৯/১১ পরবর্তী দুনিয়ায় “মুসলিম” পুরাদস্তুর রাজনৈতিক পরিচয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই পরিচয় যার দিতে হয় তার যেমন রাজনীতি আছে, যার কাছে দিতে হয় তারও রাজনীতি আছে। পরিচয়দাতার রাজনীতি হল, তিনি তার মুসলিম পরিচয়ের মাধ্যমে স্নায়ুযুদ্ধোত্তর দুনিয়ার একচ্ছত্র মার্কিন/পশ্চিমা আধিপত্যকে যে বাতাবরণে ন্যুনতম চ্যালেঞ্জটুকু করা সম্ভব তাকে সচেতন কিন্তু ইচ্ছানিরপেক্ষভাবে প্রতিনিধিত্ব করেন। আর পরিচয়গ্রহীতার রাজনীতি হল, তিনি “খারাপ” মুসলমানের মিথটুকু সামনে ঝুলিয়ে গোটা মুসলিম সমাজকে দিয়ে এর দায় বহন করানোর নৈতিক বৈধতা অর্জন করেন । বলাবাহুল্য, “ভাল” এবং “খারাপ” মুসলমানের ক্যাটাগরি তারাই তৈরি করেছেন, ৯/১১ পরবর্তী প্রেক্ষাপটে। তারা কিন্তু বিলক্ষণ জানেন যে এমন অনেক মুসলিম আছে, মুসলমানিত্ব যাদের আত্মপরিচয়কে বিনির্মাণ করে নি। কিন্তু সেসব বিবেচনার মত ধৈর্য টুইন টাওয়ার ধ্বংসের সাথে সাথেই শেষ হয়ে গেছে (হায়, মানবতাবাদ!)। তাছাড়া গ্রে জোন সবসময়ই বিপজ্জনক, মুসলমানকে শাদায় এবং কালোয় দেখাটাই সুবিধার। ফলে যারা নিজেদের “ভাল” এবং সেক্যুলার ভাবেন, ঘটনাচক্রে মুসলমান, এবং নিজেদের ৯/১১ পূর্ব সুখস্বাচ্ছন্দ্যে বহাল থাকতে চান, তারা অতি দ্রুত “ভাল” এবং “খারাপ” মুসলমানের এই ক্যাটাগরিতে নিজেদের পরিচয়কে ঝালিয়ে নিচ্ছেন।
সম্প্রতি বলিউড মুভি মাই নেম ইজ খান পশ্চিমাদেশে ছড়িয়ে থাকা দক্ষিণ এশিয়ার মুসলিম প্রবাসীকুলের জন্য “ভাল” এবং “খারাপ” মুসলমানের ক্যাটাগরিটাকে খুব মনোগ্রাহীভাবে হজম করে দেখাল। ৯/১১কে কেন্দ্রে রেখে ছবির কাহিনী আবর্তিত হয়েছে। ছবিতে দেখা যায়, ৯/১১ পূর্ব পরিস্থিতিতে ভারতীয় অটিস্টিক যুবক রিজওয়ান খান (শাহরূখ খান) মার্কিনদেশে অভিবাসিত হয়। আরেকটা বিষয়: মুসলমান রিজওয়ান খানের অটিজম নেহাত ঘটনাচক্রে নয়। পুরো ছবিতে অটিজমের একটা কার্যকরী রাজনৈতিক ভূমিকা আছে সে প্রসঙ্গে পরে আসছি। কাহিনীতে আমাদের অভিবাসী রিজওয়ান স্বামী-পরিত্যক্তা আরেক ভারতীয় অভিবাসী হেয়ার ড্রেসার মন্দিরাকে (কাজল) বিয়ে করেন। মন্দিরা হিন্দু ধর্মাবলম্বী, নিয়মিত পূজা অর্চনা করেন। আবার রিজওয়ানও একই ঘরে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়েন। যে সেক্যুলারিজম অর্ধশতাব্দীকাল ধরে প্রযুক্ত থাকার পরেও সংবিধান থেকে ভারতীয় নাগরিকদের প্রাত্যহিক জীবনে সফলভাবে অবতরণ করে নি, রিজওয়ান-মন্দিরার দাম্পত্য সম্পর্ক তাকে অবলীলায় নামিয়ে আনে একটি ভিনদেশী ফ্লাটবাড়িতে। শেষমেষ সবই ইচ্ছাপূরণের গল্প!
