somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ধর্ষণের মহামারি ছড়ানোর কারণ তাহলে এই

১৯ শে এপ্রিল, ২০১৮ দুপুর ১২:৪৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

ধর্ষণের বিচারে নারীর সামনে পদে পদে বাধা
বিচার চাইতে গেলে ধর্ষণের শিকার মেয়েটিকে অনেকেই হেয় করে, দায়ী করে।
আপস করতে বলে।
তাতে সবারই লাভ।


আলামত হিসেবে জব্দ হয়েছিল একটি ‘লাল পায়জামা, যাহাতে রক্ত মাখা’। আরও ছিল একটি সাদা সেমিজ, লাল-গোলাপি ছাপা কামিজ এবং ছাপা লাল ওড়না। সবই ‘রক্তমাখা’।

রক্তাক্ত ক্ষতবিক্ষত মেয়েটিকে ২০০৪ সালের মার্চে রাজধানীর মোহাম্মদপুর থানায় নিয়ে এসেছিলেন তাঁর এক বান্ধবী এবং পাড়ার ট্যাক্সিচালক। মেয়েটির এজাহারে রাত একটার দিকে গণধর্ষণের মামলা দায়ের হয়।

এজাহারে অল্পবয়সী পোশাকশ্রমিক মেয়েটি বলেন, তিনি কাজ শেষে আরেক বাসা থেকে চাবি নিয়ে রাত ৯টার দিকে ঘরে ফিরছিলেন। তখন নামে চেনা দুজন পুরুষ তাঁর মুখ চেপে ধরে রাস্তার মাথার ঢালে নিয়ে ফেলেন।

একজন, পরে অচেনা আরও দুজন এবং কাছের একটি বাসার তত্ত্বাবধায়ক মেয়েটিকে ধর্ষণ করেন। তারপর তাঁকে একটি দোকানের সামনে ফেলে যান।

লোকজন তত্ত্বাবধায়ককে আটকে ফেললে পুলিশ তাঁকে গ্রেপ্তার করে। মামলায় তিনি অভিযুক্ত হন। পলাতক দুই আসামির ঠিকানা না মেলায় তাঁরা অব্যাহতি পান। অচেনা দুজনের কোনো হদিসই মেলেনি।

প্রায় ১৪ বছর হলো ঢাকার ৪ নম্বর নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে মামলাটির বিচার চলছে। তত্ত্বাবধায়ক জামিনে বেরিয়ে পালিয়ে গেছেন।

রাষ্ট্রের পক্ষে সাক্ষী ছিলেন ১৪ জন। মেয়েটি ২০০৫ সালে সাক্ষ্য দেন। সাক্ষ্য দিয়েছেন ডাক্তারসহ চারজন। তবে ২০১৬ সালের এপ্রিলের পর থেকে পুলিশ ও সরকারি কৌঁসুলি (পিপি) আর কোনো সাক্ষীকে হাজির করেননি।

মেয়েটির চিকিৎসা হয়েছিল ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ওয়ান-স্টপ ক্রাইসিস সেন্টারে (ওসিসি)। পরে একটি বেসরকারি সংস্থার কাছে
আশ্রয় পান।

ঘটনার ক্ষত তাঁকে এক গভীর গর্তে ঠেলে দেয়। কারও সঙ্গে কথা বলতেন না। অন্ধকার কোনা খুঁজে ঘণ্টার পর ঘণ্টা গুটিসুটি হয়ে থাকতেন। আশ্রয়কেন্দ্রে যিনি তাঁকে পরামর্শসেবা (কাউন্সেলিং) দিতেন, তিনি বলছেন অন্তত ছয় মাস এভাবেই গেছে।

পরিবার তাঁর পাশে থাকেনি। মেয়েটি পরে নতুন জীবন পেয়েছেন। এত বছর পেরিয়ে তিনি ঘটনাটি থেকে দূরে সরতে পেরেছেন। হয়তো।

আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশের (আইসিডিডিআরবি) জ্যেষ্ঠ গবেষক রুচিরা তাবাস্‌সুম নভেদ্‌ দুই দশক ধরে নারীর প্রতি সহিংসতা নিয়ে গবেষণা করছেন। তিনি বলেছেন, ধর্ষণের শিকার নারী বা শিশু যে ধরনের শারীরিক-মানসিক পীড়ায় (ট্রমা) ভোগে, তাকে বলে পোস্ট ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিসঅর্ডার (পিটিএসডি)। যারা যুদ্ধে যায়, যাদের জীবনে ভয়াবহ কোনো অভিজ্ঞতা হয়, তাদের এ সমস্যা হয়।

এমন নির্জীব, উৎপীড়িত, ভীত অবস্থায় নিজে থেকে প্রতিকার খোঁজা খুব কঠিন। রুচিরা বলেন, ‘মামলা করা বা বিচার চাওয়াটা তো বিরাট কর্মযজ্ঞ। তেমন কিছু করতে হলে মেয়েটির সাংঘাতিকভাবে সমর্থন-সহযোগিতা লাগবে।’

বিশেষ করে পরিবারের সমর্থন চাই। কিন্তু ইজ্জত যাবে, পরিবার-সমাজ বিশ্বাস করবে না, তাকেই দোষ দেবে—এই ভয়টা বড় হয়ে আসে।

বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের আইনি সহায়তা কার্যক্রমের পরিচালক অ্যাডভোকেট মাকছুদা আখতার বলছেন, ভয়টা বাস্তব। এমনিতেই প্রথম চেষ্টা থাকে সালিসে আপসরফার। মামলা করতে গেলে বিপক্ষের আইনজীবী তো বটেই, পুলিশ-ডাক্তার আর রাষ্ট্রপক্ষেরও অনেকের মধ্যে অবিশ্বাস আর মেয়েটির দোষ খোঁজার মানসিকতা থাকে।

উত্তরা থানায় ২০০৩ সালে একজন পোশাকশ্রমিক একটি গণধর্ষণের মামলা করেছিলেন। অভিযোগ ছিল, পরিচিত দুই যুবক ভালো চাকরির ব্যবস্থা করেছেন বলে বাসায় ডেকে নিয়ে তাঁকে ধর্ষণ করেন।

রাসায়নিক পরীক্ষায় তাঁর সালোয়ারে ‘মানুষের বীর্য’ পাওয়া যায়। আর ডাক্তারি পরীক্ষা বলে, তিনি সম্প্রতি জোরপূর্বক সঙ্গমের শিকার হয়েছেন।

মামলাটির তদন্ত কর্মকর্তা (আইও) আসামিদের অভিযুক্ত করে অভিযোগপত্র দেন। তবে তিনি এ-ও লেখেন যে ‘প্রকাশ্য ও গোপন’ তদন্ত করে জেনেছেন, দুই আসামিই ‘স্বামী পরিত্যক্ত’ মেয়েটিকে ‘ভালোবাসতেন’। তাঁরা বিভিন্ন জায়গায় মেয়েটিকে নিয়ে ‘অসামাজিক কাজকর্ম’ করতেন।

২ নম্বর ট্রাইব্যুনালে মামলাটি আসার ১২ বছর পর বিচারকের আদেশে পলাতক অবস্থায় আসামিরা খালাস পান। কারণ, পুলিশ-পিপি মেয়েটিসহ একজন সাক্ষীকেও হাজির করেননি।

প্রথম আলো ঢাকার ট্রাইব্যুনালগুলোয় ১৫ বছরে ধর্ষণ, ধর্ষণজনিত মৃত্যু ও হত্যা এবং গণধর্ষণের (মৃত্যু-হত্যাসহ) অভিযোগে আসা সাড়ে পাঁচ হাজার মামলার বিচার পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করেছে। নিষ্পন্ন মামলাগুলোর মাত্র ৩ শতাংশের সাজা হয়েছে।

