somewhere in... blog

'মেহেরজান' : ভুল পরিপ্রেক্ষিত ও ভুল ভালোবাসার গল্প

২২ শে জানুয়ারি, ২০১১ বিকাল ৫:১০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


অনেকদিন ধরেই শুনছিলাম ‘মেহেরজান’ আসছে। এই আসছে আসছে মাতমের পেছনে নির্মাতা বাহিনীর চমক দেওয়ার চেষ্টাটাই হয়তো বেশি ছিল। অভিনয়ের ক্রেডিট লাইনে জয়া বচ্চনকে নিয়ে আসা সেই চমক বাণিজ্যেরই অংশ। 'মেহেরজান' চলচ্চিত্রের প্রিমিয়ার শো দেখার সুযোগ এলে তাই চমকৃৎ হতেই গিয়েছিলাম। কিন্তু মেহেরজান আসছে, আসছে রবটা যতোটা জোরে শুরু হয়েছিল এবং নানাবিধ আলোচনা শুনে চলচ্চিত্রটি নিয়ে যতোটা উচ্চাশা তৈরি হয়েছিল, প্রত্যাশা ঠিক ততোটাই মিইয়ে গেল চলচ্চিত্র দেখার পর।

'মেহেরজান' চলচ্চিত্রের ট্যাগলাইন ‘একটি যুদ্ধ ও ভালোবাসার ছবি’। যুদ্ধ ও ভালোবাসা পাশাপাশি আসলেই শুরুতেই একটি কথা মনে পড়ে। ভালোবাসা ও যুদ্ধ কোনো নিয়ম মানে না। চলচ্চিত্রটা দেখে মনে হয়েছে এটিও কোনো নিয়ম মেনে চলে নি। এটি যদি নির্মাতার ইচ্ছাকৃত হয় তাহলে বলতে হয় তিনি যথেষ্টই সফল। আমার কাছে ’একটি যুদ্ধ ও ভালোবাসার ছবি’ শেষ বিচারে হয়েছে ভুল পরিপ্রেক্ষিত আর ভুল ভালোবাসার গল্প।

চলচ্চিত্রের কাহিনীর ব্যাপারে বলা যাক। তার আগে বলে নেওয়া ভালো, চলচ্চিত্রটিতে দুটি ভিন্ন ভিন্ন সময়, দুটি ভিন্ন প্রেক্ষাপট, দুটি ভিন্ন সামাজিক অবস্থান উপস্থাপিত হয়েছে পাশাপাশি। পরিণত বয়সের ভাস্কর নিভৃতে শহরে বসে শিল্প চর্চা করছেন, আবার তিনি পুরনো ডায়েরির পাতা খুললেই পুরনো সময়ে ফিরে যান। ফিরে যান, বাংলাদেশের ইতিহাসের উত্তাল সময়ে। ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের সময়। সারাহ নামের একজন যুদ্ধশিশু মায়ের সন্ধানে এসে আবিস্কার করে অতীতকে। মেহেরকে সে দাঁড় করিয়ে দেয় অতীতের সামনে। মেহেরের খালাতো বোন নীলার গর্ভে জন্ম নেওয়া যুদ্ধশিশু সারাহকে অতীতের ঘটনা খুলে বলেন মেহের। এই বলার মধ্য দিয়েই মেহের তার অতীতকে আবার দেখে। একাত্তরের উত্তাল সময়ে বাবা-মার সঙ্গে ঢাকা ছেড়ে গ্রামে নানার বাড়িতে আশ্রয় নেয়। বিছানায় শুয়ে শুয়ে কিংবা কাত হয়ে সে ডায়েরি লেখে, ডায়েরির পাতায় তুলে রাখে যুদ্ধাক্রান্ত সময়ের স্মৃতি। একসময় পাকিস্তানী বাহিনীর হাতে নির্যাতিত খালাতো বোন নীলা হাজির হন। নীলা আত্মগ্লানিতে না ভুগে প্রতিশোধের উপায় খোঁজে। যুদ্ধের উত্তাল সময়ে মেহের গ্রামময় ঘুরে বেড়ায়। পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে ধরা পড়ার আশঙ্কা থেকে তাকে বাঁচায় পলাতক এক পাকিস্তানী সৈন্য। আহত সৈন্যটির প্রতি মেহের দূর্বল হয়ে পড়ে। শত্রুপক্ষের সৈন্য হওয়া সত্ত্বেও ওয়াসিমকে শুশ্রূষা করে ভালো করে তোলে মেহের। ওয়াসিমের প্রেমে পড়ে যায় মেহের। কিন্তু শত্রুপক্ষের একজন সেনাকে ভালোবাসার অপরাধে পরিবার থেকে কথা শুনতে হয় মেহেরকে, বাবার মার সহ্য হয় তাকে। এক রাতের আঁধারে ওয়াসিমকে নৌকায় উঠিয়ে বিদায় জানায় মেহের। কিন্তু সে ভালোবাসার বিচ্ছেদে আক্রান্ত।

