আমাদের মুক্তিযুদ্ধে মিডিয়ার একটা ভূমিকা ছিলো। কখনও তা আমাদের পক্ষে গেছে আবার কখনও বিপক্ষে। ইলেক্ট্রনিক্স মিডিয়ার তখন এত সহজলভ্যতা ছিলনা। তাই প্রিন্ট মিডিয়া একটি বড় ফ্যাক্টর ছিল। আমাদের দেশীয় পত্রিকার মধ্যে প্রায় সব পত্রিকার সাংবাদিকরাই প্রানবাজি রেখে মুক্তির পক্ষে কলম চালিয়ে ছিলেন। কিন্তু জামায়াতের মুখপত্র দৈনিক সংগ্রাম নামের পত্রিকাটি মিথ্যা, বানোয়াট এবং পাকিস্তান সরকারের দালালী করে বিভ্রান্তিকর খবর চাপতো। একটি বিদেশী পত্রিকা যদি বিরোধী ভূমিকা নেয়, তবে তা মেনে নেয়া যায়। কিন্তু শতকরা ৯৯ভাগ জনগনের পক্ষে না গিয়ে কি নির্লজ্জভাবে পাকিস্তান সরকারের দালালী করেছিলো দৈনিক সংগ্রাম।। ১৯৭১ এর ৮ এপ্রিল থেকে ১৬জুন পর্যন্ত সংখ্যা সমূহের উল্লেখযোগ্য সংবাদগুলো আমার কালেকশনে আছে সেখান থেকে ধারাবহিক ভাবে পুরোটাই আপনাদের জন্য তুলে ধরার চেষ্টা করবো। আজ ১ম কিস্তিতে যৎসামান্যই দিলাম। আগামী পর্বগুলোতে আরও বিশাল পরিসরে দেয়ার আশা রাখি। ইচ্ছে করলে কালও দিতে পারতাম, কিন্তু দেরী সইলো না কলে.....
৮ এপ্রিল:
৭ এপ্রিল রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রোকেয়া হলে চলে পাকসেনাদের তান্ডব। অথচ সংগ্রাম এই বিষয়টি হালকা করতে গিয়ে “ভারতীয় অপপ্রচার শিরোণামে” সম্পাদকীয়তে লিখে, “......এমনকি রোকেয়া হলে কিছু হওয়াতো দূরের কথা, শোনা যায় সেখানে কেবল অন্য হল থেকে দু’একটা ছাত্র এসে আশ্যয় নিয়েছিলো” অপর দিকে একজন বিদেশী সাংবাদিক মিচেল লরেন্ট এর মতে, ১০এপ্রিল তিনি এখানে এসে দেখতে পান যে, জনাদশেক ছাত্রকে একসাথে মাটিতে লাশ হয়ে পড়ে থাকতে দেখা যায়। আরও অনেককে বিছানায় যেভাবে ঘুমিয়েছিলো, সেভাবেই পড়ে থাকতে দেখা যায়। সেখানে ছিলো ছোপ ছোপ রক্তের দাগ। ছিলো ট্যাংকের মাড়িয়ে যাবার দৃশ্য।
একই দিনে দৈনিক সংগ্রামে “নিজেরে হারায়ে খুজি” উপসম্পাদকীয়তে লেখা হয়, “বাংলাদেশ ইন্দিরা গান্ধীর স্বপ্নের রামরাজ্য” ৮ এপ্রিলের প্রথম পাতায় লিখা হয় “পূর্ব পাকিস্তানের জনগন সশস্ত্র অনুপ্রবেশকারীদের দেখামাত্র খতম করে দিবে”। জামায়াতের একটি বিবৃতি ৪ কলামের বিশাল পরিসরে দেয়া হয়, যাতে লেখা ছিলো- পূর্ব পাকিস্তানের জনগন দেশের সার্বভৌমত্ব নিয়ে সাম্রাজ্যবাদী ভারতকে ছিনিমিনি খেলতে দিবে না।
৯ এপ্রিল:
“কাশ্মীর থেকে পূর্ব পাকিস্তান” শীর্ষক সম্পাদকীয়তে উল্লেখ করা হয়, “ হিন্দুস্থান পাকিস্তানের মুসলমানদের জন্য মায়াকান্না কেঁদে ও বন্ধু সেজে পূর্ব পাকিস্তানে ব্যপক অনুপ্রবেশের কসরত চালিয়ে যাচ্ছে, নেহেরু তনয়া মিসেস গান্ধী মনে করেছেন তাদের এ প্রচেষ্টা সফল হলে কাশ্মীরের মতো পূর্ব পাকিস্তান দখল করে এখানে হত্যাযজ্ঞ চালাবে।