যেসব থানা থেকে ধর্ষণসংক্রান্ত মামলা বেশি আসছে, সেগুলোতে গরিব মানুষ আর পোশাকশ্রমিকদের ঘনবসতি আছে। প্রথম আলো ৫২টি মামলা খুঁটিয়ে দেখেছে। সিংহভাগেরই অভিযোগকারীরা গরিব পরিবারের। অনেকেই শ্রমজীবী, গৃহকর্মী বা পোশাকশ্রমিক।

ধর্ষণের অভিযোগ প্রমাণ করা জটিল। তদুপরি তদন্ত ও মামলা পরিচালনায় গাফিলতি বা অবহেলার কারণে মামলাগুলো ঝুলে যায়। ঝুলে গেলে সাজা হচ্ছে খুব কম।

শুরুতে পরিবারের যদি-বা সমর্থন থাকে, ক্রমে খরচ, জটিলতা আর সামাজিক চাপে তা উবে যায়। আসে আপসের চাপ। মামলার পথঘাট জানা না থাকায় ভোগান্তি বাড়ে।

বিচারে আস্থা থাকে না। থানা ও আদালতের পরিবেশ, ‘চরিত্রহীন’ প্রমাণের চেষ্টা, ডাক্তারি পরীক্ষা—এসব ধর্ষণের অভিযোগকারীকে বিপর্যস্ত করে।

থানা-পুলিশ-হাসপাতাল

অ্যাডভোকেট মাকছুদা গত ৩০ বছর কাজের সুবাদে অনেক নারীর কাছে শুনেছেন, থানায় প্রথমেই অবিশ্বাসের মুখোমুখি হতে হয়। পুলিশ সদস্যরা প্রশ্ন করেন, নিজে থেকে গিয়েছিলেন, নাকি তাঁকে ভাড়া করে নেওয়া হয়েছিল। ‘পেশাদার যৌনকর্মী’—এমন কথাবার্তাও শুনতে হয়।

ভাবটা থাকে, মেয়েটি খারাপ না হলে তাকে বেছে নিল কেন? মাকছুদা বলেন, ‘মনে করে কি, প্রেমঘটিত। সম্মতিতে হয়েছে।’ কখনো পুলিশ মামলা নিতে চায় না, টাকাপয়সা দিতে হয়।

ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া বলছেন, মহানগরের প্রতিটি থানায় নারী ও শিশুবান্ধব সহায়তা ডেস্ক খোলা হয়েছে। সেখানে নারী কর্মকর্তা থাকেন। নারী সহায়তা ও তদন্ত বিভাগে নারী কর্মকর্তা আছেন।

অভিযোগগুলো তারপরও উঠছে। ডিএমপির মতিঝিল বিভাগের অতিরিক্ত উপকমিশনার মোনালিসা বেগম বলেন, ‘থানার বৈরী পরিবেশ দূর করার চেষ্টা হচ্ছে।নারীবান্ধব কর্মকর্তা দেওয়া দরকার।’ জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাদের মামলার তদারকি নিবিড় হওয়া চাই।

ডাক্তারি পরীক্ষায় ভুক্তভোগীর পুরো শরীরে, যৌনাঙ্গের ভেতরে ও বাইরে জোরপূর্বক সঙ্গমের আলামত খোঁজা হয়। অসংবেদনশীল পরিবেশ ভুক্তভোগীর যাতনা বাড়ায়। নারী ফরেনসিক ডাক্তারের অভাবে পরীক্ষাগুলো করেন মূলত পুরুষ ডাক্তার। অনেক মেয়ে পরীক্ষা করাতেই চান না।

তথাকথিত ‘দুই-আঙুলি’ পরীক্ষায় যোনিপথের প্রবেশযোগ্যতা ও পর্দার (হাইমেন) অবস্থাও দেখা হয়। গত সপ্তাহে হাইকোর্ট একটি রায়ে ধর্ষণের ক্ষেত্রে এ পরীক্ষা নিষিদ্ধ করেছেন।