গল্প মোটামুটি এই। চলচ্চিত্রের কাহিনী ও চিত্রনাট্যে নানা ধরনের গোলমাল রয়েছে। বলতে গেলে পুরো চিত্রনাট্যই দাঁড়িয়েছে ভুল পরিপ্রেক্ষিত ও সামাজিক অবস্থানকে প্রতিনিধিত্ব করে। মেহেরজান এর চিত্র্যনাট্য ও চিত্রায়ন একাত্তরের উত্তাল সময়ের প্রতিনিধিত্ব কোনোভাবেই করে না।

চলচ্চিত্রের অসঙ্গতিগুলো দেখে নেওয়া যাক।

১. বীরঙ্গনা নারীর চরিত্রে অভিনয় করেছেন নীলা। যুদ্ধ শুরু হয়েছে। খাজা সাহেবের বাড়িতে যুদ্ধ শুরু নিয়ে নানা কথাবার্তা হয়। হঠাৎ করেই খাজা সাহেবের বাড়িতে এসে উপস্থিত হয় নীলা। এসেই কিছু বলার আগেই অজ্ঞান হয়ে পড়ে। পাকিস্তানীদের ক্যাম্পে নির্যাতনের শিকার হওয়ার কথা জানা যায়। কিন্তু নীলার চরিত্র কোনভাবেই কোন বীরঙ্গনার চরিত্রকে রিপ্রেজেন্ট করে না। এই চরিত্রে বীরঙ্গনাদের ব্যাথা আসেনি, বঞ্চনা আসেনি। সংলাপগুলো হয়েছে কৃত্রিম, বড্ড বেশি কানে লাগার মতো। একটি ব্যতিক্রমী দিক- নীলা আত্মগ্লানিতে ভোগে না, প্রতিশোধের পথ খোঁজে। তবে চলচ্চিত্রের বিভিন্ন দৃশ্যে নীলা চরিত্রের কনফ্লিক্টিং অবস্থান দেখা গেছে। কখনও সে ঘোর পুরুষবিদ্বেষী। মুক্তিযোদ্ধা [চীনপন্থী বাম হিসেবে উপস্থাপনের চেষ্টা রয়েছে] সুমনকে অভিযোগ জানিয়ে বলে সেও অন্য পুরুষের মতো তার শরীরটাকেই চায়। সুমন মৃদু ভাষায় প্রতিবাদ করে। পরে সুমন ও নীলাকে ঘনিষ্ট অবস্থায় দেখে ফেলে খাজা সাহেব। সুমনের জন্য বন্ধ হয়ে যায় খাজা বাড়ির দরজা। সুমন বিয়ে করতে চায় নীলাকে। নীলাও বলে- সুমনের সাথে বিয়ে না হলে আমার কী হবে ভেবে দেখেছো। এই সংলাপেই নীলার অবস্থান সম্পুর্ণই বিপরীতধর্মী।
তাহলে নীলা কি ভিন্ন একজন বীরঙ্গনার চরিত্র? নীলার রাজনৈতিক পরিচয় প্রকাশিত হয় এমনভাবে- ছাত্র ইউনিয়ন করা মেয়ে। সব ছেলেরা তাকে ভয় পায়। এইসব যুক্তি কিন্তু অসঙ্গতিগুলোকে পার করতে পারে না। তাই বলতে দ্বিধা নেই বীরঙ্গনার চরিত্রে ব্যর্থ অভিনেত্রী ঋতু এ সাত্তার। তবে এই ব্যর্থতার দায়ভার পরিচালককেই নিতে হবে।
[কেউ বলতেই পারেন- বীরঙ্গনা চরিত্র মানেই সেখানে ব্যাথা, বঞ্চনা থাকবে এমনটা নয়। মেহেরজানে না হয় একজন ব্যতিক্রমি বীরঙ্গনা চরিত্র আসলো। কিন্তু ব্যতিক্রমি আদতে কতোটা হয়েছে? নীলাকে আধুনিক ও প্রগতিশীল চরিত্র দাড় করাতে চেয়েছেন পরিচালক? এতোই যদি আধুনিক হবে, এতোই যদি নিয়ম না মানা হবে তাহলে যুদ্ধশিশু হিসেবে নিজের সন্তানকে অন্যকে অ্যাডপ্ট করতে দিলো কেন! সমস্যাটা হলো পরিচালক বার বার জাহির করতে চাচ্ছেন তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় বীরঙ্গনাদের নিয়ে গবেষণা করেছেন, নীলিমা ইব্রাহিমের সঙ্গে কথা বলেছেন। এইখানে বলে নেওয়া ভালো নীলিমা ইব্রাহিমের 'আমি বীরঙ্গনা বলছি' বইয়ে বীরঙ্গনা চরিত্র রয়েছে মেহেরজান নামে। যদিও এই মেহেরজানের সঙ্গে 'মেহেরজান' এর মেহেরের মিল নেই। এতো গবেষণার পরেও চলচ্চিত্রে পরিচালক বীরঙ্গনার চরিত্র এমনভাবে উপস্থাপন করলেন কেন সেটিই বড় প্রশ্ন। কারণ চলচ্চিত্রের সংলাপের মাধ্যমে পরিচালক নিজেই অভিযোগ করেছেন- 'দু লক্ষ মা বোনের ইজ্জতের মাধ্যমে আমাদের স্বাধীনতা' এই বাক্যের মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধে নারীদের অবদানকে সরলীকরণ করা হয়েছে। 'মেহেরজান' চলচ্চিত্রের দর্শক হিসেবে বলতেই পারি- পরিচালক 'নীলা' চরিত্রের মাধ্যমে বীরঙ্গনাদের অবদানকে বিকৃতি করেছেন।]

