গত মাসে অপু ভাই এর বাসায় দাওয়াত ছিল। অপু ভাই বাংলাদেশ এম্বেসীর কমার্সিয়াল কাউন্সেল। মূলতঃ তিনি যুগ্ম সচিব, ইরানে আছে বছর চারেক। তা ওনার বাসাতেই পরিকল্পনা হল কোথাও ঘুরতে যেতে হবে। বড় গ্রুপ নিয়ে, যেখানে দূতাবাসের ভাইদের সাথে আমরাও যাব। প্রথমে ঠিক হল, তাবরিজ যাব, তেহরান থেকে ৯০০ কি.মি. দূর। কিন্তু পরে সেই পরিকল্পনা আর না আগানোতে আমাদের ছোট কমিউনিটি সিদ্ধান্ত নিলাম, আমরা হামাদান যাব। হামাদান হল হামেদান প্রদেশের রাজধানী। তেহরান থেকে থেকে প্রায় ৩০০ কি.মি. পশ্চিমে। হামেদানে আছে বিখ্যাত আলি সদর গুহা, ইবনে সিনা’র সমাধি, কবি এবং আধ্যাতিক সাধক বাবা তাহেরের সমাধি এবং আরো বেশ কিছু দর্শনীয় স্থান।
আমাদের এবারের ভ্রমন দলে আছে সস্ত্রীক বন্ধু হামিদ, ছোট ভাই আবদুল্লাহ এবং রুপম। মানে তিন জোড়া আর আমি একা, মোট ৭ জন। রুপম তার স্ত্রীসহ ১ সেপ্টেম্বরই ইরানে এসেছে, বিয়ে করেছে কয়েক মাস হল। মজার ব্যাপার হল রুপম ভাবী বিয়ের আগে জীবনে কোন দিন ঢাকা আসেন নি ! আজ তিনি একেবারে তেহরান !!

হামিদ তার অফিস থেকে একটা মাইক্রোবাস ভাড়া করেছে। ৫ সেপ্টেম্বর সকাল সাতটার মধ্যে আমরা সবাই গাড়ীতে, যাত্রা হল শুরু। প্রথমেই নাস্তা কেনার পালা। ইরানের রুটি বানানোর দোকানগুলোতে বিশাল মেশিন থাকে। প্রমাণ সাইজের রুটি বের হয়, দোকানে গুদাম ঘরের মত আটার বস্তা রাখা থাকে, লোকজন লাইন দিয়ে রুটি কেনে। এবারো ছবি তোলা হয় নি রুটির দোকানের, সামনে তুলব ইনশাল্লাহ। সকালের নাস্তার আইটেম হল রুটি, হানি ক্রিম আর চকোলেট দুধ। এছাড়া চিপস এবং বিস্কুট কেনা হল। আমি আবার এই সাত সকালেই একটা চকবার আইসক্রিম মেরে দিলাম !!

ইরানের লোকজনের কিছু অদ্ভুত অভ্যাস আছে। এরা বাড়ী ছেড়ে তাবু খাটিয়ে পার্কের পাশে ফুটপাতে শুয়ে থাকে। রাস্তার ধারে সবুজ ঘাসে বসে খাওয়া দাওয়া করে। আজ আমরাও সেটাই করলাম, কিছু দূর গিয়ে এক জায়গায় গাড়ী রেখে কোমল সবুজ ঘাসের গালিচায় বসে সবাই মিলে নাশতা সারলাম।
সকালের নাস্তা...
প্রশস্ত মসৃন রাস্তা, দু’পাশে ধু ধু প্রান্তর, দূরে পাথুরে পাহাড়, এই হল ভূ-প্রকৃতি। গাড়ী চলছে ১১০/১২০ কি.মি. প্রতি ঘন্টা গতিতে। রাস্তা এক মূখী, তাই অন্ততঃ মুখোমুখি সংঘর্ষের আশংকা নেই।
হামাদানের পথে...
হামাদান শহর থেকে প্রায় ৭০ কি.মি. উত্তরে আলি সদর গুহা। ঠিক হল প্রথমে গুহা দেখে তবেই হামাদান যাব।
গন্তব্য আলি সদর গুহা...
