। আপনি সেই ‘মৌচাকেঢিল’ দিতে যেতে পারবেন কি না সেটাও একটা ব্যপার কারন অনলাইন আর এফ কর্মাসে আপনি সারাদিন টুকটাক কেনাকাটা করেছেন। ভাবিদের শপহপিং এর ভিডিও দেখে ‘টোরিব্রচ’ এক একটা ব্যাগ ওর্ডার করে ফেলেছেন ভাবির সাথে কথা বলার জন্যে। তাই মলের গ্রাউন্ড ফেøার থেকে উঠে ফ্লোর এ, বি করে সি তে যাওয়া হলেও কেনার মতন কিছু পাওয়া যাচ্ছে না। মিরপুরের ক্রিকেট ম্যাচ আছে, কিন্তুস্টেডিয়ামের বাইরে এমন ট্রাফিক জ্যাম থাকে যে আপনি চাইলেও কোনো ওভার মিস করবেন না, ম্যাচে যান আর না-ই যান। কিন্তু এইসব তো ঢাকার ট্রাফিক জ্যামের মহৎ রম্য রূপের সামনে একেবারেই তুচ্ছ।

দৃশ্যটি কল্পনা করুন — আপনি এয়ারপোর্ট রোডে আটকে আছেন, এক ইঞ্চিও এগোচ্ছে না। আপনা আপনি গভীর শ্বাস চলে আসে। মোবাইলে রিলসগুলো ঠিক আসছে না। ডাটা কনজেসান! নেটওয়ার্ক লোড নিতে পারছে না। ঠিক যেমন বৃষ্টিতে ‘ক্লাইমেট চেঞ্জ’ ইফেক্ট ধরা পরে শহরের ড্রেনেজ অব্যবস্থাপনায়। আপনি পড়ে আছেন আপনার চিন্তাভাবনা আর চারপাশের কর্কশ হর্নের সুরে। লন্ডন সিম্ফনি ওর্কেস্ট্রার মতন মনে হবে। টুংটাং হয়েই যাচ্ছে কোথাও না কোথাও থেকে। এটা যেন হতাশার এক অদ্ভুত সিম্ফনি — সিসটাইন চ্যাপেল এর মতো। আপনার পাশে থাকা গাড়ি সমানে হেমস্টার হুইল টিপে যাচ্ছে নয়তো টিকটক ভিডিও স্ক্রল করছে, মনে হয় কখনোই লাল বাতি সবুজ হওয়ার কথা তার মনে পড়বে না। পড়বেই বা কেন? রাস্তার লালবাতির লালবাতি কবেই জ্বলে গেছে। রিকশাওয়ালা জিগজ্যাগ করে লেন পার করছে। তার চলাচল যেন এক নিখুঁত নৃত্য — স্বয়ং শামিম আরা নীপা নয় তো যেন নিউ সোনার বাংলা রওশন সার্কাসের ঘটি হাতা স্যান্ডো গ্যেঞ্জি পড়া মহিলাদের দুর্দান্ত এক্রোব্যাটিক কাজ। এটা ছেড়ে দ্রুত এগোতে যাবেন কেন? এটা তো জীবন — রঙিন সত্তায় ভরা!

এ ছাড়া, কোথায় পাবেন এত অসাধারণ মানবিক নাটক? প্রতিটি মোড় যেন ধীরে ধীরে উন্মোচিত হয় এক নতুন পর্বে, যেখানে ঢাকার রাস্তায় চলছে এক অন্তহীন সোপ ওপেরা বা মেগা সিরিয়ার। ঐ যে বিলাসবহুল এসইউভির ভদ্রলোক, কেতাদুরস্থ জসিম ভাই, তাকে আমি চিনি। এত বেশি কাজ থাকে তার যে উনি সময় করে পাইলসের চিকিৎসা করাতে পারে না। তাই জ্যামে বসে গাড়ির লেদার সিটের হিটার চালু রাখেন। গায়ে এসি’র বাতাস আর পশ্চাদ দেশে উষ্নটা উনি উপভোগ করেন। কিন্তু যখন গরম তেতিয়ে ওঠে তখন তিনি মনে করেন হর্ন বাজালে সামনে থাকা গাড়িগুলো ম্যাজিকের মতো অদৃশ্য হয়ে যাবে। টিপতে থাকেন হর্ন। আর রিকশাওয়ালা? পানের খিলি মুখে দিয়ে অনায়াসে দুই লেন ব্লক করে রাখছে একটিমাত্র কনুই দিয়ে । এসবের চেয়ে জীবন্ত নাটক কোথায় পাবেন?

আর ভাবুন তো, ট্রাফিক জ্যাম না থাকলে আমরা সমাজিকীকরণের আর কী উপায় রাখতাম? পার্ক, সিনেমা হল, বা সংস্কৃতি উৎসবের দরকার কী, যখন আমাদের আছে যানজটের মাঝে থেমে থাকা একটি জনগোষ্ঠী? এটা তো শহরের সবচেয়ে বড় গণতান্ত্রিক স্থান — সিইও, ছাত্র, রিকশাওয়ালা, এমনকি পথের মাঝখানে ঘুরে বেড়ানো কুকুর, সবাই একই জ্যামে আটকে থাকে। এটি প্রায় সমাজতন্ত্রের মতো, যেখানে প্রত্যেকে তাদের ন্যায্য ভাগের হতাশা প্রাপ্ত হয়।