২. নীলা প্রেগনেন্ট হয়ে পড়ে। এটা নীলার মিঠু খালার ভাষ্য থেকে জানা যায়। নীলা এমন একটি পরিবারের সদস্য যে পরিবারের অধিকর্তা খাজা সাহেব গ্রামের সবচেয়ে প্রভাবশালী। চলচ্চিত্রের সংলাপ অনুযায়ী, গ্রামের লোকজন তাকে পীরের মতো মানে। এমন প্রভাবশালী একটি পরিবারের পক্ষে অ্যাবরশন করানোটাই খুব স্বাভাবিক ছিল। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ের অ্যাবরশনের ঘটনাগুলোই তা-ই প্রমাণ করে। অনেক নির্যাতিত নারীই মেনে নিতে পারে নি পাকিস্তানীদের সন্তান তিনি গর্ভে ধারণ করবেন। কেউ যদি বলতে চান, অ্যাবরশনের সময় পেরিয়ে যেতে পারে। সেটিও ঠিক মেনে নেওয়ার মতো যুক্তি নয়। কারণ অস্ত্র নিয়ে যুদ্ধ করতে যান নীলা। ওই স্টেজে নিশ্চয়ই অস্ত্র নিয়ে সম্মুখ সমরে যাওয়ার মতো অবস্থা থাকার কথা না। গল্পের খাতিরে যুদ্ধশিশুর দরকার ছিল। বেশ কয়েকজন যুদ্ধশিশু পরে বাংলাদেশে মায়ের সন্ধানে এসেছেন এমন ঘটনা আমরা জানি। এমন একটা বিষয় পরিচালকের দরকার ছিলো বলেই জোর করে পারিপার্শ্বিকতা বদলে দিয়েছেন।