সকাল ১১ টা নাগাদ আমরা আলি সদর গুহায় পৌছে গেলাম। প্রচুর লোকজন এসেছে। গুহায় প্রবেশ করার টিকেট এর জন্য বিশাল লাইন। আমাদের ড্রাইভার লুতফে বেশ ভাল, সে নিজেই দায়িত্ব নিয়ে লাইনে দাঁড়িয়ে গেল। টিকেট জনপ্রতি ১২০,০০০ রিয়েল (৩০০ টাকা)। আমরা এদিক সেদিক ঘুরতে লাগলাম। চমৎকার আবহাওয়া, রৌদ্রোজ্জ্বল দিন সাথে ঠান্ডা বাতাস, ঘোরাঘুরির জন্য একেবারে আদর্শ।
এ পর্যায়ে আলি সদর গুহা নিয়ে কিছু বলি। এটি বিশ্বের সবচেয়ে বড় পানি গুহা, এর ভেতরে প্রায় ১১ কি.মি. দীর্ঘ নদী আছে। ১৯৬৭ সালে আলি সদর এবং তার দল এই গুহার মুখ আবিষ্কার এবং প্রশস্ত করেন, যদিও অধিবাসীরা আগে থেকেই ওখানে যেতেন বলে ধারণা। গুহার ভেতরের উচ্চতা ৪০ মিটার পর্যন্ত আছে কোথাও কোথাও। আর আমি দেখেছি পানির গভীরতা ১৬ মিটার পর্যন্ত লেখা আছে এক জায়গায়। পানি একেবারে ক্রিস্টাল ক্লিয়ার। আর ভেতরে বিভিন্ন খনিজ জমে এত সুন্দর ভূ-প্রকৃতি যে বলে বোঝানো যাবে না।গুহার ভেতরে আবহাওয়া খুব সুন্দর, বাতাস খুব পরিচ্ছন্ন। গুহাটি জাগরোস পর্বতমালায় অবস্থিত। আগ্রহীদের জন্য কিছু লিংক দিচ্ছি, পড়ে দেখতে পারেন।
উইকিপিডিয়া
আলি সদর ট্যুরিজম কোম্পনি
ফিরে আসি মূল কাহিনীতে, বেলা একটার দিকে টিকেট পাওয়া গেল। আমাদের গুহাতে প্রবেশ এর সময় দিয়েছে বিকেল ৫:২০! হাতে অনেক সময়। ঠিক করলাম, হামাদান গিয়ে খাওয়া-দাওয়া করে আবার বিকেলে ফিরে আসব। এখানে টুকটাক হোটেল আছে, কিন্তু সুবিধার মনে হল না। যেই কথা সেই কাজ, লুতফে বেশ ভাল একটা হোটেলে নিয়ে গেল। জয়তুন, দুঘ, জুজে, কুবিদে আর ভাত দিয়ে খাওয়াটা ভালই হল। পাঠকের দাবীতে এবার খাবারের ছবি তুলে এনেছি, দেখুন।
জয়তুন, দুঘ, রুটি, কোক...
ভাত, কুবিদে, জুজে...
খাওয়া-দাওয়া শেষ করে রওনা হলাম, লুতফে গাড়ী ঘুরিয়ে শহরের দিকে নিয়ে গেল, এক পার্কের কাছে গিয়ে হঠাৎ গাড়ী দাড় করালো। ওমা, গাড়ীর হিট মিটারের কাটা একেবারে ওপরে ! রেডিয়েটরের পানি ফেলে দিয়ে পানি ঢালাঢালি শুরু হল। শেষ পর্যন্ত জানা গেল, গাড়ীর ইঞ্জিন বসে গিয়েছে, এই গাড়ী দিয়ে আর যাওয়া যাবে না। কি আর করা, পার্কে গিয়ে বসে রইলাম, ইরানিদের কাজ কারবার দেখতে লাগলাম। যেটা আগেও বলেছিলাম, ছুটির দিন হলে এরা সবাই পার্কে চলে আসে পরিবার পরিজন নিয়ে। সেখানে রান্না করে, খায়, ঘাসে শুয়ে ঘুমায়। তাবু খাটিয়ে রাতেও পার্কেই থাকে। দেখি এক থুরথুরে বুড়ী পরিবারের জন্য রান্না করছে।
