আপনি যদি ইবোলা ভাইরাস জ্বরের নাম শুনে না থাকেন তাহলে মনে করি এখনি উপযুক্ত সময় এই ব্যাধি সম্পর্কে বিস্তারিত জেনে নেওয়ার। ইবোলা ভাইরাল জ্বর/Ebola virus disease(EVD) বা ইবোলা হেমোরেজিক জ্বর/Ebola hemorrhagic fever(EHF) ইবোলা ভাইরাস দ্বারা মানুষের শরীরে সংক্রমিত একটি রোগ। পশ্চিম আফ্রিকার দেশগুলোতে ইতিমধ্যে এই রোগ মহামারী আকারে ছড়িয়ে পরেছে! বিবিসি, সিএনএন সহ সকল আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমের মূল বিষয়বস্তু এখন ইবোলা ভাইরাস! উন্নত বিশ্বগুলো এই ভাইরাসের বিপক্ষে সর্বোচ্চ সতর্ক অবস্থান অবলম্বন করেছে! বিস্তারিত যাওয়ার আগে সংক্ষেপে এই রোগ সম্পর্কে একটু বলে নেই, ইবোলা রোগের লক্ষন হচ্ছে উচ্চ মাত্রার জ্বর, রক্তক্ষরন এবং সেন্ট্রাল নার্ভ ডেমেজ।
আক্রান্ত হলে মৃত্যুর আশংখা প্রায় ৯০% পর্যন্ত হতে পারে, ২১ দিন পর্যন্ত সময় নিতে পারে লক্ষন পরিলক্ষিত হতে, ফলখেকো বাদুর এই ভাইরাসের প্রাকৃতিক বাহক এবং এখন পর্যন্ত এ রোগের কোনো প্রতিশেধক আবিষ্কার হয়নি!
তিনটি তথ্য এই রোগটির ভয়াবহতা ব্যাখ্যা করার জন্য যথেষ্ঠ।
*প্রথমত, এখন পর্যন্ত এই রোগটির কোনো প্রতিশেধক আবিষ্কার হয়নি!
*দ্বিতীয়ত এটি ছোঁয়াচে, সাধারনত শরীরের অভ্যর্থরীন তরলের মাধ্যমে এই রোগটি ছড়ায় এমনকি মৃত্যুর পর মৃত ব্যাক্তির শরীরেও এই রোগের ভাইরাস জীবিত অবস্থায় থাকে এবং তা জীবিতো মানুষকে সংক্রামিত করবার ক্ষমতা রাখে। এবং
*তৃতীয়ত, ১০জন আক্রান্ত ব্যাক্তির মধ্যে ৬জনের মৃত্যুর সম্ভাবনা !
এখন নিশ্চয় এই রোগটির ভয়াবহতা সম্পর্কে কিছুটা আচ করতে পেরেছেন! সুতরাং বুজতেই পারছেন আমাদের মতন উন্নয়নশীল দেশে যদি এই রোগটি ঢুকে পরে এবং মহামারী আকারে দেখা দেয় তাহলে কি ভয়াবহ অবস্থার সৃষ্টি হবে! ইবোলা ভাইরাস সম্পর্কে ইতিমধ্যে অনেক গুজব এবং ভুল তথ্য অন্তর্জালের মাধ্যমে ছড়িয়ে পরেছে! আমার মনে হয় এই রোগ সম্পর্কিত কিছু গুরুত্বপূর্ন প্রশ্ন এবং তার উত্তর এখনি আমাদের জেনে নেওয়া উচিত!
প্রথমেই বলে রাখছি আমি ডাক্তার না তবে নির্ভরযোগ্য উৎস থেকে সকল তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে এবং এরপরও যদি কোনো কিছু সংশোধনের প্রয়োজন হয় তবে কমেন্ট সেকশনে তা জানানোর অনুরোধ করা হল! আমি নিচে ধাপে ধাপে এই ভাইরাস কি, কিভাবে সংক্রমিত হয়, প্রতিরোধ করবার উপায়, আক্রান্ত হলে কিভাবে চিকিৎসা দিতে হবে তা ব্যাখ্যা করবো!
ইবোলা ভাইরাস ব্যাধি কি?