যাই হোক, ৯/১১ উত্তর পরিস্থিতিতে কাহিনী দ্রুত বাঁক নেয়। মন্দিরার আগের তরফের স্কুলগামী সন্তানটি, যে তার নতুন পিতা (রিজওয়ান)র উপাধি নিজের নামের সাথে ব্যবহার করছিল, তাকে তার অমুসলিম সতীর্থরা খুন করে। সেই খুনটিও যথাসম্ভব কম উদ্দেশ্যপ্রণোদিত: কিছু মারধর করাই হয়ত উদ্দেশ্য ছিল এদের এমন একটা ইঙ্গিত আছে হালকাভাবে। রিজওয়ান খান তার স্ত্রী মন্দিরাকে দেয়া প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী মার্কিন রাষ্ট্রপতির পিছু ধাওয়া করেন এই কথা বলার জন্য যে, তার নাম খান এবং (কিন্তু/তবু) তিনি “টেররিস্ট” নন। এক পর্যায়ে তিনি প্রেসিডেন্টের (জর্জ বুশ জুনিয়র) এক সভায় উপস্থিত হয়ে একথাটি বলতে চেষ্টা করেন। কিন্তু প্রেসিডেন্টের নিরাপত্তারীরা কেবল “টেররিস্ট” শব্দটাই শুনতে পান। জর্জ বুশ জুনিয়রের পলিসিতে এটুকু শোনাই স্বাভাবিক এবং আরো স্বাভাবিক হল এরপর রিজওয়ানের গ্রেফতার হওয়া। বেচারা রিজওয়ান নানান ইন্টারোগেশন, নির্যাতন পার হয়ে অবশেষে তার “আল-কায়েদা” কানেকশন আবিষ্কৃত না হওয়ায় মুক্তি পান। কিন্তু তিনি রাষ্ট্রপতির পিছু ধাওয়া অব্যাহত রাখেন। এভাবে, একবার আমাদের রিজওয়ান হারিক্যান-উপদ্রুত একটি কৃষ্ণাঙ্গ-অধ্যুষিত মার্কিন গ্রামকে সাহায্য করতে জীবন বাজি রেখে এগিয়ে যান। তার উদ্যোগেই গ্রামটিতে সাহায্য পৌঁছায় এবং বহু গ্রামবাসীর জীবন রক্ষা পায়। সংবাদমাধ্যমগুলো তখন রিজওয়ান খানের মধ্যে সেই “ভাল” মুসলিমটিকে খুঁজে পায় যে কিনা মানবতাবাদী! যে কিনা মসজিদে সন্ত্রাসী পরিকল্পনা করতে থাকা “খারাপ” মুসলমানের একটি দলকে মার্কিন পুলিশ বাহিনীর হাতে ধরিয়ে দেয়। ততদিনে মার্কিন রাষ্ট্র বুঝে যায় যে, এই হল “ভাল” মুসলিম। ততদিনে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে জয়ী হয়ে এসেছেন কৃষ্ণাঙ্গ ওবামা। তিনি রিজওয়ানকে সাক্ষাৎ দেন, সমদুঃখী হন এবং রিজওয়ানের আদর্শে মার্কিন মুসলিমকে উজ্জীবিত হতে উপদেশ দেন। এই হল কাহিনী।
লক্ষ্য করা যায়, বেশ কিছুকাল ধরেই প্রবাসী ভারতীয় সমাজ বলিউড ফিল্মে একটা গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর হয়ে উঠেছে। হাঁটি হাঁটি পা পা করে প্রবাসের বাস্তবতা বলিউড ফিল্মে উঁকি দিতে শুরু করেছে। মুম্বাই ছবির একটা বড় বাজার এই প্রবাসী ভারতীয়বৃন্দ, তাদের স্বার্থকে অবজ্ঞা করার উপায় তো নাই। এ যাবতকাল আমরা ফিল্মে এ সংক্রান্ত যতটুকু দেখেছি তা