আলি সদর গুহা দেখার আশা যখন ছেড়ে দিয়েছি, তখন বিকেল সাড়ে চারটে নাগাদ ড্রাইভার লুতফে আরেকটা মাইক্রোবাস ঠিক করে দিল। চললাম, সেই গাড়ীতে করে। প্রথমেই শহর থেকে বের হওয়ার মুখে যানযট, ড্রাইভার বিকল্প পথে বের হল। এই ড্রাইভার সেই রকম জিনিস, গাড়ীর ড্যাশবোর্ডে এক কেতলি চা। সে একটু পর পর গ্লাসে চা ঢালে আর খায়। এরপর সিগারেট ধরায়। আর সারাক্ষণ মোবাইলে কল করে। মনে মনে বলি, আজব এক চিড়িয়ার পাল্লায় পড়লাম। আমরা সবাই অস্থির, সময়মত যেতে পারা নিয়ে। বলি, দ্রুত চালাও ভাই। বলে, ৮০ কি.মি./ঘন্টা বেগের বেশী গেলে পুলিশ ধরবে। আচ্ছা বাবা, ৮০ কি.মি./ঘন্টাতেই অন্ততঃ চালাও, গাড়ী চালানোর সময় এত তাল করলে হবে কি করে ! কথায় আছে যেখানে বাঘের ভয়, সেখানে সন্ধ্যা হয়। হঠাৎ পুলিশ সিগন্যাল দিয়ে গাড়ী থামাল। কি ঘটনা বুঝলাম না, পকেটে পাসপোর্ট আছে বৈধ ভিসা সহ, সিটবেল্ট বাধা আছে, সুতরাং চিন্তা নাই। একটু পরে ড্রাইভার ২০০,০০০ রিয়েলের কেস খেয়ে আসল, ও নাকি গাড়ী ৮০ কি.মি./ঘন্টা এর চেয়ে বেশী বেগে চালিয়েছে ! আমি সামনের সিটে বসে আছি, ও আসলেই ঐ বেগের বেশী চালায় নাই, বরং আমি চাইছিলাম ১০০ কি.মি./ঘন্টাতে চালাক ! আজব পুলিশ !!
আলি সদর গুহাতে যখন পৌছালাম তখন প্রায় বিকেল ৬:৩০। ড্রাইভার নিজেই আমাদের টিকেট নিয়ে গিয়ে সব ব্যবস্থা করল। গুহাতে ঢুকেই সবাই লাইফ জ্যাকেট পড়ে নিলাম। সংগীরা সবাই বউদের নিয়ে ছবি তোলায় ব্যস্ত। অবাক হয়ে গুহার ভেতরের ভূ-প্রকৃতি দেখতে দেখতে ঘাটের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি।
লোকজন নৌকায় ওঠার অপেক্ষায়...
দাদী/নানী'র কোলে নাতি/নাতনি... গুহা দেখতে এসেছে এই সোনা বাবু...
সুবহানাল্লাহ ! কি সুন্দর আল্লাহর এই সৃষ্টি! আমাদের পালা এলো, প্যাডেল নৌকায় করে গুহার ভেতরে ঘুরে বেড়ানোর ব্যবস্থা!
যাত্রা এখান থেকে শুরু...
