বাবা মার মৃত্য একটা ভীষন ইমোশনাল প্রক্রিয়া, নিজে এর ভেতর না দিয়ে গেলে বোঝা অসম্ভব বলেই মনে হয়। বাবা যখন কোমায় যাচ্ছিলেন আমরা ধরে নিতাম আর হয়তো বেচে উঠবেন না। যেকোন কারনেই হোক আমি বাবাকে একা পেলে জেনে নিতাম আসলে কেমন লাগছে, কি মনে হয় আসলে স্রষ্টা আছে, মৃত্যুর পরে কি কিছু আছে। শুরুতে বাবা খুব মাইন্ড করেছিলেন। আসলে প্রথমবার বাইরে নিয়ে যাওয়ার পর বাবা বেশ খানিকটা সুস্থ হয়ে যাওয়ায় আমরা ধরে নিয়েছিলাম এ যাত্রা বোধহয় বাবা বেচেই গেলেন। বাসার অন্যরা ভালো চোখে না দেখলেও বাবা ফিরে আসার পর মৃত্য, কোমায় যাওয়া ইত্যাদি নিয়ে খোলামেলা আলোচনা করতাম। আসলে একটা টিভি প্রোগ্রামে একবার দেখাচ্ছিল অনেকে কোমায় গিয়ে একটা টানেল দেখতে পায়, অনেকে দেখে একপ্রান্তে একটা তীব্র উজ্জল আলো। আশ্চযর্্যজনক ভাবে বাবা টানেল বা আলো কোনটাই দেখতে পান নি। টানেল রহস্যের অবশ্য এখন সমাধান হয়েছে, এর কারন মস্তিষ্কে অক্সিজেন ডেফিসিয়েন্সি, সুপার সনিক জেটের পাইলটরাও অনেক সময় এরকম দেখে থাকেন। মৃত্যুর অবব্যহিত পুর্বে ঠিক কি হয় এটা জানার কৌতুহল ছিল। অনেকে ফেরেশতা দেখে, কেউ ভয় পায়, কেউ দুঃস্বপ্ন দেখে। দুঃখজনক ভাবে মারা যাওয়ার কয়েকঘন্টা আগেও আমি খোজ নিয়েছি বাবার কাছে কোন কিছু সন্দেহজনক মনে হয় কিনা, বা এনিথিং সুপার ন্যাচারাল। কোনটাই না। বরং আগের দিন বিশ্বকাপ নিয়ে আমি একতরফা আলোচনা করলাম, বাবা টুকটাক মন্তব্য করলেন। এবং কয়েকঘন্টা পরে উনি নেই।
এখন পর্যন্ত নির্ভরযোগ্য কোন প্রমান দেখিনি মৃত্যুর পরের জীবন বা প্রক্রিয়া নিয়ে। তবে মৃত্যু যেহেতু এখনো রিভার্সিবল নয়, সুতরাং মৃত্যুকে গুরুত্বের সাথে না নিয়ে উপায় নেই। মানুষের ইতিহাস ঘাটলে দেখব মৃত্যু নিয়ে মানুষের কৌতুহল খুবই পুরোনো। নিয়ান্ডার্টাল, ক্রোম্যানিয়ন দের আমলে ওরাও মৃত্যুকে আলাদাভাবে দেখেছে। এবং সভ্যতার শুরু থেকেই একটা চেষ্টা ছিল কিভাবে না মরে থাকা যায়। এই চেষ্টার ওপর ভিত্তি করে দাড়িয়ে আছে নানা কাহিনী, এবং বিশেষভাবে বেশীরভাগ, হয়তো, সমস্ত ধর্ম। মিশরীয়রা যেমন বিশ্বাস করত মামি বানিয়ে রাখলে আবার বেচে ওঠা যাবে। আবার অনেক ধর্মের কাহিনীতে আছে অমৃত পান করলে আর মরতে হবে না। উপমহাদেশের অনেক ধর্মে আছে জন্মান্তরবাদ, অমর থাকার একরকম অল্টারনেট। মধ্যপ্রাচ্যের ধর্মগুলোতে আছে মৃত্যুর পর বিচার ব্যবস্থা, তারপর অনন্ত উদ্দ্যেশ্যহীন জীবন। এসব কাহিনীর সত্যমিথ্যা প্রমান করা বেশ সহজ। কিন্তু লক্ষ্যনীয় হচ্ছে সবগুলোতেই কোন না কোনভাবে অনন্তকাল বেচে থাকার হাতছানি আছে।