১০ এপ্রিল:
প্রথম পাতায় পুরো কলামজুড়ে বড় বড় হেডলাইন করে এবং বিশাল ছবি সম্বলিত লে: জে: টিক্কা খানের পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর হওয়ার সংবাদটি গুরুত্ব সহকারে।
মুক্তিযুদ্ধ শুরুর কয়েক সপ্তাহ আগে রবীন্দ্রনাথের গানকে বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে ঘোষনা করা হয়। বিষয়টি দৈনিক সংগ্রামের সহ্য হয়নি, তাই তারা “ভারতের মায়াকান্না” উপ-সম্পাদকীয়তে লিখে, “রবীন্দ্রনাথের সবচেয়ে বড় পরিচয় সে হিন্দু” এর কয়েক সপ্তাহ আগেই ঢাকা ভার্সিটির ‘জিন্নাহ হল’ ‘সূর্যসেন হল’ নাম ধারণ করে।
১১ এপ্রিল:
৭ কলাম ব্যাপী ও ৩ ইঞ্চি ব্যাস বিশিষ্ট বড় বড় হরফে “ঢাকায় শান্তি কমিটি গঠন” শিরোণামে লেখা হয়, - ঢাকার নাগরিক জীবনযাত্রা স্বাভাবিক রাখার জন্য ১৪০ সদস্য কমিটি বিশিষ্ট নাগরিক শান্তি কমিটি গঠন করা হয়েছে, যার মূল উদ্দেশ্য ভারতীয় অনুপ্রবেশ ঠেকানো, এবং কমিটিং প্রথম মিটিং শেষে দেয়া বিবৃতিতে বলা হয়, “বাংলাদেশের আভ্যন্তরীণ বিষয়ে ভারতের নির্লজ্জ হস্তক্ষেপ কোনভাবেই মেনে নেয়া যায় না, আমরা এর তীব্র নিন্দা জানাই। কমিটিতে পূর্বপাকিস্তানের কাউন্সিল মুসলিম লীগের সভাপতি খাজা জয়েন উদ্দিনকে আহবায়ক করা হয়। বাকিরা হলেন, জনাব এ কে এম শফিকুল ইসলাম, মৌলানা ফরিদ আহমদ, অধ্যাপক গোলাম আযম, পীর মহসেন উদ্দিন, মুহম্মদ আলী, এ এস এম সোলায়মান, আবুল কাশেম, আতাউল হক খান। অধ্যাপক গোলাম আযমকে কেন সভাপতি করা হয়নি এ নিয়ে বৈঠকে ব্যাপক বাক বিতন্ডতা হয়।
একই দিন “পাক ভারত সম্পর্ক” শিরোণামে উপ-সম্পাদকীয়তে লিখা হয়, “প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া দেশের জন্য একটি স্থায়ী, গ্রহনযোগ্য ইসলামী চেতনা ও আদর্শ সম্বলিত শাসন ব্যবস্থা দেয়ার জন্য সর্বদা সচেষ্ট আছেন। তিনি তার ৫ দফা আইন কাঠামোর আদেশে পাকিস্তানের ঐক্য ও ইসলামী আদর্শের পুরোপুরি বজায় রাখার নিশ্চয়তা প্রদান করেছিলেন। গত নির্বাচনের পরের কাহিনী বড়ই নাজুক। কিছু ব্যক্তি তাদের ঐক্য বজায় রাখার নির্বাচনী ওয়াদার খেলাপ করে এখন বিপ্লবের কথা বলছে, যা আমাদের জন্য দু:খজনক। এই সুযোগে আমাদের প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারত পূর্ব পাকিস্তান দখলের পাঁয়তারা করছে। যা পাকিস্তানবাসী কোনদিনই হতে দিবে না।”
চলবে.......
সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে ডিসেম্বর, ২০০৯ রাত ৩:৫৯