মানালি পৌছতে আমাদের প্রায় সন্ধ্যে হয়ে গেল। যখন মানালির কাছাকাছি তখন গাড়ী থেকে এমন দৃশ্য চোখে পড়ল। মনে মনে বললাম, আহা, এই না হলে আমাদের স্বপ্নের মানালি !
যেখানে ছিলাম, তার পাশ দিয়ে একটা পাহাড়ী নদী বয়ে যাচ্ছিল। হোটেল থেকে মিনিট দশেক হেটে মানালির মূল শহরে আসতে হয়। রাতের খাবার খেতে বেরিয়ে পড়লাম। শহরে এসে বুঝলাম, আমরা দু’'বন্ধু বড়ই বেমানান এখানে! কারণ, যারা ঘুরছে অধিকাংশই যে নব বিবাহিত দম্পতি বা প্রেমিক-প্রেমিকা যুগল !
রাস্তার ধারে বড় কড়াইএ নুডলস রান্না করছে। তাই দিয়েই রাতের খাওয়া সারলাম। তিন রাত ছিলাম মানালিতে, এক রাতে শুধু রুই মাছ আর ভাত খেয়েছিলাম, বাকী দিনগুলো ওই চওমিন বা নুডলস দিয়েই চালিয়েছিলাম। বলা বাহুল্য, পাহাড়ী এলাকায় মাছ একটু কম পাওয়া যায়। আর হালাল/হারাম ইস্যুতে মুরগী খেতাম না। আর রাস্তার ধারের চওমিন সত্যিই খুব সুস্বাদু ছিল, তাই খাওয়াটা জমত ভাল। এছাড়া তাজা ফলের শরবত ছিল আমাদের আরেকটা প্রিয় খাবার।
রাতের মানালি...
পরদিন আমাদের কর্মসূচী হল মানালি শহরটা দেখা। সকালে উঠেই দেখি আকাশ মেঘলা। গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি। মনটাই খারাপ হয়ে গেল। যদি বাকী কটা দিনও এমন যায়, তাহলেতো ট্যুরের মজাই মাটি। ঢাকা থেকে একটা দু’'টা পথ নয়রে বাবা ! শহরে যা দেখাল সেটা বলতে গেলে দু’টো মন্দির আর একটা ক্লাব জাতীয় জায়গা। প্রথম মন্দিরটা একটা পার্কের ভেতর, বেশ সুন্দর। দ্বিতীয় যে মন্দিরটায় নিয়ে গিয়েছিল, সেখান থেকে বরফ ঢাকা পাহাড়ের সুন্দর ভিউ পাওয়া গেল।
ক্লাবটার লোকেশন বেশ সুন্দর ছিল, একটা পাহাড়ী নদীর ধারে। ক্লাবে গিয়ে একটা মজার অভিজ্ঞতা হল। ভারতীয় ডিডি চ্যানেল (আমাদের বিটিভি’র মত) একটা ট্রাভেল প্রোগ্রাম করছিল, লোকজনের সাক্ষাৎকার নিচ্ছে। হঠাৎ এক লোক এসে হিন্দীতে বলছে, ভাই আপনার সাক্ষাৎকার নিতে চাই। বললাম, ভাই আমিতো বাংলাদেশ থেকে এসেছি। বলে, অসুবিধা নাই। দিলাম সাক্ষাৎকার। কবে দেখাবে সেটাও বলল। মনে মনে বলি, ভাই আপনাদের প্রোগ্রাম দেখার কি টাইম আছে আমার??
২৬ ফেব্রুয়ারী ২০০৭। আমাদের এদিনের প্রোগ্রাম হল সোলান ভ্যালিতে যাওয়া, সেখানে আইস স্কিইং করা এবং ফেরার পথে একটা উষ্ণ প্রশ্রবন দেখা। মানালি’র একটা বিখ্যাত জায়গা হল রোথাং পাস, কিন্তু সেটা বছরের নির্দিষ্ট সময় খোলা থাকে, ফেব্রুয়ারীতে বন্ধ থাকে অনেক বেশী বরফ থাকার কারণে। তাই সোলান ভ্যালি দেখেই সন্তুষ্ট থাকতে হল।
সকালে উঠেই মনটা ভাল হয়ে গেল। আগের দিন যেমন পুরোটা দিনই মেঘলা ছিল,আজ আকাশ একেবারে ফকফকা !
