আশরাফ রহমানের ব্লগপাতায় কোরানের একটি উদ্ধৃতি বাংলায় (শিরোনামের বাইতুল হিকমার বাংলা করা যেতো না?) দেওয়া আছে: 'যারা জানে আর যারা জানে না তারা কি সমান হতে পারে?' মানছি, পারে না। এবং আমার প্রশ্নও সেখানেই। যারা জানে এবং যারা জানে না। এই দুইয়ের বাইরেও আরেকটি শ্রেণী আছে। আমি ধর্মকর্ম তেমন জানি না, তবে আমার ধারণা ধর্মগ্রন্থে এই শ্রেণীর কথাও কোথাও না কোথাও নিশ্চয়ই আছে। এই তৃতীয় শ্রেণীভুক্ত মানুষেরা জানে না, কিন্তু জানার ভাণ করে থাকে। আশরাফ রহমানের লেখাপত্র থেকে তাঁকে এই তিন নম্বর শ্রেণীভুক্ত বলে প্রবল সন্দেহ হয়।
কয়েকদিন আগে এই জ্ঞানী ব্যক্তি 'মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও আওয়ামী লীগ' শিরোনামে পোস্ট লিখেছেন। জানিয়ে রাখা দরকার আওয়ামী লীগের পক্ষ হয়ে কথা বলা আমার উদ্দেশ্য নয়। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বে ন্যাপ বা কমিউনিস্ট পার্টি (এমনকি দুর্ঘটনাক্রমে জামাত) হলেও আমার কথাগুলি অন্যরকম হতো না। পরিপ্রেক্ষিত না জেনে অথবা বিবেচনা না করে ঐতিহাসিক দলিলপত্র নিয়ে নাড়াচাড়া করা কিছু বিপজ্জনক বটে। আশরাফ রহমান আমার চেয়ে ভালো জানবেন যে কোরান শরীফের অনেক সুরার পেছনে কোনো বিশেষ ঘটনা বা পরিস্থিতি আছে, যাকে 'শানে নযুল' বলে আমরা জানি। আশরাফ রহমানের উলি্লখিত পোস্টটির নাজেল হওয়ার শানে নযুল আমার জানা নেই, কিন্তু তা হয় অজ্ঞতাপ্রসূত অথবা উদ্দেশ্যমূলক (সদুদ্দেশ্য মনে করার কোনো কারণ নেই)। ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় ঘটনার প্রেক্ষাপট আড়ালে রেখে (এ ক্ষেত্রে ইচ্ছাকৃত বলে সন্দেহ করি) একটি ঐতিহাসিক দলিলের উদ্ধৃতি কোনো উদ্দেশ্য চরিতার্থ করার কাজে লাগানো চলে। বারংবার বলা হলে বিশ্বাসীর মনেও সংশয় জাগতে পারে।
1971 সালের 10 এপ্রিল কুষ্টিয়ার মেহেরপুরের এক আম্রকাননে (আশরাফ রহমান বলেছেন 'কুষ্টিয়ার আম্রকানন', এই নামে কোনো জায়গা আছে বলে জানা নেই) নির্বাচিত গণপ্রতিনিধিরা স্বাধীন বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় আদর্শ ও নীতি সম্পর্কে যে ঘোষণা দিয়েছিলেন তাতে 'সাম্য', 'মানবিক মর্যাদা' ও 'সামাজিক ন্যায়বিচার' প্রতিষ্ঠার কথা বলা হয়েছিলো। আশরাফ রহমানের আপত্তি, এগুলি 1972 সালে রচিত সংবিধানে স্থান পায়নি কেন। তার বদলে সংবিধানে 'ভারতের স্বার্থ রক্ষার জন্যে' রাষ্ট্রীয় নীতি হিসেবে অনতর্ভুক্ত হয় 'সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা, গণতন্ত্র ইত্যাদি' (হায় আশরাফ রহমান, চতুর্থটি ছিলো জাতীয়তাবাদ তা-ও আপনার জানা নেই, নাকি ইচ্ছাকৃতভাবে চেপে গেলেন আপনার উদ্দেশ্যের সঙ্গে খাপ খায় না বলে?)।