মূলত প্রবাসী ভারতীয়দের জীবন, কর্ম, সম্পর্ক, স্মৃতি এবং স্বদেশপ্রেম ইত্যাদি বিষয়ে। মাই নেম ইজ খান সে তুলনায় আরেকটু উচ্চাকাক্সী। এই ছবির অভিমুখ ভারত নয়, বরং এই ছবিতে ৯/১১-উত্তর মার্কিন রাষ্ট্রকাঠামোয় ভারতীয় অভিবাসীর রাজনৈতিক অভিযোজনের রাজনীতিটুকু অনুসন্ধানের বিষয় হয়ে উঠল, সম্ভবত এই প্রথম। মুসলিম অভিবাসী রিজওয়ান মার্কিন প্রেসিডেন্টকে সাক্ষাতের পর কিন্তু ভারতে প্রত্যাবর্তন করে না বা করার ইচ্ছাও পোষণ করে না। এটা একটা ইশারা। আরেকটা দিক হল, নিতান্ত অসুবিধাজনক সময়ে “ভাল” অভিবাসী মুসলিমদের এই রাজনীতি শুরু করতে হয়েছে। অসুবিধাটা ৯/১১-উত্তর দুনিয়া, যখন মুসলমান মানেই সম্ভাব্য টেররিস্ট! এরকম একটি পরিস্থিতিতে উত্তপ্ত এবং যুদ্ধংদেহী মার্কিনের সোজাসাপ্টা পলিসি-প্ল্যাকার্ডগুলো বহন করার জন্য রিজওয়ানের অটিজম খুবই কার্যকরী ফর্মূলা! অর্থাৎ, অটিজমের কারণেই রিজওয়ান জগতকে শাদায় এবং কালোয় দেখতে শিখেছে এবং গ্রে এরিয়া থেকে দূরে থাকতে সক্ষম। ফলে, মুসলিম তথা সমগ্র মানবতাকেই “ভাল” এবং “খারাপ” এই দুইভাগে ভাগ করে দিয়ে নিজেকে “ভাল” মানুষ এবং “ভাল” মুসলিম প্রমাণ করার রিজওয়ানীয় চেষ্টাটির মধ্যে আমরা কোনো আপত্তি তুলব না। এভাবে, হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গার প্রেক্ষিতে যে শিক্ষা রিজওয়ান ছোটবেলায় মা-র কাছ থেকে পেয়েছিল (মানুষ দুই রকম: ভাল এবং খারাপ), তার অটিজম তাকে সেই সেক্যুলারিজমের শিক্ষাটা ৯/১১ উত্তর মার্কিনদেশে মুসলমানকে ক্যাটাগরাইজ করতে কার্যকরী সহায়তা দিয়েছে। এভাবে ভাবনা আরো আগানো যায় যে, মার্কিন-উদ্ভাবিত “ভাল” এবং “খারাপ” মুসলিমের ক্যাটাগরিটাকে প্রশ্নহীনভাবে হজম করার জন্যই রিজওয়ানকে অটিস্টিক হতে হয়েছে। অটিস্টিক থাকার কারণেই রিজওয়ান “খারাপ” মুসলমানের সাথে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ঐতিহাসিক প্রহসনের রাজনৈতিক অর্থনীতিটুকু অনুধাবন করে না। ছবিতে আফগানিস্তান এবং ইরাকের প্রসঙ্গ এসেছে, কিন্তু অদ্ভূতভাবে রিজওয়ানের মনে আফগানিস্তানে বা ইরাকে মার্কিন ভূমিকা নিয়ে কোনো ক্ষোভ বা প্রশ্ন তৈরি হয় না। মার্কিন প্রেসিডেন্টকে এ বিষয়ে কোনো বিবৃতি দেয়ার চিন্তাও মাথায় আসে না তার। সে শুধু নিজের শাদা চরিত্রের বিবৃতি দিয়ে এবং তা প্রমাণ করেই খালাস। অটিস্টিক রিজওয়ানের পক্ষে আফগানিস্তানে বা ইরাকে মার্কিন ভূমিকা নিয়ে মার্কিন