আমি মানুষটা কেমন যেন! কোন একটি মর্মান্তিক ঘটনা ঘটে যাওয়ার পর সবাই যখন আবেগের সাগরে ভেসে যায়, তখন আমার মাঝে তেমন আবেগী কোন প্রতিক্রিয়া দেখা যায় না। মনে মনে শুধু ভাবতে থাকি সত্যিকারের কিছু করা সম্ভব কিনা যা করলে এই বিপদে কাজে আসবে। ভেবে চিন্তে আমার যদি কোন উপায় খুঁজে পাই, তাহলে চেষ্টা করি সেটা সার্থক করতে। তেমনি একটি উপায় খুঁজে পেয়েই সম্ভবত ঘোষনা দিয়েছিলাম চট্রগ্রাম যাচ্ছি। যা নিয়ে অনেকের মাঝে অসোন্তষ দেখেছিলাম। তবে এটা হলপ করে বলতে পারি, ঐমূহুর্তে শুধু সাহায্য করা ব্যাতিত অন্য কোন কিছু মাথায় ছিলো না।
যাই হোক, ঢাকা হতে আরো কিছু বন্ধুর সহায়তায় বেশ কিছু টাকা ও দ্রব্য সামগ্রি সংগ্রহ করে ১৪ জুন, ২০০৭ ভোরে সামহোয়্যাইনের পক্ষ থেকে সাহায্যের উদ্দেশ্যে যাওয়া দ্বিতীয় টিমে যোগ দেই। দুপুরের মাঝেই আমরা পৌঁছে যাই চট্রগ্রামে। তারপর কোনরকম বিরতী না দিয়েই কাজে নেমে পড়ি এবং আজকে ফিরে আসার আগে পর্যন্ত চলতে থাকে আমাদের কাজ। কিভাবে কি করেছি তা নিয়ে পরবর্তীতে লেখার ইচ্ছে রয়েছে।
আমরা কেন নিজেরা যাচ্ছি এবং কোন সাহায্য সংস্থাকে কেন আমাদের সংগ্রীত অর্থ দিয়ে দিচ্ছি না, তা নিয়ে অনেকে দেখলাম আলোচনা করছেন। একটি সীমিত গন্ডি থেকে বিচার করলে তাদের পয়েন্টগুলো মোটেও ইনভ্যালিড দেখাবে না। কিন্তু অতীতে বিভিন্ন ত্রান কার্যে অংশগ্রহন করে আমার যে অভিজ্ঞতা হয়েছিলো তাতে মনে হয়েছে রেড ক্রস বা অন্যান্ন সাহায্য সংস্থা যেভাবে সাহায্য করে, তা ক্ষতিগ্রস্থ অসহায় লোকগুলোর জন্য যথেষ্ট নয়। আমার মনে হয়েছিলো একই পরিমান দক্ষতা ও সম্পদ দিয়ে আরো ভালো উপায়ে সাহায্য করা সম্ভব। কোন একটি দুর্যোগ ঘটে যাওয়ার পর সাময়িক ভাবে কিছু সাহায্য এসব অসহায় লোকগুলোর সত্যিকার সমস্যার সমাধান করতে পারে না, পারার কথা নয়। আমার ব্যক্তিগত চিন্তা হচ্ছে একটু একটু করে সবাইকে সাহায্য না করে প্রায়োরিটি অনুযায়ী একজন একজন করে যতজনকে পারা যায় পূর্বের জীবনে ফিরিয়ে আসতে সাহায্য করা। এবং বাকী সম্পদ দিয়ে তুলনামূলক কম ক্ষতিগ্রস্থদের গনহারে তড়িৎ সাহায্য করা। আমাদের পরিচিত বিভিন্ন সাহায্য সংস্থার খুব কম সংখ্যকই এই পদ্ধতি প্রয়োগ করে থাকে। সুতরাং তাদের উপর ঠিক ভরসা রাখতে পারিনি।
পত্রিকায় পড়ে বা টিভিতে দেখে যে প্রকৃত ঘটনার সত্যিকার চিত্র অনুধাবন করা যায় না, তা এর আগে বিভিন্ন ত্রান টিমে কাজ করে বেশ ভালই উপলদ্ধ করেছিলাম। আপনি যখন একটি দূর্যগ পীড়িত এলাকা নিজে স্বচক্ষে দেখবেন, তখন আপনি বুঝতে পারবেন তাদের জন্য কতটা সাহায্য করার প্রয়োজন রয়েছে। এখানে আরো দু:খ জনক একটি বিষয় আমি অনেক আগেই লক্ষ করেছি যে, দুর্গতদের সাহায্য করতে এসে বিভিন্ন দেশী বিদেশী সংস্থার ও সরকারী সাহায্য গুলো বেশীর ভাগ সময়ই সাময়িক। ঘটনার কিছুদিন পরে এসব লোকগুলোর কি হলো, তা নিয়ে তাদের কোন মাথা ব্যাথা থাকে না। ব্যাটারটিতে কেমন যেন একটা আনুষ্ঠানিক ভাব রয়েছে। কোন রকমে টিকে থাকা একদল লোক যখন সহায় সম্বল হারিয়ে প্রায় নিস্ব হয়ে যান, তখন সাময়িক ভাবে দেয়া কিছু টাকাপয়সা, ঔষধ, খাদ্র সামগ্রি কিভাবে তাদের আসল সমস্যার সমাধান করতে পারে? অথচ সবগুলো সংস্থা একত্রে বসে সুন্দরভাবে পরিকল্পনা করে একটি একটি করে সবার জন্যই বাস্তব সম্মত ব্যাবস্থা গ্রহন করতে পারতো, া তাদেরকে আবার সাবলম্বী করে দিতে সহায়ক হতো।
