স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় পাকিস্তানের পক্ষ নেয়া চাকমা রাজা ত্রিদিব রায়ের ছেলে চাকমা রাজা ব্যারিস্টার দেবাশীষ রায় বলেছে-
আমরা চাপিয়ে দেয়া কোনো পরিচয় মানি না। আমরা উপজাতি নই, আদিবাসী। এ দাবি বাস্তবায়নে আমরা কাজ করে যাবো।
এদিকে জাতিসঙ্ঘে বাংলাদেশের প্রতিনিধি ইকবাল আহমেদ ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির সাথে সরকার যে চুক্তি করেছে সে প্রসঙ্গ তুলে ধরে বলেন, চুক্তির সবখানে তারা নিজেদের উপজাতি হিসেবে স্বীকার করে নিয়ে সই করেছে। সে সময় এ নিয়ে কোনো কথা তোলেননি। তাদের উপর এ পরিচয় চাপিয়ে দেয়া হয়নি। এমনকি তাদের কেউ এ নিয়ে আপত্তিও করেননি। কারণ ওখানে কোনো আদিবাসী নেই।
তবে বাংলাদেশের পাহাড়ে যে অশান্তি চলছে তার জন্য বাঙালিদের দায়ী করে সেখানে জাতিসঙ্ঘের প্রত্যক্ষ ভূমিকা চেয়েছে লার্স অ্যান্ডার্স বায়ের। তবে সে ভূমিকার কোনো রূপরেখা তিনি তুলে ধরেনি। নিউইয়র্কে গত মঙ্গলবার অনুষ্ঠিত তার সাথে পার্বত্য চট্টগ্রামের কয়েকজন পাহাড়ি নেতা ও পার্বত্য চট্টগ্রাম কমিশনের সদস্যও উপস্থিত ছিল। এর মধ্যে কমিশনের সদস্য এলসা দাবি করে, বিষয়টি জাতিসঙ্ঘের সাথে সম্পৃক্ত। কারণ শান্তিরক্ষী মিশনে বাংলাদেশের সবচেয়ে বেশি সদস্য কাজ করছে। তাই এ বিষয়ে জাতিসঙ্ঘকে একটা ভূমিকা নিতে হবে।
এর আগে বাংলাদেশের সংবিধানে পাহাড়িদের আদিবাসী হিসেবে স্বীকার করে নেয়ার জন্য চিটাগাং হিলট্র্যাক্ট কমিশন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে একটি চিঠি লিখে। চলতি বছরের গোড়ার দিকে লেখা ওই চিঠিতে পাহাড়িদের আদিবাসী হিসেবে মেনে নেয়ার জন্য তারা সরকারের কাছে দাবি জানায়। একই সাথে এ বিষয়ে তারা বিশ্ব জনমত গড়ে তোলার উদ্যোগ নেয়।
লারস অ্যান্ডার্স বায়েরকে গত বছর জাতিসঙ্ঘের আদিবাসীবিষয়ক স্থায়ী ফোরাম থেকে স্পেশাল রেপোর্টিয়ার হিসেবে বাংলাদেশে পাঠানো হয়। সে এখানে এসে পাহাড়িদের সাথে আলাপ করে জাতিসঙ্ঘের আদিবাসীবিষয়ক স্থায়ী ফোরামের চলতি বছরের ১০তম অধিবেশনে একটি প্রতিবেদন উপস্থাপন করে। চলতি মাসের ১৬ মে এ অধিবেশন শুরু হয়। গত ২৮শে মে তা শেষ হয়েছে।
প্রতিবেদনে লার্স পাহাড়ের নানা বিষয়ে বাংলাদেশের সমালোচনা করে। বিশেষ করে বাংলাদেশ থেকে শান্তিরক্ষী মিশনে সেনা নেয়ার বিষয়ে, যাদের নেয়া হচ্ছে তাদের বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘনের মতো কোনো বিষয় রয়েছে কি না তা তদারক করার জন্য জাতিসঙ্ঘ সচিবালয়কে সুপারিশ করে। একই সাথে সেনা ও নিরাপত্তাকর্মীদের বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘন, যৌন হয়রানিসহ বিভিন্ন অভিযোগ আনেন।
তবে প্রতিবেদনের কোথাও এ বিষয়ে কোনো কেস স্টাডি নেই। কবে কোথায় কিভাবে কারা এসব ঘটিয়েছেন এমন কোনো ঘটনাই পাওয়া যায়নি। অভিযোগকারী তো নয়-ই।
অনেকটা অনুমান নির্ভর এ প্রতিবেদনটিই এবারের আদিবাসী ফোরামের সভায় তুলে ধরা হয়। এতে বলা হয়, সরকারকে পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়ন করতে হবে। পাহাড়ে যত অস্থায়ী সেনা ক্যাম্প রয়েছে তার সবই গুটিয়ে নিতে হবে।
লারস যে প্রতিবেদনটি তৈরি করেছে তাতে সে অনেক অনাহূত মন্তব্য জুড়ে দেয়।
এক সময় পাহাড়ে কাজ করেছেন, বর্তমানে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ে গবেষণা করেন মেজর জেনালের (অব.) সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহীম। তিনি বলেন, সেখানে যৌন হয়রানির যে অভিযোগ করা হয়েছে সে মোটেও ঠিক নয়। সাম্প্রতিক সময়ে এমন কোনো ঘটনা ঘটেনি। আগে দু-একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা ঘটে থাকতে পারে।
