আমার একজন দূরসম্পর্কের দাদা ছিলেন। ভিষন সহজসরল এবং দরিদ্র মানুষ। উনি আমাদের আরবি পড়া শেখাতেন,আমরা উনাকে মৌলভী দাদা বলতাম। দুনিয়ার কোন বিষয় খুব একটা আগ্রহ ছিল না দাদার। মসজিদে ইমামতি করতেন তার বিনিময়ে কোন পারিশ্রমিক পেতেন না। তবে বিভিন্ন ফসলের মৌসুমে বিভিন্ন বাড়ি বাড়ি গিয়ে ফসল সংগ্রহ করতেন সবাই ধান,পাটসহ অন্যান্য ফসলের মৌসুমে ওনাকে একটু বেশী বেশী ফসল দিতেন যাতে উনি পরিবার নিয়ে চলতে পারেন। আসলে উনার সরলতার জন্য গ্রামের মানুষ উনাকে ভালবাসতো। এছাড়া মিলাদ পড়ানো,মক্তবে ছোট ছোট বাচ্চাদের আরবী শেখানোর মাধ্যমে আরো কিছু টাকা রোজগার করতেন। মৌলভী দাদা এতটাই সহজসরল ছিলেন যে সবাই যা বলতো তাই উনি বিশ্বাস করতেন। উনার এই সরলতা নিয়ে আমাদের গ্রামে বেশ কিছু গল্প প্রচলিত আছে যেগুলি আজও আমাদের গ্রামের মানুষের হাসির খোরাক।
গল্প ১.
দাদা যতটা সহজসরল উনার বড় ছেলেটা ততটাই দুষ্ট(কথায় আছে, আলেমের ঘরে জালেম হয়) । কোন কাজ করতে চাইতো না শুধু বাপের ঘাড়ে বসে বসে খেতো, আর বাপের উপর হম্বিতম্বি করতো। একবার উনার এই অকম্মা ছেলের বিয়ের বাতিক উঠলো। বাবার উপর নানাভাবে চাপ দিতে লাগলো বিয়ের জন্য। মৌলভী দাদা ছেলেকে বলতেন
-বাবা আল্লাহ আল্লাহ কর একদিন বিয়ে হয়ে যাবে।
যতবারই উনার ছেলে উনাকে বিয়ের কথা বলতো ততবারই একই কথা বলেন। ছেলে একদিন বিয়ের জন্য বিদ্রোহ ঘোষণা করলো। ঘরের মাটির হাড়ি, মাটির কলস, কাঠের চেয়ার ভাঙতে লাগলো। দাদা সেদিন বাড়িতেই ছিলেন। ছেলেকে শাসন না করে উনি জোরে জোরে বলতে লাগলেন
-লা ইলাহা ইল্লা আন্তা সুবহানাকা ইন্নি কুন্তু মিনাজোলেমিন(ঝড় বা কোন বিপদ আসলে গ্রামের মানুষ জোরে জোরে এই দোয়া পড়ে) পড়তে লাগলেন। আর বলতে লাগলেন, ছেলে পাগল হয়ে গেছে আল্লাহ তুমি তাকে রক্ষা কর। এখনো গ্রামের মানুষ কেউ বেশী দুষ্টামি করলে বলে, লাইলাহা ইল্লা আন্তা সোবাহানাকা ইন্নি কুন্তু মিনাজোলেমি,ছেলে পাগল হয়ে গেছে।
গল্প২:
একবার উনার বাড়ীতে চারটা বেড়াল দেখে উনার এক ভাতিজা রসিকতা করে বললো
-চাচা ঢাকায়তো বিড়ালের খুব দাম, একটা বিড়াল দশ হাজার টাকায় বিক্রি হয়, আপনার এই চারটা বিড়াল বিক্রি করলেতো আপনি ৪০ হাজার টাকার মালিক হয়ে যাবেন। দাদা বিষয়টি সিরিয়াসলি নিয়ে নিলেন এবং বারবার সেই চাচাকে অনুরোধ করতে লাগলেন উনার বিড়ালগুলো বিক্রি করে দেওয়ার জন্য।
গল্প৩:
একদিন দাদা গ্রামের একবাড়িতে মিলাদ পড়িয়ে আসতে আসতে বেশ রাত হয়ে গেছে। উনার সাথে আরো দুজন সঙ্গী ছিল। গ্রামের কিছু দুষ্টু ছেলে উনাকে ভয় দেখানোর জন্য শ্যাওড়াগাছে উঠে বসে ছিল। উনি শ্যাওড়া গাছের কাছাকাছি আসতে ওরা শ্যাওড়া গাছের ডাল ধরে ঝাকাতে লাগলো। উনিসহ উনার সঙ্গীরা ভিষন ভয় পেয়ে গেলেন, দাদা জোরে জোরে পড়তে লাগলেন
-লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ মুহাম্মাদুর রসুলুল্লাহ।
উনার দোয়া পড়া শুনে দুষ্টুছেলেরা গাছের ডাল ঝাঁকানোর মাত্রা আরো বাড়িয়ে দিলো এবং গাছের উপর থেকে ঢিল ছুড়তে লাগলো।
দাদা তখন উনার সঙ্গীদের বলতে লাগলেন
-গাছে জিন আছে, সবাই বিসমিল্লাহ সহকারে একই সাথে দাও দৌড়।
বলে দৌড় শুরু করলেন।
এখনো গ্রামের একটা কমন ডায়লগ, "সবাই বিসমিল্লাহ সহকারে একই সাথে দাও দৌড় "।
মৌলভী দাদা আজ পৃথিবীতে নেই কিন্তু এই সরলতার গল্পগুলো আজও মানুষের মুখে মুখে রয়ে গেছে।