রাত কয়টা বাজে এখন? আড়াইটে-তিনটে? খোলা জানালার কাছে চেয়ারে বসে আছি। বাইরে তীব্র শীতের কুয়াশাচ্ছন্ন রাত। টুপ টুপ করে শিশির ঝরে পড়ছে গাছের পাতায়। ঘরে কোন আলো নেই, সব লাইট অফ করা। অন্ধকারে বসে আছি আমি একা। জীবনের প্রায় সব আলোই যেহেতু নিভে গেছে তখন আর কৃত্রিম আলোর কী প্রয়োজন? খোলা জানালাপথে একমনে চেয়ে থেকে ভাবনার সাগরে ডুবে আছি। শীতের রাতের এই প্রহরে হয়ত কেউ জেগে নেই। সম্ভবত আমিই একমাত্র প্রাণী ঘুম যার চোখ থেকে সর্বদা পালিয়ে বেড়াচ্ছে। চোখ বুজে আবারও ভাবনার সাগরে ডুবে গেলাম।
কী করছে এখন ও? নিশ্চিন্ত মনে উষ্ণতার সাথে পাশের মানুষটিকে জড়িয়ে ধরে পরম সুখে ঘুমুচ্ছে? কারো জন্য ভাবনার কোন দায়বদ্ধতা নেই, নেই কোন পিছুটান? পিছুটান থাকবেই বা কীভাবে? হাসিমুখে আরেকজনের বাহুডোরে বাঁধা পড়ে নিজেই যে সব সম্পর্ক চুকিয়ে দিয়েছে। হয়ত এটাই সে চাইত সবসময়। আমাদের মাঝে যে সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল তা এক নিমিষেই এভাবে ধুলোয় মিশে যাবে সেটা আমার কল্পনাতেও ছিল না কিন্তু ও নিশ্চয়ই মনে মনে এমনই ভেবে রেখেছিল। অথচ আমি কি বোকা ছিলাম! ঘুণাক্ষরেও ওর মনের আসল কথাটা জানতে পারিনি! আমার সাথে এভাবে লুকোচুরি খেলে ও নিশ্চয়ই খুব আনন্দ পেত! আর আমি ওর এই লুকোচুরিকেই আমার পরম প্রাপ্তি ধরে নিয়ে সুখস্বপ্নে বিভোর হয়ে থাকতাম! ওর চোখের তারায় সবসময় দুষ্টুমি খেলা করত! ওর অনিন্দ্যসুন্দর মুখটাকে আমার মনের ক্যানভাসে সযত্নে বাঁধিয়ে রেখেছিলাম সারাটি জীবনের জন্য। কোনদিন ওই মুখটাকে স্মৃতির পাতা থেকে মুছে ফেলার কথা কল্পনাতেও আনিনি। অথচ আজ আমিই সেই মুখটাকে চিরতরে মুছে ফেলতে চাইছি! চেষ্টা করছি ওর সব স্মৃতিকে মনের ক্যানভাস থেকে চেঁছে তুলে ফেলতে!
শীতের এই কুয়াশাচ্ছন্ন রাতের অন্ধকারে নিজের ফেলে আসা অতীতকে হাতড়ে বেড়াচ্ছি কীসের নেশায়? আমি জানি না। জানি না কেন ওর কথা ভেবে নিজেকে কষ্ট দিচ্ছি প্রতিনিয়ত! তবে কি ওকে এখনও মনের গহীন কোণে সযতনে রেখে দিয়েছি? কেন ওর চেহারাটা বারবার মনের জানালাপথে উঁকি দিয়ে যায়? কেন শতচেষ্টা করেও ওর স্মৃতিগুলোকে নিজের মন থেকে তাড়াতে পারি না? কেন ও এভাবে আমাকে অসহনীয় যন্ত্রণায় বিদ্ধ করছে? মনকে চোখ ঠারতে গিয়ে আরো বেশী কষ্ট বুকে জমা হচ্ছে। চোখ থেকে ঘুম পালিয়েছে অনেক আগেই। এখন শুধু স্মৃতিচারণার তীরগুলো আঘাতে আঘাতে প্রতিনিয়ত ক্ষতবিক্ষত করে চলেছে।
হঠাৎ দরজায় করাঘাতের শব্দে চমকে উঠলাম! কে যেন দরজায় জোরে জোরে ধাক্কা দিচ্ছে! এতরাতে কে আমার কাছে আসতে পারে ভেবে পেলাম না! একটু ইতস্ততঃ করে চেয়ার থেকে উঠে পড়লাম। হয়ত কেউ কোন জরুরী প্রয়োজনে অথবা ছোটখাট বিপদে পড়ে অথবা নেহাত ঠেকায় পড়ে এই অসামাজিক আর সমাজ থেকে বিমুখ উজবুকটার কাছে কোন ছোটখাট উপকার বা সাহায্য চাইতে এসেছে! সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে গিয়ে দরজার কী হোলে চোখ রাখলাম। ছোট্ট ফুটোয় চোখ রেখে আরেকবার ভীষণভাবে চমকে উঠলাম! স্তম্ভিত বিস্ময়ে কিছুক্ষণের জন্য স্থবির হয়ে গেলাম! যার চেহারা দেখলাম তাকে আমি দেখব বলে স্বপ্নেও কল্পনা করিনি! নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছিল! দরজার দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে আমার.....
চলবে।
ছবিঃ গুগল।