বন বনানী আর পাহাড় ঘেরা পথ দিয়ে আমাদের গাড়ী চলতে লাগল। মার্বেল পাথরের পাহাড়ের দেখা পেলাম।

ভূ-গর্ভস্থ নদীতে প্রবেশের আগে আমাদের গাইড উগং রক কেইভিং এবং জিপ লাইনিং সাইটে নিয়ে গেল। কেউ যদি চায় তাহলে এই এডভেঞ্চার করতে পারে। আকাবাকা পাহাড়ের গুহার ভেতর দিয়ে উঠে গেলে সেখান থেকে কেবল বেয়ে ২১ সেকেন্ডে মাটিতে নেমে আসা, এই হল কার্যকলাপ। দুটো অপশন আছে, প্রথমে ২০০ পেসো দিয়ে কেইভিং এর জন্য চুক্তিবদ্ধ হওয়া যায়, উপরে উঠে যদি ইচ্ছে হয়, তবে আরো ২৫০ পেসো দিয়ে জিপ লাইনিং করে নীচে নেমে আসা যায় অথবা গুহা দিয়েই আবার ফিরতি পথে নেমে আসা যায়। তো এই কেইভিং এবং জিপ লাইনিং এর ব্যাপারে আমার বন্ধু বাবু’র কোন উৎসাহই নেই।








মূল প্রসংগে ফিরে আসি। আমি টাকা দিয়ে কেইভিং এর জন্য তৈরী হচ্ছি, বাবু বলল, যাও তুমি করে আস, আমি এদিকেই আছি। ওমা একটু পরে দেখি সেও হাজির! বলে, “চল আমিও যাই”। মনে মনে মুচকি হাসলাম।


জিপলাইনিং সাইটে গিয়ে মনে হল, এই গুহাপথে ফেরত যাবার চেয়ে দড়ি বেয়ে নেমে পড়াই ভাল! ২১ সেকন্ড মাত্র !!


সাবাং পৌছে সেখানকার সৈকত দেখে মনে হল, আহা যদি একটু সুযোগ পেতাম এখানে গা ভেজানোর।

আমাদের দুপুরের খাবারের আয়োজন এখানেই, সৈকতের ধারে, মিনি বুফে ! খাওয়া দাওয়া সেরে সংক্ষিপ্ত নৌ ভ্রমন শেষে পৌছালাম নদীর প্রবেশ মুখে।

মুষল ধারে বৃষ্টি হচ্ছে তখন। প্রতি নৌকায় ৬ জন করে। নৌকায় একজন লাইট ম্যান দরকার হয়, যার হাতে থাকবে একটি বাতি, মাঝির নির্দেশনা অনুযায়ী সে সেই বাতি বিভিন্ন জায়গায় ফেলবে, এখানে মাঝিই হল আমাদের গাইড। তো লাইট ম্যানের দায়িত্ব আমার কাধেই বর্তাল, নৌকার একেবারে সামনে হল আমার স্থান।

নদীর প্রবেশ মুখ
প্রাকৃতিক এই নদীটাকে আসলে আমরা বলতে পারি আট কিলোমিটার লম্বা একটি গুহা ! কিন্তু এই গুহার মেঝে হল পানি যা কিনা কোন স্থানে ৮ মিটার পর্যন্ত গভীর। এক স্থানে গুহার উচ্চতা সর্বোচ্চ ৭০ মিটার পর্যন্ত ঠেকেছে ! (যদ্দূর মনে পড়ে)। নদীর পানি মিঠা এবং লবনাক্ত পানির মিশ্রণ।

নদীর চারপাশ পাথুরে, সেখানে খনিজ বস্তুর সমাবেশ ঘটার কারণে বিভিন্ন ধরণের Rock Formation হয়েছে। ওরাও এই formation গুলোকে আকৃতি অনুযায়ী বিভিন্ন নাম দিয়েছে।

লো প্রোফাইল ডিজিটাল ক্যামেরা দিয়ে সব কিছুর ছবি তোলা সম্ভব হয় নি। কিন্তু বাতি ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখেছি আর অবাক হয়েছি ! সত্যি, এটা আল্লাহর এক আশ্চর্যজনক সৃষ্টি ! মনে মনে, বললাম, বাতি মানব হয়ে ভালই হয়েছে, যেদিকে খুশী সেদিকে বাতি ঘুরিয়ে দেখতে পারছি !