ডাক্তারি রিপোর্টে কখনো লেখা থাকে, মেয়েটি যৌন সংসর্গে অভ্যস্ত। ফরেনসিক বিশেষজ্ঞরাই বলছেন, কথাটি অবৈজ্ঞানিক এবং ধর্ষণ প্রমাণের জন্য একেবারেই অপ্রাসঙ্গিক। একটি শিশুর রিপোর্টে লেখা আছে, ‘সতীচ্ছদ পুরোনো ছেঁড়া’। এসব কথা আসামিপক্ষকে ভুক্তভোগীর চরিত্রের দিকে আঙুল তুলতে সাহায্য করে।

রিপোর্ট নিয়ে টাকা লেনদেনের অভিযোগ আছে। ফরেনসিক বিশেষজ্ঞ ডা. সোহেল মাহমুদ বলছেন, কথাটা তাঁর বিশ্বাস হয় না।


আদালতে হেনস্তা
ট্রাইব্যুনালগুলোর পিপিরা বলে থাকেন, সাক্ষীদের এমনকি এজাহারকারী বা ভুক্তভোগীদেরও আদালতে আনা যায় না। রায়ে দেরি বা খালাসের এটা বড় কারণ। ট্রাইব্যুনাল ১-এর পিপি মো. আবদুল বারী বললেন, ‘জজ সাহেব বাদীকে ফোন করান। আমরা ফোন করি। কিন্তু ফোন ধরে না।’

কয়েকজন ভুক্তভোগী আবার বলেছেন, আদালতে গিয়েও ফিরে আসতে হয়। অ্যাডভোকেট মাকছুদা বলছেন, মামলা চলতে চলতে ছোট মেয়ে বড় হয়ে যায়, বিয়ে হয়। তা ছাড়া ‘শুধু একটা মামলা চালালে হয় না’, ভুক্তভোগীর জন্য সমন্বিত সেবা লাগে। সেটা খুব অপ্রতুল।

বনানীর হোটেলে ধর্ষণের একটি আলোচিত মামলার অভিযোগকারী দুদিন ঘুরে তৃতীয় দিন সাক্ষ্য দিতে পেরেছিলেন। প্রথম দিন তিনি বোরকা পরে আদালতে এলে কানাকানি পড়ে যায়। প্রথম আলোর প্রতিবেদক আদালতের কর্মচারীদের বলতে শোনেন, ধর্ষণ না, এটা বড়লোকের ছেলের সঙ্গে ফুর্তি করার ঘটনা।

দুই-আঙুলি পরীক্ষা-সংক্রান্ত রায়ে হাইকোর্ট বিচারিক আদালতকে নিশ্চিত করতে বলেছেন, ভুক্তভোগীকে যেন অবমাননাকর প্রশ্ন করা না হয়। শুনানির সময় সাক্ষ্য আইনের ১৫৫ক ধারার জোরে আসামিপক্ষের আইনজীবীরা ভুক্তভোগীকে ‘খারাপ মেয়ে’ প্রমাণের চেষ্টা করেন। ধারাটি অনুযায়ী, ধর্ষণ বা ধর্ষণচেষ্টার অভিযোগকারীকে দুশ্চরিত্রা প্রমাণ করে তার সাক্ষ্যের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা যাবে।

সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী শাহদীন মালিক বলছেন, মেয়ে ‘সতী’ না ‘অসতী’, তার সঙ্গে ধর্ষণের কোনো সম্পর্ক নেই। ধারাটি তাকে হেনস্তা করতে সাহায্য করছে।

আদালতে ভুক্তভোগীকে বলতে হয়, ধর্ষণ কীভাবে হয়েছে। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে আছে, কেউ আবেদন করলে বা আদালত নিজের বিবেচনায় ধর্ষণসংক্রান্ত সব মামলার শুনানি একান্তে রুদ্ধদ্বার ঘরে করতে পারেন।

ফৌজদারি মামলার অভিজ্ঞ আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন প্রথম আলোকে বলেন,আজ পর্যন্ত কয়টা আবেদন হয়েছে, তা প্রশ্নসাপেক্ষ। তিনি বলেন, পিপির উচিত রুদ্ধদ্বার বিচার নিশ্চিত করা। পিপিই দেখবেন, আসামিপক্ষ যেন ভুক্তভোগীকে অশ্লীল প্রশ্ন করতে না পারে। বিচারকের দায়িত্ব ভুক্তভোগীকে অসম্মানের হাত থেকে বাঁচানো।

