স্কুল বা কলেজে থাকতেও কিন্তু আমরা বাসায় বসে থাকা দলের কেউ নই ৷ অন্তত আমরা নিজের বাসাতে থাকতাম না ৷ বিশেষ উৎসবে একে অপরের বাসায় গিয়ে হুল্লোড়ে মেতে খাওয়া বা টার্ম ফাইনালের পর সিনেমা দেখতে যাওয়াটা একটু প্রসারতা পাবে এটা নতুন তো নয় ৷ এর আগেও সিলেট, রাজশাহী-চাঁপাই বা বিরিশিরি (শেষটায় আমার যাওয়া হয় নি) যাওয়া হয়েছে আমাদের ৷ সেদিক দিয়েও এবার নতুন কিছু হয়েছে বলে মনে নাও হতে পারে ৷ নতুন সেরকম নয়ও ৷ তবু যাদের সাথে একসাথে না বসার কারণ একটা সময় শুধু শিক্ষকদের শাস্তি ছিল, তাদের সাথে এখন প্রতি তিন মাসে একবার দেখা করাও কঠিন ৷ এবারের ট্যুরেও সবাই আমরা যাই নি, যেতে পারেনি, সেটা সম্ভব নয়ও ৷ তাই এভাবে একসাথে বান্দরবনের যাওয়াটা সব সময় নতুন, রোমাঞ্চের অভাব হবার আশঙ্কাও নেই ৷ এবার হয়েছেও তাই, সবটা খুব চেনা জানা নয় ৷ মজাটা সেখানেই ৷ এটা ধারাবাহিক একটা দিনলিপি হতে যাচ্ছে ৷ কেউ ভ্রমণ নির্দেশিকা ভেবে ভুল করবেন না আশা করি ৷ আমি এখানে আমাদের ভ্রমণের কথা বলব, ভ্রামণিক অভিজ্ঞতা বলব, ভ্রমণ সওদা করতে নয় ৷
"দোস্ত একটা প্ল্যান কর, ছুটি আসে সবারই ৷ আমি আছি ৷ চল ঢাকার বাইরে কোথাও যাই ৷" লোকমান এইকথাগুলো যখন বলছিল তখন আমি জানতাম কোথায় যাওয়াটা ঠিক হবে ৷ মানে আমি তো আর আগে ঘুরিনি ! মাসখানেক আগে মুহি যখন ঘুরে আসল ওর স্কুল বন্ধুদের সাথে বান্দরবন থেকে তখন আমি একটা ধারণা পেলাম আরকি ৷ তখনই ঠিক হল পার্বত্য চট্টগ্রামে গেলে এবার বান্দরবন, রাঙ্গামাটি নয় ৷ তো মেহরাবের পরীক্ষা শেষ হতে সপ্তাহখানেক বাকি, নূর তো বরিশালে - এমন অবস্থায় লোকমানের সাথে ওয়াটসঅ্যাপে বসে প্ল্যান মোটামুটি হল ৷ মেহরাব, নূর বা লোকমান যাকেই ধরেন ফোনে পাওয়া আর সহজ নাই! মানে এখন শুধু ছেলেদের সাথেই কথা বলার মত ছোট হয়ে তো আর নেই কেউই ! যা হোক একটা প্ল্যান দাঁড় করানো গেল ৷ খরচের এস্টিমেশন দাঁড় করিয়ে সবাইকে জানানোও হল ৷ বাকি থাকল টিকিটের বন্দোবস্ত করা ৷ যাওয়ার একদিন আগে আরামবাগে একসাথে মিলিত হবার একটা সিদ্ধান্তও হল ৷ তখনো উত্তেজনা এতটুকু কমে নি, ভাবছি আমরা সবাই-ই যে আমাদের প্ল্যান অনুযায়ী সব হবে ৷ ভ্রান্তের লিস্টি এরপর শুধু বড়ই হয়েছে ৷
সেদিন বিকেলে যথারীতি বিখ্যাত মেরুর কোনখানে সবান্ধব প্রোগ্রাম ছিল, স্কুলের পোকেমন ভক্ত আজ তার ভক্তির জায়গাটায় নারীদের নিয়ে এসেছে দেখলে ওর পুরনো বন্ধুদের যে কেউই ভিরমি খাবে ৷ লোকও ঠিক সময়ে আসতে পারল না, ওর ঢাল অবশ্য অভেদ্য - জ্যাম ! সবাই একসাথে হয়ে গেলাম (নূরু তখনো বরিশালে) শ্যামলী বাস কাউন্টারে ৷ খরচ কমানোর অংশ হিসেবে নন-এসি আমাদের প্রেফারেন্সে ছিল ৷ তবে শ্যামলীর নির্দেশনা যে দিয়েছে সে ঠিক বলে নি ৷আর ফরিকাপুলে না গিয়ে ভুলই হয়েছিল ৷ কারণ শ্যামলীতে টিকিট কেটে ভুলই করেছিলাম ৷ যাত্রার প্রথম দিনের প্ল্যান বদলাতে হয় এদের কারণে ৷ চট্টলার কোন এক অজগ্রামে গাড়িটার চাকা নষ্ট হয়ে গেল ৷ দু দুটো ঘণ্টা নষ্ট হল ওখানেই ৷ আগের দিন সারা দিন গাড়িতে থাকা নূরের আর হোটেলে গিয়ে বিশ্রামর সময় রইল না ৷ বেচারার শরীর আর কত নিবে ৷ সকালে বরিশাল থেকে ঢাকা আর রাতে ঢাকা থেকে বান্দরবন !