প্রথমেই জিজ্ঞাসা করা দরকার, 'সাংবাদিক' (কিসের কে জানে, এখনো খোলাসা হয়নি, কেউ জানালে খুশি হবো) হিসেবে আশরাফ রহমানের নিশ্চয়ই জানা আছে, যুদ্ধকালীন সময়ে অনতর্বর্তী সরকারের একটি ঘোষণা ও সংবিধানের ঘোষণার মধ্যে পার্থক্য কি। পরিপ্রেক্ষিত বিবেচনা করা অবশ্যই দরকারি। 25 মার্চে পাকিসতানী সেনাদের অতর্কিত আক্রমণের মুখে বাঙালি নেতৃত্ব তখন ছত্রখান (এই পরিস্থিতির জন্যে আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব কতোটা প্রস্তুতি নিয়েছিলেন বা নেননি তা আলাদা বিতর্কের বিষয়, এখানে প্রাসঙ্গিক মনে করি না), এই বাসতব অবস্থাটি বিবেচনায় আনতে হবে। 25 মার্চ থেকে 10 এপ্রিল, ব্যবধান মাত্র 15 দিনের। এই স্বল্প সময়ের প্রস্তুতিতে দেওয়া ঘোষণাটি অনতর্বর্তীকালীন, তা মনে রাখতে হবে। তখন সারা পৃথিবীর কাছে স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের অসতিত্বের প্রমাণ দেওয়াটা সবচেয়ে বেশি জরুরি। এই ঘোষণায় ঠিক তাই করা হয়েছিলো বলে মনে করার কারণ আছে।
10 এপ্রিল দেওয়া ঘোষণার সঙ্গে 72-এর সংবিধানে ঘোষিত রাষ্ট্রনীতির খুব বিশাল বিরোধ আছে বলেও তো মনে হয় না। 'সাম্য', 'মানবিক মর্যাদা' ও 'সামাজিক ন্যায়বিচার'-এর পরিবর্তে 'গণতন্ত্র', 'সমাজতন্ত্র', 'ধর্মনিরপেক্ষতা ও 'জাতীয়তাবাদ'। তাহলে আশরাফ রহমানের হা-হুতাশ কেন? কারণ তা নাকি ভারতের রাষ্ট্রনীতির সঙ্গে মিলে যায়। তা এই নীতিগুলি কি ভারতের এজমালি সম্পত্তি যা অন্য কোনো রাষ্ট্রের আদর্শ হতে পারবে না? অথবা হলে তা ভারতপন্থী বলে ধরে নিতে হবে? যুক্তি বটে! সন্দেহ করি, ধর্মনিরপেক্ষতা নিয়েই তাঁর আসল মাথ্যব্যথা।
আওয়ামী লীগ যদি মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা বলে (সে আদর্শে এখন তারা কতোটা বিশ্বসত তা নিশ্চয়ই প্রশ্নসাপেক্ষ), সেই অধিকারটি তারা ঐতিহাসিকভাবে অর্জন করে বসে আছে। 71-এ মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব তাদের হাতে ছিলো, তারা যুদ্ধ সংগঠিত ও পরিচালনা করেছে (অবশ্যই এককভাবে নয়) এবং তাকে একটি সফল পরিণতি দিতে সক্ষম হয়েছে এইসব অস্বীকার করতে পারলে অনেকে খুশি হবেন। কিন্তু ইতিহাসের বাসতবতা খণ্ডানো যাবে কীভাবে? কোন যুক্তিতে?
এখন বৃহত্তর বা বিশ্ব পরিপ্রেক্ষিতের কথা বলা যাক। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর এইচ. জি. ওয়েলস 'দ্য আউটলাইন অব হিস্ট্রি' নামে একটি গ্রন্থ রচনা করেছিলেন। ওয়েলস-এর উদ্দেশ্য ছিলো ইউরোপীয় ইতিহাসের একটি দলিল প্রস্তুত করা। লিখতে গিয়ে দেখলেন, পৃথিবীর অবশিষ্ট অংশকে বাদ দিয়ে ইউরোপের ইতিহাস লেখা সম্ভব হচ্ছে না। ফলে তাঁকে পৃথিবীর ইতিহাসই লিখতে হলো। এই উদাহরণটি মনে রাখলে বোঝা যাবে, পৃথিবীর কোনো দেশ বা সমাজ এবং তার কোনো বিপ্লব-আন্দোলন-উত্থান-পতনের ঘটনা স্বয়ম্ভু নয়। শীর্ষেন্দুর একটি লেখায় এরকম একটি লাইন ছিলো বলে মনে পড়ছে: 'দূরে কোথাও যুদ্ধ হলে আমাদের চায়ে চিনি কম পড়ে।' এই বোধ সবার থাকে না।
