গ্লোবালাইজেশন নিয়ে আমাদের মধ্যে অনেক ভুল ধারনা আছে। আমার এক পরিচিত ঢাকায় আইন ও সালিশ কেন্দ্রে চাকরী করত, একবার শুনলাম বম্বে (মুম্বাই) গেছে মিছিল করতে অফিসের হয়ে, এবং মিছিলের উদ্দ্যেশ্য গ্লোবালাইজেশনের বিরোধিতা করা। আমি ঠিক জানি না নীতি নির্ধারক বা বুদ্ধিজীবিরা কি ঠিক বুঝে শুনে না অন্য কোন উদ্দ্যেশ্য থেকে বিশ্বায়নের বিরোধিতা করেন। কিন্তু সত্যিকার অর্থে বাংলাদেশের মতো দেশের জন্য বিশ্বায়নে ক্ষতির চেয়ে লাভ অনেক বেশী।
দেশে এখন যে রকম অস্থিরতা চলছে একটা পরিবর্তন আসন্ন মনে হয়, ঠিক কিভাবে আর কোন দিকে হবে বলা মুস্কিল। আসলে দেশের মানুষ যেমন শাসকরা তার চেয়ে খুব কি ভিন্ন হওয়ার উপায় আছে, যে দলই আসুক, বা সমরতন্ত্র আসলেও ঘুরে ফিরে সেই একই অবস্থা থাকবে। এর একটা কারন মনে হয় বিশ্ব গতি প্রকৃতি আমরা বুঝতে চাই না বা বোঝার মতো চেষ্টাও নেই। ইদানিং একটা ভুল ধারনা আমাদের "মাইরের ওপর ওষুধ নাই", শক্ত হাতে শাসন করলেই বুঝি সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। আরও অনেক দেশ এরকম একতরফা সমাধানের চেষ্টা করেছে (উদাহরন পাকিস্তান, সুদান, লিবিয়া) এখনও সফল হয় নাই, হওয়ার সম্ভবনাও কম। অন্যদিকে আপাত দৃষ্টিতে সমস্যা সংকুল messy democracy ভারতের প্রবৃদ্ধির হার এখন 10 ছুই ছুই, অথচ 50/60 এর দশকে সুবিধাজনক অবস্থানে থেকেও পাকিস্তান প্রতি বছর পিছিয়ে পড়ছে। এমনকি বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধির হার বনাম মুল্যস্ফীতি পাকিস্তানের চেয়ে বেশ ভালো, যদিও দেশে কয়েক বছর ধরেই আমাদের দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা হরতাল ধর্মঘট লেগে আছে। ভারত বলতে মার্কিনীরা এখন ভাবে হাইটেক সেন্টার আর পাকিস্তান শুনলে ভাবে টেররিস্ট। ঠিক কি কারনে ভারত এবং চীনের এত শনৈঃ শনৈঃ উন্নতি হচ্ছে এর একটু গভীরে আমাদের যাওয়া দরকার এবং আমরা ঠিক কিভাবে এই পরিস্থিতির সর্বোচ্চ ব্যবহার করতে পারি সেটাও বোঝা দরকার। আমার মনে হয় জনসাধারনের মধ্যে আমাদের এই তথ্যগুলো ছড়িয়ে দেয়ার যথেষ্ট প্রয়োজনীয়তা আছে, কেবল নীতিনির্ধারক ছাড়াও ছোটখাট ব্যবসায়ী, ছাত্রদের বিশ্বয়ানের সুযোগ নেয়ার সমূহ সম্ভাবনা আছে, কেবল না জানা বা ভুল ধারনার জন্য এসব সুযোগ আমরা হারাচ্ছি।