সাক্ষীর সুরক্ষার প্রশ্নটিও বড়, বিশেষত প্রতিপক্ষের যদি রাজনৈতিক যোগাযোগ আর টাকার জোর থাকে।

ভয়ের তাড়া
২০১৩ সালে মেয়েটির বয়স ছিল ১৬-১৭ বছর। দক্ষিণ-পশ্চিম ঢাকায় বাবা-মায়ের সঙ্গে সে থাকত। দরজির কাজ শিখছিল। এক তরুণ বন্ধু একদিন বিকেলে তাকে বুড়িগঙ্গায় বেড়াতে নিয়ে যান।

আরেকটি নৌকা থেকে তিনজন জোর করে তাদের নৌকায় উঠে পড়েন। নির্জন চরে নিয়ে বন্ধুটিকে আটকে রেখে প্রথমে তাঁরা তিনজন, তারপর আরও তিনজন এবং সবশেষে আরও চারজন মেয়েটিকে ধর্ষণ করেন।

এঁদেরই একজন রক্তাক্ত এবং শরীরজুড়ে জখম হওয়া মেয়েটিকে রাতে বাড়িতে থাকতে দেন। মেয়েটি ফোনে বড় বোনকে সব জানায়। তিনি এসে তাকে হাসপাতালে ভর্তি করিয়ে কেরানীগঞ্জ থানায় গণধর্ষণের অভিযোগে মামলা করেন।

ডাক্তার ধর্ষণের আলামত পান। মেয়েটি হাকিমের কাছে যে বিশদ জবানবন্দি দিয়েছে, সেটা মর্মান্তিক।

পুলিশ সাতজনকে গ্রেপ্তার করে। হাকিমের কাছে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে দুজন বলেন, মেয়েটির বন্ধু পনেরো শ টাকা নিয়ে তাকে তাঁদের হাতে তুলে দেন এবং মেয়েটিরও সায় ছিল।

মামলায় বন্ধুসহ ১০ জন অভিযুক্ত হন। ট্রাইব্যুনাল-১ সাক্ষ্য গ্রহণ শেষ করেছেন। সাক্ষ্য দিয়েছেন চারজন। কিন্তু মেয়েটি বা স্বজনদের কেউ আসেননি। আইনজীবীরা আদালতকে বলেছেন, এঁরা আসামিদের ভয়ে আসছেন না।

প্রথম আলোর প্রতিবেদক ঢাকায় পরিবারটির ভাড়া বাসায় গিয়েছিলেন। বাড়িওয়ালার এক আত্মীয় বলেন, ঘটনার পরপর তাঁরা চলে গেছেন। প্রতিবেদক তাঁদের গ্রামের ঠিকানায় গিয়েও কাউকে পাননি।



‘মিথ্যা’ মামলা?

আইনজীবী আমিনুল গনি অনেক মামলায় আসামিপক্ষের হয়ে লড়েছেন। তাঁর কথায়, ‘আদালতে যেসব ধর্ষণের মামলার বিচার চলছে, তার বেশির ভাগই হয়রানিমূলক।’

নারী-শিশু আইনটি মিথ্যা মামলায় ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিকে ট্রাইব্যুনালে লিখিত অভিযোগ করে পাল্টা মামলা করার সুযোগ দিয়েছে। তেমনটা করার নজির কিন্তু প্রায় নেই।

পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) অতিরিক্ত ডিআইজি শেখ মো. রেজাউল হায়দার গ্রামাঞ্চলে জমিজমা নিয়ে বিরোধের কারণে ধর্ষণের কিছু মিথ্যা মামলা হতে দেখেছেন। আর ডিএমপির উপকমিশনার মোনালিসা বেগমের মতে, ধর্ষণের অভিযোগ অধিকাংশ ক্ষেত্রে সত্য—‘তবে প্রেমঘটিত ধর্ষণের ঘটনা থাকে। সেগুলোতে জটিলতা থাকে।’