1971-এ বিশ্ব পরিস্থিতি এখনকার মতো আমেরিকা-নির্ভর একমুখী ছিলো না। সমানতরালে দাঁড়িয়ে ছিলো সমাজতান্ত্রিক বিশ্ব। এই দুই পরাশক্তির ইচ্ছা বা সমর্থন ছাড়া একটি নতুন জাতিরাষ্ট্রের উত্থান তখন কল্পনার অতীত। ইতিহাস এই সাক্ষ্য অবশ্যই দেয় যে সোভিয়েত ইউনিয়ন ও সমাজতান্ত্রিক বিশ্বের প্রত্যক্ষ সমর্থন ছাড়া বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সফল পরিণতি অত্যনত দুরূহ, এমনকি অসম্ভব ছিলো। ভারত সমাজতান্ত্রিক দেশ না হলেও তাদের ঝোঁকটা ছিলো সেদিকেই, যা 84 সালে ইনদিরা গান্ধীর মৃতু্য পর্যনত অব্যাহত ছিলো। সুতরাং যে ভারত বা সামাজতান্ত্রিক শক্তি আমাদের মুক্তিযুদ্ধে প্রত্যক্ষ সহায়তা দিয়েছিলো, স্বাধীনতার অব্যবহিত পরে তারা তাদের ইচ্ছা ও আদর্শের প্রতিফলন আমাদের মধ্যে দেখতে চাইবে তা খুব অপ্রত্যাশিত নয়।
সেই সময়ের বাংলাদেশের মানুষেরা এ-ও সাক্ষ্য দেবেন যে মুক্তিযুদ্ধপরবর্তীকালে শিক্ষিত মধ্যবিত্তদের (যাঁরা সাধারণভাবে রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক জীবনের দিকনির্দেশকের ভূমিকায় থাকেন) প্রবণতা প্রবলভাবে সমাজতন্ত্রমুখী ছিলো। এঁদের সবাই ভারতপন্থী ছিলেন, এ কথা কোনো পাগলেও বলবে না। এমনকি অনেকে মানতে না চাইলেও বলা দরকার, শেখ মুজিব ও আওয়ামী লীগ ভারতঘেঁষা, এ-ও এক ধরনের কল্পিত ও প্রচারিত কেচ্ছা।
1972 সালের বাসতবতায় এই সমাজতান্ত্রিক বলয়ের বাইরে যাওয়ার সামর্থ্য বাংলাদেশের মতো ক্ষুদ্র, যুদ্ধপীড়িত ও দরিদ্র দেশের থাকার কথা নয়। আজ এই 2007 সালেও নেই। এখন সমাজতন্ত্র নেই, আছে একক শক্তি আমেরিকা ও তার ইচ্ছাধীন বিশ্বব্যাংক-এনজিওনির্ভর বিশ্বায়নের দামামা। এদের ইচ্ছার বাইরে আমাদের একটি পা-ও ফেলার উপায় নেই।
আশরাফ রহমান 72-এর সংবিধানে ভারতের স্বার্থরক্ষার কথা বলেছেন, তার দায় আওয়ামী লীগের ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়েছেন। যদি তা মেনে নেই, তারপরেও কথা থাকে। সেই আওয়ামী লীগ স্বাধীনতার পরে 36 বছরে দেশের শাসনক্ষমতায় ছিলো দুই দফায় সাকুল্যে সাড়ে আট বছর। বাকি সাড়ে সাতাশ বছর দেশের দণ্ডমুণ্ডের কর্তা যাঁরা ছিলেন, তাঁরা ঘোষিতভাবে ভারতবিরোধী। তারপরেও আজ বাংলাদেশ ভারতীয় পণ্য ও সংস্কৃতির অবাধ বিচরণক্ষেত্র হয়ে উঠলো কী প্রকারে? তাঁরা তাহলে কার স্বার্থ রক্ষা করছিলেন বা করছেন?
মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে দেওয়া একটি ঘোষণার সঙ্গে সংবিধানের রাষ্ট্রনীতি (সেই সময়ে অধিকাংশ মানুষ যা মেনে নিয়েছিলেন) বিষয়ে আশরাফ রহমান খুব বিচলিত। অথচ পরবর্তীকালে সংবিধানটিকে ইচ্ছামতো জবাই করে যে ভোজ-উৎসব হলো, তা কার স্বার্থ রক্ষা করেছে? উত্তরটি আমরা জানি। আশরাফ রহমান এ বিষয়ে তাঁর বিজ্ঞ মতামত অচিরেই দেবেন আশা করছি।
সর্বশেষ এডিট : ১১ ই মার্চ, ২০০৭ দুপুর ২:৪৪