কিছুদিন আগে দেশের সংবাদপত্রে বেশ ভালোভাবেই একটা খবর এসেছিলঃ "ডিএনএ পরীক্ষার মাধ্যমে ব্যবসায়ী জামালুদ্দিনের কংকাল সনাক্ত"। কিন্তু ডিএনএ কিভাবে জামালুদ্দিনকে চিনতে পারল? আগেই বলেছি আমাদের প্রত্যেকের জেনেটিক সুত্র ভিন্ন (Identical Twin ছাড়া), তবে ভিন্ন হলেও নিকটাত্মীয়দের সাথে পার্থক্য দুরের আত্মীয়দের চেয়ে কম। সত্যি বলতে কি এই পার্থক্যের ওপর ভিত্তি করে বলা সম্ভব কে কতটুকু কাছের আত্মীয় । যেমন কোন জিনে যদি প্রতি প্রজন্মে 1টা করে মিউটেশন তৈরী হয়, তাহলে আমার ভাইবোনদের সাথে ঐ জিনে সর্বোচ্চ পার্থক্য হবে 1, আবার কারও সাথে যদি পার্থক্য হয় 10 তাহলে বুঝতে হবে তার সাথে most recent ancestor 10 পুরুষ আগে ছিল। 10 পুরুষ আগের এই পুর্বপুরষ হতে পারে আমার দাদার নানীর দাদীর দাদার নানা। তো দেখা যাচ্ছে most recent common ancestor শুধু যে বাবার বাবার বাবা ... বরাবর হবে ত নয়, এর মধ্যে নানা, নানীরাও জড়িত হতে পারে। জিন বা ডিএনএ-র ওপর ভিত্তি করে আমরা যে কারও সাথে যে কারও সম্পর্ক বের করতে পারি। বিজ্ঞানীরা এই কাজটাই অনেক বছর ধরে করছেন, আশ্চর্যজনক হলেও সত্য পৃথিবীব্যাপী বিভিন্ন দেশের মানুষের ডিএনএ যখন বিশ্লেষন করা হলো, দেখা গেল যে আমরা সবাই সবার আত্মীয়। তবে এখানেই শেষ নয়, সবাই যদি আত্মীয় হয়ে থাকি তবে সবার পুর্বপুরুষ কারা?
বিভিন্ন জাতির মানুষের ডিএনএ বিশ্লষন করে এসব প্রশ্নের উত্তর গত কয়েক বছরে অনেকটাই বের করা হয়েছে। এজন্য বিশেষভাবে ব্যবহার করা হয় mitochondrial DNA (mtDNA)এবং Y chromosome DNA। mtDNA আমরা শুধুমাত্র মায়ের কাছ থেকে পাই, বাবার কোন ভুমিকা নেই এখানে। তার মানে দাড়াচ্ছে আমি পেয়েছি আমার মায়ের কাছ থেকে, আমার মা পেয়েছেন তার মায়ের কাছ থেকে, তিনি পেয়েছেন তার মায়ের কাছ থেকে ইত্যাদি। এখন যদি আপনাদের কারও সাথে আমার mtDNA তুলনা করি তাহলে বের করতে পারব মায়ের দিক থেকে আমাদের most recent ancestor কত প্রজন্ম আগে ছিল। ধরা যাক 10 প্রজন্ম আগে ছিল, প্রতি প্রজন্ম যদি গড়ে 25 বছর ধরি তাহলে আমাদের মায়ের মায়ের ... মেেয়র মা যিনি, তিনি মোটামুটি 