প্রেসিডেন্টকে দুকথা শুনিয়ে দেয়া খুব স্বাভাবিকই ছিল। কিন্তু প্রবাসী ভারতীয়/দক্ষিণ এশীয় মুসলমানদের মনোবাঞ্ছা তো সেটা নয়! তারা এতসব “ঝামেলা” নিশ্চয় বহন করতে চান না! তারা যা চান, রিজওয়ান তাইই করেছে। সেই অর্থে মাই নেম ইজ খান যতটা না ঘটনার বিবৃতি, তারচে বেশি হল আকাঙ্ক্ষার বিস্তরণ। এই আকাঙ্ক্ষা মার্কিন-প্রবাসী দক্ষিণ এশীয় স্বচ্ছল ডায়াসপোরার। আর সেই আকাঙ্ক্ষার প্রতিনিধিত্ব করেছে বলেই মাই নেম ইজ খান ভারতের বাইরে রেকর্ডভাঙ্গা ব্যবসাও করেছে।
করণ জোহর (মাই নেম ইজ খান ছবির পরিচালক) যতখানি সপ্রতিভভাবে প্রবাসী মুসলিম তথা ভারতীয়র নাড়ি ধরেছেন, ততখানি সপ্রতিভভাবে মার্কিন রাজনীতির নাড়ি বুঝে উঠতে পারেন নি। পারলে তিনি এতটা আনক্রিটিক্যালি প্রথমবার নির্বাচিত হয়ে আসা একজন “আফ্রিকান-আমেরিকান” প্রেসিডেন্টের প্রশংসায় গলে যেতেন না। কালা-আমেরিকানদের সাথে বাদামি ভারতীয়দের যে সম্প্রীতির সম্ভাবনা তিনি আমেরিকার মাটিতে আবিষ্কার করতে চাইলেন তাও অনৈতিহাসিক এবং এক অর্থে বর্ণবাদীও বটে। কিন্তু মার্কিনী বর্ণবাদের ভবি তাতে ভোলবার নয়। ভোলবার নয় বলেই ইরাকে যুদ্ধরত মার্কিন বোমানিরোধক স্কোয়াডকে নিয়ে বানানো ছবি “হার্ট লকার” অস্কার পায় -- যে ছবিতে আমরা দেখি কিভাবে অদৃশ্য ইরাকী (মুসলিম) সন্ত্রাসীদের পাতা বোমাফাঁদ নস্যাৎ করছে “শান্তিকামী” মার্কিন সেনাবাহিনী! এটাই মার্কিন রাজনীতি, বুশ-ওবামা নির্বিশেষে, এটা পশ্চিমা মিডিয়ার রাজনীতিও।
মাই নেম ইজ খান প্রবাসী দক্ষিণ এশীয় মুসলমানের নাড়িতে হাত দিয়ে মার্কিন রাজনীতির নাড়ি বোঝার চেষ্টা করেছে -- যে কারণে পশ্চিমা সিনেমা বিশেষজ্ঞবৃন্দ এই ছবির কাহিনীকে “রূপকথা”র চেয়ে বেশি গুরুত্ব দিতে রাজি নন। যদিও অ-মার্কিন চোখে মার্কিন রাজনীতির চেহারা নিশ্চয়ই তাদের কৌতুহলের খোরাক হয়েছে। তবে এই ছবির মূল গুরুত্বের জায়গাটি এটা নয় নিঃসন্দেহে। রিজওয়ান খান হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে দক্ষিণ এশিয়া থেকে আসা স্বচ্ছল মার্কিন-প্রবাসীদের আত্মপরিচয়ের রাজনীতিকে প্রতিনিধিত্ব করেন। আর সেটা ৯/১১ পরবর্তী প্রেক্ষাপটে। পশ্চিম-উদ্ভাবিত “ভাল” মুসলিমের ক্যাটাগরিতে এই শ্রেণীটি কতখানি উদগ্রীব এবং অসহায়ভাবে ঝাঁপিয়ে পড়তে চাইছে, মাই নেম ইজ খান তারই ইশারা। ফলে, খুব গূঢ় অর্থে, এই ছবি ডায়াসপোরার তরফ থেকে মার্কিন রাজনীতিকে এক ধরনের পলিসি অ্যাডভাইজও।