জায়গায় জায়গায় পানির গভীরতার তথ্য দেয়া আছে, রক ফরমেশনের নাম দেয়া আছে। একটু পর পর কুরআনের আয়াত ঝোলানো আছে যেখানে আল্লাহ তার সৃষ্টি নিয়ে বলছেন। সব মিলিয়ে চমৎকার একটা অভিজ্ঞতা।
প্রায় আধা ঘন্টা পানিতে ঘুরে এক ঘাটে নামিয়ে দেয়া হল। সেখান থেকে হেটে গুহার অন্যান্য অংশ দেখতে লাগলাম। সত্যিই, আমার কল্পনার চেয়ে বড় এই গুহা, লিখে বোঝানো যাবে না আসলে। মোবাইলের ক্যামেরা দিয়ে আলো আধারিতে ছবি ভাল আসে না, যতদূর পেরেছি তুলতে আপনাদের সাথে শেয়ার করছি।
এর পর আরেক ঘাটে এসে প্রায় ২০ মিনিট নৌকা চালিয়ে আমরা বাইরে যাবার ঘাটে আসলাম। আমি আসলেই খুব অবিভূত, এমন গুহা আমি কখনো দেখিনি। আল্লাহু আকবার।
সেরাতে আমরা হামেদান শহরে থাকলাম। লুতফে শহরে আমাদের জন্য দু’টো এপার্টমেন্ট ঠিক করে রেখেছিল। খাবার দাবার ওই এনেদিল। খুব ভাল একটা দিন গেল পরিশেষে। রাতের তাপমাত্রা ১৬ ডিগ্রীর নীচে নেমে যায় হামেদানে আর আবহাওয়া খুব শুষ্ক।
পরদিন সকালে নাশতা করে বেরিয়ে পড়লাম বাবা তাহেরের সমাধির দিকে। হোটেল থেকে খুব কাছে, হেটেই চলে গেলাম। বাবা তাহের ইরানের বিখ্যাত আধ্যাত্বিক সাধক এবং কবি। কবরের পাশে দেয়ালে তার কবিতা পাথরে খোদাই করা। বাবা তাহেরকে বলা হয় Baba Taher-e Oryan (The Naked) সম্ভবতঃ এই কবি সব সময় উলংগ থাকতেন। যাহোক, কিছু ছবি তুলে চলে এলাম।
কবরের উপরের ছাদে কারুকার্য...
বাবা তাহেরের কবিতা, যারা ফারসি জানেন পড়তে পারেন...
এর পর ট্যাক্সি করে সোজা বিখ্যাত ইবনে সিনা’র সমাধিতে পৌছে গেলাম। লুতফে আমাদের সাথে আছে, ওই ট্যাক্সি ঠিক করছে। আমাদের টিকেট কেটে নিয়ে আসছে। ইবনে সিনাকে মনে হয় আপনাদের সাথে নতুন করে পরিচয় করিয়ে দেয়ার দরকার নেই। গুনী এই মনীষী ইরানের সন্তান যিনি একাধারে philosophy, astronomy, alchemy, geology, psychology, Islamic theology, logic, mathematics, physics এসব বিষয়ের উপর লিখেছেন। তার বিখ্যাত বই The Book of Healing যা কিনা একটা বিশাল দার্শনিক এবং বৈজ্ঞানিক জ্ঞানকোষ এবং The Canon of Medicine ছিল মধ্যযুগের অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যবই। বলাবাহুল্য, হামাদানে ইবনে সিনা বিশ্ববিদ্যালয় আছে। এই মনীষীর সমাধির কিছু ছবি দেখুন।
মূল কম্পাউন্ডের প্রবেশ মুখ
ইবনে সিনা...
ইবনে সিনার স্মৃতি বিজড়িত তৈজসপত্র
ইবনে সিনার লেখা বিজ্ঞান গ্রন্থ
এখানেই শুয়ে আছেন ইবনে সিনা...
ঔষধি গাছ
সমাধি থেকে দেখা হামাদান শহর...
হামাদানে আরো কিছু দেখার জায়গা ছিল, কিন্তু আমাদের হাতে সময় তেমন ছিল না। দুপুরে সেই আগের দিনের হোটেলেই খেলাম।
হোটেলের ব্যালকনি থেকে হামাদান শহর...
এদিকে লুতফে আমাদের জন্য বাসের টিকেট কেটে রেখেছ। ওর গাড়ী ঠিক হতে কয়েক দিন লাগবে। বেচারার জন্য দুঃখই হল। মোটামুটি তাড়াহুড়া করে খেয়েই বাস স্ট্যান্ডে রওনা হলাম। দুপুর ২ টায় বাস। আমরা পৌছালাম ২ টার দুয়েক মিনিট আগে। বাস ছাড়ল ঠিক ২ টায়, আরামদায়ক বাস। উঠেই দুপুরের ভাত ঘুম দিলাম। কয়েক ঘন্টা পর ঘুম থেকে উঠে দেখি, তেহরান চলে এসেছি যে! টেরই পেলাম না, রাস্তা এত ভাল ! ঠিক সন্ধ্যা ৬ টায় বাস থেকে নামলাম, আরজান্তিন স্কয়ারে। সেখান থেকে আমার বাসা হাটা পথে ১৫ মিনিট... দারুণ একটা ভ্রমনের পরিসমাপ্তি হল...
আমার যত ভ্রমন ব্লগ...