প্রেম আর বিয়ের প্রতিশ্রুতি
ধর্ষণ কী, তা বোঝাতে ২০০০ সালের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনটি ১৮৬০ সালের ফৌজদারি দণ্ডবিধির ৩৭৫ ধারাকে ভিত্তি ধরেছে। আইনটি বলছে, নিজের স্ত্রী বাদে ১৬ বছরের বেশি বয়সী মেয়ের সম্মতি ছাড়া অথবা তাকে ভয় দেখিয়ে বা প্রতারণামূলকভাবে রাজি করিয়ে তার সঙ্গে যৌনসঙ্গম হচ্ছে ধর্ষণ।

ষোলোর কম বয়সী মেয়ের সঙ্গে সঙ্গম মানেই ধর্ষণ। তবে নিজের স্ত্রীর ব্যাপার আলাদা। তার বয়স তেরোর কম না হলে দণ্ডবিধিতে ধর্ষণ বিবেচনারই সুযোগ নেই।

পুলিশ কর্মকর্তা বা পিপিদের অনেকের মনে প্রতারণার শর্তটি নিয়ে নানা প্রশ্ন আছে। এটির সুবাদেই বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে ধর্ষণের মামলাগুলো হয়।

পিপি আবদুল বারী এসব ক্ষেত্রে ধর্ষণের তারিখের অনেক পরেও মামলা হতে দেখেছেন। মেয়েটি সাবালিকা হলে বলেন, তুলে নিয়ে গিয়ে বিয়ের লোভ দেখিয়ে ধর্ষণ করে আটকে রেখেছে। তদন্তে ধর্ষণের প্রমাণ মেলে না। বারীর কথায়, ‘বোঝা যায় উইলিংলি লিভ টুগেদার করেছে। আসামি তখন বলে, জোর করে কিছু হয়নি।’ মামলা টেকে না, আপসও হয়ে যায়।

২০০৮ সালের একটি মামলায় এক মা অভিযোগ করেন, তাঁর পোশাকশ্রমিক মেয়েকে বিয়ের লোভ দেখিয়ে ধর্ষণ করেছিলেন পরিচিত এক যুবক। তারপর তাঁরা কামরাঙ্গীরচরে একটি ভাড়া বাসায় ওঠেন। মেয়ে অন্তঃসত্ত্বা হলে মা মামলাটি করেন।

মেয়ের মা ও ভাই বলছেন, মামলা চলাকালে মেয়েটির বাচ্চা হয়। তাঁরা যুবকটির সঙ্গে আপস করেন। তিনি মেয়েটিকে বিয়ে করেন।

আপসের শর্ত মেনে কেউ আর সাক্ষ্য দিতে যাননি। ২০১৬ সালে ট্রাইব্যুনাল ২ যুবকটিকে খালাস দেন। মেয়েটির মা প্রথম আলোকে বলেন, তারপর যুবকটি চলে গেছেন। খোরপোশও দিচ্ছেন না।

আপসের বাস্তবতা
নাবালিকা মেয়ের প্রেমিকটি সদলবলে তাকে ধর্ষণ করার পর সব রকম প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও মামলা কেঁচে যেতে দেখেছেন পিপি আবদুল বারী। তিনি বলেন, ‘অধিকাংশ নির্যাতিতা মেয়ে গরিব হয়। তারা আদালতের বাইরে সমঝোতায় চলে আসে। আদালতে এসে উল্টো সাক্ষ্য দেয় যে ধর্ষণ করেনি।’ অথবা সাক্ষ্যই দেয় না।

মানবাধিকার আইনজীবীরা বলছেন, বিচারে দেরি হলে আপস-সমঝোতার চাপ বাড়ে। এলাকা ছাড়তে হবে, মেয়েদের বিয়ে হবে না—এসবসহ হুমকি-ধমকি আসে। কখনো পরিবার প্রলোভনেও পড়ে।