৩. যুদ্ধের সময় বন বাদাড়ে (জঙ্গল বলাই বোধ হয় ঠিক) ঘুরে বেড়াচ্ছে মেহের। এক প্লাটুন পাকিস্তানী সৈন্য তখন গাছ ঘেরা বনের রাস্তার মধ্যে। মেহেরের কোনো দিকে খেয়াল নেই। সে বিমুগ্ধ হয়ে দেখছে গাছের সৌন্দর্য। হঠাৎ করেই দৃশ্যপটে পাকিস্তানী সেনা ওয়াসিমের আবির্ভাব। পাকিস্তানীদের হাতে ধৃত হওয়া থেকে মেহেরকে রক্ষা করে সে। শুরুতে মেহের তা বুঝতে পারে না। এক পর্যায়ে ওয়াসিমকে আঘাত করে বসে মেহের। কপালে করা আঘাতে মেহেরের হাতের চুড়ি ভেঙে যায়। তখনো ওয়াসিমের জ্ঞান আছে। বলার চেষ্টা করছে- তাকে বাঁচানোর জন্যই এই কাজ করেছে সে। আর এই বিষয়টিই দুর্বল করে তোলে মেহেরকে। সে ভাবতে থাকে আহত পাকিস্তানী সৈন্যের সেবা করা উচিত কিনা। নির্যাতনের শিকার হওয়া বোন নীলার পরামর্শ চাইতে গেলে বলে - সে হলে এক কোপে কল্লা কেটে ফেলবে। তারপর কিছুটা পাগলাটে স্বভাবের খালা সালমার পরামর্শে ওয়াসিমকে বাঁচাতে যায় মেহের। তখনও মেহেরের মনে চিন্তা - পাকিস্তানী সৈন্যটি বেঁচে আছে কিনা! পরে সেই বনে গিয়ে পাকিস্তানী সৈন্য ওয়াসিমকে নিয়ে এসে সুস্থ করে তোলে মেহের।
এইটুকু দেখে কয়েকটি প্রশ্ন স্বাভাবিকভাবেই মাথায় আসে। প্রথমত. চুড়ির সামান্য আঘাত কি এতোটাই বেশি ছিল যে ওয়াসিমের জীবন মরণের প্রশ্ন চলে আসে। আহত অবস্থায় দেখা গেছে ওয়াসিম পায়ে ব্যাথা পেয়েছে। পায়ে ব্যাথা পাওয়ার ঘটনাটি রহস্যে ঘেরা। [ব্যাখ্যা খোঁজা যেতে পারে- দলত্যাগী পাকিস্তানী সেনা মসজিদের মুসলমানদের গুলি না করায় তাকে অত্যাচার করেছে পাকিস্তানী বাহিনী]। পাকিস্তানী বাহিনীর কেউ পালিয়ে বনে বাদাড়ে লুকিয়ে থাকছে, খাচ্ছে কোথায়, থাকছে কীভাবে এই ভাবনাটা মনে হয় পরিচালকের ভেবে নেওয়া উচিত ছিল। চিত্রনাট্যকারদেরও ভাবা উচিত ছিল হয়তো।

৪. সাইকোলজিক্যাল দিক থেকে মেহের ও ওয়াসিমের প্রেমে ত্রুটি রয়েছে অনেক। গড়পড়তা বাংলা চলচ্চিত্রের নায়িকাদের মতো, নায়িকার জীবন বা মান বাঁচালো নায়ক, আর ওমনিই নায়কের প্রেমে পড়ে গেল নায়িকা। [দলত্যাগী পাকিস্তানী সৈন্যের কাহিনী শুনে মেহেরের সহানুভূতি জাগতে পারে, সেই সহানুভূতির খাতিরে ওয়াসিমকে নিরাপদে পার করে দেওয়ার ব্যবস্থা করতে পারে।] কিন্তু পরিচালক ভুলে গেলেন মেহেরের সামনে তখন পাকিস্তানী বাহিনীর দ্বারা নির্যাতিত বড় বোন নীলা রয়েছে। নীলা বিভিন্ন সময় পাকিস্তানী সৈন্যদের বিরুদ্ধে ক্ষোভের কথা বলে, অত্যাচারের কথা বলে। এই মানসিক ও শারিরীক নির্যাতনের গল্প শুনে মেহেরের ভালোবাসার এমন রূপ হওয়া স্বাভাবিক না। পাকিস্তানী বাহিনীদের কাছে নির্যাতিত একজন নারীর, যে কিনা কাছের একজন মানুষ, তার মর্মবেদনা মেহেরকে স্পর্শ করলো না, অবাক করার মতোই ঘটনা বটে। মেহের আর ওয়াসিমের প্রেমের ব্যাপারটিও অদ্ভূতভাবে উপস্থাপিত হয়েছে। তারা পরস্পর প্রেম করে বেড়িয়েছে, গ্রামে একত্রে ঘুরে বেড়িয়েছে, নৌকায় চলেছে। সবই ঘটেছে মুক্তিযুদ্ধরত একটি দেশে। অথচ গ্রামের কেউ , মুক্তিযোদ্ধাবাহিনী, রাজাকারবাহিনী কেউই ওয়াসিমের সন্ধান পেল না, ব্যাপারটি রীতিমতো অবাক করার মতো।

