অভাবের দেশ আমাদের। এটা নেই, ওটা নেই শুনতে শুনতে আমরা বড়ো হয়ে উঠেছি, অভ্যস্ত হতে শিখেছি। একদা সবচেয়ে বড়ো অভাব ছিলো খাদ্যের, তা এখন আর আগের মতো অতো তীব্র নয় বলে শুনতে পাই। তবু আকাল এখনো আছে, কিছু পুরনো, কিছু নতুন। মানুষের নিরাপত্তার আকাল আমাদের দেশে চিরকাল ছিলো এবং সে বিষয়ে কোনো উন্নতির আশা আজকাল কেউ করে বলে মনে হয় না। সামপ্রতিক আকাল বিদু্যতের, পানির, জ্বালানি তেলের, সারের। খবরের কাগজ খুললে এইসব আকালের খবর প্রতিদিন পাওয়া যায়। এর সঙ্গে প্রায় নিঃশব্দে আরেকটি জিনিস ক্রমে উধাও হয়ে যাচ্ছে _ আমাদের বাংলা বর্ণমালার চন্দ্রবিন্দু। দেশের দৈনিক ও সাপ্তাহিক কাগজগুলির ইন্টারনেট সংস্করণে এবং মুদ্রিত পত্রিকা যা কালেভদ্রে হাতে আসে তাতে এই সিদ্ধান্তে আসা যাচ্ছে যে বাংলা ভাষায় চন্দ্রবিন্দুর আকাল দারুণ আকাল পড়ে গেছে। হয়তো অবিলম্বে তা দুর্ভিক্ষের চেহারা ধারণ করে বসবে।
আশ্চর্য হয়ে ভাবি, হচ্ছেটা কি? যতোদূর জানি, চন্দ্রবিন্দু এখনো বাংলাভাষার বর্ণমালার সর্বশেষ অক্ষর এবং ব্যাকরণ ও বানানরীতি থেকে তা বাতিল হয়েও যায়নি। আমাদের জানা আছে, কোটি কোটি মানুষ যে ভাষা প্রতিদিনের জীবনে ব্যবহার করেন, সেই ভাষায় সর্বজনগ্রাহ্য কোনো বানানপদ্ধতি নেই। সেসব দেখাশোনার কাজ করে কে? এই দায়িত্বে কেউ আছে বলে মনে হয় না, তা মান্য করার প্রশ্ন সুতরাং অবান্তর। ফলে, একই অর্থে একটি শব্দ একাধিক বানানে লেখার চল আছে। গেলো, গেল, গ্যালো _ এই তিন প্রকারেই শব্দটি লেখা চলে। এর মধ্যে কোনটি অশুদ্ধ, কে বলবে? আমাদের প্রতিদিনের ব্যবহার্য শব্দগুলি থেকে এরকম উদাহরণ অসংখ্য দেওয়া সম্ভব।
অন্য সব ভাষার কথা জানা নেই, কিন্তু পৃথিবীর সর্বাধিক প্রচলিত ভাষা ইংরেজিতে কিন্তু এই ধরনের ব্যাপক অরাজকতা নেই। সত্য বটে যে মার্কিন ও বৃটিশ ইংরেজির বানান ও উচ্চারণ কিছু আলাদা। যেমন কালার বা লেবার শব্দ দুটি থেকে মার্কিনীরা বৃটিশ বানান পদ্ধতির ইউ অক্ষরটি বাদ দিয়ে ব্যবহার করে। এই ধরনের পার্থক্য জাতিগত বা রাষ্ট্রীয় কারণে ঘটে থাকতে পারে। বৃটিশ ও মার্কিনীরা সর্বদাই নিজেদের গৃহীত ও স্বীকৃত বানানরীতিটিই অনুসরণ করে থাকে। একই শব্দ একাধিক উপায়ে লেখার চল নেই। এই ধরনের পার্থক্য পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে বাংলাদেশের বাংলা বানানে থাকলে তা মানা চলে। যেমন, পশ্চিমবঙ্গে চালু 'খেলাধুলো' শব্দটিকে আমাদের মুখের ভাষার কাছাকাছি 'খেলাধুলা' বলে লিখি আমরা। তা-ই কিন্তু হওয়া উচিত।
কিন্তু চন্দ্রবিন্দু নিয়ে এই খেয়ালখুশির সর্বশেষ নিদর্শন কিছু আশংকা জাগায়। প্রায় প্রতিটি সংবাদপত্র ও সাময়িকী পড়লে মনে হবে অক্ষরের মজুত যথেষ্ট নেই, আগে হাতে কম্পোজের যুগে সীসার টাইপে মাঝেমধ্যে যেমন টান পড়তো কোনো কোনো হরফের। অথচ আজকাল কমপিউটার এসে পড়েছে, আগের মতো টাইপ/হরফ আর কিনতে হয় না। যে কোনো হরফেরই টান পড়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। কমপিউটার কখনোই বলবে না যে অমুক অক্ষরটি আর স্টকে নেই। তবু 'তিনি জানান, তার