মামলাগুলো আপসযোগ্য না। ঢাকা জেলা ও দায়রা জজ আদালতের প্রধান পিপি খন্দকার আবদুল মান্নানের মতে, রাষ্ট্রপক্ষকে কড়া নজর রেখে আপস ঠেকাতে হবে। উল্টো সাক্ষ্য দিলে সাক্ষীকে বৈরী ঘোষণা করতে হবে। আদালতেরও আপস মেনে নেওয়া উচিত না।

আপসে সবার লাভ
কয়েকটি মামলা অনুসন্ধান করে প্রথম আলো দেখেছে, আপস কিন্তু অভিযোগকারী একা করেন না।

অ্যাডভোকেট মাকছুদা বলছেন, স্থানীয় রাজনৈতিক নেতা, নির্বাচিত মেম্বার-চেয়ারম্যানসহ সমাজপতিরা আসামির পক্ষে তদবির করেন। থানায় পুলিশ আর আদালতে পিপি-পেশকার তৎপর থাকেন। কখনো এঁরা আসামি আর ভুক্তভোগীর বিয়ের ব্যবস্থা করেন। আপসের লাভের ভাগীদার অনেকে।

ট্রাইব্যুনাল ৫-এর পিপি আলী আসগর অবশ্য বললেন,তাঁরা আপসের কথা জানেনই না—‘এইটা হচ্ছে, মিয়া-বিবি রাজি তো কেয়া করেগা কাজি। আসামিপক্ষ চিন্তা করে যে যদি পিপিকে জানাই, পিপি বাধা দেবেন। আবার বাদীপক্ষ মনে করে, পিপিকে জানালে তো তিনি পয়সা চাইবেন।’ তবে কখনো হয়তো তিন পক্ষই জড়িত থাকে, ‘কেউ যদি অসততা করে, এটা হলো তার নিজস্ব ব্যাপার।’

টাকাপয়সা লেনদেনের প্রশ্নে পুলিশের সাবেক প্রধান পরিদর্শক নূর মোহাম্মদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘এটা তো অস্বীকার করার উপায় নেই। এবং এটার পেছনে দুপক্ষই (গ্রহীতা ও দাতা) দায়ী।’ তাঁর মতে, পুলিশের ক্ষেত্রে জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাদের নিবিড় তদারকি এ সমস্যা কমাতে পারে।

আইনজীবী শাহদীন মালিকের বিশ্বাস, রাষ্ট্র চাইলে দ্রুত বিচার নিশ্চিত করতে পারে। কিন্তু গরিব এই নারীদের ব্যাপারে রাষ্ট্রের গরজ খুব কম।

কেউ খোঁজ রাখে না
১২ বছর বয়সী মেয়েটি ঢাকার একটি বস্তিতে ফুফুর কাছে থাকত। ১৯৯৯ সালের এক সকালে ৯০ টাকা দিয়ে একটি ইলিশ মাছ কিনে ঘরে ফিরলে ফুফু তাকে বকাঝকা করেন। সে রাগ করে সারা দিন বস্তিতে ঘোরাঘুরি করে। সন্ধ্যায় এক প্রতিবেশী তাকে ডেকে খেতে দেন।

তারপর তিনি শিশুটিকে নিয়ে গিয়ে একটি বড়লোকের বাড়ির দারোয়ানের হাতে তুলে দেন। দুই দারোয়ান তাকে ছাদে নিয়ে ধর্ষণ করেন। পরে আরেকজন রক্তাক্ত শিশুটিকে আরেক বাড়িতে নিয়ে ধর্ষণ করেন। শিশুটি পরে মামলার এজাহারে বলে, ‘আমি চোখেমুখে অন্ধকার দেখি।’

লোকটি শিশুটিকে রাস্তায় ফেলে দেন। তার আর্তনাদে লোকজন আর পুলিশ এসে তাকে হাসপাতালে নেয়। গুলশান থানায় গণধর্ষণের মামলা হয়।