৫. চলচ্চিত্রের পোশাক আশাক কোন সময়ের তাও বোধগম্য হলো না। প্রেমে মগ্ন মেহের আর আহত পাকিস্তানী সৈন্য ওয়াসিম ঘন ঘন পোশাক পরিবর্তন করলো আর অদ্ভূত রকমের পোশাক পড়ে প্রেমে মগ্ন থাকলো, পুরো বিষয়টিই দৃষ্টিকটু লেগেছে।

৬. শত্রুপক্ষের সৈন্যকে ভালোবাসার জন্য দীর্ঘ ৩৮ বছর গ্লানিতে ভুগিয়েছে মেহেরকে। ছবির শেষ দিকে দেখা যায় মেহের আত্মগ্লানিবোধ থেকে মুক্তি পায়। সে তখন চিত্রপ্রদর্শনীর প্রস্তুতি নেয়। ভাস্কর্য করে তার অতীত ভালোবাসার কথা মনে করে। পুরো আত্মগ্লানির ব্যাপারটিই আরোপিত। ছবির ফ্ল্যাশব্ল্যাকে, মানে একাত্তরের দৃশ্যপটে, শত্রুশিবিরের কাউকে ভালোবাসা নিয়ে আত্মগ্লানি ছিল না মেহেরের। সেখানে বরং প্রতিবাদের ভাষা ছিল। ওয়াসিমকে যখন জেরা করা হচ্ছিলো তখন সে সবার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছে। সেখানে অন্তত কোনো আত্মগ্লানি ছিল না। ওয়াসিমকে বিদায়ের দৃশ্যে বিচ্ছেদ বেদনা ছিল, কিন্তু কোনো ভাবেই আত্মগ্লানির ব্যাপারটি প্রস্ফূটিত হয়নি।

৭. চলচ্চিত্রটিতে যতগুলো মুক্তিযোদ্ধার চরিত্র উপস্থাপন করা হয়েছে তার প্রতিটিই নিজেদের উপস্থাপিত করেছে ক্লান্ত যোদ্ধা হিসেবে। বলতে গেলে মুক্তিযোদ্ধাদের চরিত্র উপস্থাপনা করা হয়েছে বিকৃতভাবে। মুক্তিযুদ্ধ করতে করতে এরা ক্লান্ত, ক্লান্ত হয়ে এরা বিয়ে করতে চায়। অন্যদিকে পাকিস্তানী সৈন্য ওয়াসিমকে মহান চরিত্র হিসেবে উপস্থাপিত হয়েছে। বিষয়টি কনটেকচুয়ালি ঠিক রয়েছে কিনা তা পরিচালককে অবশ্যই ভাবতে হবে।
[প্রশ্ন হতে পারে- মুক্তিযোদ্ধাদের তো ব্যক্তিগত জীবন থাকতেই পারে। বিয়ের ইচ্ছাও হতে পারে। নয় মাসের সময়টাতে ব্যক্তিগত চাহিদা থাকবে না, এমন ভাবনাই বরংচ ভুল। কিন্তু যখন একটি চলচ্চিত্রের সবগুলো মুক্তিযোদ্ধা চরিত্রকে ক্লান্ত হিসেবে উপস্থাপন করা হয়, মুক্তিযুদ্ধে না গিয়ে বিয়ে করায় আগ্রহী হিসেবে উপস্থাপন করা হয় তখন পরিচালকের এই চাওয়ার প্রতি সন্দেহ জাগে।]

৭. হুটহাট প্রেমে পড়া দেখানো হয়ছে চলচ্চিত্রে। পুরো ব্যাপারটিই হাস্যকরভাবে উপস্থাপিত হয়েছে।