আমি সংক্ষেপে এই রোগটি সম্পর্কে একটু বর্ননা করবো! মেডিক্যাল টার্ম বা বেশি গভীরে যাবো না যাতে সবাই সহজে বুজতে পারে! এই রোগটি একটি তীব্র ভাইরাস ঘটিত রোগ যা পূর্বে Ebola hemorrhagic fever (EHF) নামে পরিচিত ছিলো! ইবোলা ভাইরাস গোত্রের পাচটির মধ্যে তিনটি প্রজাতি মানুষের শরীরে সংক্রামিত হয়ে গুরুতর অসুস্থ করবার ক্ষমতা রাখে! বাকি দুটি মানুষের জন্য তেমন ক্ষতিকর নয়! এদের মধ্যে সবচেয়ে মারাত্নক হচ্ছে জাইরে(Zaire) ইবোলা ভাইরাস(জাইরে হচ্ছে জায়গার নাম যেখানে সর্বপ্রথম এই ভাইরাসে কোনো মনুষ্য আক্রান্ত হয়েছিলো)। প্রথমবার এই ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর হার ছিলো শতকার নব্বই শতাংশ!
এই রোগের উৎপত্তি
সঠিকভাবে এই রোগের উৎপত্তি কোথা থেকে বা কিভাবে হয়েছে তা জানা না গেলেও ধারনা করা হয় যে বাদুরের দেহর্ভন্তরে এই রোগের ভাইরাস বংশবিস্তার করে পরবর্তিতে মানুষ বা স্তন্যপায়ী প্রানী আক্রান্ত বাদুর আহার করলে তা স্তন্যপায়ী প্রানীর শরিলে চলে আসে! ধারনা করা হয় যে প্রথম মানুষ জংগলে গিয়ে এই ভাইরাসে আক্রান্ত কোনো একটি প্রানীকে শিকার করে এবং পরবর্তিতে তা ভক্ষনের মাধ্যমে ভাইরাসটি লোকালয়ে নিয়ে আসে! বাদুর, শুকর বা কুকুর এইগুলোর যেকোনোটি এই ভাইরাসের বাহক হিসাবে ধরা হয়! সুদানে সর্বপ্রথম মানুষের ভিতর এই রোগের লক্ষন ধরা দেয়! সেবার ২৫৪ জন এই রোগে আক্রান্ত হয় যার মধ্যে ১৫১ জন মারা যায়। মৃত্যুর হার প্রায় ৫৩%।
এই রোগের লক্ষন সমূহঃ-
ইবোলা ভাইরাস দ্বারা সংক্রামিত হওয়ার পর সর্বোচ্চ ২১দিন লাগতে পারে এর লক্ষনসমূহ পরিলক্ষিত হওয়ার জন্য! এই রোগের লক্ষন সমূহ সাধারন ফ্লু এর মতনই। সর্দি কাশি, মাথা ব্যাথা, বুমি বুমি ভাব, ডায়েরিয়া এবং জ্বর এই রোগের প্রধান উপসর্গ। সমস্যা হচ্ছে সাধারন ফ্লু হলেও একই লক্ষন পরিলক্ষিত হয়। ধিরে ধিরে পানিশুন্যতা, কিডনি এবং লিভার এর সমস্যা এবং রক্তক্ষরন এর দিকে ধাবিত হয়! কিছু কিছু রোগীর ক্ষেত্রে রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা সম্পূর্ন ভেন্গে পরে জ্বরের মাত্রা অনেক বেশি থাকে। এইসব ক্ষেত্রে রোগীর অবস্থা অনেক খারাপ হতে পারে! যেহেতু সাধারন ফ্লু এবং ইবোলা ভাইরাসে আক্রান্ত রোগের লক্ষন একই তাই কারো উপরোক্ত কোনো উপসর্গ দেখা দিলে যত দ্রুত সম্ভব রক্ত পরীক্ষা করাতে হবে! রক্ত পরীক্ষ করে নিশ্চিত হবে যে এটা ম্যালেরিয়া, হ্যাপাটাইটিস, কলেরা বা অন্য কোনো রোগের জীবানুর করানে হচ্ছে কিনা!