কয়েকবছর হয়ে যাওয়ায় এতদিনে আমার বাবা, নানা, দাদা সবাই মোটামুটি রিসাইকেল্ড হয়ে গেছেন ধরা যায়। হাড়গুলো ছাড়া বেশীরভাগ বায়োলজিকাল অংশগুলো প্রকৃতি এর মধ্যেই নিশ্চয়ই রিক্লেইম করে নিয়েছে। হয়তো মাংসগুলো ইদুর, সাপ, ওয়র্ম, ব্যক্টেরিয়া খেয়ে ফেলেছে। আবার তাদেরকে খেয়েছে ফুড পিরামিডে এদের ওপরে যারা আছে, শেষমেশ অনেককিছুই হয়তো ফুড পিরমিডের মাথায় আছে মানুষ তাদের কোন সদস্যের শরীরে গিয়ে জমা হয়েছে। হয়তো আমার গায়েই আছে। আত্মার কি হয়েছে, বা আদৌ কিছু হয়েছে কি না আমার জানা নেই। ওনাদের আত্মাদের কেউ আমার সাথে কোন যোগাযোগ করে নি এখনও। আসলে আত্মা নামে আদৌ কিছু আছে কি না সন্দেহ। বায়োলজিকাল রিসোর্সগুলো না হয় পুনব্যবহ্ৃত হচ্ছে, কিন্তু বাবার যে বিশাল স্মৃতি ভান্ডার ছিল সেগুলো কোথায়। শেষ 20 বছরে লেখা ডায়েরীগুলো আছে, কিন্তু ডায়েরী তো আর পুরো স্মৃতি, অভিজ্ঞতাগুলো নয়। মৃত্যু এইদিক থেকে চিন্তা করলে একটা বিশাল অপচয়। সভ্যতার জন্য একটা বড়সড় লোকসানী ঘটনা। আর ব্যক্তিজীবনে তো অবশ্যই। পরকালে আরেকটা জীবন আছে এটা হয়তো স্রেফ স্বান্তনা। নো ওয়ান্ডার অমৃতের এত ডিমান্ড কাহিনী-উপকাহিনীতে।
আরো কিছু অনিবার্য বিষয় ছিল আগে। যেমন যক্ষা, কুষ্ঠ, গুটি বসন্ত হলে রক্ষা ছিল না। বিভিন্ন কারনে এগুলো আর অনিবার্য নয়। রোমানদের আমলে মানুষের গড় আয়ু ছিল 18। একশতক আগেও ছিল 40 এর নীচে। এখন অনেক দেশেই 80র ওপরে। বলাবাহুল্য দোয়াদুরুদ, ঝাড়ফুকের কারনে মানুষের জীবন এত লম্বা হয়ে যায় নি। যদি এসব মন্ত্র পড়লে লাভ হতো তাহলে সপ্তম শতাব্দিতে বা এরকম যখন নতুন ধর্ম এসেছে তার পরপরই মানুষের আয়ুতে তার একটা প্রভাব দেখা যেত। সেরকম কোন প্রমান নেই। প্রমান যা আছে তাহলো পেনিসিলিন বা এরকম এ্যান্টাইবায়োটিক আবিস্কারের পর হঠাত্ করে মানুষের আয়ু বেড়ে যাওয়া। বিজ্ঞানের উন্নতির কারনে মানুষ এখন বেশিদিন বাচে ঝাড়ফুক, দোয়াদুরুদের জন্য নয়।
কিন্তু মৃত্যু প্রসঙ্গে বিজ্ঞান কি করতে পারে? এই অংশটুকু পরের লেখায়। শুধু এটুকু বলে রাখি আজকে, 2035 সাল পর্যন্ত বেচে থাকা খুবই জরুরী, যদি মৃত্যুকে পাশ কাটাতে চান। হয়তো 2030 এই হবে। ঠিক মেইনস্ট্রীম মিডিয়ায় আসার মত ঘটা করে এসব গবেষনা হচ্ছে না অবশ্য। মৃত্যু থেমে গেলে আমাদেরকে দ্রুত আশেপাশের গ্রহগুলো কলোনাইজ করতে হবে। অনেক জিনিষই আছে যেগুলো মরে যায় না, অথবা যাদের জীবনকাল ভীষন দীর্ঘ শত মিলিয়ন বছর, যেমন জিন। কিন্তু কিভাবে মানুষের জন্য এরকম কৌশল প্রয়োগ করা যেতে।
হিমু, আপনার কথা ছিল সিঙ্গুলারিটির বাংলা একটা সমার্থক বের করে আমাকে দেবেন। এখন লাগবে আমার।