৮. মেহেরজান-এ ব্যবহৃত ভাষা কোন সময়ের? কোন অঞ্চলের? আসতাছি, করতাছি জাতীয় ভাষার ব্যবহার তো খুব সাম্প্রতিক সময়ের। ঢাকার এই আধুনিক ভাষাগত প্রকৃতি কি একাত্তরে ছিল? একাত্তরের প্রেক্ষাপটে একটি গ্রামের লোকজন এভাবে কথা বলছে তা কতোটা সঠিক! ‘আমি তোমাকে জেনুইনলি ভালোবাসি।’ এমন সংলাপ হাস্যকর বটে।

৯. চলচ্চিত্র দেখে মনে হবে সিনেমাটোগ্রাফি ভালো হয়েছে। কিন্তু যদি প্রশ্ন করা এটি কোন সময়ের? উত্তর স্বাভাব্কিভাবেই আসবে এটি উপস্থাপিত হয়েছে বর্তমান সময়ের হিসেবে, মুক্তিযুদ্ধের সময়ের নয়। গ্রামে পাকিস্তানী বাহিনীর নৃংশতার কোনো দৃশ্যই ছবিতে নেই। অবশ্য এক দৃশ্যে গ্রাম জ্বালিয়ে দেওয়ার প্রসঙ্গ এসেছে। তবে যুদ্ধের ভয় পুরো চলচ্চিত্রে উপেক্ষিত। একইভাবে উপেক্ষিত যুদ্ধকালীন সময়ের সংকট।

১০. পরিচালকের কারণে কোন চরিত্রই দাঁড়াতে পারে নি। ভিক্টর ব্যানার্জির করা খাজা সাহেব চরিত্রটি যা একটু দাঁড়িয়েছে। জয়া বচ্চনের অভিনয়কে আলোচনার মধ্যে রাখা যেতে পারে। তবে সেটিও আশানুরূপ নয়। বাকি চরিত্রগুলো বিকাশ লাভ করেনি নির্মাতাদের অবহেলায়।

চরিত্রগুলোর বিন্যাস এই ফাঁকে দেখে নেওয়া যাক-

নীলা- পাক সেনাদের ক্যাম্পে ধর্ষিত হয়ে ফেরত আসা নারী। আত্মগ্লানিতে না ভুগে সে সবসময় পথ খোঁজে প্রতিশোধের। পাক বাহিনী যখন গ্রাম আক্রমণ করে তখনো তাকে দেখা যায় দা হাতে বেরিয়ে পড়ার চেষ্টায় রত।

খাজা সাহেব- উচ্চশিক্ষিত, রাজনীতি নিয়ে বেশ জ্ঞান। দেশ ভাঙার বিরোধী, তবে মনে করে একসময় জনগণ অনিয়মের বিরুদ্ধে দাঁড়াবে। বনেদি মুসলমান পরিবারের অধিকর্তা। নিজের গ্রামকে যুদ্ধের আক্রমণ থেকে রক্ষা করতে চান। এজন্য পাকিস্তানী বাহিনী, রাজাকার বাহিনী ও মুক্তিবাহিনী এই তিন বাহিনীর চাপ মোকাবেলা করতে হয় তাকে। সবাই তাকে এসে শাসিয়ে যায়।
[তার কথা শুনেই মুক্তিযুদ্ধের উত্তাল সময়ে কোনো বাহিনীই গ্রাম আক্রমন করতে সাহস পায় না। কিছুটা অবাক করার মতোই।]

সালমা- পাগলাটে স্বভাবের। বিয়ে পাগল।

মেহের- চঞ্চল স্বভাবের মেয়ে। মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে বাবা মার সঙ্গে ঢাকা ছেড়ে গ্রামে আশ্রয় নিয়েছে। প্রেমে পড়ে পাকিস্তানী এক সৈন্যের।

ওয়াসিম- পালিয়ে থাকা পাকিস্তানী সৈন্য। পাকিস্তানের বেলুচিস্তান থেকে যুদ্ধে আসা। মেহেরের প্রেমে পড়ে।