ইবোলা ভাইরাস রোগের চিকিৎসা
আগেই বলেছি এই রোগের কোনো প্রতিশেধক এখন পর্যন্ত আবিষ্কার হয়নি সুতরাং যা করতে হবে রোগীকে সর্বোচ্চ সহযোগীতা করতে হবে নিজে নিজে সুস্থ হয়ে উঠার জন্য! ডায়েরিয়ার কারনে রোগীর শরীরে পানিশুন্যতা দেখা দিলে রোগীর জন্য সেলাইনের ব্যাবস্থা করতে হবে যাতে করে পানিশুন্যতাজনিত সমস্যা দেখা না দেয়। জ্বর নিয়ন্ত্রনে রাখার ব্যবস্থা নিতে হবে যাতে শরীরের তাপমাত্রা বেড়ে না যায় সে দিকে নজড় রাখতে হবে! ব্যাথার জন্য রোগীকে পেইন কিলার খাওয়ানো যেতে পারে যাতে করে রোগী খানিকটা স্বস্তিবোধ করে! রোগিকে সার্বক্ষনিকভাবে মনিটর করতে হবে দেখতে হবে শরিরে অক্সিজেনের পরিমান সঠিক আছে কিনা এবং ব্লাডপ্রেশার কম বা বেশি হচ্ছে নাকি!
আরোগ্যসম্ভাবনা
প্রশ্ন হচ্ছে এই রোগ নিরাময়যোগ্য কিনা! এখনি এই প্রশ্নের সঠিক কোনো উত্তর দেওয়া সম্ভব হচ্ছে নাহ! তথ্য মতে এই রোগে মৃত্যুর হার ৫০%-৯০%। রোগ ভালো হয়ে যাওয়া বা রোগী সুস্থ হয়ে উঠা অনেক কিছুর উপর নির্ভর করে! ভাইরাল ইনফেকশন কতটা প্রকট, কি ধরনের চিকিৎসা প্রদান করা হচ্ছে, রোগ কতটা দ্রুত সনাক্ত করা হয়েছে এই জিনিসগুলোর উপর অনেকাংশেই নির্ভর করে রোগীর ভালো হয়ে উঠা। সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে এই রোগের লক্ষনগুলো অন্য আরো অনেকগুলো রোগের লক্ষনের সাথে মিলে যায়! ফলে রোগ সনাক্ত করতে সময় লেগে যায়! আবার সঠিক রোগ সনাক্ত করা এবং সে অনুযায়ী চিকিৎসা দেওয়াটাও অনেক বড় একটা চ্যালেন্জ! যদি রোগ দ্রুত সময়ের মধ্যে সনাক্ত করা যায় এবং সঠিক মেডিক্যাল সাপোর্ট দেওয়া যায় তবে রোগীর বেঁচে থাকার সম্ভাবনা অনেক বেড়ে যায়!
কিভাবে এই রোগ ছড়ায়ঃ-
এই প্রশ্নের উত্তর জানাটা অনেক গুরুত্বপূর্ন। যেহেতু প্রতিশেধক আবিস্কার হয়নি সেহেতু প্রতিকার করাটাই সর্বোত্তম! এই রোগ কিভাবে ছড়ায় তা জানা থাকলে এই রোগ প্রতিরোধ করা অনেকটাই সহজ হয়ে যায়! আক্রান্ত ব্যাক্তির শরীর থেকে নির্গত তরল এর সংস্পর্শে সুস্থ ব্যাক্তি আসলে এই রোগে আক্রান্ত হতে পারে! এখন শরীল থেকে নির্গত তরল যেমন ঘাম, বুমি, ডায়েরিয়ার এর সংস্পর্শে আসলে এই রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুকি থাকে। বীর্যের মাধ্যমেও এই রোগ ছড়াতে পারে! আক্রান্ত রুগী মারা গেলেও মৃতের শরীরেও এর জীবানু সক্রিয় থাকে ফলে মৃতব্যাক্তির শেষক্রিয়া সম্পন্ন করার সময় সর্বোচ্চ সতর্কঅবস্থা অবলম্বন করা উচিত!
রোগের বর্তমান পরিস্থিতিঃ-
১৯৭৬ সালে কংগোর জিয়েরা এলাকায় প্রথমবারের মত এ রোগটি ধরা পরে। সেখানে ৩১৮জন আক্রান্ত হয় যার মধ্যে ২৮০জন(৮৮%) মারা যায় এবং পরবর্তীতে সুদানে তা ছড়িয়ে পরে এবং সেখানে ২৮৪ জন আক্রান্ত হয়ে ১৫১জন মারা যায়(৫৩%)। তবে এইবার এই রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা দেয় নতুন করে মার্চ মাসে(২০১৪) গিনিয়াতে এবং খুব দ্রুত ছড়িয়ে পরেছে পশ্চিম আফ্রিকার অন্যান্য দেশগুলোতে যথা লিবিরিয়া, সিয়িরা লিওন, নাইজেরিয়াতে। এবং এবার আগের সব রেকর্ড ভেংগে ফেলেছে! আজকের দিন পর্যন্ত টোটাল ১৩২৩ জন এই রোগে আক্রান্ত হয়েছে এবং যার মধ্যে ৭২৯ জন মারা গিয়েছে(৫৫%)। সবচেয়ে ভয়ংকর ব্যাপার হচ্ছে ৬০ জন স্বাস্থ্য কর্মী মারা গেছে যারা এই রোগের আক্রান্ত রোগীর সেবায় নিয়োজিত ছিলো!