আলোর পথে...

কিছু তথ্য...
নদী ঘুরে যখন ফিরে এলাম, তখন বৃষ্টি বিদায় নিয়েছে। সংক্ষিপ্ত সাগর ভ্রমন তাই অন্যরকম ভাল লাগল, চারিদিক স্নিগ্ধ, পাশের পাহাড়ে যেসব মেঘ বৃষ্টি হয়ে ঝরতে পারে নি তারা বিশ্রাম নিচ্ছে ! পাহাড়ের সাথে মেঘের এই সখ্য আমার সব সময়ই ভাল লাগে, যেমনটা ভাল লেগেছিল নীলগিরি গিয়ে !


পুয়ের্তো প্রিন্সেসায় আমরা যেই হোটেলে থাকতাম, সেখান থেকে প্রায় ২ কি.মি. হেটে মূল রাস্তায় যেতাম, রাতের খাবার খেতে। বেশ ভাল কিছু রেস্টুরেন্ট ছিল। বিশেষ করে একটা রেস্টুরেন্টের ইন্টেরিয়র দেখে আমি অবিভূত হয়েছিলাম আর খাবারও অবশ্যই খুব সুস্বাদু ছিল। এটা প্রথম রাতের কথা, ক্যামেরা সাথে নেইনি দেখে আফসোস হয়েছিল। খাবারের তালিকায় স্থান নিয়েছিল টুনা, ব্লু মারলিন, লাপু লাপু মাছ ! চিংড়ি তো আছেই। আরেকটা জিনিস খেলাম, সেটা হল সামুদ্রিক আগাছা ! ভালই লাগল খেতে ! ঝিনুকের স্যুপ দিয়েছিল, বুঝতে পারিনি। একটা ঝিনুক খেয়ে ফেললাম, অদ্ভুত এক স্বাদ, আমার কাছে ভাল লাগল না ! ওই জিনিস এর পর আর খাই নি। ডেসার্ট দিয়েছিল, ডাবের খোলে করে, মূলত ফলের তৈরী। সব মিলিয়ে দারুণ একটা পরিবেশনা! রেস্টুরেন্টটি সাধারাণত সব সময় পরিপূর্ণ থাকে, তাই লোকজন আগে থেকে বুকিং দিয়ে রাখে। আমরা একটা চান্স নিয়েছিলাম এবং কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে জায়গাও পেয়ে গিয়েছিলাম। রেস্টুরেন্টটির নাম কালুই ! এতই অভিজাত, যে রবিবার ওরা বন্ধ থাকে !

৭ নভেম্বর। ঈদের দিন। আমি এ পর্যন্ত তিনটি ঈদ দেশের বাইরে করেছি, এর মধ্যে তিনটিই কোরবাণীর ঈদ ! ঈদের দিনের মর্যাদা রাখতে আমরা বেছে নিয়েছিলাম ডস পালমাস আইল্যান্ড রিসোর্ট ট্রিপ। একটা ছোট্ট দ্বীপ, পুরোটাই একটা রিসোর্ট। সকালে রওনা দিয়ে বিকেল চারটা পর্যন্ত সেই দ্বীপে থাকা যাবে। দুপুরে বুফে খাবার, কায়াকিং এবং স্নরকেলিং এর ব্যবস্থাতো থাকছেই !