রৌদ্রোজ্জ্বল দিন, ঘোরার জন্য উত্তম। গাড়ী যতই আগাচ্ছিল বরফ ঢাকা পাহাড়গুলো ততই তাদের সৌন্দর্যকে মেলে ধরছিল। আল্লাহর কি অপূর্ব সৃষ্টি ! ছবিতেই দেখুন।
পথে এক জায়গায় থেমে স্কিইং করার জন্য পোষাক এবং সরঞ্জাম নিয়ে নিতে হল নির্ধারিত চার্জের বিনিময়ে। ওরাই সাথে গাইড দিয়ে দিয়েছিল। শিখিয়ে দিল স্কিইং এর বেসিক টেকনিক।
একটু চেষ্টা করতেই যখন শিখে গেলাম, আমার কাছে দুর্দান্ত লাগছিল। বিশ্বাস করুন, একটা কথা বলি, ওখানে যারা ছিল, সবার মধ্যে আমিই ছিলাম সেরা পারফরমার!
স্কিইং খুবই পরিশ্রম সাধ্য কাজ, বিশেষ করে আপনাকে যখন উপরে উঠতে হচ্ছে সব সরঞ্জামসহ। পুরো ঘেমে গিয়েছিলাম, প্রচন্ড পানি পিপাসা পাচ্ছিল। পরে এক মেয়ের কাছে পানির নিয়ে খেয়ে জান বাচিয়েছিলাম।
স্কিইং শেষে পাহাড়ের খোলে আরেক জায়গা আছে দেখার, জানা গেল। তো সেখানে যেতে হলে ঘোড়ার পিঠে চড়তে হবে, আবারো বাড়তি কয়েক’শ রুপির ধাক্কা। যাহোক, ঘোড়ায় সওয়ার হলাম। যেখানে গেলাম, সেটা ছিল সত্যিই খুব সুন্দর একটা জায়গা।
আরেকভাবে বললে, ওটা ছিল আমার যাওয়া সবচেয়ে ঠান্ডা কোন জায়গা। পাহাড়ের খোলে হওয়ায় আর সূর্য বিপরীত দিকে চলে যাওয়ায় তাপমাত্রা অনেক নেমে গিয়েছিল। আমার হাত পা ঠান্ডায় জমে যাচ্ছিল। যতক্ষণ ছিলাম, মনে হচ্ছিল, আর কিছুক্ষণ থাকলে মরেই যাব। বরফের মাঝে ওখানে ওরা একটা প্রাকৃতিক রাইড বানিয়েছে, একটা টিউবের মাঝে বসে সাই করে ওপর থেকে বরফের ট্রাকে করে নীচে নেমে যাওয়া! সেটাও চড়তে ছাড়িনি!
এখানে ঠান্ডায় জমে যাচ্ছিলাম!
ফেরার পথে উষ্ণ প্রশ্রবনে থামলাম। সেখানে একটা মন্দির গড়ে উঠেছে। উষ্ণ প্রশ্রবনের গরম পানিকে পবিত্র হিসেবে ভেবে সবাই সেখানে গোসল করছে, পর্যটকরাও কাপড় চোপড় খুলে আন্ডারওয়্যার পড়েই গোসল করছেন। স্থানীয় লোকজন তাদের নিত্য প্রয়োজনীয় কাজ কর্মও সারছেন সে পানিতে। এরকম শীতের দেশে ২৪ ঘন্টা ফ্রি ফ্রি গরম পানি পানি পাওয়া সত্যিই ভাগ্যের ব্যাপার বটে।
সোলান ভ্যালি থেকে ফেরার পথে...