নিজের কথা ভাবার সময় নেই' ধরনের বাক্য পাইকারিভাবে লেখা হচ্ছে। ব্যাকরণ বলছে, এই বাক্যটিতে শব্দটি 'তার' না হয়ে হওয়ার কথা 'তাঁর'। এটি রীতিমতো অনুচিত ও অশুদ্ধ, এই বাক্যে 'তিনি জানায়' বললে তা যেমন অশুদ্ধ হতো। এখানে 'তাঁর' শব্দটিতে চন্দ্রবিন্দুটি ব্যবহার না করার কোনো কারণ খুঁজে পাওয়া যায় না। দু'একটি ক্ষেত্রে হলে তা প্রুফ রীডিং-এর ত্রুটি বা অমনোযোগ বলে ধরে নেওয়া চলে। কিন্তু ঘটনাটি হরহামেশার এবং প্রায় প্রতিটি কাগজে। সুতরাং একে চন্দ্রবিন্দুর আকাল বলা যেতেই পারে।
কিছুদিন আগে পর্যন্ত সাপ্তাহিক এবং অধুনা দৈনিক একটি কাগজ তো মনে হয় আরেক মার্গে চলে গেছে চন্দ্রবিন্দুকে পুরোপুরি পরিহার করে ('অহো, কী দুঃসহ স্পর্ধা!')। এই বর্জনের পক্ষে যুক্তি কী, তা আমার জানা নেই। কিন্তু এর কতকগুলি সম্ভাব্য বিপদ আমি দেখতে পাই। যে কোনো দুঃখেই আমার পক্ষে আর 'কাঁদা' সম্ভব হবে না, কেননা তা 'কাদা' হয়ে যাবে। চন্দ্রবিন্দু ছাড়া 'কাদতে' হবে ভাবতেই কান্না পেয়ে যাচ্ছে। ক্রন্দন অর্থে 'কাঁদা' আর প্যাচপেচে 'কাদা'-র পার্থক্য তাহলে কীভাবে করা যাবে? ভাত 'রাঁধা' হবে না আর, কারণ সেখানে 'রাধা' এসে উপস্থিত হয়ে যাচ্ছে। 'ছিরিছাঁদ' বলতে তা বাড়ির 'ছাদ'-এ উঠে যাচ্ছে। আমি আর কিছুতেই 'বাঁধা' পড়তে পারবো না, কারণ তা হয়ে যাবে 'বাধা'। চন্দ্রবিন্দু বিহনে 'চাঁদ' হয়ে থাকছে 'চাদ'। 'বাঁদর' হবে 'বাদর' ('এ ভরা বাদরে তুমি কোথা...')। চন্দ্রবিন্দু বাদ দিয়ে 'বাঁশ' কীভাবে লেখা যাবে, বা 'বাঁশি'? 'বাশি'-তে সুর উঠবে কি? 'গাঁয়ে' আর ফেরা হবে না, হবে 'গায়ে' ফেরা । 'গোঁয়ারগোবিন্দ'-র অবস্থা কী হবে ভাবা যায়? গোলাপের 'কাঁটা' পড়বে 'কাটা'। আর ভূতের গল্পের কী হবে? চন্দ্রবিন্দু বাদ দিয়ে ভূতেরা কথা বলতে পারে না বলে জেনে এসেছি এতোদিন।
ব্যবহার না থাকার ফলে বাংলা স্বরবর্ণ থেকে একটি অক্ষর বিলীন হয়ে গেছে আমাদের চোখের সামনে। ছোটোবেলায় আমরা বর্ণমালা শেখার কালে একটি অক্ষর চিনেছিলাম, যার নাম ছিলো 'লি'। লেজ উঁচিয়ে বসে থাকা কাঠবেড়ালির মতো দেখতে অক্ষরটি একেবারে নেই হয়ে গেলো। কোনো কাজেই লাগতো না বলে। কিন্তু চন্দ্রবিন্দুর ব্যবহার এবং উপযোগিতা এখনো কিছুমাত্র কম নয়। তাকে আমরা উচ্ছেদ করার চেষ্টা করছি কেন? আর এই করতে গিয়ে আজকের শিক্ষার্থীদেরই বা আমরা কী শেখাচ্ছি? এ কথা স্বীকার করতেই হবে যে আমাদের দেশের অধিকাংশ লেখাপড়া জানা মানুষও খুব শুদ্ধ বাংলা লিখতে পারেন না। আমার এক বন্ধু রসিকতা করে একটি নিদারুণ সত্য কথা বলেন, 'আমরা ইংরেজিতে 'উইক' এবং বাংলায় 'দুর্বল'। এই অরাজকতা সেই দুর্বলতা বা উইকনেসের উপশম ঘটাবে না।
পঞ্চাশের দশকে একটি জনপ্রিয় বাংলা ছবিতে ছবি বিশ্বাসের আবেগমথিত কণ্ঠে বলা 'ফিরিয়ে দাও আমার বারোটি বছর' সংলাপটি খুব বিখ্যাত হয়েছিলো। বয়স্করা ঠাট্টাচ্ছলে এখনো তা মাঝেমধ্যে উদ্ধৃত করে থাকেন। ওই সংলাপের অনুকরণে আমার এখন বলতে ইচ্ছে করে, ফিরিয়ে দাও আমার হারানো চন্দ্রবিন্দুগুলি!
সর্বশেষ এডিট : ৩১ শে জানুয়ারি, ২০০৭ রাত ১২:৩০