পৌছানো মাত্রই ওয়েলকাম ড্রিংস দিয়ে আমাদের বরণ করা হল। প্রথমেই পুরো দ্বীপটা একটা চক্কর দিলাম, বেশ সুন্দর করে সাজিয়েছে।



এরপর চলে গেলাম স্নরকেলিং সাইটে। আকাশ একটু মেঘলা ছিল, মাঝে মাঝে একটু রোদের দেখা মিলছিল। আসলে রোদ যত বাড়বে, পানির ভেতরে আলো তত বেশী প্রবেশ করবে, অর্থাৎ আপনার স্নরকেলিংটা তত উপভোগ্য হবে। যাইহোক, এই ডস পালমাস দ্বীপের স্নরকেলিংটি আমার করা সেরা স্নরকেলিং। লোকজন অনেক কম ছিল, অনেক দূর জুড়ে ঘুরে বেড়িয়েছি আর উপভোগ করেছি সাগর তলের অপার সৌন্দর্য ! দেখেছি অপূর্ব প্রবাল আর নানা রঙের মাছ ও সামুদ্রিক প্রাণী!

স্নরকেলিং শেষে দুই দোস্ত মিলে এসে কিছুক্ষণ কায়াকিং করলাম। কায়াকিং হল ছোট্ট নৌকায় করে সমুদ্রে বৈঠা বাওয়া। মজাই লাগল। গোসল করে লাঞ্চ সারলাম। মেনু ভালই ছিল। মজা করে খেয়েছি। কাল রঙের ঝিনুকের স্যুপ ছিল, দেখেই বাদ দিলাম। তবে ডেজার্টটা বেশ উপভোগ করেছি। আহামরি কিছু ছিল না, তবে নতুন ধরনের খাবারের অভিজ্ঞতা নিতে বরাবরই আমার ভাল লাগে।



বিকেল ৩ টা ৪৫ এ আমাদের ফিরতি ট্রলার ছাড়ল। হোটেলের যেসব কর্মী আমাদের সারাদিন খেদমত করেছে তারা সবাই জেটিতে দল বেধে কিছু বাদ্যযন্ত্র বাজানো শুরু করল। সুরটাতে বিরহের ছাপ ছিল, মনে হচ্ছিল আমাদের বিদায়ে তারা মর্মাহত ! মনে হল আমি যেন আফ্রিকার কোন উদ্ভট উপজাতির Ritual এ আছি !

পূয়ের্তো প্রিনসেসায় আমাদের শেষ দিন, ৮ নভেম্বর ২০১১। বিকেলে ফ্লাইট। আজ সারাদিন এই শহরেই থাকব। আমরা ছিলাম ডে লোরো হোটেলে। আমাদের হোটেলের ইন্টেরিয়র কিন্তু বেশ ছিল। একটা বিশাল সাইজের ঝিনুকের খোল দিয়ে ওরা বেসিন বানিয়েছে, চমৎকার আইডিয়া !

নাস্তা করে শহরে চলে এলাম। চাংগি চাংগে ! এটা হল স্যুভেনির মার্কেট। দুপুর পর্যন্ত সেখানেই কাটালাম। আমার দোস্ত বাবু ধুমায়া শপিং করল। আমিও হালকা পাতলা কেনা-কাটা করলাম। মূলতঃ কোরাল আর শেল এর তৈরী গহনা, কিছু হ্যান্ড ব্যাগ।

চাংগি চাংগে স্যুভেনির মার্কেট

ফিলিপিনো উদ্ভাবন, ট্রাইসাইকেল (মোটর সাইকেল এর রুপান্তর)

NCCC মল এ দুপুরের খাবার সেরে ব্যাগপত্র নিয়ে সোজা এয়ারপোর্ট... পালাওয়ান ভ্রমনের ইতি...
পরের পর্বে আপনাদের জানাবো ম্যানিলা আর লস বানস এর কথা, সে পর্যন্ত সবাই ভাল থাকুন...

সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে নভেম্বর, ২০১১ রাত ১০:৫৫