২৭ ফেব্রুয়ারী ২০০৭। আমার জীবনের অন্যতম স্মরণীয় একটা দিন। প্রত্যাশার চেয়ে অনেক বেশী কিছু পেয়েছি এ দিন। এ দিন আমরা সকালে উঠে গাড়ী নিয়ে সরাসরি দিল্লী রওনা হব, এটাই আমাদের কর্মসূচী। সকালে ঘুম ভাংতেই টিপ টিপ জাতীয় শব্দ পেলাম। চোখে চশমা ছিল না, তাই জানালা’র বাইরে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিলাম না। কিন্তু, একটা ধারণায় মন নেচে উঠল। চোখে চশমা লাগিয়ে জানালার ধারে গিয়ে পর্দা সরালাম। আনন্দে বিশ্ময়ে ‘থ হয়ে গেলাম! নিজের চোখকে বিশ্বাসই হচ্ছিল না! এ যে Snow Fall ! জানালার সামনে ছাউনিতে প্রায় ৮/১০ ইঞ্চি পুরো বরফ!
চারিদিক এক অদ্ভুত সুন্দর সাদা ! আনন্দে আত্মহারা হয়ে গেলাম। বন্ধুকে ঘুম থেকে ডেকে তুললাম। দু’জনে মিলে নিচে গিয়ে তুষারপাত এর নীচে হাটলাম, snow ধরলাম। ছবি তুললাম, ভিডিও করলাম। সে এক অদ্ভুত অনুভূতি, বলে বোঝানো যাবে না।
আমার সাথে আমাদের ড্রাইভার ও গাড়ী...
মানালি, একটা জায়গা, এক দিন মেঘলা, পর দিন একেবারে ঝকঝকে আকাশ, তার পরদিন তুষারপাত ! সুবহানাল্লাহ ! প্রত্যাশার চেয়েও অনেক বেশী পেলাম !!
আমাদের ড্রাইভার দেখি একটু ভয় পেয়ে গেল। সে তার ২০ বছরের ড্রাইভিং জীবনে কখনো তুষারপাত দেখেনি এবং তুষার পাতের মধ্যে গাড়ীও চালায় নি। বলে, ভাই, এই তুষারপাত এর মধ্যে যাওয়া যাবে না, আমাদের কয়েক দিন এখানে থেকে যেতে হবে। আমাদের পক্ষে এটা অসম্ভব! কারণ, দিল্লী থেকে কোলকাতা ট্রেন টিকেট, কোলকাতা থেকে ঢাকা বাস টিকেট কাটা আছে। আর অফিসে যোগ দেবার ব্যাপারও আছে। সুতরাং এক দিনও এদিক সেদিক হবার কোন ব্যবস্থা নেই। ড্রাইভারকে একটু চাপা মারলাম, বললাম, ভাই, আমাদের ভিসা শেষ হয়ে যাচ্ছে। আমাদের যেতেই হবে কোন উপায় নাই। কাজ হল, বেচারা গাড়ী বের করল। প্রথমে একটু সমস্যা হলেও শহর থেকে নিরাপদেই বের হয়ে গেলাম এবং বাকী পথে আর সমস্যা হয় নি।
দিল্লীর পথে আমরা...
এই হল আমাদের গাড়ীর অবস্থা !!
তুষারপাত আস্তে আস্তে হালকা হয়ে কিভাবে বৃষ্টিতে রুপান্তরিত হল সেই প্রাকৃতিক খেলা দেখার সৌভাগ্য হল। চার পাশে শুধু সাদা আর সাদা। কি যে সুন্দর ! আপনাদের জন্য আমার করা কয়েকটি তুষার পাতের ভিডিও শেয়ার করছি।
পথে কুল্লুতে থেমে কয়েকটা শাল কিনলাম। দিল্লী যখন পৌছালাম তখন রাত একটা ! পরদিন অর্ধ দিবস দিল্লী শহর ভ্রমন। রাতের খাওয়া পথেই সেরেছিলাম, দেরী না করে পরিতৃপ্তির ঘুম দিলাম...
আগের ভ্রমন পোস্টঃ সিমলা (হিমাচল) ভ্রমন ২০০৭
আমার যত ভ্রমন ব্লগ
সর্বশেষ এডিট : ১৪ ই জুলাই, ২০১২ দুপুর ২:১১