এই রোগ নিয়ে উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু আছে কিনা?
যেহেতু রোগটি আফ্রিকার দূর্গম এলাকায় ছড়াচ্ছে যেখানে চিকিৎসা ব্যবস্থা অনেকটাই অপ্রুতুল্য তাই মৃত্যুর সংখ্যা আসংকাজনক হারে বেশি। উন্নত বিশ্ব ইতিমধ্যে সতর্ক অবস্থা জারি করা হয়েছে। কেউ এই রোগে আক্রান্ত হলেও যাতে রোগ ছড়িয়ে না পরে সে ব্যাপারে তারা খুব সতর্ক! কিন্তু সমস্যা হচ্ছে বাংলাদেশের মত উন্নয়নশীল দেশগুলোতে যদি এই রোগ ছড়িয়ে পরে তবে কিভাবে এর বিরুদ্ধে মোকাবেলা করতে হবে তা নিয়ে এখনি ভাবতে হবে। সরকার এবং স্বাস্থমন্ত্রনালয় সহ সবাইকে এখনই এই রোগের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহন করতে হবে! এই রোগটি ছড়াতে পারবে সহজে যেখানে পয়নিষ্কাশন ব্যাবস্থা অনেক খারাপ। উন্নত বিশ্বে এ কারনে এ রোগটি ছড়িয়ে পরার সুযোগ কম।
কিভাবে আপনি এ রোগের হাত থেকে বাচবেন
সাধারনত যে সকল জায়গাতে এ রোগ দেখা দিয়েছে ঐ সকল জায়গায় না গেলে আপনার ভয় পাওয়ার কিছু নেই! কিন্তু আপনি যদি লাস্ট দুই তিন সপ্তাহের মধ্যে আক্রান্ত দেশ গুলোর কোনো একটিতে ভ্রমন করে থাকেন তবে অবশ্যই সতর্ক অবস্থা গ্রহন করা উচিত। সবসময় হাত সাবান ও গরম পানি দিয়ে ধুতে হবে, খেয়াল রাখতে হবে যাতে চোখ, নাক বা মুখে হাত না লাগনো হয় হাত না ধুয়ে। আক্রান্ত ব্যাক্তির কাছে যাওয়ার সময় সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। আক্রান্ত ব্যাক্তির বডি লিকুইড যাতে আপনার সংস্পর্শে না আসে সে দিকে খেয়াল রাখতে হবে। যদি কোনো কারনে এই রোগের লক্ষন দেখা দেয় তবে সাথে সাথে নিজেকে আলাদা করে ফেলতে হবে যাতে অন্য কেউ এ রোগে আক্রান্ত না হয় এবং ডাক্তারের পরামর্শ গ্রহন করতে হবে।
বাংলাদেশ সরকারের উচিত এখনি যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহন করা। আফ্রিকার দেশে থেকে আগত যে কাউকে মেডিক্যাল চেকআপের ব্যবস্থা করতে হবে ইমিগ্রেশন পার হবার আগেই। মনে রাখতে হবে এই খুবই সংক্রামক রোগ এবং এই ব্যাধি মহামারী আকারে ছড়িয়ে পরতেও বেশি সময় লাগবে নাহ। এই ব্যাপারে সরকার, স্বাস্থমন্ত্রনালয় এবং উদ্ধতন কতৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষন করছি। এবং যত দ্রুত সম্ভব অন্তজালের মাধ্যমে সতর্কবানী সকলের মাঝে পৌছে দেওয়ার জন্যও অনুরোধ করছি।
তথ্য সূত্রঃ-
বিবিসি নিউজ লিংক।
টেলিগ্রাফ নিউজ লিংক।
বিশ্ব স্বাস্থ সংস্থা লিংক।