সুমন- মুক্তিযোদ্ধা চরিত্র হিসেবে সুমন বিকশিত নয়। তার রাজনৈতিক ওরিয়েন্টশনও ধোঁয়াটে। [যদিও সুমন চরিত্রকে চীনপন্থী বাম নেতা হিসেবে উপস্থাপনের চেষ্টা ছিল চলচ্চিত্রে। কিন্তু খাজা সাহেবের সঙ্গে সুমনের রাজনীতি বিষয়ক কথোপকথন তার রাজনীতি জ্ঞানকে প্রশ্নবিদ্ধ করে।]

মেহেরজান এর প্রচরণার জন্য যে বুকলেটটি করা হয়েছে তাতে চলচ্চিত্রটিকে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয়েছে এভাবে- মেহেরজান ‘অপর’কে ভালবাসার মানবিক বোধের ছবি। পুরুষতন্ত্রের একক ক্ষমতায়নের পথকে পাশ কাটিয়ে নারীত্বের আবেগ ও অনুভূতির বহুবিচিত্র সংবেদনশীলতাকে এগিয়ে নেয়ার প্রয়াস 'মেহেরজান'। অন্যদিকে, এই ছবির অন্যতম পরিপ্রেক্ষিত জাতীয়তাবাদের যে চোরাগুপ্তা পথে ছাড় পেয়ে যায় যুদ্ধ, হত্যা ও নৃশংসতা তারই সূক্ষ্ম সমালোচনা। শেষ পর্যন্ত ‘মেহেরজান’ যুদ্ধ ও হিংস্রতার বিরুদ্ধে নান্দনিক সমাধান দিতে ভালোবাসা ও আধ্যাত্মিকতার পথে আশ্রয় খোঁজে।’ কিন্তু দেখা চলচ্চিত্রের সঙ্গে এই বড় বড় কথাগুলোকে মেলাতে গেলে হতাশ হতে হয়। পরিচালক কী বানাতে চেয়েছিলেন এবং কী বানালেন সে ব্যাপারে বোধহয় নিজেই নিশ্চিত নন। যেভাবে মিডিয়াগুলোতে মেহেরজান চলচ্চিত্র সম্পর্কে এসেছে যে এটি -একাত্তরের নারী নির্যাতনের অনালোচিত অধ্যায়কে সামনে নিয়ে আনার প্রয়াস। কিন্তু নিয়ে আসা হলো ভুল ভাবে। শুধু ভুল বললে হয় না, সম্পুর্ণই ভুলভাবে।

পরিচালক রুবাইয়াত হোসেন ইউনিভার্সিটি অব পেনসিলভেনিয়ায় অধ্যয়নকালে বীরঙ্গনা ও একাত্তরে নারীর ভূমিকা নিয়ে গবেষণা করেছেন বলে জানা যায়। এটিও জানা যায় যে, সেই গবেষণাকালেই মেহেরজানের কাহিনীর বীজ অঙ্কুরিত হয়। কিন্তু এই যদি হয় পরিচালকের গবেষণা তবে তা আমাদের হতাশ করে। এ যাবত করা সকল গবেষণাকেই যেন ‘না বিচার’ করলো পরিচালকের নতুন এই গবেষণা। প্রযোজক স্বীকার করতে চেয়েছেন, মেহেরজান শেষপর্যন্ত কোনো গবেষণাধর্মী তত্ত্ব ও তথ্যনির্ভর ছবি নয় বরং জনপ্রিয় চলচ্চিত্রের আঙ্গিকে প্রেম-নির্ভর আবেগ অনুভূতির নাটকীয় প্রকাশ। কিন্তু শেষ বিচারে মেহেরজানকে ভুল সময়ের ও ভুল ভালোবাসার গল্পের ছবি বলা যায়। ট্যাগ লাইনে বলে দেওয়া ‘যুদ্ধ ও ভালোবাসার গল্প’কে বদলে ‘বিনোদনমূলক নিটোল ভালোবাসার গল্প’ রাখলেই ভালো করতেন পরিচালক।


অভিনয়

জয়া ব্চ্চন, ভিক্টর ব্যানার্জী, হুমায়ুন ফরিদী, খায়রুল আলম সবুজ, শর্মিলী আহমেদ, আজাদ আবুল কালাম, ঋতু এ সাত্তার, নাসিমা সেলিম, শতাব্দী ওয়াদুদ, ইকবাল সুলতান, মনিরা মিঠু, রিফাত চৌধুরী, অরূপ রাহী, শায়না আমিন ও ওমর রহীম।