যাহোক বিশ্বায়নে ফিরে আসি। যদি জানতে চাই গনতন্ত্রের সাথে রাজতন্ত্রের পার্থক্য কোথায়। সহজ কথায় উত্তর হবে গনতন্ত্রে সবাই সমান, অন্যদিকে রাজতন্ত্রে রাজা-উজিরদের অধিকার বেশী, অন্যদের কম। বিশ্বায়নকে ধরা যেতে পারে বিশ্ব অর্থনীতির গনতন্ত্রায়ন। কিভাবে? মুক্তবাজার অর্থনীতি এবং বিশ্বায়ন প্রক্রিয়া ব্যপকভাবে শুরুর আগে বিশ্বের ধনী দেশগুলোর লোকজন কেবল ধনী দেশে জন্মানোর সৌভাগ্যে অনেক সুবিধা পেত। ধনী দেশগুলো পন্য তৈরী করে গরীব দেশে বিক্রী করতে পারত। মনে আছে? আমাদের দেশে একসময় নিক্সন মার্কেট ছিল, আমরা নিজেরাও অনেক বিদেশে তৈরী জামা/কাপড় কিনে পড়তাম। কিন্তু এখন জামা কাপড় কোথায় তৈরী হয়- আমাদের দেশের গার্মেন্টসে তৈরী পোশাক এখন উলটো দিকে যাচ্ছে। 70/80-এর দশক থেকে 90 দশক এবং তার পরে পোশাকের এই উলটো প্রবাহ আসলে সম্ভব হয়েছে বিশ্বায়নের কারনে। যদি এমন হতো যুক্তরাষ্ট্র অস্বাভাবিক পরিমান শুল্ক রাখত বাংলাদেশে তৈরী পোশাকের ওপরে তাহলে যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের তৈরী পোশাক রপ্তানী করা যেত না। অন্যদিকে আমরা যদি উন্নতবিশ্ব থেকে যন্ত্রপাতি এবং প্রযুক্তি আমদানী না করতে পারতাম তাহলে এত গার্মেন্টস কারখানা দেয়াও সম্ভব হতো না। এখন বাংলাদেশে তৈরী পোশাকের যতটুকু অধিকার যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে ততটুকুই অধিকার চীনের পোশাকের, আবার ততটুকুই ফ্রান্সের পোশাকের। কোন দেশ থেকে এসেছে তার গুরুত্বের চেয়ে মানের গুরুত্ব বেশী। এটাই হচ্ছে গনতন্ত্রায়ন। বাংলাদেশের শুধু পোশাক নয়, এবং বাংলাদেশী ইঞ্জিনিয়ার আর একজন মার্কিন ইঞ্জিনিয়ারের সমান গুরুত্ব মালটি ন্যাশনাল কম্পানী গুলো কাছে। যে দক্ষ তাকেই ওরা চাকরী দেবে, তা যে দেশ থেকেই আসুক না কেন। এই পরিস্থিতি 20 বছর আগে ছিল না, 50 বছর আগে কল্পনাও করা যেত না। হাইটেক কম্পানী যেমন ইনটেল, এইচপি , মাইক্রোসফট বা আই বি এম এ পাচবছর আগের চেয়ে এখন পাচগুন বেশী বাংলাদেশী চাকরী করে।
তো রাজতন্ত্রে থেকে গনতন্ত্রে উত্তরনে কে হারে আর কে জেতে। রাজাউজিরদের লোকসান সবচেয়ে বেশী, আর একদম সাধারন জনগনের লাভ তুলনামুলক ভাবে বেশী। বিশ্বায়নেও মোটামুটি তাই, দরিদ্্রদেশ হিসেবে বাংলাদেশ হারাবে কম, কিন্তু ঠিকমতো (যেমন ভারত বা চীন করছে) কাজে লাগাতে পারলে লাভ বেশী। অন্যদিকে বিশ্বায়নে শেষমেশ অবস্থান হারাবে উন্নত বিশ্ব, বিশেষ করে যেসব দেশে জনসংখ্যা কম। ফ্রিডম্যান গত কয়েক বছরের পরিবর্তনকে বলেছেন বিশ্বায়ন ভার্সন 3.0। চমৎকার কিছু উদাহরন দিয়েছেন তার তত্ত্বের ওপর, এ নিয়ে এবং আমাদের কি কি মানসিকতা বদলানো দরকার তার ওপর পরের পর্বে আরো লিখব।
সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে সেপ্টেম্বর, ২০০৬ রাত ১১:০৭