যাই হোক, নিজের সাহায্য নিজের পদ্ধতিতে দেয়ার লক্ষেই আক্রান্ত এলাকায় যাওয়ার পরিকল্পনা গ্রহন করি। সেই লক্ষেই যোগ দিলাম সামহোয়্যারের দ্বিতীয় টিমের সাথে। সেই টিম নিয়ে গত ১৪ জুন, ২০০৭ ভোরে আমরা চলে যাই চট্রগ্রামে মূল টিমের সাথে যোগ দেয়ার জন্য। সেখানে গিয়ে আমি সবচেয়ে বেশী অবাক হয়েছিলাম যখন দেখলাম সামহোয়্যারের পক্ষ থেকে নেয়া সাহায্যের প্রক্রিয়াটা আমার নিজের চিন্তাভাবনার সাথে মিলে যাচ্ছে। তবে সামহোয়্যারইনের পরিকল্পনাটি আমারটি থেকেও অনেক বেশী কার্যকরী ছিলো।
সামহোয়্যারের আরিল ভাই ও রাহিল ভাইয়ের পরিকল্পনা অনুযায়ী আমরা খুঁজে বের করতে চেষ্টা করি সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্থ ও একদল নিরুপায় কিছু পরিবারকে। আমরা পরিকল্পনা করলাম বিপদগ্রস্থা নিরুপায় লোকগুলোকে আবার তাদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসা পর্যন্ত সাহায্য করে যাবো। তবে সেটা আমাদের সামর্থ্য অনুযায়ী হবে। সেই লক্ষে খুঁজ শুরু করি সঠিক লোকগুলোকে, যারা সত্যিই অসহায় এবং যাদের সত্যিকার অর্থেই সাহায্যের প্রয়োজন। অবশেষে দুইদিন টানা কাজ করে আমরা সেরকম বেশ কিছু পরিবার ও ব্যক্তিকে চিন্হিত করি এবং তাদেরকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যাবস্থা গ্রহন করি। সেই লক্ষে আগামী তিন মাস এসব ব্যক্তিদের আমরা সাহায্য করে যাবো। কিভাবে কি করবো, তা নিয়ে বিস্তারিত পরে লেখার ইচ্ছে রইলো।
আমাদের পরিকল্পনাগুলো বাস্তবায়নের প্রাথমিক ও সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ন ধাপ আমরা খুব সুন্দর ভাবেই শেষ করতে পেরেছি। সবাই একত্রে চেষ্টা না করলে হয়তো এত কঠিন কাজটি এত দ্রুত শেষ করা সম্ভব হতো না। ঢাকায় গত ১৩ জুন, ০৭ সকাল হতে দুপুর পর্যন্ত টানা দৌড়া দৌড়ি করে যারা অর্থ ও জামা কাপড় সংগ্রহ করেছেন ও অন্যন্ন যারা বিভিন্ন মাধ্যমে সাহায্য পাঠিয়েছেন এবং চট্রগ্রামে গতকাল পুরোটা দিন পায়ে হেটে ও আজকে ভোর থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত টানা বৃষ্টিতে ভিজে যারা এই অসাধ্যটি সাধন করলেন, তাদের ধন্যবাদ দিয়ে ছোট করার চেষ্টা করবো না। তাই আপাতত এখানেই পরিসমাপ্তি টানি। আমারা কি করলাম ও কিভাবে করলাম, তা নিয়ে ডিটেইলসে কিছু পোষ্ট দেয়ার ইচ্ছে রইল।
ছবি: (বাম দিক থেকে)
হাসান ভাই, মোর্শেদ ভাই, সাফি ভাই, জুয়েল ভাই (ব্লগার: চট্রগ্রাম থেকে), আরিল ভাই, ত্রিভুজ, সামি ভাই (পাঠক: চট্রগ্রাম থেকে), রাহিল ভাই, তালহা ভাই।
(বৃষ্টিতে হেঁটে কাজ করে সবার অবস্থা যখন খুবই খারাপ, তখন তোলা হয়েছে ছবিটি...)
--
বি:দ্র: এই পোষ্টটি সম্ভবত দেয়া লাগতো না, যদিনা ভূমি ধ্বসে আক্রান্তদের সাহায্য করার জন্য আমাদের চট্রগ্রাম যাওয়া নিয়ে এত আলোচনা/সমালোচনা না হতো। তবে তারা একটি বিষয়ে অবশ্যই ধন্যবাদ পাবার যোগ্য। তাদের অভিযোগ, আপত্তি বা গঠনমূলক কিছু সমালোচনা না আসলে হয়তো দূর্যগপীড়িত লোকদের সাহায্য করার ব্যাপারে আমাদের নিজস্ব চিন্তাভাবনা ও পদ্ধতি এবং এর গুরুত্ব নিয়ে লিখতে যেতাম না।
সর্বশেষ এডিট : ২১ শে এপ্রিল, ২০১০ রাত ১১:৪৬