250 বছর আগে জীবিত ছিলেন। একই রকম হিসাব করা সম্ভব Y chromosome দিয়েও, পার্থক্য হচ্ছে Y chromosome কেবলমাত্র ছেলেদের আছে, ছেলেরা বাবার কাছ থেকে পায়, বাবা পেয়েছে দাদার কাছ থেকে ইত্যাদি। পৃথিবীর বিভিন্ন এলাকার বিভিন্ন জাতির mtDNA নিয়ে mutation বিশ্লেষন করলে দেখা যায় মায়ের দিক থেকে আমাদের সবার most recent common ancestor 1,50,000-1,60,000 বছর আগে জীবিত ছিলেন। একই বিশ্লেষন Y chromosome এর জন্য করলে দেখা যায় বাবার দিক থেকে আমাদের most recent common ancestor 80,000 বছর আগে জীবিত ছিলেন। পার্থক্য 70,000 বছর। দুঃখজনকভাবে জেনেটিক ইভ আর আদমের কোনদিন দেখা হয় নি। ব্যবধান এত বড় কেন উত্তরটা এখনও পরিস্কার নয়, আগামী কয়েক বছরে জানা যাবে, তবে বেশ কিছু সম্ভাব্য কারন আছে পরে লিখছি।
এখানে আরও কয়েকটা ব্যাপার পরিস্কার করা দরকার, 150000 বছর আগে জেনেটিক ইভ ছিলেন এর মানে এই নয় যে ঐ সময় একজন নারীই বেচে ছিলেন, বরং ঐ সময় আরও অনেক নারী ছিলেন, তাদের জিন এখনও আমাদের মাঝে আছে, কারো জিন হয়তো আমাদের 20% এর মধ্যে আছে, কারো হয়ত 2%, কারো হয়ত কোন উত্তরাধীকারীই আর বেচে নেই, তবে একজনেরই জিন শুধু সবার মধ্যে আছে। প্রশ্ন হচ্ছে কেন এরকম বিশেষ একজন থাকতে হবে, উত্তরটা গানিতিক, প্রমানটা এখানে দেয়ার লোভ সামলাতে পারলাম না। ধরা যাক এ মুহুর্তে সমস্ত জীবিত মানুষের সেট H, এবং এদের সবার মা-দের সেট H'। স্রেফ কমনসেন্স থেকে বলতে পারব যে ছেলেমেয়েদের মোট সংখ্যা মা-দের মোট সংখ্যার সমান বা বেশী হবে (কারন কারও দুজন মা নেই কিন্ত দুজনের একই মা হতে পারে), অর্থাৎ আমরা লিখতে পারি H'< H। এখন যদি আবার মা-দের মাকে (নানীদেরকে) নিয়ে একই ভাবে নতুন সেট H'' বানাই তাহলে একই যুক্তি দিয়ে লেখা যায় H''< H'। এতক্ষনে নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন এই প্রক্রিয়া ক্রমশ চালাতে থাকলে একসময় একটি সেট H(n') পাব যার সদস্য সংখ্যা 1 (আরও ব্যাখ্যা চাইলে জানাবেন)। এই ব্যাক্তিই জেনেটিক ইভ, জিনতত্ত্ব আমাদের বলছে উনি 150000 বছর আগে জীবিত ছিলেন, কিন্তু কোথায় তার বসবাস ছিল?