যাত্রার উত্তেজনায় বাসা থেকে না খেয়েই আমি বেরিয়ে পড়ি ৷ রাত ১০ টা ৪৫ এ টিকেট, আমি সাড়ে সাতটাতেই বেরিয়ে যাই ৷ কারণটা অনুমিতই ৷ তারপর সবাই আসলে হিরাঝিলে গিয়ে আমি আর নূর খিচুড়ি খেলাম ৷ পরে চা নিব বলে তিনটে চার অর্ডার দেয়া হল ৷ খিচুড়ি বেশ মজা করেই খেলাম, তবে চা টা আর ভাগ্যে হল না ৷ হিরাঝিলে গিয়েইছিলাম চা খাব বলে আর আমার ভাগ্যেই হল না ! বাসের টিকেট ছিল শেষ লাইনের আগের চারটায় ৷ গাড়ি শ্যামলী - ধকলটা আরও বেড়েছিল যখন দেখি মাথায় কী যেন পড়ছে ধুলা মতন ৷ তারউপর গাড়ি বিকল হয়ে পড়ে থাকার কাহিনি তো বললামই একবার ৷ মোটের উপর ঢাকা থেকে বান্দরবন যেতে গিয়ে পাওয়া অভিজ্ঞতা সুখের ছিলনা ৷ তারপরও উত্তেজনার আতিশাজ্য সবকিছুকেই হার মানাচ্ছিল তখনো পর্যন্ত ৷ তাছাড়া মেহরাবের হা-করা ঘুমের মুখ বা নূরের মাতলামো মতন চেহারাটা কম বিনোদনের নয় ৷ আর ক্ষণে ক্ষণে লোকমানের বাড়িতে, অ-বাড়িতে(:প) আপডেট দেয়ার একটা প্যাটার্ন বের করতে চাচ্ছিলাম আমি ৷ শেষতক, হোটেলে পৌঁছুনো গেল নির্ধারিত সময়ের দুই ঘণ্টা পর ৷ আর হোটেলে গিয়ে দেখছি আমাদের বুক দেয়া রুম তখনো খালি হয়নি ৷ ইন্টারিম একটা রুমে ফ্রেশ হতে বলল ৷ ওতে অবশ্য সুবিধে খুব বেশি হল না ৷ একজনের শাওয়ার নেয়ার মাত্রই নিজেদের রুমে যেতে বলা হল ৷ গেলাম ব্যাগ পত্র ওভাবে নিয়েই ৷ বেশ বড় রুম, দুটো ডাবল বেড; প্রতিদিন ১৪৫০ টাকা ৷ একটু বেশিই, তবে থাকার জায়গা হিসেবে মন্দ নয় ৷ এত কথা বলতে গিয়ে হোটেলের নামটাই বলা হয় নি, হোটেল প্লাজা বান্দরবন ৷ খুব সুইটেবল একটা জায়গায়, বাস স্টেশন বলুন আর শহর বলুন- সব জায়গা থেকেই পা হাঁটা দূরত্বে ৷ রেস্ট নিতে পারা গেল ঐ সবার গোসল করা পর্যন্তই ৷ মেরু আর নূরের টেক্সট দেয়া শুরু হয়ে গেল তখন থেকেই ৷ দুজনের মানসিক অবস্থা বিপরীত, মেরুর মন হাসিখুশিই ছিল ৷ বের হলাম এবার গাড়ি ঠিক করতে, উদ্দেশ্য নীলগিরি ৷ তখনো জানি ভয় পাওয়ায় মজা আছে ৷ অদ্ভুত ইনটক্সিকেটিং ভয় ৷ বারবার এর মধ্য দিয়ে যেতে গিয়ে হেসিটেট হলেও প্রতিবারই আপনি এটার মধ্যে দিয়েই যেতে চাইবেন ৷
(চলবে)