এই মামলা ট্রাইব্যুনাল ২-এ ওঠে ২০০২ সালে। পুলিশ চার আসামিকেই গ্রেপ্তার করে অভিযুক্ত করেছিল। কিন্তু পুলিশ-পিপি একজন সাক্ষীকেও হাজির করেননি। ঘটনার প্রায় ১৭ বছর পর অভিযুক্ত ব্যক্তিরা খালাস পান। একজন তত দিনে মারা গেছেন।

আর ছোট্ট শিশুটি? কাগজপত্রে তার পুরো ঠিকানাটুকুও নেই। শুধু মামলার এজাহারে তার টিপসই বলছে, একদিন সে ছিল।
সর্বশেষ এডিট : ১৯ শে এপ্রিল, ২০১৮ দুপুর ১২:৫০
৪৫৬ বার পঠিত
১৬টি মন্তব্য ১২টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

মিশরের ঝটিকা সফর ২০২৪ _ প্রস্তুতি পর্ব

লিখেছেন নতুন, ২৫ শে নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ১১:২৭

দুনিয়াতে অনেকের কাছেই টাকা-পয়সা হাতে ময়লা। দুবাইয়ে থাকার সুবাদে সত্যিই অনেক মানুষকে দেখছি যারা এত টাকা খরচের রাস্তা খুঁজে পাচ্ছে না। এ কারণেই লুই ভিতন ২০ লক্ষ টাকার টেডি বিয়ার... ...বাকিটুকু পড়ুন

তোমাদের অভিবাদন হে বিপ্লবী!

লিখেছেন বিদ্রোহী ভৃগু, ২৫ শে নভেম্বর, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৫


তোমাদের অভিবাদন হে বিপ্লবী!

বিপন্ন সময়ে, ইতিহাসের ক্রান্তিকালে
চাটুকারিতা আর মোসাহেবির আবশ্যিকতাকে দলে
স্বৈরাচারের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে-
ছররা গুলি, টিয়ার শেল, গুপ্ত আক্রমন
সব কিছু ছাপিয়ে দৃঢ় চেতনায় অবিচল- বিজয়ের স্বপ্নে।

তোমাদের অভিবাদন হে... ...বাকিটুকু পড়ুন

অবশেষে রিক্সালীগ সফল!

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ২৫ শে নভেম্বর, ২০২৪ বিকাল ৪:২২


অবশেষে আবারো সরকার হার মানলো। হার মানলো রিক্সালীগের কাছে। এটা শুরু মাত্র। এখন সবকিছুতেই হার দিয়েই চলতে হবে হয়তো। যেটা কারোরই কাম্য ছিলনা। কাম্য ছিল তাদেরই যারা অন্যায়ভাবে শত শত... ...বাকিটুকু পড়ুন

মেগা মানডে: সংঘর্ষ, বিক্ষোভ ও অহিংস প্রতিবিপ্লবের ভূত চেপে বসেছে ঢাকাবাসীর ঘাড়ে !

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ২৫ শে নভেম্বর, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:৫৬



ঢাকায় নৈরাজ্য বেড়েই চলেছে। প্রতিদিন বিক্ষোভ ও সংঘর্ষ হচ্ছে ঢাকার বিভিন্ন স্থানে। আজকে তার সাথে ঢাকাবাসী প্রত্যক্ষ করলো অহিংস অভ্যুত্থান কর্মসূচীর! বিভিন্ন জেলা থেকে মানুষ... ...বাকিটুকু পড়ুন

চিন্ময় ব্রহ্মচারী প্রভুকে গ্রেফতার করা হল কোন উদ্দেশ্যে?

লিখেছেন সাড়ে চুয়াত্তর, ২৫ শে নভেম্বর, ২০২৪ রাত ৯:৩৯

আমার ধারণা চিন্ময় ব্রহ্মচারী প্রভুকে গ্রেফতার করা হয়েছে ইচ্ছাকৃতভাবে দেশের পরিস্থিতি অস্থিতিশীল করার জন্য। ভালো উদ্দেশ্যে তাকে গ্রেফতার করা হয় নাই। চিন্ময় ব্রহ্মচারীর কথা বার্তা আমার ভালো লাগে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×