যদি প্রশ্ন করা হয় একটি গাছের কোন ডালগুলোর পাতাগুলোর মধ্যে দুরত্ব সবচেয়ে বেশী, উত্তর হবে যে ডালগুলো গাছের গোড়ার যত কাছ থেকে বের হয়েছে তাদের পাতা তত দুরে। একই বিশ্লেষন আমরা আমাদের genetic family tree এর ওপর প্রয়োগ করতে পারি। মানুষের মধ্যে জিনগত দিক থেকে সবচেয়ে বেশী পার্থক্য পুর্ব, দক্ষিন এবং মধ্য আফ্রিকার লোকদের মধ্যে। আফ্রিকার বাইরের লোকদের মধ্যে চেহারায় অনেক পার্থক্য থাকলেও genetic difference খুব কম, সে চীনা হোক, ইউরোপিয়ান হোক বা অস্ট্রেলিয়ার আদিবাসী হোক। তার মানে দাড়াচ্ছে আফ্রিকার লোকেরা আমাদের genetic tree-এর মুলের কাছাকাছি স্থান থেকে বের হয়েছে, আমাদের ইভের জন্মস্থান দক্ষিন পুর্ব আফ্রিকায় হওয়ার সম্ভাবনা খুব বেশী। মজার ব্যাপার হচ্ছে জিনতত্ত্বের মাধ্যমে বিজ্ঞানীরা এগুলো বের করার বহু আগেই কেবল ফসিল ভিত্তিক গবেষনা থেকেই বোঝা যাচ্ছিল মানুষের জন্মস্থান আফ্রিকায় (হয়তো তানজানিয়া, কেনিয়া বা আশেপাশের এলাকায়)।
জেনেটিক আদমের ব্যাপারটাও ইভের মত Y-chromosome ডিএনএ-এর ওপর ভিত্তি করে আমরা একই গানিতিক প্রমান ব্যবহার করতে পারি এমন একজন পুরুষকে খুজে বের করার জন্য যার জিন আমাদের সবার মধ্যে আছে। আদমের বয়সটা কেন ইভের চেয়ে কম এর কারন নিশ্চিত হতে আরও কয়েক বছর লাগবে। তবে মোটামুটি কারন এরকমঃ যেহেতু মা বরাবর যেতে থাকলে পুর্বপুরুষ বাবা বরাবর পুর্বপুরুষের চেয়ে পুরোনো তার মানে দাড়াচ্ছে মেয়েদের family tree ছেলেদের চেয়ে পুরোনো এবং সে কারনে একটু বেশী বড় (বা ছড়ানো)। নিশ্চিতভাবেই জেনেটিক ইভের সময় প্রায় সমসংখক পুরুষ ছিল, তাহলে ছেলেদের গাছটা কেন ছড়ায়নি, ভেবে দেখুন কখন গাছ পাশে না ছড়িয়ে শুধু লম্বায় বড় হয়, উত্তর- যদি কেউ এর ডালপালা নিয়মিত ছেটে ফেলে। একটা দুটো ডালকে বড় হতে দিয়ে যদি বাকীগুলোকে কেটে ফেলা হয়। আরও উদাহরণ দেই, চীনে 1 বিলিয়ন লোকের মধ্যে 8-10% (মানে প্রায় 10 কোটি) লোক চেঙ্গিস খানের বংশধর, কিন্তু চেঙ্গিস খানের সময় তো আর মাত্র 10-12 জন লোক ছিল না, তাহলে বাকিদের ছেলেমেয়েরা কোথায়, তাদের সংখ্যা এত কম কেন? কারণ চেঙ্গিস খানের অসংখ্য স্ত্রী, উপপত্নী, রক্ষিতা ছিল, আর চেঙ্গিস খান তাদের মধ্য দিয়ে অসংখ্য ছেলে মেয়ে বানিয়ে রেখে গেছে, এবং তার পরবর্তি কয়েক প্রজন্মও একইভাবে নিজেদের সংখ্যা একটু বেশীই বাড়িয়েছে এজন্য এখন এত লোক চেঙ্গিস খানের উত্তরাধিকারী। ঐ সময়ের অন্যসব ডালপালা চেঙ্গিস খান এবং তার সাঙ্গপাঙ্গরা ভালভাবেই কেটে ফেলেছিল। জিনতত্ত্ব এখন আমাদের বলছে একই কান্ড পুরুষরা বহুবার নিশ্চয়ই করেছে, তাই আদমের বয়স এত কম মনে হচ্ছে।
মজার ব্যাপার হচ্ছে mtDNA আর Y-Chromosome এর এই ব্যবধান কেবল আদম, ইভের ক্ষেত্রে নয়, আর বহু সম্ভাব্য ঐতিহাসিক ঘটনা সনাক্তকরনে সাহায্য করছে, পরবর্তিতে লিখব।
আগের লেখাঃ
1- Click This Link
2- Click This Link
সর্বশেষ এডিট : ০৪ ঠা এপ্রিল, ২০০৬ বিকাল ৩:৫১