কাহিনী ও পরিচালনা : রুবাইয়াত হোসেন
প্রযোজনা : আশিক মোস্তফা
সহযোগী প্রযোজক ও প্রধান সহকারী পরিচালক : ইশতিয়াক জিকো
চিত্রনাট্য : এবাদুর রহমান ও রুবাইয়াত হোসেন
চিত্রগ্রহণ: সমীরণ দত্ত

ফরম্যাট ৩৫ মি.মি.
ব্যবহৃত ভাষা : বাংলা, ইংরেজি, উর্দু, সাবটাইটেল- ইংরেজি
দৈর্ঘ্য : ১১৯ মি.
সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে জানুয়ারি, ২০১১ রাত ২:৪২
৪৫৬ বার পঠিত
৩২টি মন্তব্য ২৪টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

বিরাট ব্যাপার-স্যাপার | রম্য =p~

লিখেছেন জটিল ভাই, ২৪ শে নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ১১:৪৩

♦أَعُوْذُ بِاللهِ مِنَ الشِّيْطَانِ الرَّجِيْمِ (বিতাড়িত শয়তান থেকে আল্লাহ্'র নিকট আশ্রয় প্রার্থনা করছি)
♦بِسْمِ ٱللَّٰهِ ٱلرَّحْمَٰنِ ٱلرَّحِيمِ (পরম করুণাময় অসীম দয়ালু আল্লাহ্'র নামে)
♦ٱلسَّلَامُ عَلَيْكُمْ (আপনার উপর শান্তি বর্ষিত হোক)


(ছবি নিজের মোবাইল... ...বাকিটুকু পড়ুন

চাই সরাসরি দুইস্তর বিশিস্ট প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত একটি শক্তিশালী নির্বাচন কমিশন: নতুন বাংলাদেশের অঙ্গীকার

লিখেছেন বিদ্রোহী ভৃগু, ২৪ শে নভেম্বর, ২০২৪ দুপুর ২:৪৪

ভূমিকাঃ

ছাত্র-জনতার সফল জুলাই বিপ্লবের পর আজ বাংলাদেশ গণতন্ত্র, মৌলিক মানবাধিকার, আইনের শাসন ও প্রকৃত উন্নয়নের এক নতুন পথে যাত্র শুরু করেছে। নোবেল লরিয়েট ড। ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তবর্তীকালীন সরকার... ...বাকিটুকু পড়ুন

=শোকর গুজার প্রভুর তরে=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ২৪ শে নভেম্বর, ২০২৪ বিকাল ৫:১৪



প্রভু তোমার দয়ার কথা, বলে হয় না শেষ তো
কত রিযিক আহার দিয়ে, রাখছো মোদের বেশ তো!
তোমার সৃষ্টির কেরামতি, নেই কো বুঝার সাধ্য
তোমার বান্দা তোমার গোলাম, শুধু তোমার বাধ্য!

গাছে... ...বাকিটুকু পড়ুন

সুপার সানডে : সংঘর্ষ ও নৈরাজ্যের পথে বাংলাদেশ!

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ২৪ শে নভেম্বর, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:৪৭


আজকের দিনটি বাংলাদেশের সচেতন মানুষের দীর্ঘদিন মনে থাকবে। এত সংঘর্ষ ও মারামারি অনেকদিন পর ঢাকাবাসী প্রত্যক্ষ করলো। দেশের অস্থিতিশীল পরিস্থিতিতে মানুষ আগে থেকেই উদ্বিগ্ন তার উপর বিভিন্ন অবরোধ... ...বাকিটুকু পড়ুন

ভয়েস অব আমেরিকার জরিপে সংস্কার শেষে ভোটের পক্ষে রায় দিয়েছে ৬৫.৯ % মানুষ

লিখেছেন শিশির খান ১৪, ২৪ শে নভেম্বর, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:৫৫


পাগল ও নিজের ভালো বুঝে ,কখনো শুনেছেন পাগল পানিতে ডুবে মারা গেছে কিংবা আগুনে পুড়ে মারা গেছে ? মানসিক ভারসাম্য না থাকলেও মানুষের অবচেতন মন ঠিকই বুঝে আগুন ও পানি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×