আসলে, আমি বলবো ঢাকার ট্রাফিক জ্যামই একমাত্র সত্যিকারের গণতান্ত্রিক স্থান। আসল জ্যামে কোনো ভিআইপি লেন নেই (আসলে আছে, কিন্তু ধরি আপাতত নাই। উনি চলে গেছেন। অরেকজন আসুক তারপর না হয় হিসেবে নেয়া যাবে)। সবাইকেই সহ্য করতে হয়। এই যানজটে আমরা সবাই সময় পাই নিজের জীবন নিয়ে চিন্তা করতে, বড় বড় সিদ্ধান্ত নিতে। টলস্টয় নাকি পাঁচ বছরে ‘ওয়ার অ্যান্ড পিস’ লিখেছেন; আপনি ‘ফাউস্ট’ এর তরজমা বা আরও বড় কিছু লিখতে পারবেন শুধু ফার্মগেট পার হতে হতে।

কিছু নিন্দুক বলবেন যে ঢাকার রাস্তা ঠিক করা উচিত, ফ্লাইওভার বা মেট্রো ব্যবস্থা ট্রাফিক “সমস্যা” সমাধান করবে। কিন্তু এরা বোঝে না আমাদের কী আছে। আপনি কি পিরামিড ভেঙে ফেলবেন কারণ তা একটু পুরোনো? ভেনিসের সব পানি ছেচে ফেলবেন একটু গন্ধ আছে বলে? ঢাকার ট্রাফিক জ্যাম এক ধরনের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য। এবং ট্রাফিক জ্যাম ছাড়া আমাদের অভিযোগ করারই বা কী থাকবে? এই জ্যাম আমাদের জীবনকে উদ্দেশ্য দেয়, আমাদের একত্র করে রাখে।

তাই, পরের বার যখন ট্রাফিক জ্যামে আটকে থাকবেন, মনে রাখবেন এটাই আসল জীবন — ‘এ্যজ গুড এ্যজ ইট গেটস’। শান্তু থাকুন, পিঠের দিকে যা আছে তাতে হেলান দিয়ে উপভোগ করুন। কেননা — নিরাস হইওনা বান্দা, যদি মমিন হও। জয়ী তুমি হবেই।



সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে সেপ্টেম্বর, ২০২৪ সকাল ৮:৪৮
৬টি মন্তব্য ৪টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ঢাকার ট্রাফিক জ্যাম: ‘এ্যজ গুড এ্যজ ইট গেটস’

লিখেছেন মুনতাসির, ২৬ শে সেপ্টেম্বর, ২০২৪ সকাল ৮:৪৩



যারা নতুন ঢাকা শহরে এসেছেন, তাদের কাছে ট্রাফিক জ্যাম হয়তো একটা অসহ্য যন্ত্রণা মনে হতে পারে যেন সময় এখানে থমকে গেছে আর গাড়ি চলার কোনো অবস্থা নেই। কিন্তু যারা... ...বাকিটুকু পড়ুন

কবিতা এবং আবৃত্তি.....

লিখেছেন জুল ভার্ন, ২৬ শে সেপ্টেম্বর, ২০২৪ সকাল ১০:৪৯

কবিতা এবং আবৃত্তি.....

আমার কাছে লেখালেখির জগতে কবিতা লেখা হচ্ছে সব চাইতে কঠিন, যা লিখতে মেধার বিকল্প নাই। একজন সাহিত্যিক-উপন্যাসিক, প্রবন্ধকার যা লিখতে অনেক পৃষ্ঠা, কিম্বা একটা বইতে প্রকাশ করেন-... ...বাকিটুকু পড়ুন

একটি ছবিই যখন না বলা অনেক কথা বলে দেয়। ( উপলব্ধি - ৮ )।

লিখেছেন মোহামমদ কামরুজজামান, ২৬ শে সেপ্টেম্বর, ২০২৪ দুপুর ২:০৮


ছবি : পিআইডি

সম্প্রতি শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর ছাত্র-জনতার চাহিদা অনুসারে (৮ আগস্ট ২০২৪) বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন ডঃ মুহাম্মদ ইউনূস। তারই ধারাবাহিকতায় প্রধান উপদেষ্টা... ...বাকিটুকু পড়ুন

পিন্ডিটি কার ⁉️

লিখেছেন সরকার পায়েল, ২৬ শে সেপ্টেম্বর, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:০৫

জাতিসংঘে এখন সদল বলে ইউনুস সাহেব l বেশ ঘটা করে ক্লিন্টন সাহেবের সাথে পরিচিতি অনুষ্ঠানে আন্দোলনের মাস্টার মাইন্ডদের পরিচয় করিয়ে দিচ্ছেন ইউনুস সাহেব l অমুক তমুক এই আন্দোলনের নেতৃত্ব... ...বাকিটুকু পড়ুন

ব্যান চিরতরে বন্ধ হোক!

লিখেছেন শূন্য সারমর্ম, ২৬ শে সেপ্টেম্বর, ২০২৪ রাত ১০:৩২








ব্যান ব্যান গেমের জয়ী এ ব্লগে কারা আপনারা ভালোমতই জানেন সম্ভবত; এখানে বিভিন্ন ভাষায় অপমান-অপদস্তের যে কাউন্টার গেম চলে সেই প্যার্টানে ব্যানের লিস্টে অনেকজনের নাম থাকাটাই মনে হয় সঠিক। কিন্তু... ...বাকিটুকু পড়ুন

×