বোমাং সার্কেলের রাজা অং শৈ প্রু নিজেদের আদিবাসী দাবি করে না। একই অবস্থান পার্বত্য চুক্তির বিরোধিতাকারী সংগঠন ইউপিডিএফ-এরও। কেবল জনসংহতি সমিতিই আদিবাসী দাবির পক্ষে অবস্থান নিয়েছে। তাদের নেতা সন্তু লারমা বাংলাদেশের আদিবাসী ফোরামের সভাপতি। সে ১৯৯৭ সালে জনসংহতি সমিতির সভাপতি হিসেবে শান্তি চুক্তিতে সই করেছিল। যে চুক্তিতে পাহাড়িদের উপজাতি বলা আছে।
প্রসঙ্গত জাতিসঙ্ঘ বাংলাদেশের স্থায়ী মিশনের ফার্স্ট সেক্রেটারি ইকবাল আহমেদ আদিবাসী ফোরামের দশম অধিবেশনে পার্বত্যচুক্তি বিষয়ে প্রতিবেদন উপস্থাপনের বিরোধিতা করে বলেন, বাংলাদেশে কোনো আদিবাসীই নেই। পার্বত্য শান্তিচুক্তি বিষয়ে আলোচনার এখতিয়ারও জাতিসঙ্ঘ আদিবাসীবিষয়ক স্থায়ী ফোরামের নেই। তাই জাতিসঙ্ঘের আদিবাসী ফোরামের উচিত মূল্যবান সময় নষ্ট না করে প্রকৃত আদিবাসীদের জন্য কাজ করা।
বাংলাদেশ প্রতিনিধির এ বক্তব্যের পরও ডেনমার্ক, গুয়াতেমালা ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো পার্বত্য শান্তি বাস্তবায়নের তাগিদ দিয়েছে। তারা বলেছে, বাংলাদেশ সরকার যেন চলমান সংবিধান সংশোধনে তাদের আদিবাসী হিসেবে কবুল করে নেন। তবে এ দাবি প্রত্যাখ্যান করেছেন ইকবাল আহমেদ।
তিনি বলেন, ১৯৯৭ সালে সই করা চুক্তিতে আদিবাসী বিষয়ে কিছু উল্লেখ করা হয়নি। আদিবাসীবিষয়ক স্থায়ী ফোরামের এখতিয়ার আদিবাসীদের বিভিন্ন বিষয় দেখভাল করা, বাংলাদেশের পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়ন নিয়ে নাক গলানো নয়।
লারস এন্ডারস বায়েরের প্রতিবেদনের ৫৬ ও ৫৮(এ) অনুচ্ছেদের বিষয়টি তুলে ধরে ইকবাল আহমেদ বলেন, জাতিসঙ্ঘ শান্তিরক্ষা মিশনে যোগদানের আগে মানবাধিকারের প্রতি সেনাসদস্যেরা কতটা শ্রদ্ধাশীল ছিলেন, তা গভীরভাবে পর্যবেক্ষণের উপায় খোঁজার কথা বলা হয়েছে প্রতিবেদনের ৫৬ অনুচ্ছেদে। অন্য দিকে ৫৮(এ) অনুচ্ছেদে মানবাধিকার লঙ্ঘনের সাথে জড়িত বাংলাদেশের সেনাসদস্যদের জাতিসঙ্ঘ শান্তিরক্ষা মিশনে না নেয়ার সুপারিশ করা হয়েছে।
পার্বত্য চুক্তি বিষয়ে প্রতিবেদন তৈরিকে স্বার্থান্বেষী মহলের ষড়যন্ত্র বলে উল্লেখ করে ইকবাল আহমেদ বলেন, ষড়যন্ত্রে সময় নষ্ট না করে বিশ্বের লাখ লাখ আদিবাসীর সমস্যা সমাধানে মূল্যবান সময় কাজে লাগানোর জন্য আমরা আদিবাসীবিষয়ক স্থায়ী ফোরামের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি।
বাংলাদেশ প্রতিনিধির বক্তব্য শেষে ডেনমার্ক ও গুয়াতেমালার সরকারি প্রতিনিধি, এশিয়া অঞ্চলের আদিবাসী প্রতিনিধিদল, আন্তর্জাতিক আদিবাসী সম্প্রদায়ের প্রতিনিধি ও মানবাধিকার সংগঠনগুলো অভিযোগ তোলে, পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নে বাংলাদেশ যথেষ্ট উদ্যোগ নেয়নি।
এশিয়া অঞ্চলের আদিবাসীদের প্রতিনিধি ও জাতিসঙ্ঘের আদিবাসীবিষয়ক স্থায়ী ফোরামের সদস্য চাকমা রাজা ব্যারিস্টার দেবাশীষ রায় বলেছে, উপজাতি, ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীসহ সব আদিবাসীর বিষয়ে দেখভাল করার এখতিয়ার আদিবাসীবিষয়ক ফোরামের আছে। সে বলেছে, শান্তিচুক্তিতে দুই পক্ষের একটি হলো রাষ্ট্র। রাষ্ট্র যদি তার প্রতিশ্রুতি না রাখে তবে অপর পক্ষ জাতিসঙ্ঘের সহযোগিতা ছাড়া আর কিইবা করতে পারে?
(ইনশাআল্লাহ চলবে)